অর্ধাঙ্গী- রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন

অর্ধাঙ্গী
অর্ধাঙ্গী

অর্ধাঙ্গী
রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন

কোন রোগীর চিকিৎসা করিতে হইলে প্রথমে রোগের অবস্থা জানা আবশ্যক। তাই অবলাজাতির উন্নতির পথ আবিষ্কার করিবার পূর্বে তাহাদের অবনতির চিত্র দেখাইতে হয়। আমি ‘স্ত্রীজাতির অবনতি’ শীর্ষক প্রবন্ধে ভগিনীদিগকে জানাইয়াছি যে, আমাদের একটা রোগ আছে- দাসত্ব। সে রোগের কারণ এবং অবস্থা কতক পরিমাণে ইতঃপূর্বে বর্ণনা করা হইয়াছে। এক্ষণে আমরা দেখাইতে চেষ্টা করিব, সেই রোগ হওয়ায় আমাদের সামাজিক অবস্থা কেমন বিকৃত হইয়াছে। ঔষধ পথ্যেবিধান স্থানান্তরে দেওয়া হইবে।

এইখানে গোঁড়া পর্দাপ্রিয় ভগিনীদের অবগতির জন্য দু’ একটা কথা বলিয়া রাখা আবশ্যক বোধ করি। আমি অবরোধ প্রথার বিরুদ্ধে দণ্ডায়মান হই নাই। কেহ যদি আমার ‘স্ত্রীজাতির অবনতি’ প্রবন্ধে পর্দা-বিদ্বেষ ছাড়া আর কোন উদ্দেশ্য দেখিতে না পান, তবে আমাকে মনে করিতে হইবে আমি নিজের মনোভাব উত্তমরূপে ব্যক্ত করিতে পারি নাই, অথবা তিনি প্রবন্ধটি মনোযোগ সহকারে পাঠ করেন নাই।

সে প্রবন্ধে প্রায় সমগ্র নারীজাতির উল্লেখ আছে। সকল সমাজের মহিলাগণই কি অবরোধে বন্দিনী থাকেন? অথবা তাঁহারা পর্দানশীন নহেন বলিয়া কি আমি তাঁহাদিগকে সম্পূর্ণ উন্নত বলিয়াছি? আমি মানসিক দাসত্বের (enslaved মনের) আলোচনা করিয়াছি।

কোন একটা নূতন কাজ করিতে গেলে সমাজ প্রথমত গোলযোগ উপস্থিত করে, এবং পরে সেই নূতন চাল-চলন সহিয়া লয়, তাহারই দৃষ্টান্তস্বরূপ পার্সি মহিলাদের পরিবর্তিত অবস্থার উল্লেখ করিয়াছি। পূর্বে তাঁহারা ছত্র ব্যবহারেরও অধিকারিণী ছিলেন না, তারপর তাঁহাদের বাড়াবাড়িটা সীমা লঙ্ঘন করিয়াছে, তবু তো পৃথিবী ধ্বংস হয় নাই। এখন পার্সি মহিলাদের পর্দা মোচন হইয়াছে সত্য, কিন্তু মানসিক দাসত্ব মোচন হইয়াছে কি? অবশ্যই হয় নাই। আর ঐ যে পর্দা ছাড়িয়াছেন, তাহা দ্বারা তাঁহাদের স্বকীয় বুদ্ধি-বিবেচনার তো কোন পরিচয় পাওয়া যায় না। পার্সি পুরুষগণ কেবল অন্ধভাবে বিলাতি সভ্যতাঅনুকরণ করিতে যাইয়া স্ত্রীদিগকে পর্দার বাহিরে আনিয়াছে, ইহাতে অবলাদের জীবনীশক্তির তো কিছু পরিচয় পাওয়া যায় না-তাঁহারা যে জড়পদার্থ, সেই জড়পদার্থই আছেন। পুরুষ যখন তাঁহাদিগকে অন্তঃপুরে রাখিতেন, তাঁহারা তখন সেইখানে থাকিতেন। আবার পুরুষ যখন তাঁহাদের ‘নাকের দড়ি’ ধরিয়া টানিয়া তাঁহাদিগকে মাঠে বাহির করিয়াছেন, তখনই তাঁহারা পর্দার বাহির হইয়াছেন। ইহাতে রমণীকুলের বাহাদুরি কী? ঐরূপ পর্দা-বিরোধ কখনই প্রশংসনীয় নহে।

কলম্বস যখন আমেরিকা আবিষ্কার করিতে কৃতসংকল্প হন, তখন লোকে তাঁহাকে বাতুল বলে নাই কি? নারী আপন স্বত্ব-স্বামিত্ব বুঝিয়া আপনাকে নরের ন্যায় শ্রেষ্ঠ জ্ঞান করিতে চাহে, ইহাও বাতুলতা বই আর কী?

পুরুষগণ স্ত্রীজাতির প্রতি যতটুকু সম্মান প্রদর্শন করেন, তাহাতে আমরা সম্পূর্ণ তৃপ্ত হইতে পারি না। লোকে কালী, শীতলা প্রভৃতি রাক্ষস প্রকৃতির দেবীকে ভয় করে, পূজা করে, সত্য। কিন্তু সেইরূপ বাঘিনী, নাগিনী, সিংহী প্রভৃতি দেবীও কি ভয় ও পূজা লাভ করে না? তবেই দেখা যায় পূজাটা কে পাইতেছেন- রমণী কালী, না রাক্ষসী নৃমুণ্ডমালিনী?

নারীকে শিক্ষা দিবার জন্য গুরুলোকে সীতা দেবীকে আদর্শরূপে দেখাইয়া থাকেন। সীতা অবশ্যই পর্দানশীন ছিলেন না। তিনি রামচন্দ্রের অর্ধাঙ্গী, রাণী, প্রণয়িনী এবং সহচরী। আর রামচন্দ্র প্রেমিক, ধার্মিক-সবই। কিন্তু রাম সীতার প্রতি যে ব্যবহার করিয়াছেন, তাহাতে প্রকাশ পায় যে, একটি পুতুলের সঙ্গে কোন বালকের যে-সম্বন্ধ, সীতার সঙ্গে রামের সম্বন্ধও প্রায় সেইরূপ। বালক ইচ্ছা করিলে পুতুলকে প্রাণপণে ভালবাসিতে পারে; পুতুল হারাইলে বিরহে অধীর হইতে পারে; পুতুলের ভাবনায় অনিদ্রায় রজনী যাপন করিতে পারে; পুতুলটা যে ব্যক্তি চুরি করিয়াছিল, তাহার প্রতি খড়্গহস্ত হইতে পারে; হারানো পুতুল ফিরিয়া পাইলে আহ্লাদে আটখানা হইতে পারে; আবার বিনা কারণে রাগ করিয়াও পুতুলটা কাদায় ফেলিয়া দিতে পারে- কিন্তু পুতুল বালকের কিছুই করিতে পারে না, কারণ, হস্তপদ থাকা সত্ত্বেও পুত্তলিকা অচেতন পদার্থ। বালক তাহার পুতুল স্বেচ্ছায় অনলে উৎসর্গ করিতে পারে, পুতুল পুড়িয়া গেল দেখিয়া ভূমে লুটাইয়া ধূলি-ধূসরিত হইয়া উচ্চৈঃস্বরে কাঁদিতে পারে।

রামচন্দ্র ‘স্বামিত্বের’ ষোলো আনা পরিচয় দিয়াছেন!! আর সীতা?- কেবল প্রভু রামের সহিত বনযাত্রার ইচ্ছা প্রকাশ করিয়া দেখাইয়াছেন যে, তাঁহারও ইচ্ছা প্রকাশের শক্তি আছে। রাম বেচারা অবোধ বালক, সীতার অনুভব-শক্তি আছে, ইহা তিনি বুঝিতে চাহেন নাই। কেননা, বুঝিয়া কার্য করিতে গেলে স্বামিত্বটা পূর্ণমাত্রায় খাটান যাইত না;-সীতার অমন পবিত্র হৃদয়খানি অবিশ্বাসের পদাঘাতে দলিতচূর্ণ করিতে পারা যাইত না। আচ্ছা, দেশকালের নিয়মানুসারে কবির ভাষায় সুর মিলাইয়া না হয় মানিয়া লই যে, আমরা স্বামীর দাসী নহি অর্ধাঙ্গী। আমরা তাঁহাদের গৃহে গৃহিণী, মরণে (না হয়, অন্তত তাঁহাদের চাকুরি উপলক্ষে যথাতথা) অনুগামিনী, সুখ-দুঃখে সমভাগিনী, ছায়াতুল্য সহচরী ইত্যাদি।

কিন্তু কলিযুগে আমাদের ন্যায় অর্ধাঙ্গী লইয়া পুরুষগণ কীরূপ বিকলাঙ্গ হইয়াছেন, তাহা কি কেহ একটু চিন্তাচক্ষে দেখিয়াছেন? আক্ষেপের (অথবা প্রভুদের সৌভাগ্যের) বিষয় যে, আমি চিত্রকর নহি- নতুবা এই নারীরূপ অর্ধাঙ্গ লইয়া তাঁহাদের কেমন অপরূপ মূর্তি হইয়াছে, তাহা আঁকিয়া দেখাইতাম।

শুক্লকেশ বুদ্ধিমানগণ বলেন যে, আমাদের সাংসারিক জীবনটা দ্বিচক্র শকটের ন্যায়-এ শকটের একচক্র পতি, অপরটি পত্নী। তাই ইংরেজি ভাষায় কথায় কথায় স্ত্রীকে অংশিনী (partner), উত্তমার্ধ (better half) ইত্যাদি বলে। জীবনের কর্তব্য অতি গুরুতর, সহজ নহে-

“সুকঠিন গার্হস্থ্য ব্যাপার
সুশৃঙ্খলে কে পারে চালাতে?
রাজ্যশাসনের রীতিনীতি
সূক্ষ্মভাবে রয়েছে ইহাতে।”

বোধ হয় এই গার্হস্থ্য ব্যাপারটাকে মস্তকস্বরূপ কল্পনা করিয়া শাস্ত্রকারগণ পতি ও পত্নীকে তাহার অঙ্গস্বরূপ বলিয়াছেন। তবে দেখা যাউক বর্তমান যুগে সমাজের মূর্তিটা কেমন।

মনে করুন, কোন স্থানে পূর্বদিকে একটি বৃহৎ দর্পণ আছে, যাহাতে আপনি আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করিতে পারেন। আপনার দক্ষিণাঙ্গভাগ পুরুষ এবং বামাঙ্গভাগ স্ত্রী। এই দর্পণের সম্মুখে দাঁড়াইয়া দেখুন-

আপনার দক্ষিণ বাহু দীর্ঘ (ত্রিশ ইঞ্চি) এবং স্কুল, বাম বাহু দৈর্ঘ্যে চব্বিশ ইঞ্চি এবং ক্ষীণ। দক্ষিণ চরণ দৈর্ঘ্যে ১২ ইঞ্চি, বাম চরণ অতিশয় ক্ষুদ্র। দক্ষিণ স্কন্ধ উচ্চতায় পাঁচ ফিট, বাম স্কন্ধ উচ্চতায় চারি ফিট! (তবেই মাথাটা সোজা থাকিতে পারে না, বাম দিকে ঝুঁকিয়া পড়িতেছে। কিন্তু আবার দক্ষিণ কর্ণভারে বিপরীত দিকেও একটু ঝুঁকিয়াছে।) দক্ষিণ কর্ণ হস্তিকর্ণের ন্যায় বৃহৎ, বাম কর্ণ রাসভকর্ণের ন্যায় দীর্ঘ! দেখুন। ভাল করিয়া দেখুন, আপনার মূর্তিটা কেমন!! যদি এ মূর্তিটা অনেকের মনোমত না হয়, তবে দ্বিচক্র শকটের গতি দেখাই। যে শকটের এক চক্র বড় (পতি) এবং এক চক্র ছোট (পত্নী) হয়, সে শকট অধিক দূরে অগ্রসর হইতে পারে না-সে কেবল একই স্থানে (গৃহকোণেই) ঘুরিতে থাকিবে। তাই ভারতবাসী উন্নতির পথে অগ্রসর হইতে পারিতেছেন না।

সমাজের বিধি-ব্যবস্থা আমাদিগকে তাহাদের অবস্থা হইতে সম্পূর্ণ পৃথক রাখিয়াছে; তাঁহাদের সুখ-দুঃখ এক প্রকার, আমাদের সুখ-দুঃখ অন্য প্রকার। এস্থলে বাবু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘নবদম্পতির প্রেমালাপ’ কবিতার দুই চারি ছত্র উদ্ধৃত করিতে বাধ্য হইলাম-

“বর। কেন সখি কোণে কাঁদিছ বসিয়া?
কনে। পুষি মেনিটিরে ফেলিয়া এসেছি ঘরে।
বর। কী করিছ বনে কুঞ্জভবনে?
কনে। খেতেছি বসিয়া টোপা কুল
* * * * * * * * * * * * * * *
বর। জগৎ ছানিয়া, কী দিব আনিয়া জীবন করি ক্ষয়?
তোমা তরে সখি, বল করিব কী?
কনে। আরো কুল পাড় গোটা ছয়।
* * * * * * * * * * * * * * *
বর। বিরহেবেলা কেমনে কাটিবে?
কনে। দেব পুতুলের বিয়ে।”

সুতরাং দেখা যায় কন্যাকে এরূপ শিক্ষা দেওয়া হয় না, যাহাতে সে স্বামীর ছায়াতুল্যা সহচরী হইতে পারে। প্রভুদের বিদ্যার গতির সীমা নাই, স্ত্রীদের বিদ্যার দৌড় সচরাচর ‘বোধোদয়’ পর্যন্ত!

স্বামী যখন পৃথিবী হইতে সূর্যনক্ষত্রের দূরত্ব মাপেন, স্ত্রী তখন একটা বালিশের ওয়াড়ের দৈর্ঘ্য প্রন্থ (সেলাই করিবার জন্য) মাপেন! স্বামী যখন কল্পনা -সাহায্যে সুদূর আকাশে গ্রহনক্ষত্রমালা-বেষ্টিত সৌরজগতে বিচরণ করেন, সূর্যমণ্ডলের ঘনফল তুলাদণ্ডে ওজন করেন এবং ধূমকেতুর গতি নির্ণয় করেন, স্ত্রী তখন রন্ধনশালায় বিচরণ করেন, চাউল ডাউল ওজন করেন এবং রাঁধুনির গতি নির্ণয় করেন। বলি জ্যোতির্বেত্তা মহাশয়, আপনার পার্শ্বে আপনার সহধর্মিণী কই? বোধ হয়, গৃহিণী যদি আপনার সঙ্গে সূর্যমণ্ডলে যান, তবে তথায় পুঁহুছিবার পূর্বেই পথিমধ্যে উত্তাপে বাষ্পীভূত হইয়া যাইবেন। তবে সেখানে গৃহিণীর না যাওয়াই ভাল!!

অনেকে বলেন, স্ত্রীলোকদের উচ্চশিক্ষার প্রয়োজন নাই। মেয়েরা চর্ব্যচোষ্য রাঁধিতে পারে, বিবিধ প্রকার সেলাই করিতে পারে, দুই-চারিখানা উপন্যাস পাঠ করিতে পারে, ইহাই যথেষ্ট। আর বেশি আবশ্যক নাই। কিন্তু ডাক্তার বলেন যে, আবশ্যক আছে, যেহেতু মাতার দোষ-গুণ লইয়া পুত্রগণ ধরাধামে অবতীর্ণ হয়। এইজন্য দেখা যায় যে, আমাদের দেশে অনেক বালক শিক্ষকের বেত্রতাড়নাকণ্ঠস্থ বিদ্যার জোরে এফএ, বিএ পাশ হয় বটে; কিন্তু বালকের মনটা তাহার মাতার সহিত রান্নাঘরেই ঘুরিতে থাকে! তাহাদের বিদ্যা পরীক্ষায় এ কথার সত্যতার উপলব্ধি হইতে পারে।

আমার জনৈক বন্ধু তাঁহার ছাত্রকে উত্তর-দক্ষিণ প্রভৃতি দিঙনির্ণয়ের কথা (cardinal points) বুঝাইতেছিলেন। শেষে তিনি প্রশ্ন করিলেন, “যদি তোমার দক্ষিণহস্ত পশ্চিমে এবং বামহন্ত পূর্বে থাকে, তবে তোমার মুখ কোন্ দিকে হইবে?” উত্তর পাইলেন, “আমার পশ্চাৎ দিকে।”

যাঁহারা কন্যার ব্যায়াম করা অনাবশ্যক মনে করেন, তাঁহারা দৌহিত্রকে হৃষ্টপুষ্ট ‘পাহল-ওয়ান’ দেখিতে চাহেন কি না? তাঁহাদের দৌহিত্র ঘুষিটা খাইয়া থাপড়টা মারিতে পারে, এরূপ ইচ্ছা করেন কি না? যদি সেরূপ ইচ্ছা করেন, তবে বোধ হয়, তাঁহারা সুকুমারী গোলাপ-লতিকায় কাঁঠাল ফলাইতে চাহেন!! আর যদি তাঁহারা ইচ্ছা করেন যে দৌহিত্রও বলিষ্ঠ হয়, বরং পয়জার পেটা হইয়া নত মন্তকে উচ্চৈঃস্বরে বলে, “মাৎ মারো! চোট লাগতা হায়!!” এবং পয়জার লাভ শেষ হইলে দূরে গিয়া প্রহারকর্তাকে শাসাইয়া বলে যে, “কায় মারতা থা? হাম নালিশ করে গা!” তাহা হইলে আমি তাঁহাদিগকে আমার বক্তব্য বুঝাইতে অক্ষম।

খ্রিষ্টিয়ান সমাজে যদিও স্ত্রীশিক্ষার যথেষ্ট সুবিধা আছে, তবু রমণী আপন স্বত্ব ষোলো আনা ভোগ করিতে পায় না। তাহাদের মন দাসত্ব হইতে মুক্তি পায় না। স্বামী ও স্ত্রী কতক পরিমাণে জীবনের পথে পাশাপাশি চলিয়া থাকেন বটে; কিন্তু প্রত্যেক উত্তমার্ধই (better half) তাঁহার অংশীর (partner-এর) জীবনে জীবন মিলাইয়া তন্ময়ী হইয়া যান না। স্বামী যখন ঋণজালে জড়িত হইয়া ভাবিয়া ভাবিয়া মরমে মরিতেছেন, স্ত্রী তখন একটা নূতন টুপির (bonnet-এর) চিন্তা করিতেছেন। কারণ তাঁহাকে কেবল মূর্তিমতী কবিতা হইতে শিক্ষা দেওয়া হইয়াছে- তাই তিনি মনোরমা কবিতা সাজিয়া থাকিতে চাহেন। ঋণদায়রূপ গদ্য (prosaic) অবস্থা তিনি বুঝিতে অক্ষম। এখন মুসলমান সমাজে প্রবেশ করা যাউক; মুসলমানের মতে আমরা পুরুষের ‘অর্ধেক’, অর্থাৎ দুইজন নারী একজন নরের সমতুল্যা। অথবা দুইটি ভ্রাতা ও একটি ভগিনী একত্র হইলে আমরা ‘আড়াইজন’ হই। আপনারা ‘মহম্মদীয় আইনে’ দেখিতে পাইবেন যে বিধান আছে, পৈতৃক সম্পত্তিতে কন্যা পুত্রের অর্ধেক ভাগ পাইবে। এ নিয়মটি কিন্তু পুস্তকেই সীমাবদ্ধ। যদি আপনারা একটু পরিশ্রম স্বীকার করিয়া কোন ধনবান মুসলমানের সম্পত্তি বিভাগ করা দেখেন, কিংবা জমিদারি পরিদর্শন করিতে যান, তবে দেখিবেন, কার্যত কন্যার ভাগে শূন্য (০) কিংবা যৎসামান্য পড়িতেছে।

আমি এখন অপার্থিব সম্পত্তির কথা বলিব। পিতার স্নেহ, যত্ন ইত্যাদি অপার্থিব সম্পত্তি। এখানেও পক্ষপাতিতার মাত্রা বেশি। ঐ যত্ন, স্নেহ, হিতৈষিতার অর্ধেকই আমরা পাই কই? যিনি পুত্রের সুশিক্ষার জন্য চারিজন শিক্ষক নিযুক্ত করেন, তিনি কন্যার জন্য দুইজন শিক্ষয়িত্রী নিযুক্ত করেন কি? যেখানে পুত্র তিনটা (বি. এ. পর্যন্ত) পাস করে, সেখানে কন্যা দেড়টা পাস (এনট্রান্স পাশ ও এফ. এ. ফেল) করে কি? পুত্রদের বিদ্যালয়ের সংখ্যা করা যায় না, বালিকাদের বিদ্যালয় সংখ্যায় পাওয়াই যায় না। যে স্থলে ভ্রাতা ‘শমস-উল-ওলামা’ সেস্থলে ভগিনী ‘নজম্-উল-ওলামা’ হইয়াছেন কি? তাঁহাদের অন্তঃপুর গগনে অসংখ্য ‘নজমন্নেসা’, ‘শমসন্নেসা’ শোভা পাইতেছেন বটে। কিন্তু আমরা সাহিত্য-গগনে 'নজম-উল-ওলামা' দেখিতে চাই!

আমাদের জন্য এদেশে শিক্ষার বন্দোবস্ত সচরাচর এইরূপ- প্রথমে আরবীয় বর্ণমালা, অতঃপর কুরআন শরীফ পাঠ। কিন্তু শব্দগুলির অর্থ বুঝাইয়া দেওয়া হয় না, কেবল স্মরণশক্তির সাহায্যে টিয়াপাখির মত আবৃত্তি কর। কোন পিতার হিতৈষণার মাত্রা বৃদ্ধি হইলে, তিনি দুহিতাকে ‘হাফেজ’ করিতে চেষ্টা করেন। সমুদয় কুরআনখানি যাঁহার কণ্ঠস্থ থাকে, তিনিই ‘হাফেজ’। আমাদের আরবি শিক্ষা ঐ পর্যন্ত। পারস্য এবং উর্দু শিখিতে হইলে, প্রথমেই “কারিমা ববখশা এ বরহালে মা” এবং একেবারে (উর্দু) ‘বানাতন নাস’ পড়! একে আকার ইকার নাই, তাতে আবার আর কোন সহজ পাঠ্যপুস্তক পূর্বে পড়া হয় নাই, সুতরাং পাঠের গতি দ্রুতগামী হয় না। অনেকের ঐ কয়খানি পুস্তক পাঠ শেষ হওয়ার পূর্বেই কন্যা-জীবন শেষ হয়। বিবাহ হইলে বালিকা ভাবে, “যাহা হোক, পড়া হইতে রক্ষা পাওয়া গেল!” কোন কোন বালিকা রন্ধন ও সূচিকর্মে সুনিপুণা হয়। বঙ্গদেশেও বালিকাদিগকে রীতিমত বঙ্গভাষা শিক্ষা দেওয়া হয় না। কেহ কেহ উর্দু পড়িতে শিখে, কিন্তু কলম ধরিতে শিখে না। ইহাদের উন্নতির চরমসীমা সলমা চুমকির কারুকার্য, উলের জুতা-মোজা ইত্যাদি প্রস্তুত করিতে শিক্ষা পর্যন্ত।

যদি ধর্মগুরু মুহাম্মদ (স) আপনাদের হিসাব-নিকাশ লয়েন যে, “তোমরা কন্যার প্রতি কীরূপ ন্যায় ব্যবহার করিয়াছ?” তবে আপনারা কী বলিবেন? পয়গম্বরদের ইতিহাসে শোনা যায়, জগতে যখনই মানুষ বেশি অত্যাচার-অনাচার করিয়াছে, তখনই এক-এক জন পয়গম্বর আসিয়া দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন করিয়াছেন। আরবে স্ত্রীজাতির প্রতি অধিক অত্যাচার হইতেছিল; আরববাসিগণ কন্যাহত্যা করিতেছিল, তখন হযরত মুহাম্মদ (স) কন্যাকুলের রক্ষকস্বরূপ দণ্ডায়মান হইয়াছিলেন। তিনি কেবল বিবিধ ব্যবস্থা দিয়াই ক্ষান্ত থাকেন নাই, স্বয়ং কন্যা পালন করিয়া আদর্শ দেখাইয়াছেন। তাঁহার জীবন ফাতেমাময় করিয়া দেখাইয়াছেন- কন্যা কীরূপ আদরণীয়া। সে আদর, সে স্নেহ জগতে অতুল।

আহা! তিনি নাই বলিয়া আমাদের এ দুর্দশা। তবে আইস ভগিনীগণ। আমরা সকলে সমম্বরে বলি:

“করিমা ববঙ্গা-এ বরহালে মা।” করিম (ঈশ্বর) অবশ্যই কৃপা করিবেন। যেহেতু “সাধনায় সিদ্ধি।” আমরা ‘করিমের’ অনুগ্রহ লাভের জন্য যত্ন করিলে অবশ্যই তাঁহার করুণা লাভ করিব। আমরা ঈশ্বর ও মাতার নিকট ভ্রাতাদের 'অর্ধেক' নহি। তাহা হইলে এইরূপ স্বাভাবিক বন্দোবস্ত হইত-পুত্র যেখানে দশ মাস স্থান পাইবে, দুহিতা সেখানে পাঁচ মাস! পুত্রের জন্য যতখানি দুগ্ধ আমদানি হয়, কন্যার জন্য তাহার অর্ধেক! সেরূপ তো নিয়ম নাই! আমরা জননীর স্নেহ-মমতা ভ্রাতার সমানই ভোগ করি। মাতৃ-হৃদয়ে পক্ষপাতিতা নাই। তবে কেমন করিয়া বলিব, ঈশ্বর পক্ষপাতী? তিনি কি মাতা অপেক্ষা অধিক করুণাময় নহেন?

আমি এবার রন্ধন ও সূচিকার্য সম্বন্ধে যাহা বলিয়াছি, তাহাতে আবার যেন কেহ মনে না করেন যে, আমি সূচিকর্ম ও রন্ধনশিক্ষার বিরোধী। জীবনের প্রধান প্রয়োজনীয় বস্তু অন্নবস্ত্র; সুতরাং রন্ধন ও সেলাই অবশ্য শিক্ষণীয়। কিন্তু তাই বলিয়া জীবনটাকে শুধু রান্নাঘরেই সীমাবদ্ধ রাখা উচিত নহে।

স্বীকার করি যে, শারীরিক দুর্বলতাবশত নারী জাতি অপর জাতির সাহায্যে নির্ভর করে। তাই বলিয়া পুরুষ ‘প্রভু’ হইতে পারে না। কারণ জগতে দেখিতে পাই, প্রত্যেকেই প্রত্যেকের নিকট কোন-না-কোন প্রকার সাহায্য প্রার্থনা করে, যেন একে অপরের সাহায্য ব্যতীত চলিতে পারে না। তরুলতা যেমন বৃষ্টির সাহায্যপ্রার্থী, মেঘও সেইরূপ রুর সাহায্য চায়। জল বৃদ্ধির নিমিত্ত নদী বর্ষার সাহায্য পায়, মেঘ আবার নদীর নিকট ঋণী। তবে তরঙ্গিনী কাদম্বিনীর ‘স্বামী’, না কাদম্বিনী তরঙ্গীনীর ‘স্বামী’? এ স্বাভাবিক নিয়মের কথা ছাড়িয়া কেবল সামাজিক নিয়মে দৃষ্টিপাত করিলেও আমরা তাহাই দেখি।

কেহ সূত্রধর, কেহ তন্তুবায় ইত্যাদি। একজন ব্যারিস্টার ডাক্তারের সাহায্যপ্রার্থী, আবার ডাক্তারও ব্যারিস্টারের সাহায্য চাহেন। তবে ডাক্তারকে ব্যারিস্টারের স্বামী বলিব, না ব্যারিস্টার ডাক্তারের স্বামী? যদি ইহাদের কেহ কাহাকে 'স্বামী' বলিয়া স্বীকার না করেন, তবে শ্রীমতীগণ জীবনের চিরসঙ্গী শ্রীমানদিগকে 'স্বামী' ভাবিবেন কেন?

আমরা উত্তমার্ধ (better halves) তাঁহারা নিকৃষ্টার্থ (worse halves), আমরা অর্ধাঙ্গী, তাঁহারা অর্ধাঙ্গ। অবলার হাতেও সমাজের জীবন মরণের কাঠি আছে, যেহেতু “না জাগিলে সব ভারত-ললনা” এ ভারত আর জাগিতে পারিবে না। প্রভুদের ভীরুতা কিংবা তেজস্বিতা জননীর ইচ্ছার উপর নির্ভর করে। তবে কেবল শারীরিক বলের দোহাই দিয়া অদূরদর্শী ভ্রাতৃ মহোদয়গণ যেন শ্রেষ্ঠত্বের দাবি না করেন!

আমরা পুরুষের ন্যায় সুশিক্ষা ও অনুশীলনের সম্যক সুবিধা না পাওয়ায় পশ্চাতে পড়িয়া আছি। সমান সুবিধা পাইলে আমরাও কি শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করিতে পারিতাম না? আশৈশব আত্মনিন্দা শুনিতেছি, তাই এখন আমরা অন্ধভাবে পুরুষের শ্রেষ্ঠতা স্বীকার করি এবং নিজেকে অতি তুচ্ছ মনে করি। অনেক সময় “হাজার হোক ব্যাটা ছেলে!” বলিয়া ব্যাটা ছেলেদের দোষ ক্ষমা করিয়া অন্যায় প্রশংসা করি। এই তো ভুল।

আমি ভগিনীদের কল্যাণ কামনা করি। তাঁহাদের ধর্মবন্ধন বা সমাজবন্ধন ছিন্ন করিয়া তাঁহাদিগকে একটা উন্মুক্ত প্রান্তরে বাহির করিতে চাহি না। মানসিক উন্নতি করিতে হইলে হিন্দুকে হিন্দুত্ব বা খ্রিষ্টানকে খ্রিষ্টানি ছাড়িতে হইবে এমন কোন কথা নাই। আপন আপন সম্প্রদায়ের পার্থক্য রক্ষা করিয়াও মনটাকে স্বাধীনতা দেওয়া যায়। আমরা যে কেবল উপযুক্ত শিক্ষার অভাবে অবনত হইয়াছি, তাই বুঝিতে ও বুঝাইতে চাই।

অনেকে হয়তো ভয় পাইয়াছেন যে, বোধ হয় একটা পত্নী-বিদ্রোহের আয়োজন করা হইতেছে। অথবা ললনাগণ দলে দলে উপস্থিত হইয়া বিপক্ষকে রাজকীয় কার্যক্ষেত্র হইতে তাড়াইয়া দিয়া সেই পদগুলি অধিকার করিবেন-শামলা, চোগা, আইন-কানুনের পাঁজি-পুঁথি লুঠিয়া লইবেন। অথবা সদলবলে কৃষিক্ষেত্রে উপস্থিত হইয়া কৃষকগুলিকে তাড়াইয়া দিয়া তাহাদের শস্যক্ষেত্র দখল করিবেন, হাল গরু কাড়িয়া লইবেন, তবে তাঁহাদের অভয় দিয়া বলিতে হইবে- নিশ্চিন্ত থাকুন।

পুরুষগণ আমাদিগকে সুশিক্ষা হইতে পশ্চাদপদ রাখিয়াছেন বলিয়া আমরা অকর্মণ্য হইয়া গিয়াছি। ভারতে ভিক্ষু ও ধনবান-এই দুই দল লোক অলস; এবং ভদ্রমহিলার দল কর্তব্য অপেক্ষা অল্প কাজ করে। আমাদের আরাম-প্রিয়তা খুব বাড়িয়াছে। আমাদের হস্ত, মন, পদ, চক্ষু ইত্যাদির সদ্ব্যবহার করা হয় না। দশজন রমণীরত্ন একত্র হইলে ইহার উহার-বিশেষত আপন আপন অর্ধাঙ্গের নিন্দা কিংবা প্রশংসা করিয়া বাকপটুতা দেখায়। আবশ্যক হইলে কোন্দলও চলে। আশা করি এখন ‘স্বামী’র স্থলে ‘অর্ধাঙ্গ’ শব্দ প্রচলিত হইবে।

উৎস নির্দেশ :
‘অর্ধাঙ্গী’ প্রবন্ধটি রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন প্রবন্ধগ্রন্থ ‘মতিচূর’ গ্রন্থের প্রথম খণ্ড থেকে সংকলিত হয়েছে।

‘অর্ধাঙ্গী’ প্রবন্ধের শব্দার্থ ও টীকা :
➠ অর্ধাঙ্গী- স্ত্রী
➠ আবশ্যক- দরকার।
অবলাজাতি- বলহীনা। এখানে নারীসমাজ অর্থে ব্যবহৃত।
➠ অবনতি- অনুন্নতি, হীনতা।
➠ ইতঃপূর্বে- এর আগে।
➠ পথ্য- রোগীর জন্য উপযুক্ত আহার্য। রোগান্তে গ্রহণযোগ্য খাদ্য।
➠ বিধান- শাস্ত্রবিহিত নিয়ম রীতি-নীতি।
➠ স্থানান্তর- ভিন্ন স্থান।
➠ ভগিনী- সহোদরা; বোন।
➠ গোঁড়া- ধর্মমতে অন্ধবিশ্বাসী ও একগুঁয়ে; অতিশয় সংরক্ষণশীল মনোভাবাপন্ন।
অবরোধ প্রথা- অন্তঃপুরে লোকচক্ষুর আড়ালে মেয়েদের আটক রাখার নিয়ম।
➠ দণ্ডায়মান- দণ্ডের মতো খাড়া; দাঁড়িয়ে আছে এরূপ; খাড়া।
চাল-চলন- রীতি-নীতি; আচার-ব্যবহার।
➠ পার্সি- পারস্য দেশের অর্থাৎ ইরানি।
➠ ছত্র- ছাতা
➠ মোচন- ত্যাগ, ছেড়ে দেওয়া।
➠ স্বকীয়- স্বীয়, নিজের।
বিলাতি সভ্যতা- পাশ্চাত্য সভ্যতা।
➠ অনুকরণ- নকল।
➠ জড়পদার্থ- যে সকল বস্তুর চেতনা নেই।
নাকের দড়ি- নাকাল ও বাধ্য করার অস্ত্র।
➠ বাহাদুরি- পৌরুষ; কৃতিত্বের গৌরব।
➠ কলম্বস- ক্রিস্টোফার কলম্বস (১৪৪৭-১৫০৬) প্রসিদ্ধ ইতালীয় নাবিক এবং আমেরিকা মহাদেশের আবিষ্কর্তা। স্পেনের রাজদম্পতি ফার্ডিনান্ড ও ইজাবেলার পৃষ্ঠপোষকতায় ১৪৯২ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম সমুদ্রযাত্রা করেন। প্রথমে তিনি কিউবা, বাহামা প্রভৃতি দ্বীপ এবং ক্রমে জ্যামাইকা, দক্ষিণ আমেরিকা, ত্রিনিদাদ প্রভৃতি আবিষ্কার করেন।
➠ কৃতসংকল্প- প্রতিজ্ঞা করেছে এমন, স্থিরসংকল্প।
স্বত্ব-স্বামিত্ব- অধিকার ও মালিকানা।
➠ বাতুল- পাগল, উন্মাদ।
স্বত্ব-স্বামিত্ব- অধিকার ও মালিকানা।
➠ বাতুলতা- পাগলামি।
➠ বই- ছাড়া।
➠ তৃপ্ত- সন্তুষ্ট
➠ কালী- শিবপত্নী; দশ মহাবিদ্যার অন্যতম; চণ্ডিকার একটি রূপ।
➠ শীতলা- বসন্তরোগের কল্পিত অধিষ্ঠাত্রী দেবী। বসন্তরোগ।
➠ রাক্ষস- পুরাণে কল্পিত ভয়ংকরদর্শন নরখাদক প্রাণিবিশেষ।
➠ নৃ- নর; পুরুষ।
➠ নৃমুণ্ড- মানুষের মস্তক বা মাথা।
➠ নৃমুণ্ডমালিনী- হিন্দু দেবী কালী; নরমুণ্ডসমূহ গ্রথিত মালাধারণকারিণী।
➠ সীতা- রামায়ণে বর্ণিত মিথিলারাজ জনকের কন্যা ও রামচন্দ্রের পত্নী।
➠ পর্দানশীন- অবরোধবাসিনী; পর্দার অন্তরালে বাস করে এমন।
➠ রামচন্দ্র- রামায়ণে বর্ণিত দশরথ ও কৌশল্যার পুত্র এবং সীতার স্বামী।
➠ প্রণয়িনী- অনুরক্ত রমণী; প্রেমের যোগ্য নারী বা নায়িকা।
➠ সহচরী- সঙ্গে বিচরণ করে এমন; সঙ্গী; সাথী।
➠ অধীর- ব্যাকুল, উৎকণ্ঠিত, ব্যগ্র; কাতর।
➠ রজনী- রাত্রি, নিশা।
➠ খড়্গহস্ত- অস্ত্র দিয়ে আঘাত করতে উদ্যত এমন; অত্যন্ত ক্ষুব্ধ; কুপিত।
➠ আহ্লাদ- হর্ষ; আনন্দ; আমোদ।
➠ আটখানা- অস্থির; কুটিকুটি।
➠ হস্তপদ- হাতপা।
➠ পুত্তলিকা- খড়ের তৈরি মানুষের প্রতিমূর্তি; পুতুল।
➠ ভূমে- ভূমিতে; পৃথিবীতে।
➠ উৎসর্গ- স্বত্বত্যাগ করে দান।
ধূলি-ধূসরিত- ধুলো লেগে মলিন।
➠ উচ্চৈঃস্বরে- উচ্চরব; চিৎকার; জোরগলা।
➠ ষোলো আনা- সম্পূর্ণ, পুরোপুরি।
➠ স্বামিত্ব- মালিকানা, অধিকার।
➠ বেচারা- নিরুপায় ব্যক্তি। নিরীহ লোক।
➠ অবোধ- অবুঝ।
➠ অমন- ওইরূপ; ওই প্রকার।
➠ পদাঘাত- পা দিয়ে আঘাত; পদপ্রহার।
➠ দলিত- পিষ্ট; নিপীড়িত।
➠ চূর্ণ- সম্পূর্ণ ভগ্ন; গুঁড়োয় পরিণত।
➠ দেশকাল- স্থান ও সময়।
➠ নহি- না হই; নই।
➠ অর্ধাঙ্গী- স্বামী-স্ত্রীকে পুরো পরিবারের একক হিসেবে কল্পনা করে স্ত্রীকে অর্ধাঙ্গী গণ্য করা হয়।
➠ যথাতথা- যত্রতত্র; যেখানে- সেখানে।
➠ অনুগামিনী- অনুসরণকারিণী; পশ্চাদ্‌গামিনী; সহযাত্রী।
➠ কলিযুগ- হিন্দুদের পুরাণ বর্ণিত চতুর্থ বা শেষ যুগ; ধর্মভাবের অভাবের ফলে অঘটন সংঘটনের যুগ।
➠ বিকলাঙ্গ- এক বা একাধিক অঙ্গ নেই এমন; অঙ্গহীন।
➠ আক্ষেপ- অঙ্গবিক্ষেপ; ক্ষোভ প্রকাশ; বিলাপ।
➠ সৌভাগ্য- শুভ বা কল্যাণকর অদৃষ্ট; অনুকূল ভাগ্য।
➠ চিত্রকর- পটুয়া; চিত্রশিল্পী।
➠ শুক্লকেশ- শুভ্র বা সাদা চুল বিশিষ্ট, পক্বকেশ।
➠ দ্বিচক্র- দু চাকা।
➠ শকট- গাড়ি, যান।
➠ দ্বিচক্র শকট- পা-দানে (padal) চাপ দিয়ে চাকা ঘোরানো হয় এমন দু চাকার যান (পেছনের চাকার ওপর চালকের আসনযুক্ত); সাইকেল।
➠ পতি- স্বামী; পালক; রক্ষক।
➠ পত্নী- জায়া; ভার্যা; স্ত্রী।
➠ উত্তমার্ধ- স্ত্রী।
➠ গুরুতর- মারাত্মক; জটিল।
➠ গার্হস্থ্য- গৃহস্থের কর্তব্য বা ধর্ম; সংসার।
➠ রীতিনীতি- আচার-আচরণ; প্রথা; রেওয়াজ।
➠ সূক্ষ্মভাবে- পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে।
➠ শাস্ত্রকার- শাস্ত্র-রচয়িতা, প্রাচীন ধর্মগ্রন্থ-প্রণেতা।
➠ মূর্তি- চিত্র; রূপ।
➠ দর্পণ- আয়না।
➠ আপাদমস্তক- পা থেকে মাথা পর্যন্ত।
➠ নিরীক্ষণ- মনোযোগের সঙ্গে পরীক্ষা; যত্ন সহকারে অবলোকন; অভিনিবেশের সঙ্গে দর্শন।
➠ রাসভকর্ণ- গাধার কান।
➠ মনোমত- ইচ্ছানুরূপ; পছন্দসই, মনের মতো।
➠ বিধিব্যবস্থা- আইনকানুন; নিয়মকানুন।
➠ নবদম্পতির প্রেমালাপ- কবিতাটি প্রকৃত নাম হলো ‘নববঙ্গদম্পতির প্রেমালাপ’। যা মানসী কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভূক্ত। কবিতাটি তিনটি অংশে বিভক্ত: বাসরশয়নে, সরোদানে, অন্দর বাগানে।
➠ ছত্র- পদ্যে পঙ্‌ক্তি বা চরণ, লাইন।
➠ উদ্ধৃত- কোনে রচনা বা উক্তি থেকে সংগৃহীত বা সংকলিত।
➠ বর- স্বামী।
➠ কনে- নববধূ; নববিবাহিত কন্যা।
➠ সখী- নারীর নারীবন্ধু; বান্ধবী; সঙ্গিনী। এখানে স্ত্রীকে সখী বলে সম্বোধন করেছেন।
➠ পুষি- লালনপালন করি।
➠ মেনি- বিড়ালী।
➠ কুঞ্জভবন- লতাপাতায় আচ্ছাদিত গৃহাকার ভবন।
➠ টোপা কুল- দেশি কুলবিশেষ।
➠ ক্ষয়- ধ্বংস; বিনাশ।
➠ পাড়- বৃন্তচ্যুত করো।
➠ বিরহ- প্রিয়জনের সঙ্গে বিচ্ছেদ।
➠ বেলা- সময়।
➠ দেব- দিবো।
➠ সচরাচর- সাধারণত; প্রায়শ; প্রায়ই।
‘বোধোদয়’- ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর রচিত ‘শিশুশিক্ষা’ তৃতীয় ভাগ বইয়ের নাম। ‘বোধোদয়’ প্রথম প্রকাশিত হয় ১৮৫১ খ্রিষ্টাব্দে।
➠ নক্ষত্র- রাতে মহাকাশে দৃশ্যমান আলোকবিন্দুর মতো জাজ্বল্যমান মহাজাগতিক গ্যাসীয় বস্তু; তারা; তারকা।
ওয়াড়- লেপ-বালিশ ইত্যাদির আবরণ।
➠ কল্পনা- ধারণা; আন্দাজ; অনুমান।
➠ গ্রহনক্ষত্রমালা- মহাজাগতিক জ্যোতিষ্কসমূহ।
➠ বেষ্টিত-  ঘেরাও করা হয়েছে।
➠ সৌরজগৎ- সূর্য ও তার গ্রহ-উপগ্রহ মিলে যে জগৎ।
➠ সূর্য- সৌরজগতের কেন্দ্রীয় নক্ষত্র-যাকে কেন্দ্র করে গ্রহসমূহ আবর্তিত হয় এবং যার নিকট থেকে গ্রহ-উপগ্রহসমূহ আলো ও তাপ পেয়ে থাকে-পৃথিবী থেকে এর দূরত্ব ৯,৩০,০০,০০০ মাইল, এর ব্যাস ৮,৬৪,০০০ মাইল এবং এর ভর পৃথিবীর তুলনায় ৩,৩০,০০০ হাজার গুণ।
➠ তুলাদণ্ড- দাঁড়িপাল্লা।
➠ ধূমকেতু- উপবৃত্তাকার কক্ষপথে সূর্যকে প্রদক্ষিণরত উজ্জ্বল কেন্দ্র ও অনুজ্জ্বল পুচ্ছবিশিষ্ট গ্যাসীয় জ্যোতিষ্কবিশেষ; ঝাঁটাতারা।
➠ রন্ধনশালা- রান্নাঘর; রসুইঘর; পাকঘর।
➠ বিচরণ- চলাফেরা করা।
➠ রাঁধুনি- রান্না করা যার পেশা; পাচিকা; রন্ধনকারী।
➠ জ্যোতির্বেত্তা- নভোমণ্ডল গ্রহনক্ষত্র জ্যোতিষ্ক প্রভৃতি বিষয়ক বিজ্ঞানে পারদর্শী।
➠ সহধর্মিণী- স্ত্রী; পত্নী; ভার্যা।
➠ উত্তাপ- তাপ; উষ্ণতা।
➠ চর্ব্যচোষ্য- চিবিয়ে ও চুষে খেতে হয় এমন।
➠ বিবিধ- বহুবিধ; হরেক রকম।
➠ যথেষ্ট- প্রচুর; ঢের।
➠ ধরাধাম- পৃথিবী; মর্ত্যলোক; সংসার।
➠ অবতীর্ণ- উপনীত; উপস্থিত।
➠ বেত্রতাড়না- বেতের শাসন; বেতের নির্যাতন।
➠ কণ্ঠস্থ বিদ্যা- মুখস্থ বিদ্যা।
এফ.এ- First Arts। বর্তমান উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়।
➠ বিএ- কলাবিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক ডিগ্রি; Bachelor Arts  ডিগ্রি।
➠ সহিত- সাথে।
➠ উপলব্ধি- অনুভূতি, বোধ। প্রাপ্তি, লাভ। জ্ঞান।
➠ জনৈক- (জনোই্কো) অনির্দিষ্ট কোনো একজন।
➠ দিঙ্‌নির্ণয়- দিক নিরূপণ।
➠ দক্ষিণহস্ত- ডানহাত।
➠ বামহস্ত- বামহাত।
➠ পশ্চাৎ দিকে- পেছনেদিকে; পরের দিকে।
➠ ব্যায়াম- স্বাস্থ্যরক্ষার উদ্দেশ্যে বিধিমোতাবেক অঙ্গচালনা; শরীরচর্চা।
➠ দৌহিত্র- কন্যার পুত্র; নাতি।
➠ হৃষ্টপুষ্ট- মোটা; স্থূলকায়।
পাহল-ওয়ান- পালোয়ান, কুস্তিগির।
➠ পয়জার- জুতো, পাদুকা।
মাৎ মারো- মেরো না।
চোট লাগতা হ্যায়- ব্যথা লাগছে।
কায় মারতা থা? হাম নালিশ করে গা!- কেন মারছিলে? আমি নালিশ করব।
➠ তন্ময়- তাতে একান্তভাবে নিমগ্ন; তাছাড়া অন্য কোনো চিন্তা বা অনুভূতি নেই এমন।
➠ অপার্থিব- অবস্তুগত।
➠ হিতৈষিতা- হিতকামনা, কল্যাণসাধনের ইচ্ছা।
➠ এনট্রান্স- প্রবেশিকা, বর্তমান মাধ্যমিক বা এসএসসি।
শমস-উল-ওলামা- জ্ঞানী ব্যক্তিদের উপাধি। এই উপাধির অর্থ ওলামা বা জ্ঞানীদের মধ্যে সূর্য।
নজম্-উল-ওলামা- জ্ঞানীদের মধ্যে নক্ষত্র।
➠ হিতৈষণা- কল্যাণ-ইচ্ছা।
➠ হাফেজ- সম্পূর্ণ কুরআন শরিফ যাঁর মুখস্থ।
কারিমা ববখশা এ বরহালে মা- করিম বা আল্লাহ আমাদের এ অবস্থা দিয়েছেন।
সলমা চুমকি- সোনা বা রূপার চকচকে বুটি দানা।
➠ তরঙ্গিনী- নদী।
➠ কাদম্বিনী- মেঘমালা।
➠ সূত্রধর- ছুতার, কাঠের মিজি।
➠ তন্তুবায়- তত্ত্ব বয়ন করে যে, তাঁতি, যে কাপড় বোনে।
➠ শামলা- শালের এক রকম পাগড়ি, উকিলের পরিধেয় পাগড়ি।
➠ চোগা- লম্বা ঢিলা বুক-খোলা এক ধরনের জামা যা চাপকানের উপরে পরা হয়।

‘অর্ধাঙ্গী’ প্রবন্ধের পাঠ-পরিচিতি ও মূলভাব :

বেগম রোকেয়ার ‘অর্ধাঙ্গী’ প্রবন্ধে উনিশ শতকের শেষ ও বিশ শতকের গোড়ায় ভারতবর্ষে পুরুষশাসিত সমাজজীবনের সবক্ষেত্রে নারী, বিশেষ করে মুসলমান নারী সমাজের পশ্চাদপদতা, দুর্বহ জীবন ও অধিকারহীনতাকে দেখানো হয়েছে পুরুষের নিদারুণ স্বার্থপরতা ও আধিপত্যকামী মানসিকতার প্রেক্ষাপটে। অত্যন্ত ব্যথিত হৃদয়ে বেগম রোকেয়া আবেগধর্মী যুক্তিপ্রধান এই রচনায় নারীসমাজকে জ্ঞানচর্চা ও কর্মব্রত, অধিকার সচেতনতা ও মুক্তি আকাঙ্ক্ষায় আকৃষ্ট করতে সচেষ্ট হয়েছেন। তিনি দেখাতে চেয়েছেন, সমাজ যে পূর্ণ ও স্বাভাবিক গতিতে অগ্রসর হতে পারছে না তার কারণ পরিবার ও সমাজজীবনের অপরিহার্য অর্ধেক শক্তি নারীসমাজের দুর্বল ও অবনত অবস্থা। এজন্য পুরুষসমাজের দৃষ্টিভঙ্গির সংকীর্ণতাকে দায়ী করেছেন তিনি।

এই রচনায় তিনি নারীজাগরণের পক্ষে যে সুচিন্তিত, দৃঢ় ও বলিষ্ঠ মতামত ব্যক্ত করেছেন তাতে তাঁর মন্তব্যে আছে আবেগের গাঢ়তা আর যুক্তিতে আছে তীক্ষ্ণতা। তিনি দেখাতে চেয়েছেন, সমাজজীবনের অগ্রগতি ও কল্যাণসাধনের জন্যে নারীজাগরণ এবং সেই সঙ্গে পুরুষ সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের কোনো বিকল্প নেই।


‘অর্ধাঙ্গী’ প্রবন্ধের লেখিকার পরিচিতি :

বাংলা অঞ্চলের মুসলমান সমাজে নারী জাগরণের পথিকৃৎ রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন অন্তঃপুরবাসিনী জীবন শুরু করলেও সামাজিক সীমাবদ্ধতার বেড়াজাল অতিক্রম করে বিদ্যাচর্চায়, শিক্ষা সংগঠনে ও সামাজিক অগ্রগতি সাধনে বরণীয় ও স্মরণীয় হয়ে আছেন। তিনি বিরাট ঝুঁকি নিয়ে অবরোধবাসিনীদের উন্মুক্ত বিশ্বে পদার্পণ করার যে আহ্বান জানিয়েছিলেন, তা আমাদের সমাজজীবনে আজ সার্থকতা লাভ করেছে। মুসলমান মেয়েদের শিক্ষার জন্য স্কুল প্রতিষ্ঠা তাঁর অসাধারণ কীর্তি। সমস্ত প্রতিকূলতার ভিতরেও আপন উদ্যম ও প্রচেষ্টায় রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন ইংরেজি ও বাংলা ভাষায় যে দক্ষতা অর্জন করেছিলেন তা বিস্ময়কর। রোকেয়া সাখাওয়াত হেসেন বাংলা সাহিত্যে বেগম রোকেয়া নামে বিশেষ পরিচিত।

সমাজসেবা ব্রত হলেও রোকেয়া কলম ধরেছিলেন সমাজকে জাগানোর লক্ষ্যে এবং এভাবেই তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন তীক্ষ্ণ, ঋজু, যুক্তিনিষ্ঠ গদ্যলেখক এবং সমাজসচেতন সাহসী সাহিত্যিক হিসেবে। ঠিক বেগম রোকেয়ার তুল্য লেখক তৎকালীন হিন্দু বা মুসলমান, নারী বা পুরুষ আর কেউ ছিলেন না- বেগম রোকেয়া এমনই এক অদ্বিতীয় রচনারীতির অধিকারী ছিলেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হচ্ছে পদ্মরাগ, অবরোধবাসিনী, মতিচুর, সুলতানার স্বপ্ন ইত্যাদি। ইংরেজি গ্রন্থ Sultana's Dreamও তাঁরই রচনা। বেগম রোকেয়ার লেখা প্রকাশিত হতো ‘মিসেস আর. এস. হোসেন’ নামে।

বেগম রোকেয়ার জন্ম ১৮৮০ খ্রিষ্টাব্দে রংপুর জেলার মিঠাপুকুর থানার পায়রাবন্দ গ্রামে। তাঁর মৃত্যু ১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দে।


‘অর্ধাঙ্গী’ প্রবন্ধের বহুনির্বাচনি প্রশ্ন :

প্রশ্ন থেকে

অভিনন্দন!
আপনি পেয়েছেন -এর মধ্যে!
যা


‘অর্ধাঙ্গী’ প্রবন্ধের জ্ঞানমূলক প্রশ্ন :
➠ লেখিকা সম্পর্কে:
১. মুসলিম সমাজে নারী জাগরণের পথিকৃৎ কে?
উত্তর: মুসলিম সমাজে নারী জাগরণের পথিকৃৎ রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন।
২. রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন কী হিসেবে জীবন শুরু করেন?
উত্তর: রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন একজন লেখক হিসেবে জীবন শুরু করেন।
৩. বিদ্যার্জনের মাধ্যমে রোকেয়া সাখাওয়াত কীসের বেড়াজাল অতিক্রম করেন?
উত্তর: বিদ্যার্জনের মাধ্যমে রোকেয়া সাখাওয়াত সামাজিক সীমাবদ্ধতার বেড়াজাল অতিক্রম করেন।
৪. বেগম রোকেয়া কলম ধরেছিলেন কেন?
উত্তর: সমাজকে জাগানোর লক্ষ্য বেগম রোকেয়া কলম ধরেছিলেন।
৫. সমকালীন হিন্দু বা মুসলমান সমাজে কার তুল্য লেখক ছিল না?
উত্তর: সমকালীন হিন্দু বা মুসলমান সমাজে বেগম রোকেয়ার তুল্য লেখক ছিল না।
৬. ‘পদ্মরাগ’ গ্রন্থের রচয়িতা কে?
উত্তর: ‘পদ্মরাগ’ গ্রন্থের রচয়িতা রোকেয়া সাখাওয়াত। হোসেন।
৭. বেগম রোকেয়ার রচিত ইংরেজি গ্রন্থের নাম কী?
উত্তর: বেগম রোকেয়ার রচিত ইংরেজি গ্রন্থের নাম ‘Sultana’s Dream’.
৮. বেগম রোকেয়ার লেখা কোন নামে প্রকাশিত হতো?
উত্তর: বেগম রোকেয়ার লেখা ‘মিসেস আর, এস, হোসেন’ নামে প্রকাশিত হতো।
৯. বেগম রোকেয়া কত খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন?
উত্তর: বেগম রোকেয়া ১৮৮০ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন।
১০. বেগম রোকেয়া কেন জেলায় জন্মগ্রহণ করেন?
উত্তর: বেগম রোকেয়া রংপুর জেলা জন্মগ্রহণ করেন।
১১. বেগম রোকেয়া কত খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন?
উত্তর: বেগম রোকেয়া ১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন।
➠ মূলপাঠ থেকে:
১২. রোগীর চিকিৎসা করতে হলে প্রথমে কী জানা আবশ্যক?
উত্তর: রোগীর চিকিৎসা করতে হলে প্রথমে রোগের অবস্থা জানা আবশ্যক।
১৩. অবনতির উন্নতির পথ আবিষ্কারের আগে কীসের চিত্র দেখাতে হবে?
উত্তর: অবনতির উন্নতির পথ আবিষ্কারের আগে তাদের অবনতির চিত্র দেখাতে হবে।
১৪.'স্ত্রীজাতির অবনতি' কী জাতির রচনা?
উত্তর: 'স্ত্রীজাতির অবনতি' প্রবন্ধ জাতীয় রচনা।
১৫. লেখিকা 'স্ত্রীজাতির অবনতি' প্রবন্ধে নারীদের কোন রোগের কথা উল্লেখ করেছেন?
উত্তর: লেখিকা স্ত্রীজাতির অবনতি' প্রবন্ধে নারীদের দাসত্ব রোগের কথা উল্লেখ করেছেন।
১৬. দাসত্ব রোগের কারণে আমাদের সামাজিক অবস্থা কেমন হয়েছে?
উত্তর: দাসত্ব রোগের কারণে আমাদের সামাজিক অবস্থা বিপর্যস্ত হয়েছে।
১৭. বেগম রোকেয়ার কোন প্রবন্ধে প্রায় সমস্ত নারী জাতির উল্লেখ আছে?
উত্তর: বেগম রোকেয়ার 'স্ত্রীজাতির অবনতি' প্রবন্ধে প্রায় সমস্ত নারী জাতির উল্লেখ আছে।
যেকোনো নতুন কাজে প্রথমে কোথায় গোলযোগ বাঁধে?
উত্তর: যেকোনো নতুন কাজে প্রথমে সমাজে গোলযোগ বাঁধে।
১৯. পার্সি মহিলাদের পর্দা মোচন হলে কী মোচন হয়নি?
উত্তর: পার্সি মহিলাদের পর্দা মোচন হলেও তাদের মানসিক দাসত্ব মোচন হয়নি।
২০. পার্সি পুরুষগণ কিসের অনুকরণ করে স্ত্রীদের পর্দার বাইরে এনেছিলেন?
উত্তর: পার্সি পুরুষগণ অন্ধভাবে বিলাতি সভ্যতার অনুকরণ করে স্ত্রীদের পর্দার বাইরে এনেছিলেন।
২১. আমেরিকা আবিষ্কারে কৃতসংকল্প হন কে?
উত্তর: কলম্বাস আমেরিকা আবিষ্কারে কৃতসংকল্প হন।
২২. কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের সংকল্পকে মানুষ কী মনে করেছিল?
উত্তর: কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের সংকল্পকে মানুষ বাতুলতা মনে করেছিল।
২৩. পুরুষগণ স্ত্রীজাতির প্রতি যে সম্মান দেন তাতে আমরা কী হতে পারি না?
উত্তর: পুরুষগণ স্ত্রীজাতির প্রতি যে সম্মান দেন তাতে আমরা তৃপ্ত হতে পারি না।
২৪. নারীদের শিক্ষা দেওয়ার জন্য গুরুলোকে কাকে আদর্শ হিসেবে দেখিয়েছেন?
উত্তর: নারীদের শিক্ষা দেওয়ার জন্য গুরুলোকে সীতাদেবীকে আদর্শ হিসেবে দেখিয়েছেন।
২৫. কে একাধারে রামচন্দ্রের প্রণয়নী, সহচরী এবং রানী?
উত্তর: স্বামী যখন ঋণজালে জড়িত হয়ে মরেন, স্ত্রী তখন নতুন টুপির চিন্তা করেন।
৩৮. মহম্মদীয় আইনে পৈতৃক সম্পত্তিতে কন্যার ভাগ কীভাবে হয়?
উত্তর: মহম্মদীয় আইনে পৈতৃক সম্পত্তিতে কন্যা পুত্রের অর্ধেক ভাগ পায়।
৩৯. বেগম রোকেয়ার মতে আত্মীয়সম্পর্ক কী?
উত্তর: বেগম রোকেয়ার মতে আত্মীয়সম্পর্ক হৃদয়ের সম্পর্ক।
৪০. বেগম রোকেয়া সাহিত্য-গগনে কী দেখতে চান?
উত্তর: বেগম রোকেয়া সাহিত্য-গগনে ‘নজম-উল-ওলামা’ দেখতে চান।
৪১. সমুদয় কুরআন যাঁর কণ্ঠস্থ থাকে তাঁকে কী বলে?
উত্তর: সমুদয় কুরআন যাঁর কণ্ঠস্থ থাকে তাঁকে হাফেজ বলে?
৪২. বঙ্গদেশে বালিকাদিগকে কীসের শিক্ষা দেওয়া হয় না?
উত্তর: বঙ্গদেশে বালিকাদিগকে বঙ্গভাষা শিক্ষা দেওয়া হয় না?
৪৩. কোথায় কন্যাহত্যার প্রচলন ছিল?
উত্তর: আরবে কন্যাহত্যার প্রচলন ছিল।
৪৪. ঈশ্বর ও মাতার নিকট আমরা কেমন নই?
উত্তর: ঈশ্বর ও মাতার নিকট আমরা অর্ধেক নই?
৪৫. মাতৃহৃদয়ে কী নেই?
উত্তর: মাতৃহৃদয়ে পক্ষপাতিত্ব নেই!
৪৬. নারী সমাজের অবনতি হওয়ার অন্যতম কারণ কী?
উত্তর: উপযুক্ত শিক্ষার অভাবই নারীমুক্তি অবনত হওয়ার অন্যতম কারণ।
৪৭. আমরা কেন অন্ধকারে গেছি?
উত্তর: সুশিক্ষা থেকে পিছিয়ে থাকার কারণে আমরা অন্ধকারে চলে গিয়েছি।
৪৮. ‘অর্ধাঙ্গী’ প্রবন্ধে কোন সময়ের ভারতবর্ষের পুরুষশাসিত সমাজজীবনে নারীর দুঃখ জীবন ও অধিকারহীনতা দেখানো হয়েছে?
উত্তর: ‘অর্ধাঙ্গী’ প্রবন্ধে উনিশ শতকের শেষ ও বিশ শতকের গোড়ার ভারতবর্ষের পুরুষশাসিত সমাজজীবনে নারীর দুঃখ জীবন ও অধিকারহীনতা দেখানো হয়েছে।
৪৯. ‘অর্ধাঙ্গী’ প্রবন্ধের বিষয় কী?
উত্তর: ‘অর্ধাঙ্গী’ প্রবন্ধের বিষয় নারীর অধিকার ও স্বাধীনতা।
৫০. বেগম রোকেয়ার মতে দশজন মহিলা একত্র হলে কী করে?
উত্তর: বেগম রোকেয়ার মতে দশজন মহিলা একত্র হলে স্বামীদের নিন্দা কিংবা প্রশংসা করেন।
৫১. বেগম রোকেয়া স্বামীর স্থলে কী শব্দ প্রতিস্থাপন হওয়ার আশা করেছেন?
উত্তর: বেগম রোকেয়া স্বামীর স্থলে ‘অর্ধাঙ্গ’ শব্দ প্রতিস্থাপন হওয়ার আশা করেছেন।

‘অর্ধাঙ্গী’ প্রবন্ধের অনুধাবনমূলক প্রশ্ন :

১. ‘কোনো রোগীর চিকিৎসা করিতে হইলে প্রথমে রোগের অবস্থা জানা আবশ্যক।’-উক্তিটি বুঝিয়ে লেখো।
উত্তর: সমাজে নারীর অধঃপতিত দশা থেকে মুক্তির জন্য প্রথমে তাদের হীনদশার স্বরূপ উন্মোচন জরুরি- এই প্রসঙ্গটিই আলোচ্য উক্তির মাধ্যমে ফুটে উঠেছে।
কোনো রোগীর চিকিৎসা করার আগে ডাক্তার রোগীর কাছ থেকে রোগের অবস্থা জেনে নেন। কারণ রোগ সম্পর্কে সঠিক ধারণা না থাকলে ভুল চিকিৎসার ফলে রোগীর ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। নারীদের মুক্তির উপায় নির্দেশ করার আগে তাই ‘অর্ধাঙ্গী’ প্রবন্ধের লেখিকা সমাজে তাদের প্রকৃত অবস্থান অনুধাবনের গুরুত্ব প্রকাশ করেছেন এই উক্তিটির মাধ্যমে।

২. রোকেয়াকে কেন ‘নারী আন্দোলনের পথিকৃৎ’ বলা হয়?
উত্তর: নারীদের মুক্তির আলো প্রদর্শনের জন্য আজীবন সংগ্রাম করায় বেগম রোকেয়াকে ‘নারী আন্দোলনের পথিকৃৎ’ বলা হয়।
অন্তঃপুরবাসিনী হিসেবে জীবন শুরু করলেও সমাজের বেড়াজাল অতিক্রম করে নিজেকে প্রকাশ করতে সক্ষম হন বেগম রোকেয়া। সেই সাথে সমাজের নারীদের হীনদশা থেকে মুক্ত করতে আজীবন সাহসী ভূমিকা পালন করেন তিনি। এই লক্ষ্যে নিজের উদ্যম ও প্রচেষ্টায় শিক্ষাগ্রহণের পাশাপাশি, নারীশিক্ষার প্রসারের জন্য স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। বিরাট ঝুঁকি নিয়ে তৎকালীন সমাজের অবরোধবাসিনীদের উন্মুক্ত বিশ্বে পদার্পণের আহ্বান জানিয়েছিলেন এই মহীয়সী নারী।

‘৩. অর্ধাঙ্গী’ প্রবন্ধে লেখিকা পার্সি পুরুষদের সমালোচনা করেছেন কেন?
উত্তর: অন্ধভাবে বিলাতি সভ্যতার অনুকরণ করায় ‘অর্ধাঙ্গী’ প্রবন্ধের লেখিকা পার্সি পুরুষদের সমালোচনা করেছেন।
বিলাতি সভ্যতাকে অনুকরণ করতে গিয়ে পার্সি পুরুষগণ তাদের সূত্রীদের পর্দার বাইরে এনেছিল। কিন্তু তারা স্ত্রীদের শিক্ষা ও বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার কোনো সুযোগ সৃষ্টি করেনি। ফলে নারীদের পর্দা মোচন হলেও মানসিক দাসত্ব মোচন হয়নি। পার্সি পুরুষদের এইভাবে পর্দাপ্রথা বিলোপ করার প্রচেষ্টার তীব্র সমালোচনা করেছেন বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন।

৪. ‘হস্তপদ থাকা সত্ত্বেও পুত্তলিকা অচেতন পদার্থ।’- ব্যাখ্যা করো।
উত্তর: নারীদের মানসিক দাসত্ব ও পরাধীনতার বিষয়টিই প্রকাশিত হয়েছে আলোচ্য উক্তিটির মাধ্যমে।
আমাদের সমাজে নারীরা পুরুষদের সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির কারণে শৃঙ্খলিত জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে ‘অর্ধাঙ্গী’ প্রবন্ধের লেখিকা রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন রাম ও সীতার উদাহরণ টেনেছেন। সীতা দেবী রামের রানি ও প্রণয়িনী হলেও তাঁর কোনো স্বাধীনতা ছিল না। সীতা দেবীর প্রতি রামের আচরণকে লেখিকা পুতুলের সাথে অবোধ বালকের আচরণের সাথে তুলনা করেছেন। পুতুলের মতোই হস্তপদ থাকার পরও নারীরা পুরুষের আজ্ঞাধীন সেবাদাসীতে পরিণত হয়।

৫. ‘নবদম্পতির প্রেমালাপ’ কবিতাটিতে ‘অর্ধাঙ্গী’ প্রবন্ধের কোন বিষয়টি প্রকাশিত হয়েছে?
উত্তর: সমাজে নারী ও পুরুষের জীবনযাপনের পার্থক্য নির্দেশ করতেই 'অর্ধাঙ্গী' প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘নবদম্পতির প্রেমালাপ’ কবিতাটি সংযুক্ত করা হয়েছে।
আমাদের সমাজে পুরুষ ও নারীকে অভিন্ন সত্তা ভাবা হয় না বলে তাদের জীবনযাপন প্রণালিতেও দেখা যায় ব্যাপক বৈসাদৃশ্য। ‘নবদম্পতির প্রেমালাপ’ কবিতায় নববিবাহিত বর ও কনের কতিপয় সংলাপের ভেতর দিয়ে এই দৃশ্যই প্রতীয়মান হয়। কবিতা থেকে দেখা যায় যে, কন্যাকে এমন শিক্ষা দেওয়া হয় যাতে সে স্বামীর ছায়াতুল্য সহচরী হতে পারে।

৬. ‘অবরোধবাসিনী’ কথার অর্থ কী? ব্যাখ্যা করো।
উত্তর: 'অবরোধবাসিনী' বলতে পুরুষশাসনের ফলে গৃহবন্দি হওয়া অন্তঃপুরের নারীদের বোঝানো হয়েছে।
নারীর স্থান শুধু গৃহে এবং গৃহকর্মই তার জীবনের উদ্দেশ্য এমন যুক্তি দেখিয়ে সংকীর্ণমনারা নারীকে বন্দি করেছে গৃহমধ্যে। ফলে নারী বঞ্চিত হয়েছে শিক্ষা ও বুদ্ধিবৃত্তি চর্চার সুযোগ থেকে। ‘অর্ধাঙ্গী’ প্রবন্ধে বেগম রোকেয়া এদেরকেই অবরোধবাসিনী বলে অভিষিত করেছেন এবং তাদের মানসিক দাসত্ব দূর করতে উদ্যোগী হয়েছেন।

৭. নারীর প্রতি পুরুষের কোন দৃষ্টিভঙ্গি ‘অর্ধাঙ্গী’ প্রবন্ধে প্রবন্ধকার সমালোচনা করেন? বর্ণনা করো।
উত্তর: নারীর প্রতি পুরুষের অসম্মানজনক দৃষ্টিভঙ্গির সমালোচনা করেছেন 'অর্ধাঙ্গী' প্রবন্ধের প্রাবন্ধিক।
আমাদের সমাজে পুরুষেরা নারীদের পশ্চাৎপদ করে রাখতে চায়। তারা মনে করে নারীরা চার দেওয়ালের মধ্যে আবদ্ধ থাকলে সংসারকর্মে একনিষ্ঠ থাকতে পারবে। সংসার করার জন্য তাদের পুস্তকের শিক্ষার দরকার নেই। এরকম প্রেক্ষাপটে প্রবন্ধকার মনে করেন নারীদের পশ্চাৎপদতা মানসিক দাসত্বের প্রধান কারণ শিক্ষার অভাব। প্রকৃত শিক্ষা গেলে নারীরাও নিজেদেরকে পুরুষের সমকক্ষ করে তুলতে পারবে।

৮. ‘অর্ধাঙ্গী’ প্রবন্ধে লেখিকা নারীর পশ্চাৎপদতার কী কী কারণ ব্যাখ্যা করেছেন?
উত্তর: শিক্ষা ও কর্মজীবনে নারীর পশ্চাৎপদতার কারণ হিসেবে লেখক নারীদের মানসিক দাসত্বকে দায়ী করেছেন।
পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা নারীদের মন ও মগজকে এমনভাবে প্রভাবিত করেছে যে, তারা নিজেরাই নিজেদের চার দেওয়ালে আবদ্ধ প্রাণী হিসেবে মনে করে। পুরুষের ন্যায় নারীদের সুশিক্ষার সুযোগের অভাবও তাদের পশ্চাৎপদতার অন্যতম কারণ বলে লেখিকা মনে করেন।

৯. অপার্থিব সম্পত্তিতে পুত্র ও কন্যার অধিকারের বৈষম্য নিরূপণ করো।
উত্তর: অপার্থিব সম্পত্তি বা অবস্তুগত সম্পত্তির অধিকারে পুত্র ও কন্যার মাঝে নানা অসমতা লক্ষ করা যায়।
পিতার স্নেহ ও যত্ন ইত্যাদি অপার্থিব সম্পত্তির উদাহরণ। পিতার এই স্নেহ ও যত্নের ভাগ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পুত্র ও কন্যার উপর সমভাবে বণ্টিত হয় না। পুত্র উচ্চশিক্ষা ও উন্নত শিক্ষার সুযোগ লাভ করলেও কন্যার ক্ষেত্রে তা করা হয় না। বরং কন্যার ক্ষেত্রে সামান্য শিক্ষাকেই যথেষ্ট মনে করা হয় যা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক।

১০. ‘আমরা সাহিত্য গগনে নজম্-উল-ওলামা দেখিতে চাই।’- উক্তিটি ব্যাখ্যা করো।
উত্তর: নারীশিক্ষার প্রয়োজনীয়তা নির্দেশ করতেই আলোচ্য উক্তিটির অবতারণা করেছেন ‘অর্ধাঙ্গী’ প্রবন্ধের লেখিকা।
আমাদের সমাজে নারীশিক্ষাকে গুরুত্বের সাথে দেখা হয় না ফলে নারীরা উচ্চশিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত। ফলে পুরুষেরা শমস-উল-ওলামা বা জ্ঞানীদের মধ্যে সূর‍্য উপাধি পেলেও নারীরা এ ধরনের যোগ্যতা অর্জনের সুযোগ পায় না। পুরুষের পাশাপাশি নারীশিক্ষার গুরুত্ব অনুধাবন করে লেখিকা তাই নারীদের মধ্যেও 'নজম-উল-ওলামা' বা জ্ঞানীদের মধ্যে নক্ষত্র তৈরির সুযোগ সৃষ্টির দাবি জানিয়েছেন।

১১. ‘পুত্রদের বিদ্যালয়ের সংখ্যা করা যায় না, বালিকাদের বিদ্যালয়ের সংখ্যা পাওয়াই যায় না।’- উক্তিটি ব্যাখ্যা করো।
উত্তর: নারী ও পুরুষের শিক্ষাগ্রহণের ক্ষেত্রে বৈষম্য প্রকাশ পেয়েছে উক্তিটির মাধ্যমে।
নারীশিক্ষা প্রসারে আমাদের সমাজে জোরালো ভূমিকা দৃশ্যমান নয়। পুরুষদের জন্য পর‍্যাপ্ত শিক্ষাজান থাকলেও নারীদের বেলায় তা একা হাতেগোনা। পুরুষ ও নারীকে একসঙ্গে শিক্ষিত করে তোলা গেলে দেশ ও জাতির অগ্রগতি সাধিত হবে। সমাজে পুরুষ ও নারীর মধ্যে যে বৈষম্য, তারই প্রকাশ ঘটেছে উদ্ধৃত উক্তিটিতে।

১২. ‘বালকের মনটা তাহার মাতার সহিত রান্না ঘরেই ঘুরিতে থাকে।’- কেন?
উত্তর: আমাদের সমাজে মায়েরা উচ্চশিক্ষিত হয় না বলে ছেলেমেয়েরা উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করলেও মানসিকতার দিক থেকে তারা অন্দরমহলের গণ্ডি পেরুতে পারে না।
আমাদের সমাজব্যবস্থায় মায়েরা বাড়ির চার দেওয়ালের মধ্যে আবন্ধ থাকে। বিশেষ করে রান্নাবান্নার কাজ করতেই তাদের সিংহভাগ সময় কেটে যায়। তাই আমাদের দেশের ছেলেমেয়েদের যতই উচ্চশিক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করা হোক না কেন, জেনেটিক কারণে তাদের মন মায়ের সঙ্গে রান্নাঘরেই পড়ে থাকে।

১৩. ‘আমরা যে কেবল উপযুক্ত শিক্ষার অভাবে অবনত হইয়াছি, তাই বুঝিতে ও বুঝাইতে চাই।’- ব্যাখ্যা করো।
উত্তর: শিক্ষার অভাবই নারীসমাজের অবনতির মূল কারণ।
উনিশ শতকের শেষ ও বিশ শতকের গোড়ার দিকে রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন বাঙালি মুসলিম নারীসমাজের পশ্চাৎপদতা অবলোকন করেছেন। প্রতিটি ক্ষেত্রেই তারা ছিল পিছিয়ে। মানসিক দাসত্বের কারণে তারা শিক্ষাগ্রহণে অনাগ্রহী ছিল। কিন্তু উপযুক্ত শিক্ষার অভাবে যে তাদের অবনতি হয়েছে, তা-ই তিনি লেখনীর মাধ্যমে বোঝাতে চেয়েছেন।

১৪. ‘স্বামী’র স্থলে ‘অর্ধাঙ্গ’ শব্দটি প্রচলিত হওয়ার যৌক্তিকতা বর্ণনা করো।
উত্তর: 'স্বামী'র স্থলে ‘অর্ধাঙ্গ’ শব্দটি প্রচলিত হওয়ার যৌক্তিকতা হলো, এটি স্ত্রীর সমান মর্য্যাদা এবং অধিকারকে তুলে ধরে।
‘অর্ধাঙ্গ’ শব্দটি স্বামী-স্ত্রী সম্পর্ককে সহযোগিতামূলক এবং সমতাভিত্তিক হিসেবে দেখায়, যেখানে দুইজনই একে অপরের পরিপূরক অংশ। এটি পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বেরিয়ে গিয়ে নারীর গুরুত্ব ও সমান মর্য্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে সহায়ক। ফলে, ‘অর্ধাঙ্গ’ শব্দটি সমাজে সমতার প্রতি একটি ধাপে ধাপে পরিবর্তন আনার প্রমাণ।

১৫. ‘অর্ধাঙ্গী’ প্রবন্ধে লেখক কোন প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ‘নবদম্পতির প্রেমালাপ’ কবিতাংশটি ব্যবহার করেছেন? বর্ণনা কর।
উত্তর: ‘অর্ধাঙ্গী’ প্রবন্ধে লেখক রবীন্দ্রনাথের ‘নবদম্পতির প্রেমালাপ’ কবিতাংশটি ব্যবহার করেছেন, যেখানে এক নবদম্পতির মধ্যে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের মাধুর্য্য ও সমতা ফুটে ওঠে।
এই কবিতাংশটির মাধ্যমে লেখক বোঝাতে চেয়েছেন যে, সত্যিকার সম্পর্ক হলো একে অপরকে সমান মর্য্যাদা ও ভালোবাসা দিয়ে গড়ে তোলা। এতে পুরুষ ও নারীর মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সমতার ধারণা তুলে ধরা হয়েছে, যা নারীর স্বাধীনতা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর মাধ্যমে লেখক নারীর অর্ধাঙ্গী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার বিষয়টি উপস্থাপন করেছেন, যেখানে নারীর স্বাধীনতা ও সম্মান প্রতিষ্ঠিত হয়।

১৬. “রামচন্দ্র ‘স্বামিত্বের’ ঘোলো আনা পরিচয় দিয়াছেন।”- উক্তিটি ব্যাখ্যা করো।
উত্তর: রামচন্দ্র সীতাকে বনবাসে পাঠিয়ে স্ত্রীর প্রতি যে অধিকার দেখিয়েছিলেন, প্রাবন্ধিক তাকে স্বামিত্বের ‘ষোলো আনা পরিচয়’ আখ্যা দিয়ে বিদ্রূপ করেছেন প্রশ্নোক্ত উক্তিটির মাধ্যমে।
সীতা হলেন রামায়ণে উল্লিখিত রামচন্দ্রের স্ত্রী। যদিও সীতা ছিলেন রামচন্দ্রের অর্ধাঙ্গী, প্রণয়িনী, সহচরী- তবুও শুধু লোকের মন রাখার জন্য রামচন্দ্র তাঁকে বনবাসে পাঠিয়েছিলেন। প্রাবন্ধিক এ প্রসঙ্গে বলেছেন, রামচন্দ্র সীতাকে বনবাসে পাঠিয়ে অপমানিত করে স্বামিত্বের ষোলো আনা পরিচয় দিয়েছেন। রামচন্দ্র যদি সীতার অনুভবশক্তিকে শ্রদ্ধা করতেন, তাহলে সীতার অমন পবিত্র হৃদয়কে অবিশ্বাসের পদাঘাতে চূর্ণ করতে পারতেন না।

১৭. ‘অবলার হাতেও সমাজের জীবন-মরণের কাঠি আছে।’-উক্তিটি ব্যাখ্যা করো।
উত্তর: নারীর অধিকারকে অবহেলা করে সমাজের সার্বিক উন্নতি সম্ভব নয়- এ বক্তব্যই প্রকাশিত হয়েছে উক্তিটির ভেতর দিয়ে।
সমাজের যথার্থ বিকাশ অবশ্যই নারী ও পুরুষের সমতাভিত্তিক অগ্রগতির মাধ্যমে সম্ভব। শিক্ষা ও জ্ঞানের চর্চা থেকে নারীকে বঞ্চিত করার ফলেই আমাদের সমাজের এ অধঃপতন বলে লেখিকা মত প্রকাশ করেছেন। পুরুষের স্বার্থ ও নারীর স্বার্থ এক ও অভিন্ন-একথা বোঝাতেই উক্তিটি করা হয়েছে।

১৮. নারী ও পুরুষকে প্রাবন্ধিক দ্বিচক্রযানের সঙ্গে তুলনা করেছেন কেন?
উত্তর: নারী ও পুরুষ সমাজে একে অপরের পরিপূরক, তাই প্রাবন্ধিক তাদের দ্বিচক্রযানের সঙ্গে তুলনা করেছেন।
রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন তাঁর ‘অর্ধাঙ্গী’ প্রবন্ধে নারী-পুরুষের মধ্যে বিরাজমান অসংগতি উল্লেখ করে দেখিয়েছেন যে, উভয়পক্ষ সমান না হলে সমাজ ভারসাম্য বজায় রেখে চলতে পারে না। তাই তিনি নারী ও পুরুষকে দ্বিচক্রযানের সঙ্গে তুলনা করেছেন। সমাজ নামক এ দ্বিচক্রযানের দুটি চাকা, তার একটি হচ্ছে নারী আর অপরটি হচ্ছে পুরুষ। একটিকে বাদ দিয়ে আর একটির কথা চিন্তা করা যায় না। নারীরা সমাজের অর্ধাঙ্গ। নারীর উন্নতি বাদ দিয়ে সমাজের সার্বিক কল্যাণ বা অগ্রগতি সম্ভব নয়।

১৯. হযরত মুহাম্মদ (স) কীভাবে কন্যাকুলের রক্ষক হলেন? ব্যাখ্যা করো।
উত্তর: হযরত মুহাম্মদ (স) কন্যাকুলের রক্ষক হয়েছিলেন। কন্যা সন্তানের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি বিভিন্ন ব্যবস্থা এবং নিজের জীবনে কন্যা পালনের অনুপম দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।
মহানবি হযরত মুহাম্মদ (স) আগমনের পূর্ব যুগে আরবের অধিবাসীরা স্ত্রীজাতির উপর অমানুষিক অত্যাচার ও নির্যাতন চালাত। এমনকি কন্যাসন্তান হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের হত্যা করা হতো। এখন পরিস্থিতিতে হযরত মুহাম্মদ (স) কন্যাকূলের রক্ষক হিসেবে আবির্ভূত হন। তিনি স্ত্রীজাতির অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য নানাবিধ ব্যবস্থা গ্রহণ করেন এবং কন্যা সন্তানদের পরম আদরে লালন-পালনের নির্দেশ দেন। শুধু তাই নয়, তিনি কন্যা সন্তান পালনকে নিজের আদর্শ হিসেবে দেখিয়েছিলেন। যা লক্ষ করা যায় তাঁর ব্যক্তিগত জীবনে কন্যা ফাতেমার প্রতি আচরণের মধ্য দিয়ে। আর এভাবে হযরত মুহাম্মদ (স) কন্যাকুলের রক্ষক হয়েছিলেন।

২০. ‘সীতার সাথে রাম যেমন, বালকের সাথে পুতুল তেমন’- উক্তিটি ব্যাখ্যা করো।
উত্তর: ‘অর্ধাঙ্গী’ প্রবন্ধে উল্লিখিত রামচন্দ্র সীতার সজো বালকসুলভ স্বেচ্ছাচারিতা করেছিলেন বলেই সীতার সঙ্গে তার সম্পর্ককে বালকের সঙ্গে পুতুলের সম্পর্কের মতো বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
সীতা হলেন রামায়ণে উল্লিখিত রামচন্দ্রের স্ত্রী। আর রামচন্দ্র প্রেমিক, ধার্মিক- সবই। কিন্তু সীতার প্রতি রাম যে ব্যবহার করেছেন তাতে প্রকাশ পায় যে, একটি পুতুলের সঙ্গে বালকের যে সম্বন্ধ, সীতার সঙ্গে রামের সম্বন্দ্বও প্রায় সেরূপ। বালক ইচ্ছে করলে পুতুলটিকে প্রাণপণে ভালোবাসতে পারে, ইচ্ছে হলে ছুড়ে ফেলতে পারে। কিন্তু পুতুল কিছুই করতে পারে না, কারণ হাত-পা থাকা সত্ত্বেও পুতুল অচেতন পদার্থ। এখানে সীতাকে পুতুলের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। সীতার সঙ্গে রাম ওই বালকের মতো ব্যবহার করেছেন।

২১. ‘প্রভুদের বিদ্যার গতির সীমা নাই।’- উক্তিটি ব্যাখ্যা করো।
উত্তর: ‘অর্ধাঙ্গী’ প্রবন্ধের স্বামী তথা পুরুষের তুলনায় নারীর শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হওয়ার প্রসঙ্গাটি প্রকাশ করা হয়েছে উল্লিখিত উক্তির মাধ্যমে।
রূপে বর্ণনা করা হয়েছে। প্রাবন্ধিকের মতে, পুরুষ যখন বাইরের জগতে জ্ঞান-বিজ্ঞানের সকল শাখায় বিচরণ করে, তখনই নারী কেবল সূচি কর্ম ও নানাবিধ রন্ধন প্রণালির পরীক্ষা নিয়ে ব্যস্ত থাকে। নারী-পুরুষের শিক্ষার বৈষম্যের প্রতি ইঙ্গিত করেই উক্তিটি করা হয়েছে।

২২. ‘মাতৃ-হৃদয়ে পক্ষপাতিতা নাই।’- উক্তিটি বুঝিয়ে দাও।
উত্তর: ‘মাতৃ-হৃদয়ে পক্ষপাতিতা নাই’ বলতে বোঝানো হয়েছে- ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে মায়ের নিকট সমান স্নেহ-মমতা ভোগ করে।
পুরুষশাসিত সমাজে নারীদের অধিকার সমান নয়। কিন্তু মাতৃ-হৃদয়ে নারী-পুরুষ তথা পুত্র ও কন্যার কোনো ভেদ নেই। পুত্র ও কন্যা ভেদে সেখানে গর্ভধারণের সময়সীমা বা বুকের দুধের বণ্টনে পক্ষপাতিত্ব করা হয় না। মায়ের স্নেহ-মমতা পুত্র-কন্যা সমানভাবে ভোগ করে, কিন্তু পুরুষশাসিত সমাজে পুরুষেরাই নারীর প্রতি বৈষম্যের সৃষ্টি করে।

২৩. ‘আবশ্যক হইলে কোন্দলও চলে’-উক্তিটি ব্যাখ্যা করো।
উত্তর: উক্তিটির মাধ্যমে আমাদের সমাজে কর্তব্য সম্পর্কে অসচেতন নারীদের স্বভাব-প্রকৃতি তুলে ধরেছেন প্রাবন্ধিক।আমাদের সমাজের নারীরা নিজেদের করণীয় সম্পর্কে নিজেরাই অসচেতন এবং অলস। দশজন নারী একসঙ্গে মিলিত হলে পরস্পরের স্বামীর দোষ-গুণ কিংবা পরচর্চার বাকপটুতা প্রদর্শনে তৎপর হয়। কখনো কখনো তাদের মধ্যে বিবাদও বেধে যায়, কোন্দল চলে। নারীদের এ অবস্থার প্রতি ইঙ্গিত প্রদর্শন করা হয়েছে উক্তিটিতে।

২৪. ‘মানসিক দাসত্ব’ বলতে বেগম রোকেয়া কী বুঝিয়েছেন?
উত্তর: বেগম রোকেয়ার লেখায় 'মানসিক দাসত্ব' বলতে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন নারীর মনের উপর পুরুষতান্ত্রিক সমাজের প্রভাব এবং স্বাধীন চিন্তার অভাব।
তিনি উল্লেখ করেছেন যে, নারীরা পুরুষের চাপে তাদের নিজস্ব চিন্তাশক্তি বা ইচ্ছার প্রকাশ করতে পারেন না। এই দাসত্ব মানসিক এবং সামাজিক, যা তাদের নিজের অধিকার ও ক্ষমতার বিষয়ে সচেতন হতে দেয় না। রোকেয়া দেখিয়েছেন যে, অনেক ক্ষেত্রে নারীরা বাহ্যিক পরিবর্তন, যেমন পর্দা ত্যাগ বা শিক্ষার সুযোগ পেলেও, তাদের মনের দাসত্ব মুক্ত হয় না। সমাজে পুরুষের সিদ্ধান্তই তাদের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং নারীরা তাদের জীবনের দিকনির্দেশনায় স্বাধীন ভূমিকা রাখতে পারে না। তিনি এ দাসত্ব থেকে মুক্তির পথ হিসেবে নারীর শিক্ষার উপর জোর দিয়েছেন, যাতে তারা নিজেদের অধিকারের প্রতি সচেতন হতে পারে এবং নিজেদের সক্ষমতা উপলব্ধি করতে পারে।


‘অর্ধাঙ্গী’ প্রবন্ধের সৃজনশীল প্রশ্ন- ১

নিচের উদ্দীপকটি পড় এবং প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও:
রেণু ও রাজু একই পিতা-মাতার সন্তান। কিন্তু তাদের পিতা-মাতা রাজুকে রেণু অপেক্ষা বেশি আদর-যত্ন করে। দুই ভাইবোন খেতে বসলে বড় ভাগটা রাজু পায়। রাজু কোনো অপরাধ করলে তাদের পিতা-মাতা বেটা ছেলে বলে আমলে নেয় না। রাজুর জন্য গৃহশিক্ষক থাকলেও রেণুর জন্য তা রাখা হয়নি। রেণু যতই বয়ঃপ্রাপ্ত হচ্ছে পিতা-মাতা তার বিয়ে দেওয়ার জন্য ততই ব্যাকুল হয়ে উঠেছে। এতে রেণু আপত্তি করলে তার মা বলেন, মেয়েদের এত লেখাপড়া শিখে কাজ নেই, বরং ঘর-দোর সাজানো গোছানো, সুয়েটার বুনন এবং রান্না করাটা শিখে নিলে তা কাজে আসবে।

ক. ‘শমস-উল-ওলামা’ অর্থ কী?
খ. ‘স্বামী’র ছলে ‘অর্ধাঙ্গ’ শব্দটি প্রচলিত হওয়ার যৌক্তিকতা বর্ণনা করো।
গ. অনুচ্ছেদে রেণুর পরিবারে নারীর যে অবস্থাটি ফুটে উঠেছে তা ‘অর্ধাঙ্গী’ প্রবন্ধের আলোকে ব্যাখ্যা করো।
ঘ. ‘অনুচ্ছেদে রেণুর মায়ের মনোভাব সমকালীন প্রতিক্রিয়াশীল সমাজের মনোভাবেরই সমান্তরাল’-মন্তব্যটি ‘অর্ধাঙ্গী’ প্রবন্ধের আলোকে বিশ্লেষণ করো।

-----------

‘অর্ধাঙ্গী’ প্রবন্ধের সৃজনশীল প্রশ্ন- ২

নিচের উদ্দীপকটি পড় এবং প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও:
শিশির এক মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করে। বালিকা বয়সে তার স্কুলে যাওয়ার খুব শখ থাকলেও সে পারিবারিক শাসন ডিঙিয়ে স্কুলে যেতে পারেনি। মায়ের কাছে সে আরবি বর্ণমালা শিখেছে। এরপর কায়দা শিখে যখনই আমপারা শিখতে শুরু করে তখনই তার বিয়ের প্রস্তাব আসে। তার পিতা-মাতা কালবিলম্ব না করে মেয়ের বিয়ে দেয়। ভাগ্যগুণে শিশির ভালো স্বামী পেয়ে যায়। সে স্বামীর সংসারে থেকে নিজের প্রচেষ্টা ও স্বামীর উৎসাহে বিদ্যা অর্জন করে। তাতে সে সমাজে নারীর হীন অবস্থা বুঝতে পারে। নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য সে নারীশিক্ষা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে তার এলাকার নারীদের শিক্ষিত করে তোলে।

ক. ‘অবরোধ প্রথা’ কী?
খ. ‘অর্ধাঙ্গী’ প্রবন্ধে লেখক কোন প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ‘নবদম্পতির প্রেমালাপ’ কবিতাংশটি ব্যবহার করেছেন? বর্ণনা করো।
গ. উদ্দীপকে শিশিরের পিতৃ-পরিবারে ব্যক্ত নারীর প্রতি মানোভাব ‘অর্ধাঙ্গী’ প্রবন্ধের আলোকে ব্যাখ্যা করো।
ঘ. শিশিরের কাজের মধ্যে ‘অর্ধাঙ্গী’ প্রবন্ধের প্রাবন্ধিকের ইচ্ছার কি কোনো প্রতিফলন ঘটেছে? তোমার উত্তরের পক্ষে যুক্তি দাও।

-----------

‘অর্ধাঙ্গী’ প্রবন্ধের সৃজনশীল প্রশ্ন- ৩

নিচের উদ্দীপকটি পড় এবং প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও:
পাখি পোষা অপুর একটি প্রিয় শখ। এ জন্য সুন্দর করে সে একটি খাঁচা বানিয়েছে। অনেক দিন ধরে এ খাঁচায় সে একটি ঘুঘু পুষতো। ফরিদ নামে অপুর এক বন্ধু ছিল। সে ছিল একজন পাখি বিশারদ। একদিন অপুদের বাড়ি বেড়াতে এসে পাখির এ বন্দিদশা দেখে সে খুব কষ্ট পায়। অপুকে অনুরোধ করে পাখিটি সে খাঁচা থেকে মুক্ত করে দেয়। কিন্তু কী আশ্চর্য, পরদিন সকালে ঘর থেকে বেরিয়েই সে দেখতে পায়, পাখিটি তার খাঁচার পাশেই বসে আছে।

ক. ‘স্ত্রীজাতির অবনতি’ শীর্ষক প্রবন্ধে লেখিকা নারীদের যে রোগটির কথা জানিয়েছেন সেটা কী?
খ. ‘অর্ধাঙ্গী’ প্রবন্ধে লেখিকা অবলাদের অবনতির চিত্র দেখাতে চেয়েছেন কেন?
গ. খাঁচামুক্ত পাখিটির সাথে ‘অর্ধাঙ্গী’ প্রবন্ধের কোন দিকটির মিল রয়েছে?
ঘ. ‘অর্ধাঙ্গী’ প্রবন্ধের আলোকে মুক্ত পাখিটি খাঁচার পাশে বসে থাকার কারণটি বিশ্লেষণ করো।

ক. ‘স্ত্রীজাতির অবনতি’ শীর্ষক প্রবন্ধে লেখিকা নারীদের যে রোগটির কথা জানিয়েছেন সেটা হলো দাসত্ব।
খ) ‘অর্ধাঙ্গী’ প্রবন্ধে লেখিকা অবলা তথা নারী জাতির উন্নতির পথ আবিষ্কারের জন্যই তাদের অবনতির চিত্র দেখাতে চেয়েছেন।
কেননা, কোনো রোগীর চিকিৎসার জন্য সবার আগে যেমন সঠিকভাবে তার রোগ নির্ণয় করা দরকার তেমনি কোনো জাতির উন্নতির জন্য সবার আগে দরকার সঠিকভাবে তার অবনতির চিত্রটি প্রত্যক্ষ করা। তা না হলে তাদের অবনত অবস্থাকে কিছুতেই উন্নত করা সম্ভব হবে না।

গ. খাঁচামুক্ত পাখিটির সাথে ‘অর্ধাঙ্গী’ প্রবন্ধের যে দিকটির মিল রয়েছে তাহলো নারীদের মানসিক দাসত্ব। পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় নারী স্বাধীনতা সব সময় পুরুষ মুখাপেক্ষী। পুরুষদের ইচ্ছায় নারীরা যেমন এক প্রকার গৃহবন্দি থাকে, তেমনি ঘরের বাইরে এলেও পুরুষদের ইচ্ছাতেই তা আসতে হয়। এখানে নারীদের কোনো জীবনীশক্তি বা চেতনাবোধের উপস্থিতি লক্ষ করা যায় না। তাই যুগ যুগের সঞ্চিত অভিজ্ঞতায় নারীরা মনে করে, তারা জন্মগতভাবেই পুরুষদের দাসী। তাই অপুর পাখিটিকে মুক্ত করে দেয়ার মতো কোনো ব্যক্তিবিশেষ বা বিশেষ কোনো সমাজের পুরুষরা যদি নারীদের স্বাধীন করে দিতে চায় তবু তারা সেটাকে যথাযথভাবে গ্রহণ করতে পারে না। সেক্ষেত্রেও তারা পাখিটির মতোই ঘুরেফিরে এসে পুরুষেরই মুখাপেক্ষী হয়ে ওঠে। লেখিকা রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন তাঁর 'অর্ধাঙ্গী' প্রবন্ধে এটাকেই নারীদের মানসিক দাসত্ব বলে অভিহিত করেছেন। আর এ দাসত্ব থেকে তাদের মুক্ত করার লক্ষ্যেই তিনি তাদের অবনতির চিত্র দেখাতে চেয়েছেন।

ঘ) রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন তাঁর 'অর্ধাঙ্গী' প্রবন্ধে নারীজাতির যে বিশেষ রোগটির প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন তা হলো দাসত্ব। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় যুগ যুগের সঞ্চিত অভিজ্ঞতায় নারীরা সব সময় নিজেদের পুরুষের মুখাপেক্ষী করে রাখে। কোথাও কখনো তাদের স্বাধীনতা দেয়া হলেও তারা এ পুরুষনির্ভরশীলতার বলয় থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না। রোকেয়া এটাকে মানসিক দাসত্ব বলে অভিহিত করেছেন। উদ্দীপকের পাখিটি যেমন দীর্ঘদিন খাঁচায় বন্দি থাকার পর মুক্ত হয়েও আবার খাঁচার কাছে ফিরে এসেছে, নারী জাতির ক্ষেত্রেও ঠিক তেমনটিই ঘটে। এটা আসলে দীর্ঘদিনের অভ্যাসজনিত একটি মানসিক সমস্যা। একটানা দীর্ঘদিন একটি পরিবেশে থাকলে তার প্রতি মানুষের যে ধরনের একটি আলাদা টান ও নির্ভরশীলতা তৈরি হয়, খাঁচামুক্ত পাখি ও স্বাধীনতা পাওয়া নারী সমাজের ক্ষেত্রেও ঠিক তাই হয়। লেখিকা তাঁর 'অর্ধাঙ্গী' প্রবন্ধে নানা যুক্তি ও দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করে এ বিষয়টিই অত্যন্ত চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন।


‘অর্ধাঙ্গী’ প্রবন্ধের সৃজনশীল প্রশ্ন- ৪
নিচের উদ্দীপকটি পড় এবং প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও:
দুসন্তানের জনক রাশেদ একটি বেসরকারি সাহায্য সংস্থার জনসংযোগ কর্মকর্তা। তার স্ত্রী রিনা একটি বেসরকারি কলেজের শিক্ষক। তাদের একমাত্র ছেলে জাহিদ ঢাকার একটি নামী স্কুলে ক্লাস সেভেনে পড়ে এবং একমাত্র মেয়ে অনিমা পড়ে ক্লাস থ্রিতে। তারা দুজনে মিলে প্রতি মাসে যা উপার্জন করে তাতে সংসার চালিয়েও বেশ কিছু টাকা উদ্বৃত্ত থাকে। রিনার সহকর্মী জামানও দুসন্তানের জনক। তার স্ত্রী একজন গৃহিণী। তাই একজনের উপার্জনে তার সংসার চালাতে খুব কষ্ট হয়। ছেলেমেয়েরা পাড়ার একটি সাধারণ স্কুলে লেখাপড়া করলেও তাদের অনেক চাহিদাই পূরণ করা সম্ভব হয় না। সংসার খরচ মিটিয়ে মাস শেষে হাতে কোনো টাকাও অবশিষ্ট থাকে না। ক. সংসার জীবনকে কারা দ্বিচক্র শকটের ন্যায় বলে অভিহিত করেন?
খ. সংসার জীবনকে একটি দ্বিচক্র শকট বলা হয়েছে কেন?
গ. 'অর্ধাঙ্গী' প্রবন্ধে রাশেদের সংসার সম্পর্কে লেখিকার যে মনোভাব ব্যক্ত হয়েছে তা তুলে ধর।
ঘ. সংসার চালাতে জামানের কষ্টের বিষয়টি 'অর্ধাঙ্গী' প্রবন্ধের আলোকে বিশ্লেষণ কর।
ক) শুক্লকেশ বুদ্ধিমানগণ সংসার জীবনকে দ্বিচক্র শকটের ন্যায় বলে অভিহিত করেন।
খ) দুজন মানুষের মিলিত প্রয়াসেই একটি সংসার গড়ে ওঠে বলে সংসার জীবনকে একটি দ্বিচক্র শকট বলা হয়েছে। এ দ্বিচক্র শকটের একটি শকট হচ্ছে পতি এবং অপরটি পত্নী। কোনো শকট বা গাড়ির দুটি চক্র বা চাকা যদি সমান না হয়, তবে সেই শকট বা গাড়ির পক্ষে অধিক দূরে অগ্রসর হওয়া সম্ভব নয়। ঠিক একইভাবে একটি সংসারের পতি এবং পত্নী যদি সমান না হন কিংবা তারা যদি সমান তালে চলতে না পারেন তবে সেই সংসার উন্নতির পথে অধিক দূর অগ্রসর হতে পারে না বলে শুক্লকেশ বুদ্ধিমান বা জ্ঞানী বৃদ্ধগণ সংসার জীবনকে একটি দ্বিচক্র শকটের ন্যায় বলে অভিহিত করেছেন।
গ) 'অর্ধাঙ্গী' প্রবন্ধে লেখিকা রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের মনোভাব অনুযায়ী রাশেদের সংসারটি তুলনামূলকভাবে একটি আদর্শ সংসার। লেখিকা তার প্রবন্ধে বলেছেন শুক্লকেশ বুদ্ধিমানগণ মনে করেন, সংসারের বৈশিষ্ট্য একটি দ্বিচক্র শকটের মতো। এর একটি চক্র বা চাকা পতি আর অপরটি হচ্ছে পত্নী। একটি শকট বা গাড়ির দুটি চক্র বা চাকা সমান না হলে তা যেমন অধিক দূরে অগ্রসর হতে পারে না, তেমনি একটি সংসারে পতি এবং পত্নী যদি সমান না হয় তবে সে সংসারের চাকাটিও উন্নতির পথে খুব একটা অগ্রসর হতে পারে না। সেদিক থেকে রাশেদ এবং তার স্ত্রী রিনা দুজনেই সমান সমান। তারা দুজনেই সংসারের জন্য পরিশ্রম করে এবং অর্থ উপার্জন করে। ফলে তাদের সংসারে তেমন কোনো অভাব-অনটন নেই। এ জন্যেই লেখিকা তার প্রবন্ধে নারী ও পুরুষের সমতার ওপর বিশেষ জোর দিয়েছেন। কেননা, তিনি মনে করেন, নারী-পুরুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফলেই একটি সংসার সুষমভাবে তার উন্নয়নের পথে অগ্রসর হতে পারে।
ঘ) 'অর্ধাঙ্গী' প্রবন্ধে একটি সংসারকে দ্বিচক্র শকট বা দুচাকার গাড়ি বলে অভিহিত করা হয়েছে। শুক্লকেশ বুদ্ধিমানদের উদ্ধৃতি দিয়ে প্রাবন্ধিক রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন এ প্রসঙ্গে বলেছেন, সংসারের এই দুটি চাকার একটি হচ্ছে পতি এবং অপরটি পত্নী। একটি গাড়ির দুটি চাকা সমান না হলে তা যেমন সামনে অগ্রসর না হয়ে একই স্থানে ঘুরপাক খায়, তেমনি একটি সংসারের পতি ও পত্নী সমান তালে কাজ করতে না পারলে সেই সংসারেরও উন্নতি হয় না। উদ্দীপকে বর্ণিত জামানের সাংসারিক অবস্থা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তার সংসার হচ্ছে এমন একটি শকট বা গাড়ির মতো যার দুটি চাকা অসমান। কেননা, জামান নিজে চাকুরি করে সংসারের জন্য অর্থ উপার্জন করলেও শুধু গৃহিণী হওয়ার কারণে তার স্ত্রী তা করতে পারে না। তাই এ অসমান চাকা নিয়ে তার পক্ষে সংসার নামক শকট বা গাড়ি নিয়ে অধিক দূরে অগ্রসর হওয়া সম্ভব হয় না। আর এ কারণেই একক উপার্জনে সংসার চালাতে গিয়ে তাকে হিমশিম খেতে হয়। এক্ষেত্রে তার স্ত্রীও যদি তার সমান হতো অর্থাৎ রাশেদের স্ত্রীর মতো সংসারের অর্থ উপার্জনে সহযোগী হতে পারতো তবে তাদের সংসারের এ দুরবস্থা হতো না।
লেখিকা অত্যন্ত যৌক্তিক ও বাস্তবতার সাথে জামানের সংসারিক দুরবস্থার প্রকৃত কারণটি তার প্রবন্ধে তুলে ধরেছেন।

‘অর্ধাঙ্গী’ প্রবন্ধের সৃজনশীল প্রশ্ন- ৫
নিচের উদ্দীপকটি পড় এবং প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও: আব্দুল কাদের হোসেনপুর গ্রামের একজন সাধারণ কৃষক। তিন মেয়ে ও দুই ছেলেসহ তাঁর পরিবারের সদস্য সংখ্যা সাত জন। স্ত্রী গ্রামের সালাম শেখের বাড়িতে কাজ করে। পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে মেয়েরা বাড়ির কাজ করে। মেয়েদের পড়ানোর ব্যাপারে কোনো আগ্রহ না থাকলেও ছেলেদের শিক্ষিত করার জন্য তিনি আপ্রাণ চেষ্টা করেন। তিনি মনে করেন, মেয়েদের বিয়ে দিলেই তার দায়িত্ব শেষ। ওদের পড়িয়ে কী লাভ! ক. কে কন্যাকূলের রক্ষকস্বরূপ দণ্ডায়মান হয়েছিলেন?
খ. 'স্ত্রীদের বিদ্যার দৌড় সচরাচর বোধোদয় পর্যন্ত।'- উক্তিটি ব্যাখ্যা কর।
গ. 'ওদের পড়িয়ে কী লাভ!'- উক্তিটির সঙ্গে 'অর্ধাঙ্গী' প্রবন্ধের সাদৃশ্য আলোচনা কর।
ঘ. ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার ব্যাপারে আব্দুল কাদেরের ভূমিকাটি 'অর্ধাঙ্গী' প্রবন্ধের আলোকে বিশ্লেষণ কর।
ক) হযরত মুহাম্মদ (স) কন্যাকূলের রক্ষকস্বরূপ দণ্ডায়মান হয়েছিলেন।
খ) রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন তাঁর 'অর্ধাঙ্গী' প্রবন্ধের এ উক্তির মাধ্যমে নারী শিক্ষা প্রসঙ্গে পুরুষ ও নারীর মধ্যে যে বৈষম্য রয়েছে তা তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন, পুরুষরা যেখানে বিদ্যাচর্চার সর্বোচ্চ সুযোগ পায়, স্ত্রীদের বিদ্যার দৌড় সেখানে কেবল ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর রচিত শিশু শিক্ষার তৃতীয় ভাগ অর্থাৎ 'বোধোদয়' পর্যন্ত। পুরুষ যখন বাইরের জগতের জ্ঞানবিজ্ঞানের সকল শাখায় বিচরণ করে, নারীরা তখন কেবল সুচিকর্ম ও নানা প্রকার রান্নার কৌশল নিয়ে ব্যস্ত থাকে। পুরুষশাসিত সমাজে পুরুষেরা নারী শিক্ষার প্রতি খুব একটা নজর দেয় না। তারা মনে করে, নারীরা শিক্ষিত হলেও সমাজের তেমন কোনো লাভ হবে না।
গ) 'অর্ধাঙ্গী' প্রবন্ধে রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন নারী শিক্ষার উপর গুরুত্বারোপ করেছেন নারী শিক্ষার বেহাল অবস্থা দেখে। উদ্দীপকের আব্দুল কাদেরের মধ্যেও নারী শিক্ষার প্রতি অনীহা দেখা যায়।
আমাদের সমাজে নারী শিক্ষার পশ্চাদপদতার মূল কারণ তাদের শিক্ষা গ্রহণের সুযোগের স্বল্পতা। পুরুষ শাসিত সমাজ নারীদের শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে চায়নি। তারা মনে করত নারীরা শিক্ষিত হলে সমাজ কলুষিত হবে। তাই অভিভাবকরা কন্যাদের শিক্ষাগ্রহণের বিষয়টিকে নিরুৎসাহিত করতেন। তারা মনে করতেন, মেয়েরা কোনো মতে লিখতে-পড়তে জানলেই তো চলে। উদ্দীপকের আব্দুল কাদের একজন কৃষক। তার স্ত্রী পরের বাসায় ঝিয়ের কাজ করে। তার ধারণা কন্যারাও বড় হয়ে মায়ের মতো কাজ করবে। তাদের পড়িয়ে লাভ নেই। নারী শিক্ষায় অনীহার স্বরূপ উন্মোচনে উদ্দীপকটি প্রবন্ধের সঙ্গে পুরোপুরি সঙ্গতিপূর্ণ।
ঘ) 'অর্ধাঙ্গী' প্রবন্ধে নারী জাগরণের পথিকৃৎ রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন নারী-পুরুষের শিক্ষার মধ্যে যে বৈষম্য তা অত্যন্ত স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন। উদ্দীপকে কৃষক আব্দুল কাদেরের মধ্যেও এ ধরনের মানসিকতা দেখা যায়। পুরুষশাসিত সমাজে পুরুষের কর্তৃত্ব এবং নারীর মানসিক দাসত্বের কারণে নারীরা পিছিয়ে আছে। আমাদের এ সমাজে নারীরা পুরুষের হাতের পুতুল। অন্যদিকে পুরুষের সাহায্যপ্রার্থী হয়ে চলার কারণে নারীর মধ্যে মানসিক দাসত্ব তৈরি হয়। আর এর কারণ হিসেবে দায়ী শিক্ষার বৈষম্য, সামাজিকভাবে নারীর অধিকার হরণ, সচেতনতার অভাব, নারীদের পরনির্ভরশীলতা এবং তাদের আত্মপ্রত্যয়হীন মনোভাব। নারীরা সম অধিকারের দাবিদার হলেও তারা পুরুষের তুলনায় সুযোগ-সুবিধা পায় খুবই কম। একজন পিতা ছেলেদের লেখাপড়া করাতে যতোটা আগ্রহ দেখান, মেয়েদের বেলায় ততোটা দেখান না। উদ্দীপকের কৃষক আব্দুল কাদের ছেলে দুটিকে শিক্ষিত করার ব্যাপারে গুরুত্ব দিলেও মেয়েদের ব্যাপারে ঠিকই উদাসীনতা দেখিয়েছেন। উদ্দীপকের এ বাস্তবতাই 'অর্ধাঙ্গী' প্রবন্ধে চমৎকারভাবে আলোচিত হয়েছে।

‘অর্ধাঙ্গী’ প্রবন্ধের সৃজনশীল প্রশ্ন- ৬
নিচের উদ্দীপকটি পড় এবং প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও: সবুজ ও নীলিমা দশ বছর ধরে সংসার করছে। কিন্তু কোনোদিন সবুজ সংসারের উন্নয়নে নীলিমার সঙ্গে পরামর্শ করেনি। সে মনে করে মেয়েরা স্বল্পবুদ্ধিসম্পন্ন। নীলিমাও এ নিয়ে তাঁর স্বামীকে কিছু বলে না। মানবাধিকার কর্মী রাবেয়া মনে করেন, 'সমাজে নারীর অবমূল্যায়নের জন্য নীলিমার মতো নারীরাই দায়ী। নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন নয় বলেই পুরুষরা তাদের উপর একচেটিয়া কর্তৃত্ব করে।' ক. কাদের পর্দা মোচন হয়েছে?
খ. 'মানসিক দাসত্ব' বলতে লেখিকা কী বুঝিয়েছেন?- ব্যাখ্যা কর।
গ. উদ্দীপকের নীলিমার মনোভাব 'অর্ধাঙ্গী' প্রবন্ধের আলোকে ব্যাখ্যা কর।
ঘ. 'নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন নয় বলেই পুরুষরা তাদের উপর একচেটিয়া কর্তৃত্ব করে।'- উক্তিটি অর্ধাঙ্গী প্রবন্ধের আলোকে বিশ্লেষণ কর।
ক) পার্সি মহিলাদের পর্দা মোচন হয়েছে।
খ) নারী জাগরণের পথিকৃৎ রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন তাঁর 'অর্ধাঙ্গী' প্রবন্ধে নারী জাতিকে মানসিক দাসত্বের শিকার বলে অভিহিত করেছেন। যুগ যুগ ধরে পুরুষশাসিত সমাজে বাস করার জন্য নারীরা ভেতর-বাহির সব দিক থেকেই পুরুষের দাসী হয়ে পড়েছে। মূলত শিক্ষার অভাবেই তারা পুরুষের তুলনায় সবক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়েছে। তারা ভালো-মন্দ বিবেচনা না করে পুরুষের সব নির্দেশ মেনে নিয়ে ব্যক্তিত্বহীন ও অসাড় জীবন-যাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। শিক্ষিত নারীরাও পর্দানশীন জীবন-যাপন করায় নিজেদের ক্ষমতা অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে। তাই 'অর্ধাঙ্গী' প্রবন্ধে মানসিক দাসত্বকে নারীদের মূল সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। 'মানসিক দাসত্ব' বলতে মূলত নারীর ব্যক্তিত্বহীনতা ও মুক্তচিন্তার অক্ষমতাকেই বুঝানো হয়েছে।
গ) রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন তাঁর 'অর্ধাঙ্গী' প্রবন্ধে নিজেদের অধিকার সম্পর্কে নারীদের উদাসীনতা সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। উদ্দীপকেও দেখা যায়, নারীরা নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন নয় বলে পুরুষরা কারণে-অকারণে তাদের উপর কর্তৃত্ব করে। অনেক আগে থেকেই আমাদের দেশের নারীরা সবদিক থেকে বঞ্চিত ছিল। উনিশ শতকের শুরুতে তাদের এ বঞ্চনা আরও প্রকট আকার ধারণ করে। পুরুষশাসিত এ সমাজে আগে থেকেই তাদের বাস্তবিক শিক্ষা-দীক্ষা, বাইরের আলোবাতাস ও জ্ঞানের অনুশীলন থেকে বঞ্চিত রাখা হয়েছিল। আর এ জন্যই উদ্দীপকের নীলিমা দশ বছর ধরে সবুজের সংসার করলেও সবুজ সংসারের উন্নয়নে নীলিমার কোনো মতামত গ্রহণ করেনি। আর নীলিমাও এ নিয়ে স্বামীকে কিছু বলেনি। এর মূল কারণ নীলিমা তার অধিকার সম্পর্কে সচেতন নয়। আর এ অসচেতনতার কারণেই স্বামী তার উপর একচেটিয়া কর্তৃত্ব করতে পারে।
ঘ) বাঙালি মুসলিম নারী জাগরণের পথিকৃৎ রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন তাঁর 'অর্ধাঙ্গী' প্রবন্ধে সমাজ উন্নয়নে নারীদের অংশগ্রহণের গুরুত্বের বিষয়টিকে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে তুলে ধরেছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি নারী জাতিকে জেগে ওঠারও আহ্বান জানিয়েছেন। নীলিমার মতো নারীদের মানসিকতাই যে সমাজে নারীদের অবমূল্যায়নের অন্যতম কারণ- প্রবন্ধে তিনি এটাও উল্লেখ করেছেন।
'অর্ধাঙ্গী' প্রবন্ধে রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন দেখিয়েছেন যে, আমাদের দেশে নারীরা যুগ যুগ ধরে শোষিত, বঞ্চিত, লাঞ্ছিত ও অবহেলিত। মুসলিম নারীরা সমাজের এক অদৃশ্য শেকলে বন্দি। পুরুষশাষিত সমাজে অনেকটা গায়ের জোরেই তাদের শিক্ষা-দীক্ষার ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখা হয়েছে। তাদের মেধা ও ইচ্ছা শক্তিকে কাজে না লাগানোর ফলে তারা আজ সমাজের সম্পদ না হয়ে বোঝায় পরিণত হয়েছে। এর ফলে তাদের মধ্যে তৈরি হয়েছে এক ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত মানসিক দাসত্ব।
উদ্দীপকের নীলিমাও এ মানসিক দাসত্বের শিকার। সে তার অধিকার সম্পর্কে সচেতন নয়। দশ বছর আগে সবুজের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। কিন্তু সংসারের উন্নয়নে তার স্বামী কোনোদিনই তার সঙ্গে কোনো পরামর্শ করেনি। নীলিমা যদি নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হতো তবে সবুজের মতো পুরুষরা তার উপর এভাবে একচেটিয়া কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠ করতে পারতো না। তাই নারীদের এ মানসিক দাসত্বের খোলস ছেড়ে নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হওয়া দরকার। আর সেই সাথে দরকার পরিবার ও সমাজের উন্নয়মূলক কাজে নিজেদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা।

‘অর্ধাঙ্গী’ প্রবন্ধের সৃজনশীল প্রশ্ন- ৭
নিচের উদ্দীপকটি পড় এবং প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও:
বিয়ের ৪ বছরের মাথায় এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় রাবেয়ার স্বামী মারা যায়। এ জন্য দুই বছরের একটি সন্তান নিয়ে তাকে তার বাবার বাড়িতে চলে যেতে হয়। বাবার বাড়িতে গিয়ে তাকে নানা গঞ্জনার শিকার হতে হয়। তার মাও তাকে কখনো কখনো গাল-মন্দ করে। এসব সহ্য করতে না পেরে রাবেয়া এক সময় ভাইদের কাছে তার বাবার সম্পত্তির অংশ দাবী করে। সবাই বিস্মিত, এমন কথা সে কী করে বলতে পারলো! এতে করে তার বিড়ম্বনা আরো বেড়ে যায়। ক. মহম্মদীয় আইনে পৈতৃক সম্পত্তিতে কন্যা পুত্রের কত ভাগ পায়?
খ. 'মাতৃহৃদয়ে পক্ষপাতিতা নাই'- বলতে কী বুঝানো হয়েছে?
গ. উদ্দীপকে বর্ণিত রাবেয়ার বিষয়টি অর্ধাঙ্গী প্রবন্ধে কীভাবে প্রতিফলিত হয়েছে- ব্যাখ্যা কর।
ঘ. রাবেয়া সামাজিক বৈষম্যের শিকার- 'অর্ধাঙ্গী' প্রবন্ধের আলোকে উক্তিটি বিশ্লেষণ কর।
ক) মহম্মদীয় আইনে পৈতৃক সম্পত্তিতে কন্যা পুত্রের অর্ধেক ভাগ পায়।
খ) 'মহম্মদীয়' আইনে 'পৈত্রিক সম্পত্তিতে কন্যা পুত্রের অর্ধেক ভাগ পাইবে, এ নিয়ম থাকলেও মাতৃস্নেহে পুত্র-কন্যার মধ্যে কোনো ব্যবধান বা পক্ষপাতিত্ব নেই। মায়ের নিকট পুত্র-কন্যা সবাই সমান স্নেহলাভের অধিকারী। কিন্তু আমাদের সমাজে পিতাকে কিছুটা ব্যবধান করতে দেখি। পিতা পুত্রের জন্য যতোটা সুযোগ-সুবিধা করে দেন, কন্যার জন্য ততোটা দেন না। এমনকি সন্তানদের সম্পত্তি বণ্টনের ক্ষেত্রে সমতা রক্ষা তো দূরের কথা মহম্মদীয় আইনও তারা মানেন না। মেয়েদের প্রতি তাদের এ বৈষম্যমূলক আচরণ সমাজ স্বাভাবিক বলেই মেনে নেয়। আসলে পুরুষদের এ দৃষ্টিভঙ্গি সমাজেরই এক অপসৃষ্টি। অথচ মাতৃহৃদয় কিন্তু সব কিছুতেই নিরপেক্ষ। পার্থিব বা অপার্থিব কোনো ক্ষেত্রেই তারা বৈষম্য করতে চান না। তার কাছ থেকে পুত্র-কন্যা সব সময় সমান স্নেহ ও ভালোবাসা পেয়ে থাকে। 'মাতৃহৃদয়ে পক্ষপাতিতা নাই'- কথাটি দিয়ে মূলত এ কথাই বুঝানো হয়েছে।
গ) নারী জাগরণের অগ্রদূত রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন তার 'অর্ধাঙ্গী' প্রবন্ধে খ্রিস্টান ও মুসলমান সমাজে নারীদের অধিকার সম্পর্কে আলোকপাত করতে গিয়ে সমাজে সমগ্র নারীজাতির অবস্থান স্পষ্ট করার চেষ্টা করেছেন।
উদ্দীপকে বর্ণিত রাবেয়া চরিত্রটি পারিবারিক ও সামাজিক বৈষম্যের শিকার। স্বামী মারা যাওয়ার পর রাবেয়া নানামুখী সংকটে পড়ে। বাবার বাড়িতেও সে এ সংকট থেকে মুক্তি পাচ্ছিলো না। নিজের ন্যায্য অধিকার থেকেও সে বঞ্চিত হচ্ছিলো। এ সমাজে নারীরা যেন সর্বত্রই বঞ্চিত। লেখিকা তাঁর 'অর্ধাঙ্গী' প্রবন্ধে বলেছেন- মুসলমানদের মতে আমরা পুরুষের অর্ধেক অর্থাৎ দুজন নারী একজন নরের সমতুল্য। অথবা দুইজন ভ্রাতা ও একজন ভগিনী একত্র হইলে আমরা আড়াইজন হই।
মহম্মদীয় আইনে বলা হয়েছে যে, পৈতৃক সম্পত্তিতে কন্যা পুত্রের অর্ধেক ভাগ পাবে। এই নিয়মটি কিন্তু পুস্তকেই সীমাবদ্ধ। বাস্তবে এ অবস্থা আরও করুণ। উদ্দীপকের রাবেয়া এই নির্মম সমাজ বাস্তবতারই এক সাধারন শিকার।
ঘ) বাঙালি মুসলিম নারী জাগরণের পথিকৃৎ রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত বাঙালি মুসলিম নারী সমাজের শৃঙ্খলিত জীবন-যাপনে বেদনার্ত হয়েছেন। তিনি তার 'অর্ধাঙ্গী' প্রবন্ধে এদেশের নারী সমাজকে তার আপন শক্তিতে জেগে ওঠার আহ্বান জানিয়েছেন। উদ্দীপকে বর্ণিত রাবেয়া চরিত্রটি পারিবারিক ও সামাজিক বৈষম্যের শিকার। স্বামী মারা যাওয়ার পর একটি মেয়ের শ্বশুর বাড়িতে থাকার অধিকার ক্ষীণ হয়ে পড়ে। সেক্ষেত্রে মেয়েরা অসহায় অবস্থায় পতিত হয়। রাবেয়াকে দেখেছি শ্বশুর বাড়ি থেকে সন্তানকে নিয়ে বাবার বাড়িতে চলে আসতে। কিন্তু সেখানেও সে ভালো অবস্থায় থাকতে পারেনি। এক্ষেত্রে একটি মেয়ে পুরুষের উপর কতটুকু নির্ভরশীল সে দিকটি ফুটে উঠেছে। সমাজের অর্ধেক অংশ নারীসমাজকে সীমাহীন বৈষম্যমূলক আচরণের মাঝে রেখে কখনোই সমাজের উন্নয়ন সম্ভব নয়। পুরুষের যেমন উচ্চ হৃদয়বৃত্তি আছে, তেমনি নারীদেরও তা আছে। সেই হৃদয়বৃত্তির অনুশীলন ও চর্চার মাধ্যমে সমাজে বহু কল্যাণ হওয়া সম্ভব। অথচ রাবেয়া স্বামী ছাড়া সামাজিক ও মানসিকভাবে অসহায় হয়ে পড়ে। লেখিকা তাঁর 'অর্ধাঙ্গী' প্রবন্ধে সমাজ জীবনের সর্বক্ষেত্রে পুরুষদের নিদারুণ স্বার্থপরতা, আধিপত্যকামী মানসিকতার প্রেক্ষাপটে নারী সমাজ বিশেষ করে মুসলমান নারী সমাজের পশ্চাদপদতা, দুর্বিষহ জীবন ও অধিকারহীনতার বিষয়টিকে স্পষ্ট করে দেখিয়েছেন। রাবেয়া তার অসহায় অবস্থায় বাবার সম্পত্তি দাবি করাকে পরিবারের সবাই অপরাধমূলক কাজ হিসেবে ধরে নিয়েছে এবং তার ওপর সবার অসন্তুষ্টি এতে আরো বেড়ে গেছে। যা মোটেই কাঙ্ক্ষিত ছিলো না। বরং সবার কাছ থেকেই তার আরও অতিরিক্ত সহযোগিতা ও সহানুভূতি পাওয়ার কথা ছিলো। এ প্রসঙ্গে রোকেয়া তার অর্ধাঙ্গী প্রবন্ধে স্পষ্ট করে বলেছেন, আমরা পুরুষের অর্ধেক অর্থাৎ দুজন নারী একজন পুরুষের সমান। মুহম্মদীয় আইনে বলা আছে, পৈতৃক সম্পত্তিতে কন্যা-পুত্রের অর্ধেক ভাগ পাবে। তবে এ নিয়মটি শুধু পুস্তকেই সীমাবদ্ধ। বাস্তবে এর অবস্থা আরও করুণ। সমাজ ব্যবস্থার এ বৈষম্যমূলক নীতি নারী জীবনকে দুর্দশাগ্রস্ত করে তুলেছে। নারীর প্রতি পুরুষ, পরিবার তথা সমাজের বৈষম্যমূলক আচরণই উদ্দীপক ও অর্ধাঙ্গী প্রবন্ধে ফুটে উঠেছে। সমাজের উন্নয়ন ও অগ্রপতির স্বার্থে এর একটি সহজ ও যৌক্তিক সমাধান হওয়া উচিত।

‘অর্ধাঙ্গী’ প্রবন্ধের সৃজনশীল প্রশ্ন- ৮
নিচের উদ্দীপকটি পড় এবং প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও: পরিবারের অমতে শিমুল তার পছন্দের পাত্রী মিনুকে বিয়ে করে। মিনু মেধাবী ছাত্রী। সে তার মেধা দিয়ে সমাজ উন্নয়নের পাশাপাশি নিজেকেও স্বাবলম্বী করতে চায়, কিন্তু শিমুল তাতে রাজি হয় না। ফলে শিক্ষিত নারী হয়েও মিনু ঘরে বসে থাকে। সেখানেও তার মতামতের কোনো মূল্য নেই। স্বামীর সকল সিদ্ধান্তই তাকে মুখ বুজে সহ্য করতে হয়। ক. কে স্বামিত্বের ষোল আনা পরিচয় দিয়েছেন?
খ. “তাই বলিয়া পুরুষ ‘প্রভু’ হইতে পারে না।”- উক্তিটি ব্যাখ্যা করো।
গ. শিমুল ‘অর্ধাঙ্গী’ প্রবন্ধের কোন চরিত্রটির প্রতিনিধিত্ব করছে- ব্যাখ্যা করো।
ঘ. নারীর প্রতি পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি কীরূপ- উদ্দীপক ও অর্ধাঙ্গী প্রবন্ধের আলোকে বিশ্লেষণ করো।
ক) রামচন্দ্র স্বামিত্বের ষোল আনা পরিচয় দিয়েছেন।
খ) উদ্ধৃত উক্তিটির মাধ্যমে লেখিকা পুরুষ ও নারীর সম্পর্কের ধরন কেমন হওয়া উচিত তা বুঝাতে চেয়েছেন। শারীরিক দুর্বলতাবশত নারীজাতি পুরুষের সাহায্যের উপর নির্ভরশীল। নারীর প্রতি পুরুষশাসিত সমাজের বৈষম্যমূলক আচরণ তাদের কোণঠাসা করে রেখেছে। শিক্ষার অভাবে তারা মানসিকভাবে সবল হতে পারছে না। কিন্তু তাই বলে পুরুষের উচিত নয় তাদের ওপর প্রভুত্ব খাটানো। জগৎজুড়ে প্রতিটি জীবই কোনো না কোনোভাবে একে অন্যের ওপর নির্ভরশীল হলেও ওরা কেউ কারও স্বামী বা প্রভু নয়। অথচ পুরুষ নারীর স্বামী হয়ে তার ওপর প্রভুত্ব করে। অথচ নারী-পুরুষ একে অপরের পরিপূরক। মূলত এই বিষয়টি বোঝাতে লেখিকা তাঁর প্রবন্ধে উদ্ধৃত উক্তিটি করেছেন। গ) উদ্দীপকের শিমুল 'অর্ধাঙ্গী' প্রবন্ধে উল্লিখিত রাজা রামচন্দ্রের প্রতিনিধিত্ব করছে। রোকেয়া স্বামীদের প্রভুত্বের বিষয়টি স্পষ্ট করার জন্য রামায়ণের রাম ও সীতার ঘটনাটি উপস্থাপন করেছেন। রাম ও সীতার মধ্যে ভালোবাসার কমতি ছিল না। কিন্তু তারপরও রাম-সীতাকে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দিতে পারেনি। উদ্দীপকে উল্লিখিত শিমুল এর মধ্যেও আমরা রামের ছাপ লক্ষ করি। শিমুল পরিবারের অমতে ভালোবেসে মিনুকে বিয়ে করে। তাদের মধ্যেও ভালোবাসার কমতি ছিল না। কিন্তু তারপরও শিমুল তার স্ত্রীকে স্বাধীনভাবে চলতে দেয়নি। স্ত্রীর প্রতি শিমুল তার স্বামিত্বের ষোলআনা অধিকার বজায় রাখতে চেয়েছে। রাজা রামচন্দ্রও ইচ্ছার বিরুদ্ধে সীতাকে বনবাসে পাঠিয়ে তার স্বামিত্বের ষোলআনা পরিচয় দিয়েছেন। রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন এ প্রসঙ্গে বলেছেন, রামচন্দ্র সীতাকে বনবাসে পাঠিয়ে অপমানিত করে স্বামিত্বের ষোলআনা পরিচয় দিয়েছেন। তা না হলে রাম-সীতার অমন পবিত্র হৃদয়কে অবিশ্বাসের পদাঘাতে চূর্ণ করতে পারতেন না। সীতার সঙ্গে রাম যেন পুতুলের মতোই আচরণ করেছেন। শিক্ষিত নারী মিনুর সমাজ উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত হওয়ার ইচ্ছাকে প্রত্যাখ্যান করে উদ্দীপকের শিমুলও স্বামিত্বের ষোল আনা পরিচয় দিয়েছে এবং তার সাথে পুতুলের মতোই আচরণ করেছে। তাই বলা যায়, উদ্দীপকের শিমুলের সঙ্গে প্রবন্ধের রামচন্দ্রের যথেষ্ট সাদৃশ্য রয়েছে।
ঘ) নারী জাগরণের অগ্রদূত রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন তাঁর 'অর্ধাঙ্গী' প্রবন্ধে সুস্পষ্টভাবে বলেছেন, নারী সমাজের 'অর্ধাঙ্গী'। নারীকে বাদ দিয়ে সমাজের সার্বিক কল্যাণ বা অগ্রগতি সম্ভব নয়। নারী-পুরুষের যৌথ প্রচেষ্টাতেই সমাজের কল্যাণ সাধন হতে পারে। কিন্তু আমাদের সমাজে নারীর প্রতি পুরুষের রয়েছে সীমাহীন বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গি- যা উদ্দীপকেও প্রতিফলিত হয়েছে। নারীর প্রতি পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি হলো যথেষ্ট সংকীর্ণ, স্বার্থপর ও আধিপত্যকামী। রোকেয়া 'অর্ধাঙ্গী' প্রবন্ধে পুরুষ রামচন্দ্রের সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির অবতারণা করে পুরুষের স্বার্থপরতা ও স্বামিত্বের গর্বের বিষয়টিকে তুলে ধরেছেন। রামচন্দ্র সীতার পবিত্র হৃদয়খানি অবিশ্বাসের আঘাতে চূর্ণ করে স্বামিত্বের ষোলআনা পরিচয় দিয়েছিলেন। অথচ রাম যদি সীতার প্রতি উদার মানসিকতার পরিচয় দিতে পারতেন, তাহলে সীতা তাঁর সমতুল্য সহচর হতে পারতেন। উদ্দীপকে উল্লিখিত শিমুল এর মধ্যেও আমরা রামচন্দ্রের সাদৃশ্য দেখতে পাই। শিমুল তার স্ত্রী মিনুর স্বাবলম্বী হওয়ার বিষয়টি মেনে নিতে পারেনি। উনিশ শতকের শেষ এবং বিশ শতকের গোড়ার দিকে ভারতবর্ষে পুরুষশাসিত সমাজ ব্যবস্থায় সর্বক্ষেত্রে নারীরা বিশেষ করে মুসলিম নারীরা ছিল পুরুষের আধিপত্যকামিতার শিকার। পুরুষরা একচেটিয়াভাবে নারীদের ন্যায্য শিক্ষা-দীক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে। তারা মনে করেছে নারীরা শিক্ষিত হয়ে উঠলে সমাজ নষ্ট হয়ে যাবে। পুরুষের সংকীর্ণ মানসিকতার কারণে নারীরা তাদের পিতার পার্থিব ও অপার্থিব সম্পত্তি থেকেও বঞ্চিত হয়েছে। এই সমাজ ব্যবস্থার কারণেই রামচন্দ্র তার স্ত্রী সীতাকে বিসর্জন দিয়েছিলেন। উদ্দীপকের শিমুলও পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার কারণে মিনুকে স্বাবলম্বী হতে দেয়নি। এমনকি সংসারের কোনো সিদ্ধান্তেও তাকে অংশগ্রহণ করার সুযোগ দেয়নি।
সময়ের পরিবর্তন হলেও পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীদের অধিকােেরর বিষয়টি এখনও দারুণভাবে উপেক্ষিত। সমাজ উন্নয়নের বৃহত্তর স্বার্থেই এ পিরিস্থিতির দ্রুত অবসান হওয়া দরকার।

‘অর্ধাঙ্গী’ প্রবন্ধের সৃজনশীল প্রশ্ন- ৯
নিচের উদ্দীপকটি পড় এবং প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও :
রুহীর বয়স সাত, বাবা সম্প্রতি তাকে একটি খেলনা গাড়ি কিনে দিয়েছেণ। খেলতে গিয়ে গাড়ির পেছনের একটি চাকা ভেঙ্গে যাওয়ায় সে কান্নাকাটি শুরু করে। বড় ভাই রুমী আরেকটি পুরোনো গাড়ি থেকে একটি চাকা খুলে পিছনের চাকার স্থানে জুড়ে দেয় কিন্তু চাকাটি বেশ ছোট হওয়ায় গাড়ি চালাতে গিয়ে বিপত্তি দেখা দেয়। রুহী যেই গাড়ি ধাক্কা দেয় সেই সেটি একস্থানে ঘুরতে থাকে, সামনে এগোয় না।
(ক) ‘অর্ধাঙ্গী’ প্রবন্ধের শুরুতে লেখিকা তাঁর কোন প্রবন্ধের কথা টেনে এনেছেন?
(খ) ‘অর্ধাঙ্গী’ প্রবন্ধের শুরুতে লেখিকা গোঁড়া পর্দাপ্রিয় ভগ্নীদের কাছে কোন বিষয়টি কেন পরিষ্কার করে ব্যাখ্যা করেছেন?
(গ) উদ্দীপকে রুহীর খেলনা গাড়ির অবস্থাটি ‘অর্ধাঙ্গী’ প্রবন্ধের কোন দিকটিকে উপস্থাপন করেছে? যুক্তিপূর্ণ উত্তর দাও।
(ঘ) ‘সমাজকে একটি গাড়ির সাথে তুলনা করলে নারী-পুরুষের সমান অবদান সমাজ-উন্নয়নের জন্যে অত্যাবশ্যক।’ -উদ্দীপক ‘অর্ধাঙ্গী’ প্রবন্ধের আলোকে বিষয়টি বুঝিয়ে দাও।
-----------

‘অর্ধাঙ্গী’ প্রবন্ধের সৃজনশীল প্রশ্ন- ১০
নিচের উদ্দীপকটি পড় এবং প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও :
সামিয়া ও ফারিয়া দু-বোন। সামিয়া ছোটবেলা থেকেই পড়ালেখায় মনোযোগী, ফারিয়া মনে করে মেয়েদের পড়ালেখা করে কী হবে? তাদের কাজ হচ্ছে স্বামীর সংসার করা। সামিয়া নিজের জন্যে ভাবে না, তার দুশ্চিন্তা বোনকে নিয়ে। সে ভাবে পড়ালেখা না করার কারণে সে স্বামী-সংসারে পদে পদে বঞ্চনার শিকার হবে, কখনোই মর্যাদা সহকারে জীবন যাপনে সক্ষম হবে না। ফারিয়ার এ নিয়ে কোন দুশ্চিতাই নেই।
(ক) ‘অর্ধাঙ্গী’ প্রবন্ধে কোন সময়কার বাঙালি সমাজের কথা বলা হয়েছে?
(খ) লেখিকা মানসিক দাসত্ব বলতে কী বুঝিয়েছেন?
(গ) সামিয়া ও ফারিয়া দু-বোনের চিন্তাচেতনার পার্থক্য চিহ্নিত কর।
(ঘ) নিজের বোন ফারিয়ার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সামিয়ার যে উদ্বেগ উদ্দীপকে প্রকাশ পেয়েছে তার যৌক্তিকতা মূল্যায়ন কর।
-----------

তথ্যসূত্র :
১. সাহিত্য পাঠ: একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড, ঢাকা, ২০২৫।
২. রচনাসমগ্র: বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন, ঝিনুক প্রকাশনী, জুলাই ২০১১। ৩. আধুনিক বাংলা অভিধান: বাংলা একাডেমি, এপ্রিল, ২০১৮।
৪. ব্যবহারিক বাংলা অভিধান: বাংলা একাডেমি, ১৮তম, ২০১৫।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url