পরিচ্ছেদ ১২: সমাস প্রক্রিয়ায় শব্দ গঠন
|
| সমাস প্রক্রিয়ায় শব্দ গঠন |
সমাস প্রক্রিয়ায় শব্দ গঠন
সমাসের মাধ্যমে নতুন শব্দ গঠিত হয়। বাক্যের মধ্যে পরস্পর সম্পর্কিত একাধিক পদের এক শব্দে পরিণত হওয়ার নাম সমাস। নিচের বাক্য দুটির দিকে তাকানো যাক:
১ম বাক্য: পরীক্ষাসমূহের নিয়ন্ত্রক পরীক্ষার সময় সংক্রান্ত সূচি স্কুল ও কলেজে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন।
২য় বাক্য: পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক পরীক্ষার সময়সূচি স্কুল-কলেজে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন।
১ম বাক্যের ‘পরীক্ষাসমূহের নিয়ন্ত্রক’, ‘সময় সংক্রান্ত সূচি’ এবং ‘স্কুল ও কলেজ’ পদগুলো ২য় বাক্যে যথাক্রমে ‘পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক’, ‘সময়সূচি’ এবং ‘স্কুল-কলেজ’ হিসেবে সংক্ষিপ্ত হয়েছে। সংক্ষেপ করার এই প্রক্রিয়ার নাম সমাস।
সমাসবদ্ধ শব্দকে বলে সমস্তপদ, যেমন ‘পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক’, ‘সময়সূচি’ এবং ‘স্কুল-কলেজ’। এর প্রথম অংশের নাম পূর্বপদ এবং শেষ অংশের নাম পরপদ। এখানে ‘পরীক্ষা’, ‘সময়’ ও ‘স্কুল’ হলো পূর্বপদ এবং ‘নিয়ন্ত্রক’, ‘সূচি’ ও ‘কলেজ’ হলো পরপদ।
যেসব শব্দ দিয়ে সমস্তপদকে ব্যাখ্যা করা হয়, তাকে ব্যাসবাক্য বলে। এখানে ‘পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক’ পদের ব্যাসবাক্য হলো ‘পরীক্ষাসমূহের নিয়ন্ত্রক’, ‘সময়সূচি’ পদের ব্যাসবাক্য হলো ‘সময় সংক্রান্ত সূচি’ এবং ‘স্কুল-কলেজ’ পদের ব্যাসবাক্য হলো ‘স্কুল ও কলেজ’। এছাড়া যেসব পদ নিয়ে সমাস হয়, সেগুলোকে সমস্যমান পদ বলে। ১ম বাক্যের ‘পরীক্ষাসমূহের নিয়ন্ত্রক’ পদগুলোর ‘পরীক্ষাসমূহের’ এবং ‘নিয়ন্ত্রক’ হলো সমস্যমান পদ।
সমস্তপদ সাধারণত এক শব্দ হিসেবে লেখা হয়, যেমন ‘সময়সূচি’। উচ্চারণ বা অর্থের বিভ্রান্তি ঘটার আশঙ্কায় কিছু ক্ষেত্রে পূর্বপদ ও পরপদের মাঝখানে হাইফেন (-) বসে, যেমন ‘স্কুল-কলেজ’। কিছু ক্ষেত্রে পূর্বপদ ও পরপদকে আলাদা লেখা হয়, যেমন ‘পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক’।
সমাস মূলত চার প্রকার। যথা: দ্বন্দ্ব, কর্মধারয়, তৎপুরুষ ও বহুব্রীহি।
১. দ্বন্দ্ব সমাস
দ্বন্দ্ব সমাসে পূর্বপদ ও পরপদ উভয় পদের অর্থের সমান প্রাধান্য থাকে। যেমন:
‘সোনা-রুপা’ সমস্তপদের ব্যাসবাক্য ‘সোনা ও রুপা’।
নিচের বাক্যে সমস্তপদটির প্রয়োগ থেকে এর পূর্বপদ ও পরপদের অর্থের প্রাধান্য বোঝা
যাবে:
সোনা-রুপার দাম বেড়ে গেছে।
অর্থাৎ সোনার দামও বেড়ে গেছে, রুপার দামও বেড়ে গেছে।
দ্বন্দ্ব সমাসের ক্ষেত্রে সমজাতীয়, বিপরীত ও অনুরূপ শব্দের সংযোগ ঘটে। যেমন:
| মা ও বাবা = মা-বাবা | স্বর্গ ও নরক = স্বর্গ-নরক |
| জমা ও খরচ = জমাখরচ | হাত ও পা = হাত-পা |
| উনিশ ও বিশ = উনিশ-বিশ | ঝড় ও বৃষ্টি = ঝড়বৃষ্টি |
| আসা ও যাওয়া = আসা-যাওয়া | ধীরে ও সুস্থে = ধীরেসুস্থে |
| ভালো ও মন্দ = ভালোমন্দ | সোনা ও রুপা = সোনা-রুপা |
| তুমি ও আমি = তুমি-আমি | পোটলা ও পুটলি = পোটলা-পুটলি |
কিছু দ্বন্দ্ব সমাসে পূর্বপদ ও পরপদের বিভক্তি সমাসবদ্ধ হলেও বিদ্যমান থাকে। এই ধরনের দ্বন্দ্ব সমাসের নাম অলুক দ্বন্দ্ব সমাস। যেমন:
| হাতে ও কলমে = হাতে-কলমে | চোখে ও মুখে = চোখেমুখে |
| চলনে ও বলনে = চলনে-বলনে | -------- |
সমস্যমান পদ কখনো কখনো দুইয়ের বেশি হতে পারে। যেমন:
| সাহেব, বিবি ও গোলাম = সাহেব-বিবি-গোলাম |
| হাত, পা, চোখ ও কান = হাত-পা-চোখ-কান |
২. কর্মধারয় সমাস
যে সমাসে পরপদের অর্থ প্রাধান্য পায়, তাকে কর্মধারয় সমাস বলে। যেমন:
গোলাপ নামের ফুল = গোলাপফুল, যা কাঁচা তাই মিঠা = কাঁচা-মিঠা।
ক. কিছু কর্মধারয় সমাসের সমস্যমান পদে ‘যে’ যোজক থাকে, যেমন:
| খাস যে জমি = খাসজমি | চিত যে সাঁতার = চিতসাঁতার |
| ভাজা যে বেগুন = বেগুনভাজা | সিদ্ধ যে আলু = আলুসিদ্ধ |
| কনক যে চাঁপা = কনকচাঁপা | টাক যে মাথা = টাকমাথা |
| যে চালাক সে চতুর = চালাকচতুর | যে শান্ত সে শিষ্ট = শান্তশিষ্ট |
খ. কিছু কর্মধারয় সমাসের পূর্বপদ সংখ্যাবাচক শব্দ হয়, সেগুলোকে দ্বিগু কর্মধারয় বলে। যেমন:
| তিন ফলের সমাহার = ত্রিফলা | চার রাস্তার মিলন = চৌরাস্তা |
গ. কিছু কর্মধারয় সমাসে সমস্যমান পদের মধ্যবর্তী এক বা একাধিক পদ লোপ পায়। এগুলো মধ্যপদলোপী কর্মধারয় নামে পরিচিত। যেমন:
| ঘি মাখানো ভাত = ঘিভাত | হাতে পরা হয় যে ঘড়ি = হাতঘড়ি |
| ঘরে আশ্রিত জামাই = ঘরজামাই | বিজয় নির্দেশক পতাকা = বিজয়-পতাকা |
ঘ. যার সঙ্গে তুলনা করা হয়, তা উপমান। কিছু কর্মধারয় সমাসে উপমানের সঙ্গে গুণবাচক শব্দের সমাস হয়। এগুলোকে উপমান কর্মধারয় বলে। এই সমাসে পরপদ সাধারণত বিশেষণ হয়। যেমন:
| কাজলের মতো কালো = কাজলকালো | শশের মতো ব্যস্ত = শশব্যস্ত |
ঙ. যাকে তুলনা করা হয়, তা উপমেয়। কিছু কর্মধারয় সমাসে উপমেয় পদের সাথে উপমান পদের সমাস হয় । এগুলোকে উপমিত কর্মধারয় সমাস বলে। এই সমাসে উভয় পদই বিশেষ্য হয়। যেমন:
| পুরুষ সিংহের ন্যায় = সিংহপুরুষ | আঁখি পদ্মের ন্যায় = পদ্মআঁখি |
| মুখ চন্দ্রের ন্যায় = চন্দ্রমুখ | -- |
চ. কিছু কর্মধারয় সমাসে উপমেয় পদের সাথে উপমান পদের অভেদ কল্পনা করা হয়। এগুলোকে
রূপক কর্মধারয় সমাস বলে। যেমন:
| বিষাদ রূপ সিন্ধু = বিষাদসিন্ধু | মন রূপ মাঝি = মনমাঝি |
৩. তৎপুরুষ সমাস
সমস্যমান পদের বিভক্তি ও সন্নিহিত অনুসর্গ লোপ পেয়ে যে সমাস হয়, তার নাম তৎপুরুষ সমাস। এই সমাসে পরপদের অর্থ প্রাধান্য পায়।
ক. বিভক্তি লোপ পাওয়া তৎপুরুষ সমাসের উদাহরণ:
| ছেলেকে ভুলানো = ছেলে-ভুলানো | দুঃখকে প্রাপ্ত = দুঃখপ্রাপ্ত |
| ধানের খেত = ধানখেত | পথের রাজা = রাজপথ |
| মামার বাড়ি = মামাবাড়ি | অকালে মৃত্যু = অকালমৃত্যু। |
| গোলায় ভরা = গোলাভরা | গাছে পাকা = গাছপাকা |
খ. সন্নিহিত অনুসর্গ লোপ পাওয়া তৎপুরুষ সমাসের উদাহরণ:
| মধু দিয়ে মাখা = মধুমাখা | চিনি দিয়ে পাতা = চিনিপাতা |
| রান্নার জন্য ঘর = রান্নাঘর | বিয়ের জন্য পাগলা = বিয়েপাগলা |
| গ্রাম থেকে ছাড়া = গ্রামছাড়া | আগা থেকে গোড়া = আগাগোড়া। |
গ. কিছু ক্ষেত্রে বিভক্তি লোপ পায় না, এসব তৎপুরুষ সমাসের নাম অলুক তৎপুরুষ, যেমন:
| গরুর গাড়ি = গরুরগাড়ি | তেলে ভাজা= তেলেভাজা |
৪. বহুব্রীহি সমাস
যে সমাসে পূর্বপদ বা পরপদ কোনোটির অর্থ না বুঝিয়ে অন্য কিছু বোঝায়, তাকে বহুব্রীহি সমাস বলে। যেমন:
| বউ ভাত পরিবেশন করে যে অনুষ্ঠানে = বউভাত | লাঠিতে লাঠিতে যে যুদ্ধ = লাঠালাঠি |
ক. পূর্বপদ বিশেষণ এবং পরপদ বিশেষ্য হলে তাকে সমানাধিকার বহুব্রীহি বলে। যেমন:
| এক গোঁ যার = একগুঁয়ে | লাল পাড় যে শাড়ির = লালপেড়ে |
খ. পূর্বপদ ও পরপদ উভয়ই বিশেষ্য (কখনো কখনো ক্রিয়াবিশেষ্য) হলে ব্যাধিকরণ বহুব্রীহি হয়। যেমন:
| গোঁফে খেজুর যার = গোঁফখেজুরে | -- |
গ. যে বহুব্রীহি সমাসের ব্যাসবাক্য থেকে এক বা একাধিক পদ লোপ পায়, তাকে পদলোপী বহুব্রীহি বলে। যেমন:
| চিরুনির মতো দাঁত যার = চিরুনদাঁতি | হাতে খড়ি দেওয়া হয় যে অনুষ্ঠানে = হাতেখড়ি |
ঘ. পারস্পরিক ক্রিয়ায় কোনো অবস্থা তৈরি হলে ব্যতিহার বহুব্রীহি হয়। যেমন:
| হাতে হাতে যে যুদ্ধ = হাতাহাতি | কানে কানে যে কথা = কানাকানি |
ঙ. যে বহুব্রীহি সমাসে সমস্যমান পদের পূর্বপদের বিভক্তি অক্ষুণ্ণ থাকে, তাকে অলুক বহুব্রীহি বলে। যেমন:
| গায়ে এসে পড়ে যে = গায়েপড়া | কানে খাটো যে = কানেখাটো |
চ. যে বহুব্রীহি সমাসের পূর্বপদ সংখ্যাবাচক, তাকে সংখ্যাবাচক বহুব্রীহি সমাস বলে। যেমন:
| চার ভুজ যে ক্ষেত্রের = চতুর্ভুজ | সে (তিন) তার যে যন্ত্রের = সেতার |
| বহুনির্বাচনি প্রশ্ন : |
|---|
প্রশ্ন থেকে
অভিনন্দন!
|
| তথ্যসূত্র : |
|---|
|
১. বাংলা ব্যাকরণ ও নির্মিতি: নবম-দশম শ্রেণি, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও
পাঠ্যপুস্তক বোর্ড, ঢাকা, ২০২৫। ২. প্রমিত বাংলা ভাষার ব্যাকরণ: বাংলা একাডেমি, প্রথম খণ্ড, ঢাকা, ২০১২। ৩. প্রমিত বাংলা ব্যবহারিক ব্যাকরণ: বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ২০১৬। ৪. ভাষা শিক্ষা: দি অ্যাটলাস পাবলিশিং হাউস, ঢাকা, অক্টোবর ২০২১-২২। ৫. আধুনিক বাংলা অভিধান: বাংলা একাডেমি, ঢাকা, এপ্রিল, ২০১৮। ৬. ব্যবহারিক বাংলা অভিধান: বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ১৮তম, ২০১৫। |
