ভাষা

মানুষ ভাষা-সম্পদের অধিকারী। ভাব প্রকাশের প্রয়োজন থেকেই ভাষার উদ্ভব। মানুষের উচ্চারিত অর্থবহ বহুজনবোধ্য ধ্বনিসমষ্টিই ভাষা। পরস্পর ভাব-বিনিময়ের জন্য এক-এক সমাজের মানুষ গড়ে তুলেছে এক-এক রকম ধ্বনিব্যবস্থা। ভাষা হচ্ছে অর্থবহ প্রণালিবদ্ধ ধ্বনি-প্রতীক। মানুষ তার কণ্ঠনিঃসৃত যে ধ্বনি বা ধ্বনিসমষ্টির মাধ্যমে ভাব ও অনুভূতিকে অন্যের কাছে বোধগম্যভাবে পৌঁছে দেয়, তা-ই ভাষা (Language)। ভাষা মানবগোষ্ঠীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান সম্পদ। সমাজবদ্ধ মানুষের পারস্পরিক ভাব বিনিময়ে ভাষা একটি উন্নত মাধ্যম। 

মানবসভ্যতার বিকাশে ভাষার ভূমিকা অপরিসীম। আদিমকালে মানুষ যখন গুহাবাসী, বন্য ও অভব্য ছিল, তখনো মানুষ নিজেদের মধ্যে ভাবের আদান-প্রদান করত। তখন ভাব-বিনিময়ের মাধ্যম ছিল ইশারা-ইঙ্গিত-অঙ্গভঙ্গি ইত্যাদি। এগুলো ভাষা বিকাশের প্রাথমিক রূপ হিসেবে বিবেচ্য। বস্তুত আদিকালে মানুষ পারস্পরিক ভাব-বিনিময়ের জন্য যেসব মাধ্যম ব্যবহার করত সেগুলো হলো: 

(ক) ইশারা-ইঙ্গিত, (খ) অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ব্যবহার, (গ) নাচ, (ঘ) চিত্র ইত্যাদি। 

সৃষ্টির প্রথম যুগে সভ্যতার সোপানে প্রথম পদক্ষেপ হলো সংঘবদ্ধ হয়ে কাজ করা। আর এ থেকেই তৈরি হলো সমাজ। কালের যাত্রায় মানুষ যখন সংঘবদ্ধভাবে বসবাস করতে শুরু করল, তখন সে বুঝতে পারল যে কেবল ইশারা-ইঙ্গিত, অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে মনের ভাব সম্পূর্ণরূপে প্রকাশ করা যায় না। নিরন্তর প্রচেষ্টা, বুদ্ধি ও সাধনার মাধ্যমে কালক্রমে মানুষ ধ্বনির প্রণালিবদ্ধ উচ্চারণ ও ব্যবহারে সক্ষম হলো। 

মানুষের কণ্ঠনিঃসৃত বাধ্বনিই ভাষা হিসেবে গৃহীত। বলা বাহুল্য, ইঙ্গিতের মাধ্যমেও ভাবের আদান-প্রদান করা যায়, কিন্তু কণ্ঠধ্বনি হচ্ছে মানুষের অনুভূতি প্রকাশের সর্বোত্তম প্রক্রিয়া। কণ্ঠধ্বনির মাধ্যমে মানুষ সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ভাব প্রকাশে সক্ষম। তাই আমরা ভাষা বলতে বুঝি বাগ্যন্ত্র-সৃষ্ট সর্বজনবোধ্য ধ্বনিসমষ্টিকে। অর্থাৎ মানুষ তার মনের ভাব প্রকাশ করার জন্য কণ্ঠ, জিহ্বা, ওষ্ঠ, দন্ত, নাসিকা, মুখবিবর প্রভৃতি বাগ্যন্ত্রের সাহায্যে বোধগম্য যে ধ্বনি বা ধ্বনিসমষ্টি উচ্চারণ করে থাকে, সেই ধ্বনি বা ধ্বনিসমষ্টিই ভাষা। 

১.১ ভাষার সংজ্ঞার্থ ও বৈশিষ্ট্য 

সংজ্ঞার্থ: মনের ভাব প্রকাশ করার জন্য মনুষ্যজাতি অপরের বোধগম্য যে ধ্বনি বা ধ্বনিসমষ্টি উচ্চারণ করে থাকে, তাকে ভাষা বলে। 

ভাষাবিজ্ঞানীগণ বিভিন্নভাবে ভাষাকে সংজ্ঞায়িত করেছেন। এ প্রসঙ্গে কয়েকজন প্রখ্যাত ভাষাপণ্ডিতের ভাষা-সম্পর্কিত চিন্তাসূত্র উদ্ধৃত করা হলো: 

ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে, ‘মনুষ্যজাতি যে ধ্বনি বা ধ্বনিসকল দ্বারা মনের ভাব প্রকাশ করে, তার নাম ভাষা।’ 

ভাষা সম্পর্কে ডক্টর সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, ‘মনের ভাব প্রকাশের জন্য বাগ্যন্ত্রের সাহায্যে উচ্চারিত, ধ্বনির দ্বারা নিষ্পন্ন, কোনো বিশেষ সমাজে ব্যবহৃত, স্বতন্ত্রভাবে অবস্থিত, তথা বাক্যে প্রযুক্ত শব্দ-সমষ্টিকে ভাষা বলে।’ 

মূলত মানুষের মনোভাব-প্রকাশক কণ্ঠনিঃসৃত অর্থবহ ধ্বনিসমষ্টিই ভাষা। 

ভাষার বৈশিষ্ট্য 

১. ভাষা কণ্ঠনিঃসৃত ধ্বনির সাহায্যে গঠিত; 

২. ভাষার অর্থদ্যোতকতা গুণ বিদ্যমান; 

৩. ভাষা একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচলিত ও ব্যবহৃত; 

৪. ভাষা মানুষের স্বেচ্ছাকৃত আচরণ ও অভ্যাসের সমষ্টি; 

দেশ, কাল ও পরিবেশভেদে ভাষার পার্থক্য ও পরিবর্তন ঘটে। আদি মানবের যে ভাষা ছিল, কালের প্রবাহে তা পরিবর্তিত হয়ে বহু ভাষার জন্ম দিয়েছে। এ জন্য আমরা বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ভাষার ব্যবহার দেখতে পাই। যেমন: বাংলাদেশে 'বাংলা ভাষা', ইংল্যান্ডে 'ইংরেজি ভাষা', জাপানে 'জাপানি ভাষা', রাশিয়ায় 'বুশ ভাষা' ইত্যাদি। বর্তমানে পৃথিবীতে সাড়ে তিন হাজারের ওপর ভাষা প্রচলিত আছে। 

১.২ বাংলা ভাষার উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ 

বাংলা ভাষা হাজার বছরের পুরনো। বাংলা ভাষার উৎসমূলে যে ভাষার সন্ধান পাওয়া যায়, তার নাম ইন্দো-ইউরোপীয় মূল ভাষা। আজ থেকে প্রায় পাঁচ হাজার বছর পূর্বে ইউরোপের মধ্যভাগ হতে দক্ষিণ-পূর্বাংশ ভূভাগে ইন্দো-ইউরোপীয় মূল ভাষা প্রচলিত ছিল। এ ইন্দো-ইউরোপীয় মূল ভাষাই হলো বাংলা ভাষার আদি উৎস। তবে এ আদি উৎস থেকে বিবর্তনের পরবর্তী ধাপেই বাংলা ভাষার জন্ম হয়নি। ভাষার স্বাভাবিক পরিবর্তন ও বিবর্তনের ধারায় অনেক কাল ধরে অনেকগুলো স্তর পেরিয়ে সপ্তম শতকে বাংলা ভাষার উদ্ভব ঘটেছে। তবে বাংলা ভাষার উদ্ভবকাল নির্ণয়ে পণ্ডিতগণের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে, বাংলা ভাষার উদ্ভবকাল ৬৫০ খ্রিষ্টাব্দ। আর ডক্টর সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ৯৫০ খ্রিষ্টাব্দকে বাংলা ভাষার উদ্ভবকাল বলে মনে করেন। 

১.৩ সাধু ও চলিত রীতি: সর্বনাম ও ক্রিয়াপদের পার্থক্য 

বাংলাদেশের মানুষ তাদের মনের ভাব প্রকাশের জন্য যে ভাষা ব্যবহার করে, তার নাম বাংলা ভাষা। বাংলাদেশের বাইরে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ এবং ঝাড়খণ্ড, বিহার, উড়িষ্যা, ত্রিপুরা, আসামের করিমগঞ্জ ও কাছাড়ের অধিবাসীদের একটি অংশের মাতৃভাষা বাংলা। বস্তুত, দেশ-জাতি-ধর্মনির্বিশেষে বাঙালি জনসমাজে ব্যবহৃত শব্দ নিয়ে বাংলা ভাষা গঠিত। বাংলা ভাষা প্রায় দেড় হাজার বছরের পুরনো। দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহারের ফলে বাংলা ভাষায় বিভিন্ন রূপের সৃষ্টি হয়েছে। উল্লেখ্য, পৃথিবীর সব ভাষাতেই দুটো রূপ দেখা যায়। একটি লেখার ভাষা, অন্যটি মুখের ভাষা। ভাষারীতির দিক থেকে বাংলা ভাষার দুটি রূপ বা রীতি লক্ষ করা যায়। একটি সাধু ভাষা এবং অপরটি চলিত ভাষা। 

সাধু ভাষা 

সাধু ভাষা বাংলা ভাষার একটি প্রাচীন লিখিত রূপ। বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন ও মধ্যযুগে পদ্যই ছিল ভাব প্রকাশের প্রধান বাহন। মধ্যযুগে কতিপয় ক্ষেত্রে চিঠিপত্র, দলিল-দস্তাবেজে গদ্যের ব্যবহার দেখা গেলেও তা ছিল খুবই সীমিত। ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে বাংলা গদ্যে গ্রন্থ প্রণয়নের প্রয়োজন দেখা দেয়। ১৮০০ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত ফোর্ট উইলিয়াম কলেজকে কেন্দ্র করে গদ্যচর্চা শুরু হয়। সেদিনকার গদ্য লেখকগণ গদ্যগ্রন্থ রচনা করতে গিয়ে মূলত নির্ভর করলেন সাধুজনের মধ্যে ব্যবহৃত সংস্কৃত ভাষার ওপর। এভাবে উনিশ শতকে বাংলা গদ্যের যে লিখিত রূপ গড়ে ওঠে, তার নাম দেওয়া হয় সাধু ভাষা। সাধু ভাষা সম্পর্কে ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘সাধু ভাষা সমগ্র বঙ্গদেশের সম্পত্তি। এর চর্চা সর্বত্র প্রচলিত থাকাতে বাঙালির পক্ষে ইহাতে লেখা সহজ হইয়াছে।’ 

বস্তুত বাংলা গদ্যের প্রাথমিক পর্যায়ে মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার, রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, অক্ষয়কুমার দত্ত প্রমুখ পণ্ডিত সংস্কৃত ভাষার অনুসরণে তৎসম শব্দবহুল যে সাহিত্যিক গদ্যরীতি গড়ে তোলেন, তা-ই সাধু ভাষা হিসেবে স্বীকৃত। 

চলিত ভাষা 

কোনো একটি প্রধান ভাষার আওতাভুক্ত সমগ্র ভূখণ্ডের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন কথ্যরূপ বা মৌখিক ভাষা ব্যবহৃত হয়। মুখের ভাষাকে লিখিত ভাষায় ব্যবহার করার উদ্দেশ্যে চলিত ভাষার প্রচলন হয়। তবে সবার মুখের ভাষাই চলিত ভাষা নয়, কারণ মুখের ভাষা অঞ্চলভেদে পরিবর্তন হয়। তাই নির্দিষ্ট অঞ্চলে একটি নির্দিষ্ট এলাকার শিক্ষিত ও শিষ্টজনের মৌখিক ভাষাকে মান চলিত ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। উল্লেখ্য, ভাগীরথী নদীর তীরবর্তী এলাকা এবং কলকাতার ভদ্র ও শিক্ষিত সমাজে ব্যবহৃত মৌখিক ভাষাটিকে অল্প-বিস্তর পরিমার্জিত করে একটি সর্বজনবোধ্য আদর্শ কথ্য ভাষা গড়ে তোলা হয়। এটাই হলো বাংলার আদর্শ চলিত ভাষা। বাংলা ভাষাভাষী শিক্ষিত জনগণ এ আদর্শ ভাষাতেই পারস্পরিক ভাবের আদান-প্রদান করে থাকে। চলিত ভাষা বর্তমানে একাধারে লেখার ভাষা ও মুখের ভাষা। 

মূলত যে ভাষারীতিতে ক্রিয়াপদ ও সর্বনাম পদ সংক্ষিপ্ত আকারে ব্যবহৃত হয়, তাকে চলিত ভাষা বলে। যেমন : তারা খেলছে। ওরা ঘুমিয়ে রয়েছে। 

প্রধানত ক্রিয়াপদ ও সর্বনাম পদের পার্থক্য বিবেচনা করেই সাধু ভাষা ও চলিত ভাষা নিরূপণ করা হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়: ‘তাহারা পড়িতেছে’- বাক্যটিতে দুটি পদ আছে। ‘তাহারা’ সর্বনাম পদ এবং ‘পড়িতেছে’ ক্রিয়াপদ। সাধু ভাষার উল্লিখিত পদ দুটোতে সর্বনাম পদ ও ক্রিয়াপদ পূর্ণরূপে ব্যবহৃত হয়েছে। এবার বাক্যটিকে চলিত ভাষায় রূপান্তর করলে তার রূপ দাঁড়াবে ‘তারা পড়ছে’। এ ক্ষেত্রে বাক্যটিতে ‘তারা’ সর্বনাম পদ এবং ‘পড়ছে’ ক্রিয়াপদ সংক্ষিপ্ত আকারে ব্যবহৃত হয়েছে। 

সাধু ভাষার ক্রিয়াপদ: করিতেছি, খাইয়াছি, বলিতেছি, যাইতেছি, পড়িতেছি, দেখিতেছি ইত্যাদি। 

চলিত ভাষার ক্রিয়াপদ: করছি, খেয়েছি, বলছি, যাচ্ছি, পড়ছি, দেখছি ইত্যাদি। 

সাধু ভাষার সর্বনাম পদ: তাহার, তাহারা, তাহাদের, উহাদের ইত্যাদি। 

চলিত ভাষার সর্বনাম পদ: তার, তারা, তাদের, ওদের ইত্যাদি। 

সাধু ভাষা ও চলিত ভাষায় ক্রিয়াপদের কতিপয় রূপ: 

সাধু ভাষা চলিত ভাষা
করিব করব
পড়িব পড়ব
লিখিব লিখব
করিতেছিলাম করছিলাম
পড়িতেছিলাম পড়ছিলাম
লিখিয়াছি লিখেছি
করিয়াছি করেছি
পড়িয়াছি পড়েছি
পড়িতে থাকিব পড়তে থাকব
করিতেছি করছি
করিলাম করলাম
খাইতেছে খাচ্ছে
হইত হতো
খাইবে খাবে
যাইবে যাবে
বলিব বলব
করিলে করলে
যাইও যেয়ো/যেও
খাইও খেয়ো/খেও
লইব নেব
করিতাম করতাম
হইয়া হয়ে

সাধু ভাষা ও চলিত ভাষায় সর্বনাম পদের কতিপয় রূপ:

সাধু ভাষা চলিত ভাষা
তাহার তার
তাহাদের তাদের
তাহাতে তাতে
তাহারা তারা
তাহাকে তাকে
ইহারা এরা
ইহাদের এদের
উহারা ওরা
উহাদের ওদের
উহা
এই
ইহা এটি
ইহাকে একে
কাহার কার
যাহা যা

Next Post Previous Post