১. ভাষা ও বাংলা ভাষা

১.১ ভাষা

প্রাণিজগতে একমাত্র মানুষের ভাষা আছে। শরীর ও স্নায়ুবিজ্ঞানীরা পরীক্ষা করে দেখেছেন যে, ভাষা ব্যবহারের জন্য মানুষের স্নায়ুতন্ত্র, মস্তিষ্ক ও অন্যান্য প্রত্যঙ্গ যেভাবে তৈরি হয়েছে, অন্যান্য প্রাণীর ক্ষেত্রে তা দেখা যায় না। ভাষার সাহায্যে আমরা কথা বলি। ভাষার মাধ্যমে আমরা প্রকাশ করি আমাদের অভিজ্ঞতা, নানা ধরনের আবেগ, বিভিন্ন প্রকার অনুভূতি, যেমন- হিংসা, বিদ্বেষ, ভালোলাগা ও ভালোবাসা, ঘৃণা, ক্ষোভ ইত্যাদি। ভাষার আরও কাজ রয়েছে। ভাষা আমাদের শিক্ষার মাধ্যম, ভাষার সাহায্যে আমরা অন্যের সঙ্গে তর্কবিতর্ক করি। ভাষাকে দেশগঠনের হাতিয়ার হিসেবেও গ্রহণ করা হয়। দেশগঠন বলতে দেশের ও মানুষের উন্নয়ন ও অগ্রগতিকে বোঝায়। এই অগ্রগতি বা কল্যাণসাধন কীভাবে করা যাবে, কীভাবে দেশের মানুষের মঙ্গল করা সম্ভব- সেসব কথা ভাষার মাধ্যমে মানুষের কাছে তুলে ধরতে হয়। ভাষা দুই প্রকার- (ক) মৌখিক ভাষা (Oral Language) ও (খ) লিখিত ভাষা (Written Language)|

ক) মৌখিক ভাষা:

আদিতে লেখার ব্যবস্থা বা লিখিত ভাষার প্রচলন ছিল না। মুখের ভাষাই তখন মানুষের একমাত্র প্রকাশমাধ্যম ছিল। এখনো বিশ্বের বহু ভাষা মৌখিক পর্যায়ে রয়ে গেছে। আমাদের দেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলোর প্রত্যেকেরই ভাষা আছে। কিন্তু তাদের সব ভাষার লিখন-ব্যবস্থা নেই; মুখে-মুখে সেগুলো প্রচলিত আছে। যেসব ভাষা লেখার কোনো ব্যবস্থা নেই সেগুলোই হলো মৌখিক ভাষা।

খ) লিখিত ভাষা:

মুখের ভাষার সীমাবদ্ধতা আছে। যে-ব্যক্তি তা ব্যবহার করে তার জীবন শেষ হলে এ ভাষার সঙ্গে আর পরিচিত হওয়া যায় না। তার জ্ঞান, অভিজ্ঞতা বা উপলব্ধির সঙ্গে অন্য মানুষের পরিচিত হওয়ার কোনো সুযোগ থাকে না। কোনোকিছুর কাছে হার স্বীকার করা মানুষের ধর্ম নয়। মানুষ চেষ্টা করেছে তার ভাষাকে ধরে রাখতে, যাতে ব্যক্তির মৃত্যুর পরও ভাষা বেঁচে থাকে। এভাবেই একদিন আবিষ্কৃত হয়েছে লিখন-ব্যবস্থা (Writing-System)। বিশ্বের ভাষাগুলো লেখার নানা ব্যবস্থা রয়েছে। আপাত মনে হয়, ভাষাসমূহের লিখনব্যবস্থা বহু এবং একটির সঙ্গে আর-একটির কোনো মিল নেই। কিন্তু সে-ধারণা বাস্তব নয়।

ভাষার লিখন-ব্যবস্থা:

ভাষার লিখন-ব্যবস্থা প্রধানত তিন প্রকার:

বর্ণভিত্তিক (Alphabetic):

বিশ্বের অনেক ভাষারই বর্ণ আছে; যেমন- বাংলা, ইংরেজি, রুশ, হিন্দি, তামিল প্রভৃতি। এসব ভাষার লিখনব্যবস্থা হলো বর্ণভিত্তিক।

অক্ষরভিত্তিক (Syllabic):

অক্ষর (Syllable) বলতে বোঝায় কথার টুকরো অংশ। কথা বলার সময় আমরা এ-অংশই উচ্চারণ করি। একে উচ্চারণের একক (unit) ধরা হয়। একে দল-ও বলে। অক্ষর অনুযায়ী যেসব ভাষা লেখার ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে তাকে বলে অক্ষরভিত্তিক লিখনরীতি। যেমন-জাপানি ভাষা। 

ভাবাত্মক (Idiographic):

বিশ্বে এমন কিছু ভাষা আছে যেগুলো লেখার জন্য বর্ণ কিংবা অক্ষর-কোনোটিই ব্যবহার করা হয় না। অনেকটা ছবি এঁকে এসব ভাষা লেখা হয়। এই লিখন-ব্যবস্থাই হলো ভাবাত্মক। চীনা, কোরীয় ভাষা এ-পদ্ধতিতে লেখা হয়।

১.২ ভাষার উপাদান

ভাষার প্রধান উপাদানগুলো হলো- ধ্বনি, শব্দ, বাক্য ও বাগর্থ। নিচে এগুলো আলোচনা করা হলো।

ক) ধ্বনি:

বাতাসে আঘাতের ফলে ধ্বনির সৃষ্টি হয়। কিন্তু সব ধ্বনিই ভাষার ধ্বনি নয়। ভাষায় তাকেই ধ্বনি হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে যা বাগযন্ত্রর সাহায্যে তৈরি হয়। বাগযন্ত্রের ক্ষমতা অসীম। এর সাহায্যে আমরা পশু-পাখির নানারকম ডাক ডাকতে বা অনুকরণ করতে পারি। কিন্তু এসব ভাষার ধ্বনি নয়। ভাষার ধ্বনি শুধু বাগযন্ত্রের সাহায্যে উৎপাদিত হলে চলবে না, তাকে অবশ্যই অর্থপূর্ণ হতে হবে। পশু-পাখির ডাক কিংবা এ জাতীয় কোনো ডাককে আমরা বলি আওয়াজ। ভাষার একটি ধ্বনির স্থলে আরেকটি ধ্বনি বদলে দিলে নতুন অর্থবোধক শব্দ তৈরি হয়। যেমন- ‘কাল’। এখানে ক্ ধ্বনিটি বদলিয়ে খ বললেই সম্পূর্ণ ভিন্ন অর্থ বহন করে এমন শব্দ তৈরি হয়। যেমন-খাল, গাল, তাল, ঢাল, মাল, শাল ইত্যাদি। এভাবে আমরা ঋ গ্‌ ম্ শ্ ধ্বনি পাই। ধ্বনির উপলব্ধি ভাষাভাষীদের মনেই রয়েছে এবং সাক্ষর ও নিরক্ষর সব মানুষই তা জানে, বোঝে ও ব্যবহার করে।

খ) শব্দ:

এক বা একাধিক ধ্বনি মিলে শব্দের সৃষ্টি হয়। যেমন-মানুষ। এখানে পাঁচটি ধ্বনি আছে: ম্+ আ+ন্‌+উ+(ষ)। লক্ষ করো, এ-উদাহরণে শেষ ধ্বনিটি বোঝাতে তালব্য-শ লিখে প্রথম বন্ধনীতে মূর্ধন্য-ষ লেখা হয়েছে। মনে রাখতে হবে, মূর্ধন্য-ষ ধ্বনি নয়, বর্ণ।

গ) বাক্য:

বাক্য বলতে কথা বা বাচনকে বোঝায়। ভাষার উপাদান হিসেবে ধরলে বাক্যের স্থান তৃতীয়। ধ্বনি দিয়ে যা শুরু হয়েছিল শব্দে এসে তা আরও সংহত হয়। বাক্যে এসে পরিপূর্ণ না হলেও সে অনেকটাই পূর্ণতা পায়। প্রতিটি বাক্যই কেউ উৎপাদন করে আর কেউ শোনে। বাক্যের সঙ্গে তাই দুজনের সম্পর্ক রয়েছে- বক্তা ও শ্রোতা। এই দুই পক্ষের মধ্যে কোনো ঘাটতি থাকলে চলে না। বক্তা যা বলে তাতে শ্রোতার সব কৌতূহল মিটতে হয়। এজন্য বলা হয়: যা উক্তি হিসেবে সম্পূর্ণ এবং যাতে শ্রোতা পরিপূর্ণভাবে তৃপ্ত হয় তা-ই হলো বাক্য। যেমন- আমরা গ্রামে বাস করি। মহৎ গুণই মানুষকে বড় করে।

চিত্র: ১.১ : বক্তা ও শ্রোতা
চিত্র: ১.১ : বক্তা ও শ্রোতা 

ঘ) বাগর্থ:

অভিধানে শব্দের অর্থ থাকে। কিন্তু সেই শব্দ যখন বিশেষ পরিবেশে ব্যবহার করা হয় তখন তার অর্থ বদলে যায়। একই কথা বলা চলে বাক্য প্রসঙ্গে। আমরা শব্দের সাহায্যে যে-বাক্য তৈরি করি, তার অর্থ বাক্যে গিয়ে পরিবর্তিত হতে পারে। যেমন- ‘পোড়া’ একটি শব্দ। এর অর্থ ‘দগ্ধ হওয়া’ (আগুনে তার খড়ের ঘর পুড়ে গেছে)। শব্দটি দিয়ে যখন বাক্য তৈরি করে বলা হয় 'আমার মন পুড়ছে'- তখন এ-‘পোড়া’ দগ্ধ হওয়া নয়। ভাষার শব্দ ও বাক্যের এসব অর্থের আলোচনাই হলো বাগর্থ।

১. ৩ প্রকাশমাধ্যম ও ভাষা

ভাষা মানুষের ভাব প্রকাশের একমাত্র মাধ্যম নয়। এজন্য আরও কিছু মাধ্যম রয়েছে। ভাষা আবিষ্কারের পূর্বে নানারকম অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে, কখনো আবার ছবি এঁকে মানুষ নিজেকে প্রকাশ করেছে। এজন্য নানা ধরনের চিহ্ন এবং সংকেতও ব্যবহার করা হয়েছে। আমরা মুখ বা চেহারার নানা ভঙ্গি করে হাসি, কান্না, বিস্ময়, জিজ্ঞাসা ইত্যাদি বোঝাতে পারি। মাথা নেড়ে হাঁ বা না বোঝাতে পারি। এজাতীয় ভাষাকে বলে অঙ্গভঙ্গির ভাষা। রাস্তায় দেখা যায়, ট্রাফিক পুলিশ হাতের ইশারায় গাড়ি থামায়, আবার চলার নির্দেশ দেয়। রাস্তার দুপাশে অনেক নির্দেশ থাকে- কোন দিকে গাড়ি চলবে, কোন দিকে গাড়ি চলবে না, রাস্তা সোজা না বাঁকা, পথচারী কীভাবে রাস্তা পার হবে ইত্যাদি। যারা কথা বলতে ও শুনতে পায় না তাদের আমরা বলি মূক ও বধির। তাদের ব্যবহারের জন্য এক ধরনের ভাষা আছে। হাতের আঙুল ব্যবহার করে, কখনো আঙুল মুখে ছুঁয়ে, কখনো আবার হাত মাথায় উঠিয়ে, কখনো বুকে হাত দিয়ে তারা তাদের ভাব প্রকাশ করে। ভাষার মধ্যে এই যোগাযোগও পড়ে। একে বলে সংকেত ভাষা। ইশারা ভাষা হিসেবেও তা পরিচিত।

চিত্র: ১.২: সংকেত ভাষা
চিত্র: ১.২: সংকেত ভাষা

১.৪ মাতৃভাষা ও বাংলা ভাষা

মাতৃভাষা অর্থ মায়ের ভাষা। অন্যভাবে বলা যায়, আমরা মায়ের কাছ থেকে যে-ভাষা শিখি তা-ই হলো আমাদের মাতৃভাষা। শিশু সব সময়ই যে মায়ের কাছ থেকে ভাষা শেখে তা নয়। কখনো কখনো এর ব্যতিক্রম ঘটে। মায়ের মতো যে শিশুকে প্রতিপালন করে কিংবা জন্মের পর থেকে যার সেবায় ও যত্নে শিশু ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠে তার ভাষাই শিশু প্রথম শেখে। বাঙালি মায়ের সন্তান জন্মের পর থেকে স্প্যানিশ বা জার্মানভাষী মায়ের পরিচর্যায় বড় হলে তার প্রথম বা মাতৃভাষা কখনো বাংলা হবে না, হবে স্প্যানিশ বা জার্মান। তাই বলা হয়, শিশু প্রথম যে-ভাষা শেখে তা-ই তার প্রথম ভাষা বা মাতৃভাষা। সাধারণত দেখা যায় যে, বাঙালি মায়ের শিশুর মাতৃভাষা বাংলা, ইংরেজ মায়ের শিশুর ইংরেজি, আরবি মায়ের শিশুর আরবি, জাপানি মায়ের শিশুর জাপানি।

১.৫ ভাষার রূপবৈচিত্র্য

ভাষার কোনো অখণ্ড বা একক রূপ নেই। একই ভাষা নানা রূপে ব্যবহৃত হয়। ভাষার এসব রূপবৈচিত্র, নিচে আলোচনা করা হলো।

উপভাষা

একই ভাষা যারা ব্যবহার করে তাদেরকে বলে একই ভাষাভাষী বা ভাষিক সম্প্রদায়। আমরা যারা বাংলা ভাষায় কথা বলি তারা সকলে বাংলাভাষী সম্প্রদায়ের অন্তর্গত। সকলের বাংলা আবার এক নয়। ভৌগোলিক ব্যবধান, যোগাযোগ ব্যবস্থা, সমাজগঠন, ধর্ম, পেশা ইত্যাদি কারণে এক এলাকার ভাষা থেকে অন্য এলাকার ভাষায় পার্থক্যের সৃষ্টি হয়। ভৌগোলিক ব্যবধান বা অঞ্চল ভেদে ভাষার যে-বৈচিত্র্য তা-ই হলো উপভাষা। এ-ভাষাকে আঞ্চলিক ভাষা-ও বলা হ। আমাদের প্রতিটি জেলার ভাষাই বৈচিত্র্যপূর্ণ। আমাদের প্রত্যেক জেলার নিজস্ব উপভাষা রয়েছে। উপভাষায় কথা বলা মোটেও দোষের নয়। উপভাষা হলো মায়ের মতো। মাকে আমরা শ্রদ্ধা করি, নিজ-নিজ উপভাষাকে আমাদের শ্রদ্ধা ও সম্মান করতে হবে। নিচে বাংলাদেশের কয়েকটি উপভাষার পরিচয় দেওয়া হলো।

উপভাষিক এলাকা      উপভাষার নমুনা

খুলনা-যশোর : অ্যাকজন মানুশির দুটো ছাওয়াল ছিল।
বগুড়: অ্যাকজনের দুই ব্যাটা ছৈল আছিল্।
রংপুর: অ্যাকজন ম্যানশের দুইকনা ব্যাটা আছিলো।
ঢাকা: অ্যাকজন মানশের দুইডা পোলা আছিলো।
ময়মনসিংহ: অ্যাকজনের দুই পুৎ আছিল্।
সিলেট: অ্যাক মানুশর দুই পোয়া আছিল্।
চট্টগ্রাম: এগুয়া মানশের দুয়া পোয়া আছিল্।
নোয়াখালী: অ্যাকজনের দুই হুত আছিল্।

প্রমিত ভাষা

একই ভাষার উপভাষাগুলো অনেক সময় বোধগম্য হয় না। এজন্য একটি উপভাষাকে আদর্শ ধরে সবার বোধগম্য ভাষা হিসেবে তৈরি ভাষারূপই হলো প্রমিত ভাষা। এ-ভাষার মাধ্যমে শিক্ষা, প্রশাসনিক কাজ, ব্যবসা-বাণিজ্য সম্পাদিত হয়। দেশের সংবাদপত্র ও ইলেকট্রনিক মাধ্যমে এ-ভাষারূপ ব্যবহার করা হয়। উপভাষা ও প্রমিত ভাষার পার্থক্য সুস্পষ্ট:

প্রমিত ভাষার লিখিত ব্যাকরণ থাকে; উপভাষার থাকে না।

উপভাষা শিশুকাল থেকে প্রাকৃতিক নিয়মে অর্জন করতে হয়; প্রমিত ভাষা চর্চা করে শিখতে হয়।

প্রমিত ভাষা শেখার বিষয়; উপভাষা অর্জনের বিষয়।

কথ্যভাষা

শিক্ষক যখন শ্রেণিকক্ষে পাঠদান করেন, কিংবা কোনো বিশেষ অনুষ্ঠানে আমরা বক্তব্য উপস্থাপন করি তখন ভাষা ব্যবহারে সচেতনতা দেখা যায়। তাই বিশেষ পরিবেশ ও প্রয়োজনের বাইরে যখন ভাষা ব্যবহার করা হয় তাকে কথ্যভাষা বলে। অনানুষ্ঠানিক পরিবেশে বন্ধু কিংবা সহকর্মী বা পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে আলাপচারিতায় এ-ভাষারূপ ব্যবহার করা হয়।

সাধু ও চলিতভাষা

মানুষ যে ভাষায় কথা বলে সেই ভাষারূপ লিখিত ভাষায় গ্রহণ করা হয় না। মুখের ভাষা স্বাভাবিক ও স্বতঃস্ফূর্ত হলেও লিখিত ভাষা সে-তুলনায় আড়ষ্ট ও কৃত্রিম। বাংলা লিখিত ভাষা যখন উদ্ভাবিত হয়, তখন উদ্ভাবকরা সেভাবেই বাংলা গদ্যের ভাষাকে তৈরি করেছিলেন। এ-ভাষাই সাধুভাষা বা সাধুরীতি হিসেবে পরিচিত। উল্লেখ করা যায় যে, সাধুভাষার সৃষ্টিতে যাঁরা নিয়োজিত ছিলেন, তাঁরা বাংলা ভাষী হলেও লোকজ মানুষের ভাষারীতিতে শ্রদ্ধাশীল ছিলেন না। তাঁরা সংস্কৃত ভাষার পণ্ডিত ছিলেন। ফলে সেই ভাষার আদলে তাঁরা ভাষার এই রীতি তৈরি করেন। সব পণ্ডিতই যে এ-আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন তা নয়। কিন্তু তাঁদের সে-প্রচেষ্টা পরবর্তীকালে গ্রহণীয় হয় নি। সাধুভাষার পরিচয় গ্রহণ করলে দেখা যায় যে, এ-ভাষায় বেশি পরিমাণে সংস্কৃত শব্দই শুধু নেই, সংস্কৃত ব্যাকরণের বিভিন্ন বিষয় গৃহীত হয়েছে। প্রথম দিকের সাধুভাষা ছিল আড়ষ্ট। এ-ভাষা প্রাঞ্জল হয়ে উঠতে অনেক দিন লেগেছে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরই প্রথম এ কাজ করেন। এজন্য তাঁকে বাংলা সাধুভাষার জনক বলা হয়। নিচে সাধুভাষার উদাহরণ দেওয়া হলো:

নদীতে স্নান করিবার সময় রাজদত্ত অঙ্গুরীয় শকুন্তলার অঞ্চলকোণ হইতে সলিলে পতিত হইয়াছিল। পতিত হইবামাত্র এক অতিবৃহৎ রোহিত মৎস্যে গ্রাস করে। সেই মৎস্য, কতিপয় দিবস পর, এক ধীবরের জালে পতিত হইল। ধীবর, খণ্ড খণ্ড বিক্রয় করিবার মানসে, ঐ মৎস্যকে বহু অংশে বিভক্ত করিতে করিতে তদীয় উদরমধ্যে অঙ্গুরীয় দেখিতে পাইল। ঐ অঙ্গুরীয় লইয়া, পরম উল্লসিত মনে, সে এক মণিকারের আপণে বিক্রয় করিতে গেল। (ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর: শকুন্তলা)

সাধুভাষার তুলনায় চলিতভাষা বা চলিতরীতি নবীন। সব ধরনের কৃত্রিমতা থেকে লিখিত বাংলা ভাষাকে মুক্ত করাই চলিতভাষা সৃষ্টির প্রেরণা। এ-ভাষা জীবনঘনিষ্ঠ, আমাদের প্রতিদিনের মুখের ভাষার কাছাকাছি। কোনো কষ্টকল্পনা এতে স্থান পায় না। এ-ভাষারীতির শব্দসমূহ স্বভাবতই আমাদের পরিচিত। বাংলা প্রবাদ-প্রবচন খুব সহজে এ-ভাষায় ব্যবহার করা যায়। নিচে বাংলা চলিতরীতির উদাহরণ তুলে ধরা হলো:

সাহিত্যের সহজ অর্থ যা বুঝি সে হচ্ছে নৈকট্য, অর্থাৎ সম্মিলন। মানুষ মিলিত হয় নানা প্রয়োজনে, আবার মানুষ মিলিত হয় কেবল মেলারই জন্যে, অর্থাৎ সাহিত্যেরই উদ্দেশে। শাকসবজির খেতের সঙ্গে মানুষের যোগ ফসল-ফলানোর যোগ। ফুলের বাগানের সঙ্গে যোগ সম্পূর্ণ পৃথক জাতের। সবজি খেতের শেষ উদ্দেশ্য খেতের বাইরে, সে হচ্ছে ভোজ্যসংগ্রহ। ফুলের বাগানের যে-উদ্দেশ্য তাকে এক হিসাবে সাহিত্য বলা যেতে পারে। অর্থাৎ, মন তার সঙ্গে মিলতে চায়- সেখানে গিয়ে বসি, সেখানে বেড়াই, সেখানকার সঙ্গে যোগে মন খুশি হয়। (রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যের তাৎপর্য)

বহুনির্বাচনি প্রশ্ন

ঠিক উত্তরের পাশে টিকচিহ্ন (√) দাও:

১। প্রাণিজগতে একমাত্র কাদের ভাষা আছে?
ক. পাখির
খ. পশুর
গ. মানুষের
ঘ. সবার

২। ভাষা ব্যবহারের জন্য অন্যান্য প্রাণীর তুলনায় মানুষ ব্যতিক্রম যে দিক থেকে তা হলো-
i. স্নায়ুতন্ত্র
ii. মস্তিষ্ক
iii. মানুষের অন্যান্য প্রত্যঙ্গ

নিচের কোনটি ঠিক?
ক. i
খ. ii
গ. i ও ii
ঘ. i, ii ও iii

৩। ভাষার মাধ্যমে আমরা যে ধরনের অনুভূতি প্রকাশ করি তা হলো-
i. হিংসা-বিদ্বেষ
ii. ভালোলাগা-ভালোবাসা
iii. ঘৃণা, ক্ষোভ

নিচের কোনটি ঠিক?
ক. i
খ. ii
গ. i ও ii
ঘ. i, ii ও iii

Next Post Previous Post