ভাব ও কাজ : কাজী নজরুল ইসলাম
![]() |
ভাব ও কাজ |
মূলপাঠ:
ভাবে আর কাজে সম্বন্ধটা খুব নিকট বোধ হইলেও আদতে (প্রকৃতপক্ষে; আদৌ) এ-জিনিস দুইটায় কিন্তু আসমান (আকাশ)-জমিন (মাটি, ভূপৃষ্ঠ) তফাৎ (পার্থক্য)। ভাব জিনিসটা হইতেছে পুষ্পবিহীন (ফুলবিহীন) সৌরভের (সুন্দর গন্ধ, সুগন্ধ, সুবাস) মতো, একটা অবাস্তব উচ্ছ্বাস (প্রবল ভাবাবেগ। উল্লাস।) মাত্র। তাই বলিয়া কাজ মানে যে সৌরভবিহীন পুষ্প (ফুল), ইহা যেন কেহ মনে করিয়া না বসেন। কাজ জিনিসটাই ভাবকে রূপ দেয়, ইহা সম্পূর্ণভাবে বস্তুজগতের।
তাই বলিয়া ভাবকে যে আমরা মন্দ বলিতেছি বা নিন্দা করিতেছি, তাহা নহে; ভাব জিনিসটা খুবই ভালো। মানুষকে কব্জায় (আয়ত্তে, অধিকারে) আনিবার জন্য তাহার সর্বাপেক্ষা() কোমল জায়গায় ছোঁওয়া দিয়া তাহাকে মাতাইয়া না তুলিতে পারিলে তাহার দ্বারা কোনো কাজ করানো যায় না, বিশেষ করিয়া আমাদের এই ভাব-পাগলা দেশে। কিন্তু শুধু ভাব লইয়াই থাকিব, লোককে শুধু কথায় মাতাইয়া মশগুল (মগ্ন, বিভোর) করিয়াই রাখিব, এও একটা মস্ত (বড়ো, বিশাল) বদ-খেয়াল (খারাপ চিন্তা, খারাপ আচরণ)। এই ভাবকে কার্যের দাসরূপে নিয়োগ করিতে না পারিলে ভাবের কোনো সার্থকতাই থাকে না। তাহা ছাড়া ভাব দিয়া লোককে মাতাইয়া তুলিয়া যদি সেই সময় গরমাগরম কার্যসিদ্ধি (কর্মে সাফল্য প্রাপ্তি, অভীষ্টলাভ।) করাইয়া লওয়া না হয়, তাহা হইলে পরে সে ভাবাবেশ কপূরের (বৃক্ষরস থেকে তৈরি গন্ধদ্রব্য বিশেষ, যা বাতাসের সংস্পর্শে অল্পক্ষণের মধ্যে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়।)মতো উড়িয়া যায়। অবশ্য, এখানে কার্যসিদ্ধি মানে স্বার্থসিদ্ধি (অন্যের ভালোমন্দ বিবেচনা না করে নিজের মঙ্গল বা হিতসাধন।) নয়। যিনি ভাবের বাঁশি বাজাইয়া জনসাধারণকে নাচাইবেন, তাঁহাকে নিঃস্বার্থ ত্যাগী ঋষি (শাস্ত্রজ্ঞ তপস্বী, মুনি, যোগী।) হইতে হইবে। তিনি লোকদিগের সূক্ষ্ম অনুভূতি বা ভাবকে জাগাইয়া তুলিবেন মানুষের কল্যাণের জন্য, নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য নয়। তাঁহাকে একটা খুব মহত্তর (দুইয়ের মধ্যে অধিকতর মহৎ।) উদ্দেশ্য ও কল্যাণ কামনা লইয়া ভাবের বন্যা বহাইতে হইবে, নতুবা বানভাসির (বন্যায় ভাসানো, বন্যায় যা বা যাদের ভাসিয়ে আনে।) পর পলিপড়ার মতো সাধারণের সমস্ত উৎসাহ ও প্রাণ একেবারে কাদাঢাকা পড়িয়া যাইবে। এই জন্য কেহ কেহ বলেন যে, লোকের কোমল অনুভূতিতে যা দেওয়া পাপ। কেননা অনেক সময় অনুপযুক্ততা প্রযুক্ত ইহা হইতে সুফল না ফলিয়া কুফলই ফলে। আগে হইতে সমস্ত কার্যের বন্দোবস্ত (ব্যবস্থা, আয়োজন।) করিয়া বা কার্যক্ষেত্র তৈয়ার রাখিয়া তবে লোকদিগকে সোনার কাঠির ছোঁওয়া দিয়া জাগাইয়া তুলিতে হইবে। নতুবা তাহারা যখন জাগিয়া দেখিবে যে, তাহারা অনর্থক (ব্যর্থ, নিষ্ফল, অকারণ।) জাগিয়াছে, কোনো কার্য করিবার নাই, তখন মহা বিরক্ত হইয়া আবার ঘুমাইয়া পড়িবে এবং তখন আর জাগাইলেও জাগিবে না। কেননা, তখন যে তাহারা জাগিয়া ঘুমাইবে এবং জাগিয়া ঘুমাইলে তাহাকে কেহই তুলিতে পারে না। তাহা অপেক্ষা বরং কুম্ভকর্ণের (রামায়ণে বর্ণিত রাবণের ছোটো ভাইয়ের নাম। সে একনাগাড়ে ছয় মাস ঘুমাত।) নিদ্রা ভালো, সে-ঘুম ঢোল কাঁসি বাজাইয়া ভাঙানো বিচিত্র নয়।
এ-কথাটা একটা মস্ত সত্যি, তাহা এতদিনে আমরা ঠেকিয়া শিখিয়াছি। এই যে সেদিন একটা হুজুগে (সাময়িক আন্দোলন, জনরব, গুজব।) মাতিয়া হুড়হুড় করিয়া হাজার কতক স্কুল-কলেজের ছাত্রদল বাহির হইয়া আসিল, কই তাহারা তো তাহাদের এই সৎ সঙ্কল্প, এই মহৎ ত্যাগকে স্থায়ীরূপে বরণ করিয়া লইতে পারিল না। কেন এমন হইল? একটা সাময়িক উত্তেজনার মুখে এই ত্যাগের অভিনয় করিতে গিয়া ‘স্পিরিট’ (ইংরেজি Spirit শব্দটির অর্থ উদ্দীপনা, উৎসাহ, শক্তি। এ প্রবন্ধে ‘আত্মার শক্তির পবিত্রতা’ অর্থে স্পিরিট শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে।) কে কী বিশ্রী ভাবেই না মুখ ভ্যাঙচানো হইল। যাহারা শুধু ভাবের চোটে না বুঝিয়া না শুনিয়া শুধু একটু নামের জন্য বা বদনামের ভয়ে এমন করিয়া তাহাদের 'স্পিরিট' বা আত্মার শক্তির পবিত্রতা নষ্ট করিল, তাহারা কি দরকার পড়িলে আবার কাল এমনি করিয়া বাহির হইয়া আসিতে পারিবে? আজ যাহারা মুখে চাদর জড়াইয়া কল্যকার (পূর্ব বা পরবর্তী দিন। এখানে পূর্বের দিন অর্থে।) ত্যক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে আবার মুখটি চুন করিয়া ঢুকিল, কাল দেশের সত্যিকার ডাক আসিলে তাহারা কি আর তাহাতে সাড়া দিতে পারিবে? হঠকারিতা করিয়া একবার যে ভোগটা ভুগিল বা ভ্রম করিল, তাহারই অনুশোচনাটা তাহারা কিছুতেই মন হইতে মুছিয়া ফেলিতে পারিবে না- বাহিরে যতই কেন লা-পরওয়া (গ্রাহ্য না করা।) ভাব দেখাক না। এখন সত্যিকার ডাক শুনিয়া প্রাণ চাহিলেও সে লজ্জায় তাহাতে আসিয়া যোগদান করিতে পারিবে না। এই রূপে আমরা আমাদের দেশের প্রাণশক্তি এই তরুণদের ‘স্পিরিট’টাকে কুব্যবহারে আনিয়া মঙ্গলের নামে দেশের মহাশত্রুতা সাধনই করিতেছি না কি? রাগিবার কথা নয়, এখন ইহা রীতিমতো বিবেচনা-সাপেক্ষ। আমাদের এই আশা-ভরসাস্থল যুবকগণ এত দুর্বল হইল কীরূপে বা এমন কাপুরুষের মতো ব্যবহারই বা করিল কেন? সে কি আমাদেরই দোষে নয়? সাপ লইয়া খেলা করিতে গেলে তাহাকে দস্তুরমতো (রীতিমতো, যথেষ্ট, নিতান্ত।) সাপুড়ে হওয়া চাই, শুধু একটু বাঁশি বাজাইতে পারিলেই চলিবে না। আজ যদি সত্যিকার কর্মী থাকিত দেশে, তাহা হইলে এমন সুবর্ণ (সোনা, স্বর্ণ।) সুযোগ মাঝ-মাঠে মারা যাইত না। ত্যাগী অনেক আছেন দেশে, কিন্তু কর্মীর অভাবে বা তথাকথিত কর্মী নামে অভিহিত লোকদের সত্য সাধনার অভাবে তাঁহারা কোনো ভালো কাজে আর কোনো অর্থ দিতে চাহেন না, বা অন্য কোনোরূপ ত্যাগ স্বীকার করিতেও রাজি নন। কী করিয়া হইবেন? তাঁহারা তাঁহাদের চোখের সামনে দেখিতেছেন যে, কতো লোকের কতো মাথার ঘাম পায়ে ফেলার ধন দেশের নামে, কল্যাণের নামে আদায় করিয়া বাজে লোকে নিজেদের উদর পূর্ণ করিতেছে। যাঁহারা সত্যিকার দেশকর্মী-সে বেচারারা সত্যি কথা স্পষ্টভাবে বলিতে গিয়া এই সব কর্মীর কারচুপিতে পুয়াল (খড়।) চাপা পড়িয়া গিয়াছে। বেচারারা এখন ভালো বলিতে গেলেও এই সব মুখোশ-পরা ত্যাগী মহাপুরুষগণ হট্টগোল বাঁধাইয়া লোককে সম্পূর্ণ উল্টা বুঝাইয়া দিয়া তাহাকে একদম খেলো, বুটা ইত্যাদি প্রমাণ করিয়া দেন। সহজ জনসাধারণের সরল মন এ-সব না ধরিতে পারার দরুন তাহাদের মন অতি অল্পেই ঐ সত্যিকার কর্মীদের বিরুদ্ধে বিষাইয়া উঠে। ‘দশচক্রে ভগবান ভূত’ (দশজনের চক্রান্তে সাধুও অসাধু প্রতিপন্ন হতে পারে, বহুলোকের ষড়যন্ত্রে অসম্ভবও সম্ভব হয়।) কথাটা মস্ত সত্যি কথা।
তাহা হইলে এখন উপায় কী? এক সহজ উপায় এই যে, এখন হইতে জনসাধারণের বা শিক্ষিত কেন্দ্রের উচিত, ভাবের আবেগে অতিমাত্রায় বিহ্বল হইয়া কাণ্ডাকাণ্ড (ন্যায়-অন্যায়, ভালোমন্দ।) ভালোমন্দ জ্ঞান হারাইয়া না ফেলা। আমরা বলিব, ভাবের সুরা পান করো ভাই, কিন্তু জ্ঞান হারাইও না। তাহা হইলে তোমার পতন, তোমার দেশের পতন, তোমার ধর্মের পতন, মনুষ্যত্বের পতন। ভাবের দাস হইও না, ভাবকে তোমার দাস করিয়া লও। কর্মে শক্তি আনিবার জন্য ভাব-সাধনা কর। ‘স্পিরিট’ বা আত্মার শক্তিকে জাগাইয়া তোল, কিন্তু তাই বলিয়া কর্মকে হারাইও না। অন্ধের মতো কিছু না বুঝিয়া না শুনিয়া ভেড়ার মতো পেছন ধরিয়া চলিও না। নিজের বুদ্ধি, নিজের কর্মশক্তিকে জাগাইয়া তোল। তোমার এই ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্যই দেশকে উন্নতির দিকে, মুক্তির দিকে আগাইয়া লইয়া যাইবে। এ-সব জিনিস ভাব-আবিষ্ট হইয়া চক্ষু বুজিয়া হয় না। কোমর বাঁধিয়া কার্যে নামিয়া পড়িতে হইবে এবং নামিবার পূর্বে ভালো করিয়া বুঝিয়া-সুঝিয়া দেখিয়া লইতে হইবে, ইহার ফল কী। শুধু উদ্মো ষাঁড়ের (বন্ধনমুক্ত ষাঁড়।) মতো দেওয়ালের সঙ্গে গা ঘেঁষড়াইয়া নিজের চামড়া তুলিয়া ফেলা হয় মাত্র। দেওয়াল প্রভু কিন্তু দিব্যি দাঁড়াইয়া থাকেন। তোমার বন্ধন ওই সামনের দেওয়ালকে ভাঙিতে হইলে একেবারে তাহার ভিত্তিমূলে শাবল মারিতে হইবে।
আবার বলিতেছি, আর ভাবের ঘরে চুরি করিও না। আগে ভালো করিয়া চোখ মেলিয়া দেখ। কার্যের সম্ভাবনা-অসম্ভাবনার কথা অগ্রে বিবেচনা করিয়া পরে কার্যে নামিলে তোমার উৎসাহ অনর্থক নষ্ট হইবে না। মনে রাখিও তোমার ‘স্পিরিট’ বা আত্মার শক্তিকে অন্যের প্ররোচনায় (উসকানি, উত্তেজনা সৃষ্টি।) নষ্ট করিতে তোমার কোনো অধিকার নাই। তাহা পাপ- মহাপাপ।
শব্দার্থ ও টীকা :
আসমান- আকাশ।
জমিন- মাটি, ভূপৃষ্ঠ।
কজায়-
আয়ত্তে, অধিকারে।
মশগুল- মগ্ন, বিভোর।
বদ-খেয়াল- খারাপ
চিন্তা, খারাপ আচরণ।
দাদ- প্রতিশোধ, প্রতিহিংসা।
কপূর-
বৃক্ষরস থেকে তৈরি গন্ধদ্রব্য বিশেষ, যা বাতাসের সংস্পর্শে অল্পক্ষণের মধ্যে
ক্ষয়প্রাপ্ত হয়।
ঋষি- শাস্ত্রজ্ঞ তপস্বী, মুনি, যোগী।
বানভাসি- বন্যায় ভাসানো, বন্যায় যা বা যাদের ভাসিয়ে আনে।
বন্দোবস্ত-
ব্যবস্থা, আয়োজন।
অনর্থক- ব্যর্থ, নিষ্ফল, অকারণ।
কুম্ভকর্ণ-
রামায়ণে বর্ণিত রাবণের ছোটো ভাইয়ের নাম। সে একনাগাড়ে ছয় মাস ঘুমাত। এখানে যে খুব
ঘুমায় বা সহজে যাকে জাগানো যায় না।
হুজুগ- সাময়িক আন্দোলন, জনরব,
গুজব।
সঙ্কল্প- প্রতিজ্ঞা, শপথ।
স্পিরিট- ইংরেজি
Spirit শব্দটির অর্থ উদ্দীপনা, উৎসাহ, শক্তি। এ প্রবন্ধে ‘আত্মার শক্তির
পবিত্রতা’ অর্থে স্পিরিট শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে।
কল্যকার- পূর্ব বা
পরবর্তী দিন। এখানে পূর্বের দিন অর্থে।
লা-পরওয়া- গ্রাহ্য না করা।
দস্তুরমতো- রীতিমতো, যথেষ্ট, নিতান্ত।
সুবর্ণ-
সোনা, স্বর্ণ।
পুয়াল- খড়।
দশচক্রে ভগবান ভূত- দশজনের
চক্রান্তে সাধুও অসাধু প্রতিপন্ন হতে পারে, বহুলোকের ষড়যন্ত্রে অসম্ভবও সম্ভব হয়।
কাণ্ডাকাণ্ড- ন্যায়-অন্যায়, ভালোমন্দ।
উদ্মো ষাঁড়-
বন্ধনমুক্ত ষাঁড়।
প্ররোচনা- উসকানি, উত্তেজনা সৃষ্টি।
পাঠের উদ্দেশ্য:
এই প্রবন্ধ পাঠ করে শিক্ষার্থীরা মহৎ কাজের জন্য অনুপ্রাণিত হবে। শুধু ভাবের উচ্ছ্বাসে উদ্বেল হওয়া নয়, ভাবের সঙ্গে পরিকল্পিত কর্মশক্তি ও বাস্তব উদ্যোগের প্রয়োজন সম্পর্কে সচেতন হবে।
পাঠ-পরিচিতি:
‘ভাব ও কাজ’ প্রবন্ধটি নেওয়া হয়েছে 'যুগবাণী' গ্রন্থ থেকে। ভাব ও কাজের মধ্যে পার্থক্য অনেক। মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য ভাবের গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু শুধু ভাব দিয়ে মহৎ কিছু অর্জন করা যায় না। তার জন্য কর্মশক্তি এবং সঠিক উদ্যোগের দরকার হয়। ভাবের দ্বারা মানুষকে জাগিয়ে তোলা যায়, কিন্তু যথাযথ পরিকল্পনা ও কাজের স্পৃহা ছাড়া যে কোনো ভালো উদ্যোগ নষ্ট হয়ে যেতে পারে। এ রচনাটিতে লেখক দেশের উন্নতি ও মুক্তি এবং মানুষের কল্যাণের জন্য ভাবের সঙ্গে বাস্তবধর্মী কর্মে তৎপর হওয়ার ওপর জোর দিয়েছেন।
লেখক-পরিচিতি:
কাজী নজরুল ইসলাম ১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৪শে মে (১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ই জ্যৈষ্ঠ) বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বিদ্যালয়ের পড়াশুনা শেষ করতে পারেননি। দশম শ্রেণির ছাত্র থাকাকালে প্রথম মহাযুদ্ধ শুরু হলে তিনি স্কুল ছেড়ে বাঙালি পল্টনে যোগদান করেন। যুদ্ধ শেষ হলে ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দে বাঙালি পল্টন ভেঙে দেওয়া হয়। নজরুল কলকাতায় ফিরে এসে সাহিত্যচর্চায় আত্মনিয়োগ করেন। এ সময় সাপ্তাহিক 'বিজলী' পত্রিকায় তাঁর 'বিদ্রোহী' কবিতাটি প্রকাশিত হলে চারদিকে সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। তাঁর কবিতায় পরাধীনতা ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ উচ্চারিত হয়েছে। অবিচার ও শোষণের বিরুদ্ধে তিনি প্রবল প্রতিবাদ করেন। এজন্য তাঁকে বিদ্রোহী কবি বলা হয়। তাঁর রচনাবলি অসাম্প্রদায়িক চেতনার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
কবিতা, সংগীত, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ ও গল্প- সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় নজরুল প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। তিনি সাম্যবাদী চেতনাভিত্তিক কবিতা, শ্যামাসংগীত, ইসলামি গান ও গজল লিখেছেন। কবিতা ও গানে বহুল পরিমাণে আরবি-ফারসি শব্দ ব্যবহার করেছেন। মাত্র তেতাল্লিশ বছর বয়সে তিনি কঠিন রোগে আক্রান্ত হন এবং তাঁর সাহিত্যসাধনায় ছেদ ঘটে। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগে কবিকে বাংলাদেশে আনা হয়।
১৯৭৪ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডি.লিট উপাধি লাভ করেন। ১৯৭৬ সালে তিনি
বাংলাদেশের নাগরিকত্ব ও একুশে পদক পান। তিনি আমাদের জাতীয় কবি। তাঁর বিখ্যাত
গ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে, কাব্যগ্রন্থ: ‘অগ্নি-বীণা’, ‘বিষের বাঁশী’,
‘সাম্যবাদী’, ‘সর্বহারা’, ‘সিন্ধু-হিন্দোল’, ‘চক্রবাক’; উপন্যাস: ‘মৃত্যুক্ষুধা’,
‘কুহেলিকা’; গল্পগ্রন্থ ‘ব্যথার দান’, ‘রিক্তের বেদন’, ‘শিউলিমালা’;
প্রবন্ধগ্রন্থ ‘যুগবাণী’, ‘রুদ্র-মঙ্গল’; নাটক: ‘ঝিলিমিলি’, ‘আলেয়া’, ‘মধুমালা’
ইত্যাদি।
কাজী নজরুল ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দের ২৯শে আগস্ট ঢাকায় মৃত্যুবরণ
করেন।
কর্ম-অনুশীলন
ক. ‘আত্মার শক্তি’ বিষয়ে একটি গল্প রচনা কর (একক কাজ)।
খ. একদল ‘ভাবে’র
পক্ষে এবং আরেক দল ‘কাজে’র পক্ষ নিয়ে বিতর্কে অংশগ্রহণ করবে (দলগত কাজ)।
অনুশীলনী:
বহুনির্বাচনি প্রশ্ন
১. ‘ভাব ও কাজ’ লেখাটি কোন ধরনের সাহিত্য?
ক. ছোটগল্প
খ. প্রবন্ধ
গ. কাহিনি কাব্য
ঘ. উপন্যাস
২. “সে ভাবাবেশ কপূরের মতো উড়িয়া যায়”- বাক্যটির 'কপূর' শব্দের অর্থ নিচের কোনটি?
ক. কপালের রেখা
খ. এক ধরনের পাখি বিশেষ
গ. বাতাসের সংস্পর্শে
বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় এমন বস্তু
ঘ. বাতাসের সংস্পর্শে অল্পক্ষণের মধ্যে ক্ষয়প্রাপ্ত হয় এমন বস্তু
৩. ‘ভাবের সুরা পান করো ভাই, কিন্তু জ্ঞান হারাইও না।’ জ্ঞান হারালে-
i.
দেশের পতন হবে
ii. নিজের পতন হবে
iii. মনুষ্যত্বের পতন হবে
নিচের কোনটি সঠিক?
ক. i ও ii
খ. i ও iii
গ. ii ও
iii
ঘ. i, ii ও iii
উদ্দীপকটি পড় এবং ৪ ও ৫ নম্বর প্রশ্নের উত্তর দাও:
জুয়েল ৮ম
শ্রেণিতে পড়ে। সে ক্লাসে সবসময় চুপচাপ থাকে। দেখলে মনে হয় কী যেন চিন্তা করছে।
ক্লাসের পড়াও ঠিকমত শেখে না। কিন্তু তার স্বপ্ন এস.এস.সি. পরীক্ষার পর একটি ভালো
কলেজে ভর্তি হবে।
৪. ‘ভাব ও কাজ’ প্রবন্ধ অনুযায়ী জুয়েলের আচরণ হচ্ছে-
ক. পুষ্পহীন সৌরভ
খ. সৌরভহীন পুষ্প
গ. বদ খেয়াল
ঘ. লা-পরওয়া
৫. ‘ভাব ও কাজ’ প্রবন্ধ অনুযায়ী জুয়েলের উচিত-
i. ভাব ও কাজের সমন্বয় করা
ii. ভাবের উচ্ছ্বাসকে নিয়ন্ত্রণ করা
iii. বাস্তবধর্মী কাজে তৎপর হওয়া
নিচের কোনটি সঠিক?
ক. i ও ii
খ. i ও iii
গ. ii ও
iii
ঘ. i, ii ও iii
সৃজনশীল প্রশ্ন- ১ |
---|
তুমি স্বপ্নে রাজা হতে পার, কোটি কোটি টাকা, বাড়ি-গাড়ির মালিক হতে পার। কল্পলোকের সুন্দর গল্পও হতে পার, কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন এক জগৎ। এখানে বড় হতে হলে পরিশ্রমের বিকল্প নেই। শিক্ষার দ্বারা নিজের সুপ্ত প্রতিভাকে জাগ্রত করে সঠিক কর্মানুশীলনের মাধ্যমে বড়ো হতে হবে। সুতরাং কল্পনার জগতে হাবু-ডুবু না খেয়ে দেশ ও জাতির কল্যাণে আত্মনিয়োগ করাই মনুষ্যত্বের পরিচায়ক। ক. যিনি ভাবের বাঁশি বাজিয়ে জনসাধারণকে নাচাবেন তাকে কেমন হতে হবে? খ. লেখক ‘স্পিরিট’ বা আত্মার শক্তিকে জাগিয়ে তুলতে বলেছেন কেন? গ. উদ্দীপকটি ‘ভাব ও কাজ’ প্রবন্ধের যে দিকটি নির্দেশ করে তা বর্ণনা করো। ঘ. ‘কল্পনার জগতে হাবু-ডুবু না খেয়ে দেশ ও জাতির কল্যাণে আত্মনিয়োগ করাই মনুষ্যত্বের পরিচায়ক’- মন্তব্যটি ‘ভাব ও কাজ’ প্রবন্ধের আলোকে মূল্যায়ন করো। |