জীবন বিনিময়: গোলাম মোস্তফা

জীবন বিনিময়: গোলাম মোস্তফা
জীবন বিনিময়: গোলাম মোস্তফা 

জীবন বিনিময়
গোলাম মোস্তফা 

বাদশা বাবর কাঁদিয়া ফিরিছে, নিদ নাহি চোখে তাঁর-
পুত্র তাঁহার হুমায়ুন বুঝি বাঁচে না এবার আর!
চারিধারে তার ঘনায়ে আসিছে মরণ-অন্ধকার। 

রাজ্যের যত বিজ্ঞ হেকিম কবিরাজ দরবেশ
এসেছে সবাই, দিতেছে বসিয়া ব্যবস্থা সবিশেষ,
সেবাযত্নের বিধিবিধানের ত্রুটি নাহি এক লেশ। 

তবু তাঁর সেই দুরন্ত রোগ হটিতেছে নাক হায়,
যত দিন যায়, দুর্ভোগ তার ততই বাড়িয়া যায়-
জীবন-প্রদীপ নিভিয়া আসিছে অস্তরবির প্রায়। 

শুধাল বাবর ব্যগ্রকণ্ঠে ভিষকবৃন্দে ডাকি,
‘বল বল আজি সত্যি করিয়া, দিও নাকো মোরে ফাঁকি,
এই রোগ হতে বাদশাজাদার মুক্তি মিলিবে নাকি?’ 

নতমস্তকে রহিল সবাই, কহিল না কোন কথা,
মুখর হইয়া উঠিল তাঁদের সে নিষ্ঠুর নীরবতা
শেলসম আসি বাবরের বুকে বিধিল কিসের ব্যথা। 

হেনকালে এক দরবেশ উঠি কহিলেন- ‘সুলতান,
সবচেয়ে তব শ্রেষ্ঠ যে-ধন দিতে যদি পার দান,
খুশি হয়ে তবে বাঁচাবে আল্লা বাদশাজাদার প্রাণ।’

শুনিয়া সে কথা কহিল বাবর শঙ্কা নাহিক মানি-
‘তাই যদি হয়, প্রস্তুত আমি দিতে সেই কোরবানি,
সবচেয়ে মোর শ্রেষ্ঠ যে ধন জানি তাহা আমি জানি।’
এতেক বলিয়া আসন পাতিয়া নিরিবিলি গৃহতল
গভীর ধেয়ানে বসিল বাবর শান্ত অচঞ্চল,
প্রার্থনারত হাতদুটি তাঁর, নয়নে অশ্রুজল। 

কহিল কাঁদিয়া- ‘হে দয়াল খোদা, হে রহিম রহমান,
মোর জীবনের সবচেয়ে প্রিয় আমারি আপন প্রাণ,
তাই নিয়ে প্রভু পুত্রের প্রাণ কর মোরে প্রতিদান।' 

স্তব্ধ-নীরব গৃহতল, মুখে নাহি কারো বাণী
গভীর রজনী, সুপ্তি-মগন নিখিল বিশ্বরাণী,
আকাশে বাতাসে ধ্বনিতেছে যেন গোপন কি কানাকানি।

সহসা বাবর ফুকারি উঠিল ‘নাহি ভয় নাহি ভয়,
প্রার্থনা মোর কবুল করেছে আল্লাহ যে দয়াময়,
পুত্র আমার বাঁচিয়া উঠিবে মরিবে না নিশ্চয়।’ 

ঘুরিতে লাগিল পুলকে বাবর পুত্রের চারিপাশ
নিরাশ হৃদয় সে যেন আশার দৃপ্ত জয়োল্লাস,
তিমির রাতের তোরণে তোরণে উষার পূর্বাভাস। 

সেইদিন হতে রোগ-লক্ষণ দেখা দিল বাবরের,
হৃষ্টচিত্তে গ্রহণ করিল শয্যা সে মরণের,
নতুন জীবনে হুমায়ুন ধীরে বাঁচিয়া উঠিল ফের। 

মরিল বাবর না, না ভুল কথা, মৃত্যু কে তারে কয়?
মরিয়া বাবর অমর হয়েছে, নাহি তার কোন ক্ষয়,
পিতৃস্নেহের কাছে হইয়াছে মরণের পরাজয়! 

উৎস নির্দেশ:
‘জীবন বিনিময়’ কবিতাটি গোলাম মোস্তফার ‘বুলবুলিস্তান’ কাব্যগ্রন্থ থেকে সংকলিত হয়েছে।

শব্দার্থ ও টীকা:
বিনিময়- বদল।
নিদ- ঘুম।
ভিষকবৃন্দ- চিকিৎসকগণ।
বাদশাজাদা- সম্রাটের পুত্র, এখানে হুমায়ুন।
শেলসম- তীক্ষ্ণ অস্ত্রের মতো।
শঙ্কা- ভয়।
অস্তরবি-অস্তগামী সূর্য।
দৃপ্ত- উদ্ধত (এখানে উদ্দীপিত অর্থে ব্যবহৃত)।
সবচেয়ে যে শ্রেষ্ঠধন- প্রত্যেক মানুষের কাছে নিজের জীবনই শ্রেষ্ঠ ধন হিসেবে বিবেচ্য।
ধেয়ানে- ধ্যানে।
সুপ্তিমগ্ন- ঘুমে অচেতন।
ফুকারি- চিৎকার করে।
কবুল- স্বীকার, গৃহীত।
তিমির রাতের তোরণে ঊষার পূর্বাভাস- ভোরের আগমন আঁধার রাতের অবসান ঘোষণা করে। এখানে হুমায়ুনের মুমূর্ষু অবস্থা তিমির রাত এবং রোগমুক্তির লক্ষণকে উষার পূর্বাভাস বলা হয়েছে।

পাঠের উদ্দেশ্য:
------------

পাঠ-পরিচিতি:
কবিতাটিতে পিতৃস্নেহের একটি মহৎ দৃষ্টান্ত উপস্থাপিত হয়েছে। পিতার স্নেহ-বাৎসল্যের কাছে মৃত্যুর পরাজয় এই কবিতার প্রতিপাদ্য বিষয়। মোগল সম্রাট বাবরের পুত্র হুমায়ুন কঠিন রোগে আক্রান্ত। বিজ্ঞ চিকিৎসকেরা অনেক চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে তাঁর জীবনের আশা ছেড়ে দিয়েছেন। এক দরবেশ এসে জানালেন যে, সম্রাট যদি তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ ধন দান করেন তবেই তাঁর পুত্র জীবন লাভ করতে পারেন। সম্রাট বাবর উপলব্ধি করলেন, নিজের প্রাণের চেয়ে আর বেশি প্রিয় কিছু নেই। তিনি বিধাতার কাছে সর্বশ্রেষ্ঠ সে ধনের বিনিময়ে পুত্রের জীবন ভিক্ষা চাইলেন। আল্লাহ তাঁর প্রার্থনা মঞ্জুর করলেন। এভাবে পিতৃস্নেহের কাছে মরণের পরাজয় ঘটল। অর্থাৎ সন্তানের প্রতি পিতার অপরিসীম ভালোবাসা ও অনুভূতি প্রকাশ পেয়েছে কবিতাটিতে।

কবি পরিচিতি:
গোলাম মোস্তফা যশোর জেলার শৈলকুপা থানার মনোহরপুর গ্রামে ১৮৯৭ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি কলকাতার রিপন কলেজ থেকে বি.এ. পাস করেন। কর্মজীবনে তিনি বিভিন্ন সরকারি বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। কাব্য, উপন্যাস, জীবনী, অনুবাদ ইত্যাদি সাহিত্যের প্রায় সকল শাখায় তাঁর স্বচ্ছন্দ পদচারণা ছিল। কাব্যচর্চার ক্ষেত্রেই ইসলামি ঐতিহ্য থেকে তিনি প্রেরণা লাভ করেছিলেন। তাঁর প্রকাশিত কাব্য: রক্তরাগ, খোশরোজ, বুলবুলিস্তান, উপন্যাস: ভাঙ্গাবুক, রূপের নেশা, এক মন এক প্রাণ; জীবনী: বিশ্বনবী, মরুদুলাল; অনুবাদ: কালামে ইকবাল, আল কুরআন, শিকওয়া ও জওয়াবে শিকওয়া ইত্যাদি। তিনি ১৯৬৪ সালে মৃত্যুবরণ করেন।।

বহুনির্বাচনি প্রশ্ন:
১. ‘জীবন বিনিময়’ কবিতায় কবি হুমায়ুনের মুমূর্ষু অবস্থা বোঝানোর জন্য কোন উপমাটি ব্যবহার করেছেন?
ক. জীবন-প্রদীপ
খ. অস্তরবির প্রায়
গ. নিষ্ঠুর নীরবতা
ঘ. ঊষার পূর্বাভাস
২. ‘তিমির রাতের তোরণে তোরণে উষার পূর্বাভাস’ বলতে কী বোঝানো হয়েছে?
ক. হুমায়ুনের রোগমুক্তির লক্ষণ
খ. বাবরের শান্ত-অচঞ্চল মন
গ. বাবরের প্রার্থনা কবুল হওয়া
ঘ. বাবরের মৃত্যুশয্যা গ্রহণ
নিচের উদ্দীপকটি পড় এবং ৩ ও ৪-সংখ্যক প্রশ্নের উত্তর দাও।
পত্রিকায় প্রকাশ: বরিশাল যাবার পথে লঞ্চ ডুবিতে পুত্রকে বাঁচাতে গিয়ে পিতার মৃত্যু।
৩. উদ্দীপকে 'জীবন বিনিময়' কবিতার যে দিক প্রকাশ পেয়েছে তা হলো-
i. সন্তান বাৎসল্য
ii. অপত্যস্নেহ
iii. পিতার আত্মত্যাগ
নিচের কোনটি সঠিক?
ক. iও ii
খ. i ও iii
গ. ii ও iii
ঘ. i, ii ও iii
8. ‘জীবন বিনিময়’ কবিতার কোন পঙ্ক্তির সঙ্গে উদ্দীপকের ভাবের সাদৃশ্য রয়েছে?
ক. জীবন-প্রদীপ নিভিয়া আসিছে অস্তরবির প্রায়
খ. পিতৃস্নেহের কাছে হইয়াছে মরণের পরাজয়
গ. হৃষ্টচিত্তে গ্রহণ করিল শয্যা সে মরণের
ঘ. মোর জীবনের সবচেয়ে প্রিয় আমারি আপন প্রাণ

জ্ঞানমূলক প্রশ্ন
----------

অনুধাবনমূলক প্রশ্ন
--------------

সৃজনশীল প্রশ্ন- ১
বাবার সঙ্গে ঢাকায় বেড়াতে এসে ছিনতাইকারীর কবলে পড়ে উৎপল ও তার বাবা। একপর্যায়ে ছিনতাইকারীরা উৎপলকে আঘাত করতে এলে বাবা তাকে সরিয়ে দিয়ে নিজে ছিনতাইকারীর ছুরিতে রক্তাক্ত হন। হাসপাতালে ডাক্তার সাহেব যখন উৎপলকে জানান যে, এই মুহূর্তে রক্ত না হলে রোগী বাঁচানো যাবে না। সঙ্গে সঙ্গে উৎপল তার শরীর থেকে প্রয়োজনীয় রক্ত দিয়ে বাবাকে আশঙ্কামুক্ত করেন।
ক. ‘জীবন বিনিময়’ কবিতায় কোনটিকে ‘সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ ধন’ বলা হয়েছে?
খ. কবি ‘জীবন বিনিময়’ কবিতায় নীরবতাকে নিষ্ঠুর বলেছেন কেন?
গ. উৎপলকে সরিয়ে দেয়ার মধ্য দিয়ে উদ্দীপকের পিতার মাঝে ‘জীবন বিনিময়’ কবিতার বাদশা বাবরের যে পরিচয় মেলে তা ব্যাখ্যা কর।
ঘ. “ভাবগত ঐক্য থাকলেও উদ্দীপকটি ‘জীবন বিনিময়’ কবিতার ঘটনাপ্রবাহের সমার্থক নয়” মন্তব্যটি বিশ্লেষণ কর। ২০২৫
-----------

সৃজনশীল প্রশ্ন- ১
-------------
-----------

সৃজনশীল প্রশ্ন- ২
-------------
-----------

তথ্যসূত্র :
১. বাংলা সাহিত্য: নবম-দশম শ্রেণি, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড, বাংলাদেশ, ২০২৫।
২. আধুনিক বাংলা অভিধান: বাংলা একাডেমি, এপ্রিল, ২০১৮।
৩. ব্যবহারিক বাংলা অভিধান: বাংলা একাডেমি, ১৮তম , ২০১৫।

Next Post Previous Post