তাহারেই পড়ে মনে- সুফিয়া কামাল

তাহারেই পড়ে মনে
তাহারেই পড়ে মনে

তাহারেই পড়ে মনে
সুফিয়া কামাল

হে কবি, নীরব কেন ফাগুন যে এসেছে ধরায়,
বসন্তে বরিয়া তুমি লবে না কি তব বন্দনায়?”
      কহিল সে স্নিগ্ধ আঁখি তুলি-
     দক্ষিণ দুয়ার গেছে খুলি?
বাতাবি নেবুর ফুল ফুটেছে কি? ফুটেছে কি আমের মুকুল?
দখিনা সমীর তার গন্ধে গন্ধে হয়েছে কি অধীর আকুল?”

এখনো দেখনি তুমি?” কহিলাম, “কেন কবি আজ
এমন উন্মনা তুমি? কোথা তব নব পুষ্পসাজ?
     কহিল সে সুদূরে চাহিয়া-
     অলখেপাথার বাহিয়া
তরী তার এসেছে কি? বেজেছে কি আগমনী গান?
ডেকেছে কি সে আমারে? শুনি নাই, রাখি নি সন্ধান।”

কহিলাম, “ওগো কবি! রচিয়া লহ না আজও গীতি,
বসন্ত-বন্দনা তব কণ্ঠে শুনি- এ মোর মিনতি
     কহিল সে মৃদু মধু-স্বরে-
     “নাই হলো, না হোক এবারে-
আমারে গাহিতে গান, বসন্তেরে আনিতে বরিয়া-
রহেনি, সে ভুলেনি তো, এসেছে তা ফাগুনে স্মরিয়া।”

কহিলাম: “ওগো কবি, অভিমান করেছ কি তাই?
যদিও এসেছে তবু তুমি তারে করিলে বৃথাই।”

কহিল সে পরম হেলায়-
     “বৃথা কেন? ফাগুন বেলায়
ফুল কি ফোটেনি শাখে? পুষ্পারতি?
মাধবী কুঁড়ির বুকে গন্ধ নাহি? করে নাই অর্ঘ্য বিরচন?”

“হোক, তবু বসন্তের প্রতি কেন এই তব তীব্র বিমুখতা?”
কহিলাম, “উপেক্ষায় ঋতুরাজে কেন কবি দাও তুমি ব্যথা?
     কহিল সে কাছে সরে আসি-
     কুহেলি উত্তরী তলে মাঘের সন্ন্যাসী-
গিয়াছে চলিয়া ধীরে পুষ্পশূন্য দিগন্তের পথে
রিক্ত হস্তে! তাহারেই পড়ে মনে, ভুলিতে পারি না কোনো মতে।”

চিত্রকর: নাজমা শাওয়াল ইলারাহ; ৪র্থ শ্রেণি
চিত্রকর: নাজমা শাওয়াল ইলারাহ; ৪র্থ শ্রেণি
‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতার উৎস নির্দেশ :
সুফিয়া কামালের ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতাটি ১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দে ‘মাসিক মোহাম্মদী’ পত্রিকায় [নবম বর্ষ, ষষ্ঠ সংখ্যা, ১৩৪২] প্রথম প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে এটি ‘সাঁঝের মায়া’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত হয়। কবিতাটি অক্ষরবৃত্ত ছন্দে রচিত। অক্ষরবৃত্ত ছন্দের লয় বা গতি ধীর। মূলপর্ব ৮ ও ১০ মাত্রার। ৮ + ১০ = ১৮ মাত্রার।

‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতার শব্দার্থ ও টীকা :
➠ হে কবি- কবিভক্ত এখানে কবিকে সম্বোধন করেছেন।
নীরব কেন- উদাসীন হয়ে আছেন কেন? কেন কাব্য ও গান রচনায় সক্রিয় হচ্ছেন না।
➠ ফাগুন- ফাল্গুন মাস।
ফাগুন যে এসেছে ধরায়- পৃথিবীতে ফাল্গুন অর্থাৎ বসন্তের আবির্ভাব ঘটেছে।
➠ ধরায়- পৃথিবীতে।
➠ বরিয়া- বরণ করে।
➠ লবে না- নিবে না।
➠ তব- তোমার।
➠ বন্দনা- প্রার্থনা।
তব বন্দনায়- তোমার রচিত বন্দনা-গানের সাহায্যে। অর্থাৎ বন্দনা-গান রচনা করে বসন্তকে কি তুমি বরণ করে নেবে না?
স্নিগ্ধ আঁখি- স্নেহপূর্ণ মায়াজড়িত চোখ বা দৃষ্টি।
দক্ষিণ দুয়ার গেছে খুলি?- কবির জিজ্ঞাসা- বসন্তের দখিনা (দক্ষিণের) বাতাস বইতে শুরু করেছে কি না। উদাসীন কবি যে তা লক্ষ করেননি তার এই জিজ্ঞাসা থেকে তা স্পষ্ট হয়।
বাতাবি নেবুর ফুল ফুটেছে কি? ফুটেছে কি আমের মুকুল?- বসন্তের আগমনে বাতাবি লেবুর ফুল ও আমের মুকুলের গন্ধে দখিনা বাতাস দিগ্বিদিক সুগন্ধে ভরে তোলে। কিন্তু উন্মনা কবি এসব কিছুই লক্ষ করেননি। কবির জিজ্ঞাসা তাঁর উদাসীনতাকেই স্পষ্ট করে।
➠ দখিনা সমীর- দক্ষিণ দিকের বাতাস।
➠ সমীর- বাতাস।
➠ অধীর- ব্যাকুল; অস্থির; চঞ্চল।
এখনো দেখনি তুমি?- কবিভক্তের এ কথায় আমরা নিশ্চিত হই প্রকৃতিতে বসন্তের সব লক্ষণ মূর্ত হয়ে উঠেছে। অথচ কবি তা লক্ষ করছেন না।
➠ উন্মনা- উদাসীন।
কোথা তব নব পুষ্পসাজ- বসন্ত এসেছে অথচ কবি নতুন ফুলে ঘর সাজাননি। নিজেও ফুলের অলংকারে সাজেননি।
➠ পুষ্পসাজ- ফুল দিয়ে সাজানো।
➠ অলখ- অলক্ষ। দৃষ্টি অগোচরে।
➠ পাথার- সমুদ্র।
➠ বহিয়া- বেয়ে।
➠ সন্ধান- খোঁজখবর; হদিস।
➠ রচিয়া লহ- রচনা করে নাও।
➠ মিনতি- অনুরোধ।
➠ স্মরিয়া- স্মরণ করে।
➠ অভিমান- প্রিয়জনের ত্রুটিপূর্ণ আচরণ-জনিত মনোবেদনা বা ক্ষোভ।
বসন্ত-বন্দনা তব কণ্ঠে শুনি- এ মোর মিনতি।- কবি বন্দনা-গান রচনা করে বসন্তকে বর্ণনা করলেও বসন্ত অপেক্ষা করেনি। ফাল্গুন আসার সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃতিতে বসন্ত এসেছে।
করিলে বৃথাই- ব্যর্থ করলে। অর্থাৎ কবি-ভক্তের অনুযোগ-বসন্তকে কবি বরণ না করায় বসন্তের আবেদন গুরুত্ব হারিয়েছে।
➠ হেলায়- অবহেলায়।
➠ শাখে- শাখায়; গাছের ডালে।
➠ পুষ্পারতি - ফুলেল বন্দনা বা নিবেদন।
পুষ্পারতি লভেনি কি ঋতুর রাজন?- ঋতুরাজ বসন্তকে বরণ ও বন্দনা করার জন্য গাছে গাছে ফুল ফোটেনি? অর্থাৎ বসন্তকে সাদর অভ্যর্থনা জানানোর জন্যেই যেন ফুল ফোটে।
➠ ঋতুর রাজন- ঋতুরাজ বসন্ত।
➠ কুঁড়ি- মুকুল; আফোটা ফুল।
➠ মাধবী- বাসন্তী লতা বা তার ফুল।
➠ অর্ঘ্য- পূজার উপকরণ।
অর্ঘ্য বিরচন- অঞ্জলি বা উপহার রচনা। প্রকৃতি বিচিত্র সাজে সজ্জিত হয়ে ফুল ও তার সৌরভ উপহার দিয়ে বসন্তকে বরণ করে।
উপেক্ষায় ঋতুরাজে কেন কবি দাও তুমি ব্যথা- কবিভক্ত বুঝতে পারছেন না, কবি যথারীতি সানন্দে বসন্ত বন্দনা না করে তার দিকে মুখ ফিরিয়ে রয়েছেন কেন।
➠ বিমুখতা- মুখ ফেরানো।।
➠ কুহেলি- কুয়াশা।
➠ উত্তরী- চাদর। উত্তরীয়।
কুহেলি উত্তরী তলে মাঘের সন্ন্যাসী- কবি শীতকে মাঘের সন্ন্যাসীরূপে কল্পনা করেছেন। যে সন্ন্যাসী কুয়াশার চাদর পরিধান করে আছে।
মাঘের সন্ন্যাসী- কবি শীতকে মাঘের সন্ন্যাসীরূপে কল্পনা করেছেন। যে সন্ন্যাসী কুয়াশার চাদর পরিধান করে আছে।
পুষ্পশূন্য দিগন্তের পথে- শীত প্রকৃতিতে দেয় রিক্ততার রূপ। গাছের পাতা যায় ঝরে। গাছ হয় ফুলহীন। শীতের এ রূপকে বসন্তের বিপরীতে স্থাপন করা হয়েছে। প্রকৃতি বসন্তের আগমনে ফুলের সাজে সাজলেও কবির মন জুড়ে আছে শীতের রিক্ততার ছবি। শীত যেন সর্বরিক্ত সন্ন্যাসীর মতো কুয়াশার চাদর গায়ে পত্রপুষ্পহীন দিগন্তের পথে চলে গেছে।
➠ রিক্ত হস্তে- শূন্য হাতে।
তাহারেই পড়ে মনে- প্রকৃতিতে বসন্ত এলেও কবির মন জুড়ে আছে শীতের রিক্ত ও বিষণ্ণ ছবি। কবির মন দুঃখ ভারাক্রান্ত। তার কণ্ঠ নীরব। শীতের করুণ বিদায়কে তিনি কিছুতেই ভুলতে পারছেন না। তাই বসন্ত তার মনে কোনো সাড়া জাগাতে পারছে না। বসন্তের সৌন্দর্য তার কাছে অর্থহীন, মনে কোনো আবেদন জানাতে পারছে না। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, তাঁর প্রথম স্বামী ও কাব্যসাধনার প্রেরণা-পুরুষের আকস্মিক মৃত্যুতে কবির অন্তরে যে বিষণ্ণতা জাগে তারই সুস্পষ্ট প্রভাব ও ইঙ্গিত এ কবিতায় ফুটে উঠেছে।

‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতার পাঠ-পরিচিতি :

‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতায় প্রকৃতি ও মানবমনের সম্পর্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক তাৎপর্যময় অভিব্যক্তি পেয়েছে। সাধারণভাবে প্রকৃতির সৌন্দর্য মানবমনের অফুরন্ত আনন্দের উৎস। বসন্ত-প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য যে কবিমনে আনন্দের শিহরণ জাগাবে এবং তিনি তাকে ভাবে ছন্দে সুরে ফুটিয়ে তুলবেন সেটাই প্রত্যাশিত। কিন্তু কবিমন যদি কোনো কারণে শোকাচ্ছন্ন কিংবা বেদনা-ভারাতুর থাকে তবে বসন্ত তার সমস্ত সৌন্দর্য সত্ত্বেও কবির অন্তরকে স্পর্শ করতে পারবে না।

এ কবিতায় কবির ব্যক্তিজীবনের দুঃখময় ঘটনার ছায়াপাত ঘটেছে। তাঁর সাহিত্য সাধনার প্রধান সহায়ক ও উৎসাহদাতা স্বামী সৈয়দ নেহাল হোসেনের আকস্মিক মৃত্যুতে (১৯৩২) কবির জীবনে প্রচণ্ড শূন্যতা নেমে আসে। তাঁর ব্যক্তিজীবন ও কাব্যসাধনার ক্ষেত্রে নেমে আসে এক দুঃসহ বিষণ্ণতা। কবিমন আচ্ছন্ন হয়ে যায় রিক্ততার হাহাকারে। ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতাকে আচ্ছন্ন করে আছে এই বিষাদময় রিক্ততার সুর। তাই বসন্ত এলেও উদাসীন কবির অন্তর জুড়ে রিক্ত শীতের করুণ বিদায়ের বেদনা।

কবিতাটির আরেকটি লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এর নাটকীয়তা। গঠনরীতির দিক থেকে এটি সংলাপনির্ভর রচনা। কবিতার আবেগময় ভাববস্তুর বেদনাঘন বিষণ্ণতার সুর এবং সুললিত ছন্দ এতই মাধুর্যমতি যে তা সহজেই পাঠকের অন্তর ছুঁয়ে যায়।


‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতার কবি পরিচিতি :

সুফিয়া কামাল বাংলাদেশের বিশিষ্ট মহিলা কবি ও নারী আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ। তাঁর জন্ম ১৯১১ খ্রিষ্টাব্দের ২০শে জুন বরিশালে। তাঁর পৈতৃক নিবাস কুমিল্লায়। কবির পিতার নাম সৈয়দ আব্দুল বারী এবং মায়ের নাম সাবেরা বেগম। যে সময়ে সুফিয়া কামালের জন্ম তখন বাঙালি মুসলমান নারীদের কাটাতে হতো গৃহবন্দি জীবন। স্কুল কলেজে পড়ার কোনো সুযোগ তাদের ছিল না। ওই বিরুদ্ধ পরিবেশে সুফিয়া কামাল প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ পাননি। পারিবারিক নানা উত্থান পতনের মধ্যে তিনি স্বশিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছেন। তারই মধ্যে তিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের চর্চায় আত্মনিয়োগ করেছেন। পরবর্তীকালে সাহিত্য সাধনা ও নারী আন্দোলনে ব্রতী হয়ে তিনি শুধু কবি হিসেবেই বরণীয় হননি, জননী সম্ভাষণে ভূষিত হয়েছেন।

সুফিয়া কামালের উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ হচ্ছে: ‘সাঁঝের মায়া(১৯৩৮)’, ‘উদাত্ত পৃথিবী(১৯৬৪)’, ‘মায়া কাজল(১৯৯১) ইত্যাদি। এছাড়াও তিনি গল্পগ্রন্থ (কেয়ার কাঁটা, ১৯৩৭), ভ্রমণকাহিনি, প্রবন্ধ ও স্মৃতিকথা (একাত্তরের ডায়েরি, ১৯৮৯) লিখেছেন। বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৬২), একুশে পদক (১৯৭৬), স্বাধীনতা পদক(১৯৭৬), নাসির উদ্দীন স্বর্ণপদকসহ বিভিন্ন পদকে ভূষিত হয়েছেন তিনি।
সুফিয়া কামাল ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দের ২০শে নভেম্বর ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।


‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতার বহুনির্বাচনি প্রশ্ন :

প্রশ্ন থেকে

অভিনন্দন!
আপনি পেয়েছেন -এর মধ্যে!
যা


চিত্রকর: আফরিন আয়েশা; ৩য় শ্রেণি
চিত্রকর: আফরিন আয়েশা; ৩য় শ্রেণি
‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতার জ্ঞানমূলক প্রশ্ন :
১. কবি সুফিয়া কামাল কত সালে জন্মগ্রহণ করেন?
উত্তর: কবি সুফিয়া কামাল ১৯১১ সালে জন্মগ্রহণ করেন।
২. সুফিয়া কামালের জন্মের সময় কাদেরকে গৃহবন্দি জীবন কাটাতে হতো?
উত্তর: সুফিয়া কামালের জন্মের সময় বাঙালি মুসলমান নারীদেরকে গৃহবন্দি জীবন কাটাতে হতো।
৩. সুফিয়া কামালের জন্মের সময় পরিবারে কোন ভাষার প্রবেশ একরকম বন্ধ ছিল?
উত্তর: সুফিয়া কামালের জন্মের সময় পরিবারে বাংলা ভাষার প্রবেশ একরকম বন্ধ ছিল।
৪. সুফিয়া কামালের স্বামীর নাম কী ছিল?
উত্তর: সুফিয়া কামালের স্বামীর নাম ছিল সৈয়দ নেহাল হোসেন।
৫. পারিবারিক নানা উত্থান-পতনের মধ্যে সুফিয়া কামাল কেমন শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছিলেন?
উত্তর: পারিবারিক নানা উত্থান-পতনের মধ্যে সুফিয়া কামাল স্বশিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছিলেন।
৬. সাহিত্য সাধনায় সুফিয়া কামালের প্রধান উৎসাহদাতা কে ছিলেন?
উত্তর: সাহিত্য সাধনায় সুফিয়া কামালের প্রধান উৎসাহদাতা ছিলেন তাঁর স্বামী সৈয়দ নেহাল হোসেন।
৭. ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতাটি ‘মাসিক মোহাম্মদী’ পত্রিকার কততম সংখ্যায় প্রকাশিত হয়?
উত্তর: ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতাটি ‘মাসিক মোহাম্মদী’ পত্রিকার ষষ্ঠ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়।
৮. ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতায় কবির মন কীসে আচ্ছন্ন হয়ে যায়?
উত্তর: ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতায় কবির মন রিক্ততার হাহাকারে আচ্ছন্ন হয়ে যায়।
৯. কবিকে বসন্ত-বন্দনা রচনা করতে বলেছে কে?
উত্তর: কবি-ভক্তরা কবিকে বসন্ত-বন্দনা রচনা করতে বলেছে।
১০. ‘অলখ’ শব্দের অর্থ কী?
উত্তর: ‘অলখ’ শব্দের অর্থৎ অলক্ষ বা দৃষ্টির অগোচর।
১১. ‘উন্মনা’ শব্দের অর্থ কী?
উত্তর: ‘উন্মনা’ শব্দের অর্থৎ অন্যমনস্ক।
১২. কবি সুফিয়া কামালের যখন জন্ম হয় তখন বাঙালি রমণীরা কীভাবে দিন কাটাত?
উত্তর : কবি সুফিয়া কামালের যখন জন্ম হয় তখন বাঙালি রমণীরা গৃহবন্দি অবস্থায় দিন কাটাত।
১৩. কোন ঋতুর দিকে চেয়ে কবি রিক্ত ও বিষণ্ণ হয়ে আছেন?
উত্তর: শীত ঋতুর দিকে চেয়ে কবি রিক্ত ও বিষণ্ণ হয়ে আছেন।
১৪. ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতায় কোন ফুলের উল্লেখ আছে?
উত্তর: ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতায় মাধবী ফুলের উল্লেখ আছে।
১৫. ‘আঁখি’ শব্দের বুৎপত্তি নির্দেশ কর।
উত্তর: আঁখি অক্ষি।
১৬. ‘সাজ’ শব্দের বুৎপত্তি নির্দেশ কর।
উত্তর: সাজ সজ্জা।
১৭. সুফিয়া কামাল কত খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন?
উত্তর : সুফিয়া কামাল ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন।
১৮. শীতের রিক্ততার সাথে কবি কিসের সাদৃশ্য খুঁজে পেয়েছেন?
উত্তর : শীতের রিক্ততার সাথে কবি নিজ জীবনের অনন্ত শূন্যতার সাদৃশ্য খুঁজে পেয়েছেন।
১৯. ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতাটি কত খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়?
উত্তর : ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতাটি ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়।
২০. সুফিয়া কামাল কোথায় জন্মগ্রহণ করেন?
উত্তর : সুফিয়া কামাল বাংলাদেশের বরিশাল জেলার শায়েস্তাবাদে জন্মগ্রহণ করেন।
২১. ‘বরিয়া’ শব্দের অর্থ কী?
উত্তর : বরিয়া শব্দের অর্থ বরণ করে।
২২. কবি সুফিয়া কামালের প্রথম স্বামী সৈয়দ নেহাল হোসেন কবে মৃতু্যবরণ করেন?
উত্তর : কবির প্রথম স্বামী সৈয়দ নেহাল হোসেন মৃত্যুবরণ করেন ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে।
২৩. ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতার গঠনরীতির দিক থেকে প্রধান বৈশিষ্ট্য কী?
উত্তর : ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতায় গঠনরীতির প্রধান বৈশিষ্ট্য হল সংলাপ নির্ভরতা।
২৪. ‘সমীর’ শব্দের অর্থ কী?
উত্তর : সমীর শব্দের অর্থ বাতাস।
২৫. কবি সুফিয়া কামালের পিতার নাম কি?
উত্তর : কবি সুফিয়া কামালের পিতার নাম সৈয়দ আবদুল বারী।
২৬. সুফিয়া কামালের পেশাগত জীবনের শুরু হয়েছিল কীভাবে?
উত্তর : শিক্ষকতা দিয়ে সুফিয়া কামালের পেশাগত জীবনের শুরু হয়েছিল।
২৭. ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতায় কবি কোন গান বাজার কথা জানতে চেয়েছেন?
উত্তর : ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতায় কবি আগমনী গান বাজার কথা জানতে চেয়েছেন।
২৮. ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতাটি ‘মাসিক মোহাম্মদী’ পত্রিকার কততম সংখ্যায় প্রকাশিত হয়?
উত্তর : ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতাটি ‘মাসিক মোহাম্মদী’ পত্রিকার ষষ্ঠতম সংখ্যায় প্রকাশিত হয়।
২৯. কবি সুফিয়া কামালের কাব্য সাধনার প্রেরণাপুরুষ কে ছিলেন?
উত্তর : কবি সুফিয়া কামালের কাব্য সাধনার প্রেরণাপুর“ষ ছিলেন কবির প্রথম স্বামী সৈয়দ নেহাল হোসেন।
৩০. তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতায় কবির মন কিসে আচ্ছন্ন হয়ে যায়?
উত্তর : ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতায় কবির মন রিক্ততার হাহাকারে আচ্ছন্ন হয়ে যায়।

‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতার অনুধাবনমূলক প্রশ্ন :

১. ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতায় কবির যে বিষাদঘন একাকিত্বের বিষয়টি ফুটে উঠেছে, তা ব্যাখ্যা করো।
উত্তর: কবি সুফিয়া কামাল রচিত ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতাটিতে মানবমনের বেদনামথিত শোকের চূড়ান্ত— প্রকাশ ঘটেছে।
➠ প্রিয়জন হারিয়ে একাকী জীবনযাপন করতে থাকা কবি এতটাই উদাসীন হয়ে পড়েন যে, প্রকৃতিতে শীত চলে গিয়ে বসন্তের আগমন ঘটলেও কবি টের পান না। কবি-ভক্তরা তাঁকে বসন্ত-বন্দনামূলক গান রচনা করতে অনুরোধ করলেও সাড়া দেন না কবি। কারণ কবির মনে যে বিষাদময় স্মৃতি বার বার ফিরে আসে, তা কিছুতেই ভুলতে পারেন না কবি। কবির এই বিষাদময়তা ও একাকিত্বের প্রভাব তাঁর কাব্য সৃষ্টিতেও পড়েছে।

২. ‘অলখের পাথার বাহিয়া’- চিত্রকল্পটির মর্মার্থ ব্যাখ্যা করো।
উত্তর: সুদূরতম ইঙ্গিত প্রদান করার লক্ষ্যে কবি “অলখের পাথার বাহিয়া” চিত্রকল্পের অবতারণা করেছেন।
➠ ‘অলখের পাথার বাহিয়া’- বাক্যটির আভিধানিক অর্থ দাঁড়ায় দৃষ্টিসীমার বাইরে সমুদ্রপথে ছুটে চলা কোনো কিছু। ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতায় স্মৃতিভারাক্রান্ত কবির মনে বসন্তের আগমনের দৃশ্যটির দূরত্ব বুঝাতে এই চিত্রকল্পটি ব্যবহৃত হয়েছে। কবির হৃদয়ে যেন বসন্তের আগমনের মতোই সুদূর সমুদ্রপথ পাড়ি দিয়ে কোনো এক সুখকর স্মৃতি দুয়ারে এসে হানা দেয়। এখানে প্রিয়-মানুষটির চিরতরে হারিয়ে যাওয়ার বিষয়টির প্রতিও ইঙ্গিত প্রদান করা হয়েছে।

৩. ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতায় শীত ঋতুকে কীসের সাথে তুলনা করা হয়েছে? ব্যাখ্যা করো।
উত্তর: ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতায় শীত ঋতুকে মাঘের সন্ন্যাসীর সাথে তুলনা করা হয়েছে।
➠ শীত ঋতুতে চারদিকে নিঃস্বতা ও রিক্ততার যে ছবি দেখা যায় তাতে প্রকৃতিকে সন্ন্যাসীর মতো অলংকারহীন মনে হয়। কবি সুফিয়া কামাল ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতায় শীতের রিক্ত ও জরাজীর্ণতাকে বোঝাতে শীত ঋতুকে মাঘের সন্ন্যাসী বলে উল্লেখ করেছেন। শীত ঋতুতে চারদিকে পাতাবিহীন গাছের যে প্রাকৃতিক নান্দনিকতা তৈরি হয়, তা দৃশ্যত সন্ন্যাসীর মতোই মনে হয়।

৪. প্রিয়জন হারানোর বেদনা কীভাবে মানুষের মনে ছায়াপাত করে? ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতাবলম্বনে তা বর্ণনা করো।
উত্তর: প্রিয়জন হারানোর বিষাদঘন বেদনা মানুষকে তিলে তিলে কষ্ট দেয়।
➠ কবি সুফিয়া কামাল ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতায় তাঁর ব্যক্তিজীবনের এক মর্মান্তিক বেদনার স্মৃতিকেই তুলে ধরেছেন। প্রিয়জন হারানোর বেদনা মানুষকে ক্রমান্বয়ে বিষণ্ণ ও উদাস করে তোলে। কবি ও কবি-ভক্তের সংলাপে কবির নিরাসক্ত উদাস ভাবটি সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। প্রকৃতিতে বসন্ত এলেও কবি শীতের রিক্ততা ভুলতে পারেন নি। কারণ তাঁর মনোজগতে প্রিয়জন হারানোর ব্যথা গভীর হয়ে বার বার উঁকি দিচ্ছে। প্রিয় মানুষটিকে হারানোর বেদনা তাই কবিকে করে তুলেছে জীবনবিমুখ, নিরাসক্ত এক বিষণ্ণ মানুষ।

৫. ‘হে কবি নীরব কেন?’- কবি কোন কারণে নীরব?
উত্তর: প্রিয়জন হারানোর বিষাদময় স্মৃতি ভুলতে না পেরে নিঃস্ব কবিকে নীরব ভূমিকা পালন করতে দেখা যায়।
➠ প্রকৃতিতে বসন্তের আগমন ঘটলেও কবির মনোজগৎ জুড়ে বিরাজ করছে শীতের রিক্ততা ও বিষণ্ণতার ছবি। কবির মন দুঃখ-ভারাক্রান্ত। শীতের করুণ বিদায় কবির মনে যে বেদনার ছায়াপাত রেখে গেছে, তা কবি কিছুতেই ভুলতে পারছেন না। এখানে প্রকৃতি ও মানব মনের মিলের দিকটি গুরুত্বের সাথে তুলে ধরা হয়েছে। কবির নীরবতার কারণটি যেন প্রকৃতির চিরাচরিত পরস্থিতির মাঝেই খুঁজে পাওয়া সম্ভব। মূলত প্রিয়জন হারানোর বেদনায় কাতর কবি স্বাভাবিকভাবেই নিঃস্ব, রিক্ত এবং নীরব হয়ে পড়েন।

৬. ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতাটি নাটকীয় গুণসম্পন্ন। সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করো।
উত্তর : কবিতার মধ্যে যখন নাটকীয় গুণ থাকে তখন তাকে নাটকীয় গুণসম্পন্ন কবিতা বলে। নাটকীয় কবিতার মধ্যে একাধিক চরিত্র বা একাধিক ব্যক্তির মধ্যে ভাব ফুটে ওঠে। বেগম সুফিয়া কামালের ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতায় নাটকীয়তার ভাব সুস্পষ্ট।
➠ গঠনরীতির দিক থেকে এটি একটি সংলাপধর্মী কবিতা। কবিতাটি নির্মিত হয়েছে কবি ও কবিভক্তের মধ্যে নাটকীয় সংলাপের ভিত্তিতে। এভাবে কবিতার সবকটি চরণ দ্বৈত ছন্দোবদ্ধ কথোপকথনের রীতিতে রচিত হয়েছে। কবিতায় এ ধরনের নাটকীয়তা খুব কমই লক্ষ করা যায়। কবি সুফিয়া কামাল এ নাটকীয়তা সৃষ্টির মাধ্যমে কবিতাটিকে ভিন্নমাত্রায় ভূষিত করেছেন। কবিতায় নাটকীয় সংলাপের ভাব থাকায় একে নাটকীয় গুণসম্পন্ন কবিতা বলা যায়।

৭. ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতায় বসন্তের আগমনে কবি উদাসীন কেন?
উত্তর : বসন্তের নয়নলোভা সৌন্দর্য থাকা সত্ত্বেও কবিমনে আজ তীব্র উদাসীনতা, আচরণে অনাকাঙিক্ষত বিষণ্ণতা।
➠ কেননা বসন্তের আগমনের কিছুকাল পূর্বেই যাবতীয় রিক্ততা, শূন্যতা আর নিঃস্বতা নিয়ে শীত ঋতু হারিয়ে গেছে পুষ্পশূন্য দিগন্তে। শীতের প্রকোপে বৃক্ষলতা হয়েছে পত্রহীন, পুষ্পীন, পান্ডুর এবং শ্রীহীন। এর আগমন ও বিদায়ে প্রকৃতি থেকেছে নীরব। শীতের এই উদার্য কবির কাছে শীতকে মহিমান্বিত করেছে। তাই কবি শীতকে ভুলতে পারেন নি। শীতের রিক্ত ও নিঃস্বভাব কবিচিত্তে যে বেদনার সঞ্চার করেছে তার আবেগেই তিনি নির্মোহ এবং নিশ্চল। একটি চরম দুঃখবোধ বা কিছু হারানোর বিলাপ কবির মানসে পূর্ণ আসন দখল করেছে। তাই কখন চুপিসারে তাঁর দ্বারে বসন্তের আগমন ঘটেছে তা তিনি লক্ষ্য করেন নি। তিনি উদাসীনভাবে বসন্তকে উপেক্ষা করেছেন। ফলে বসন্তের আগমনকে তিনি স্বাগত জানাতে পারেন নি।

৮. ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতায় প্রকৃতির সৌন্দর্য ও কবির মনের অবস্থার মধ্যে কোনটি প্রধান হয়ে উঠেছে বলে তুমি মনে করো? কেন?
উত্তর : এ কবিতায় প্রকৃতি ও মানবমনের সম্পর্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ও তাৎপর্যময় অভিব্যক্তি লাভ করেছে। কবিতার বিষয়বস্তু পর্যালোচনা করলে আপাতদৃষ্টিতে তাকে প্রকৃতি বিষয়ক কবিতা বলেই মনে হয়। নিঃস্বর্গ অর্থাৎ প্রকৃতি বিষয়ক কবিতার সমস্ত বৈশিষ্ট্য এতে রয়েছে। কিন্তু প্রকৃতির মধুর রূপরাশির বর্ণনা করাই কবির একমাত্র উদ্দেশ্য নয়। বসন্তের আবেদন তার হৃদয় দুয়ারে ব্যর্থ হয়ে গেছে। কবির মন দুঃখভারাক্রান্ত। তাঁর কণ্ঠ নীরব। শীতের করুণ বিদায়কে তিনি কিছুতেই ভুলতে পারছে না। বসন্তেরর সৌন্দর্য তার অর্থহীন মনে কোন আবেদন জানাতে পারছে না। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য তার প্রথম স্বামী ও কাব্য সাধনার প্রেরণা পুরুষের আকস্মিক মৃতু্যতে কবির অন্তরে যে বিষণ্ণতা জাগে তারই সুস্পৃষ্ট প্রভাব ও ইঙ্গিত এ কবিতায় ফুটে উঠেছে।
ঋতুরাজ বসন্ত এসেছে ফুলে ফুলে সাজানো, সৌরভমুখর মাদকতাময় প্রকৃতির প্রতিশ্রুতি নিয়ে। কিন্তু বসন্তের নয়নলোভা সৌন্দর্য কবিকে মুগ্ধ করতে পারে নি। কেননা কবি শীতের রিক্ততার জন্য বেদনাহত। শীতের প্রভাব তার হৃদয় থেকে মুছে যায় নি। তিনি উদাসীনভাবে বসন্তকে উপেক্ষা করছেন।

৯. “তরী তার এসেছে কি? বেজেছে কি আগমনী গান?
ডেকেছে কি সে আমারে? শুনি নাই, রাখি নি সন্ধান।”- পঙক্তি দুটি বুঝিয়ে লেখো।
উত্তর : কবি অকাল বৈধব্যের শিকার। তাঁর হৃদয় দুঃখে-শোকে মুহ্যমান। কবির সে শোকদগ্ধ মনে ঋতুরাজ বসন্তের অপরূপ সমারোহে আগমন কোনো আনন্দের বাণী নিয়ে আসে নি।
কবি এতই আনমনা যে, তিনি খেয়ালই করেন নি প্রকৃতিতে কখন ঋতুরাজের আগমন ঘটেছে। কবির চেতনা আজ বিমূঢ়। ফুলের সুবাস ও পাখির কলরব তাঁর চিত্তে পুলক শিহরণ জাগায় নি। তাঁর বিরহকাতর ব্যথাদীর্ণ হৃদয়ের অনন্ত হাহাকারের জন্যই কবি এসবের সন্ধান রাখেন না। কবি এত ফুলের সৌরভ, দখিনা সমীকরণ দেখে এতটুকুও আবেগকম্পিত হন নি। অন্তরে তাঁর কোনো শিহরণ জাগে নি। তিনি মৌন, তিনি উদাসীন হয়ে আছে। কবির অনুরাগী জনৈক ভক্তের বসন্তকে বরণ করে নেয়ার মিনতি জানানোর পর কবি জানতে চাইলেন দিগন্তের পথ বেয়ে সৌন্দর্যের পসরা বোঝাই তরীখানি এসেছে কি না। বসন্তের কোনো আগমনী বাণী তিনি শুনতে পান নি। কেননা কবির মন শীতের ঋতুতেই আচ্ছন্ন হয়ে আছে।

১০. ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতা অবলম্বনে সংক্ষেপে বসন্ত ঋতুর বর্ণনা দাও।
উত্তর : সাধারণভাবে প্রকৃতির সৌন্দর্য মানব মনের অফুরন্ত আনন্দের উৎস। সেই অফুরন্ত আনন্দের উৎস হিসেবে পৃথিবীতে বসন্তের আবির্ভাব ঘটেছে। প্রকৃতিতে ঘটে গেছে এক অনিন্দ-হিন্দোল। দখিন দুয়ার খুলে গেছে। বাগানে ফুটেছে বাতাবি লেবুর ফুল। ফুটেছে আমের মুকুল। দখিনা সমীর গন্ধে গন্ধে অধীর-আকুল হয়েছে। নতুন ফুল প্রকৃতিকে সাজিয়েছে তার পূর্ণ রূপ মাধুর্য দিয়ে। মাধবী কুঁড়ির বুকে গন্ধ ছড়িয়েছে। দখিনা বাতাস বইতে শুরু করেছে। সঙ্গে এনেছে পৃথিবীর সমস্ত সৌরভ। আমের মুকুলে মৌমাছির গুঞ্জরণ, মাধবী ফুলের কুঁড়ির নাচন আর বনে বনে ফুলের আসরে নানা পাখ-পাখালীর কণ্ঠে বসন্তের এ আগমন যেন মানবমনকে আনন্দে শিহরণে উদ্বেলিত করে তুলেছে। বনভূমি নতুন পত্রপল্লবে বিচিত্র ফুলের বাহারে হয়ে উঠেছে রঞ্জিত, নতুন সাজে সজ্জিত হয়ে উঠেছে পুলকিত স্বচ্ছলতার এক প্রগাঢ় নিকুঞ্জ।

১১. ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতায় শীতের রিক্ততার মধ্যে কবির অতীত জীবনের যে সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায় তা লেখ।
উত্তর: শীত ঋতু প্রকৃতিতে দেয় রিক্ততার রূপ। শীতের প্রকোপে বৃক্ষলতা পত্রহীন, পুষ্পহীন পাণ্ডুর এবং শ্রীহীন হয়ে যায়।
এমন রিক্ত নিঃস্ব প্রকৃতিকে তাই সংসার ত্যাগী সন্ন্যাসীর মতো মনে হয়। রিক্ত শীতের সাথে রিক্ত সন্ন্যাসীর অপূর্ব সাদৃশ্য খুঁজে পেয়েছেন কবি তাঁর প্রিয়জন হারানো রিক্ত নিঃস্ব অনিকেত জীবনে। শীতের রিক্ততার মত কবির হৃদয় বেদনাবিধুর। কারণ কবির সাহিত্য সাধনার প্রধান সহায়ক ও উৎসাহদাতা স্বামী নেহাল হোসেনের আকস্মিক মৃত্যুতে কবির অন্তরে অনির্বচনীয় শূন্যতা নেমে আসে। তাঁর কাব্য সাধনায় ছন্দপতন ঘটতে থাকে। এক দুঃসহ বিষণ্নতায় কবির মন আচ্ছন্ন হয়ে আছে রিক্ততার হাহাকারে। যে রিক্ততা রয়েছে শীত প্রকৃতিতেও। তাই কবি তাঁর অতীত জীবনের রিক্ততার আশ্চর্য সাদৃশ্য খুঁজে পেয়েছেন নিঃস্ব রিক্ত শীতের মধ্যে।

১২. “কুহেলি উত্তরী তলে মাঘের সন্ন্যাসী- গিয়াছে চলিয়া ধীরে পুষ্পশূন্য
দিগন্তের পথে রিক্ত হস্তে!”- ব্যাখ্যা কর।
উত্তর : বসন্ত জাগ্রত দ্বারে। দখিনা দুয়ার আজ খোলা। চারিদিকে প্রকৃতি সেজেছে নবোঢ়া কন্যার মতন।
কবির পরিচয় এই বসন্তের গান গাওয়াতে বসন্তকে "Come, gentle spring! ethercal mildness! come". এই বলে থমসন একদিন যে উক্তি করেছিলেন জগতের কবিকুলের তাইং শাশ্বত ধ্যান ধারণা। অথচ আমাদের কবি তা থেকে অন্যথা। কবিমন এই দ্বিধাদ্বন্দ্ব এবং বসন্ত সমাগমনে ভ্রুক্ষেপহীনতার কারণ বিশ্লেষণ করে বলেছেন। কবি আজ বহুদিন ধরে প্রিয়জন বিরহিত। তাই শীতের জীর্ণতা আর রিক্ততার মাঝে কবি খুঁজে পান নিজের জীবনের সাদৃশ্য। কবির প্রথম জীবনের আলোর দিশারী, বর্তমান সম্পদপূর্ণ সুখী জীবনে আর নেই। যে দিয়েছে কবিকে অনুপ্রেরণা, কবিকে প্রস্ফুটিত ও বিকশিত করার জন্য যার আয়োজন ছিল ব্যাপক, সে রিক্ত শীতের মতন পুষ্পশূন্য দিগন্তের পথে হারিয়ে গেছে। কবির বসন্ত দিনে সেই সর্বশক্তি মাঘের সন্ন্যাসী গভীর বিষাদের রাগিনী ধ্বনিত করেছে দিক হতে দিগন্তে। তাইতো কবি বসন্ত বন্দনায় নিজেকে করেন নি ব্যাপৃত। ফিরে গেছেন অতীত জীবনের স্মৃতির কাছে। তাই চারিদিকের পুষ্পিত ফাল্গুন মনে হয় কবির কাছে বেদনাবিধূর। স্মৃতির দংশন জ্বালায় কবিমন উদাসী এক বাউল- যেখানে সুখ নেই, নেই কোন আনন্দের বার্তা।

১৩. “অলখের পাথার বাহিয়া
তরী তার এসেছে কি? বেজেছে কি আগমনী গান?”- ব্যাখ্যা করো।
উত্তর : প্রকৃতিতে বসন্ত এসেছে ফুলে-ফুলে সাজানো, সৌরভমুখর মাদকতাপূর্ণ প্রকৃতির প্রতিশ্রুতি নিয়ে।
এসেছে বাতাবি লেবুর মন উদাস করা সুবাসে, পাখির গানে, ভ্রমরের গুঞ্জনে আর আম্রমুকুলের সুরভিতে। শীতের জরাজীর্ণতার হয়েছে অবসান। অথচ সাড়ম্বরে জেগে ওঠা প্রকৃতির এতসব আহ্বান কবির মনে জাগাতে পারে নি কোন আনন্দের সুর। আনে নি কোন শিহরণ। কেননা পুষ্পশূন্য, রিক্ত হস্তে কিছুকাল পূর্বেই শীত ঋতু বিদায় নিয়েছে। শীতের আগমন ও বিদায়ে প্রকৃতি থেকেছে নীরব। শীতের এ রিক্ত ও নিঃস্বভাব কবিচিত্তে যে বেদনার সঞ্চার করেছে তার আবেগেই তিনি নির্মোহ এবং নিশ্চল। কবির ভক্তকূল তাঁকে বসন্তের আগমনী সংবাদ জানিয়েছেন। কিন্তু কবি উদাসীনভাবে বলেছেন, সত্যিই বসন্ত এসেছে কি না কিংবা বসন্তের আগমনী গান বেজেছে কি না তা তিনি জানেন না। কখন চুপিসারে তাঁর দ্বারে বসন্তের আবির্ভাব ঘটেছে তা তিনি লক্ষ্য করেন নি। ফলে তিনি বসন্তকে স্বাগত জানাতে পারেন নি। তাই কবির ব্যথাতুর হৃদয়ের বাণী-
“অলখের পাথার বাহিয়া
তরী তার এসেছে কি? বেজেছে কি আগমনী গান?”


‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতার সৃজনশীল প্রশ্ন- ১

নিচের উদ্দীপকটি পড়ো এবং প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও।
যারে খুব বেসেছিনু ভালো
সে মোরে ছেড়ে চলে গেল
যে ছিল মোর জীবন ছায়া
রেখে গেছে শুধু মায়া।
লাগে না ভালো অপরূপ প্রকৃতি
যতই করুক কেউ মিনতি
আমি এখন রিক্ত শূন্য
মন পড়ে রয়েছে তার জন্য
সে দিল মোরে কেমনে ফাঁকি আমি এখন বড় একাকী।

ক. “তাহারেই পড়ে মনে” কবিতাটি প্রথম কোন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়?
খ. “উপেক্ষায় ঋতুরাজে কেন কবি দাও তুমি ব্যথা?”- উক্তিটি দিয়ে কী বোঝানো হয়েছে?
গ. উদ্দীপকে ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতার কোন দিকটি প্রকাশ পেয়েছে? ব্যাখ্যা করো।
ঘ. “উদ্দীপকটি ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতার সুরকে প্রকাশ করতে পারেনি।”-তোমার মতের পক্ষে যুক্তি দাও।

ক. ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতাটি প্রথম ‘মাসিক মোহাম্মদী’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
খ. “উপেক্ষায় ঋতুরাজে কেন কবি দাও তুমি ব্যথা” উক্তিটি দ্বারা সানন্দে বসন্ত— না করে তার দিকে কবির মুখ ফিরিয়ে থাকার কথা বোঝানো হয়েছে।
➠ প্রতি বছর বসন্তের আগমন ঘটে। গাছে গাছে ফুল ফোটে, বিচিত্র রঙের ফুলে ফুলে শাখা ভরে যায়। মাধবী কুঁড়ি সুগন্ধ ছড়িয়ে দেয় চারদিকে। প্রকৃতি বিচিত্র সাজে সজ্জিত হয়ে ফুল ও তার সৌরভ উপহার দিয়ে বসন্তকে বরণ করে নেয়। কবি ভক্তের অনুযোগ, বসন্তকে কবি বরণ না করায়, বসন্তের আবেদন যেন গুরুত্ব হারিয়েছে। কবিভক্ত বুঝতে পারছেন না, কেন কবি বসন্তের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। ঋতুরাজকে উপেক্ষায় করে কবি যেন তাকে তীব্র ব্যথা দিয়েছেন।

গ. উদ্দীপকের প্রথম দুচরণে ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতার বিষাদময় রিক্ততার হাহাকার দিকটি প্রকাশ পেয়েছে।
➠‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতার বসন্ত প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য কবিমনে আনন্দের শিহরন জাগাবে, তিনি তাকে ভাবে ছন্দে সুরে ভরিয়ে তুলবেন সেটাই প্রত্যাশিত। কিন্তু কবিমন যদি কোনো কারণে শোকাচ্ছন্ন বা বেদনা ভারাতুর থাকে তবে তা কবির অন্তরকে স্পর্শ করতে পারবে না। কবির মন জুড়ে আছে শীতের রিক্ত ও বিষণ্ণ ছবি। তাঁর মন গভীরভাবে দুঃখ ভারাক্রান্ত। তাঁর কণ্ঠ নীরব। শীতের করুণ বিদায়কে কবি কিছুতেই ভুলতে পারছেন না। আর তাই বসন্তও তাঁর মনে কোনো সাড়া জাগাতে পারছে না। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, তাঁর প্রথম স্বামী তাঁর কাব্য সাধনার প্রেরণা-পুরুষ ছিলেন। তাঁরই আকস্মিক মৃতু্যতে কবির অন্তরে যে বিষণ্ণ বেদনার রিক্ততার সুর বেজে উঠেছে, তারই সুস্পষ্ট প্রভাব ও ইঙ্গিত এ কবিতায় বিধৃত হয়েছে। উদ্দীপকের কবিতাংশেও রয়েছে আকস্মিক বিচ্ছেদ-বেদনার করুণ হাহাকার। কেননা, কবি যাকে ভালোবেসেছিলেন। সে ছিল তাঁর জীবন-ছায়া, সে শুধু মায়াভরা স্মৃতি রেখে তঁার জীবন থেকে চিরদিনের জন্য হারিয়ে গেছে। তাঁর জীবন এখন ফাঁকা, তিনি এখন একাকী। সব সৌন্দর্যবোধ, সব কিছুর গুরুত্ব এখন ম্লান হয়ে গেছে। তাই অপরূপ প্রকৃতির রূপের প্রতি তাঁর কোনো আকর্ষণ নেই। কেননা, সমস্ত মন পড়ে আছে কেবল তাঁরই জন্য। কাজেই একথা বলা যায় যে, উদ্দীপকের প্রথম দুরচণে ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতার বিষণ্ণ বেদনার রিক্ততার সুর প্রকাশ পেয়েছে।

ঘ. “উদ্দীপকটি যেন ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতার মর্মবাণীকেই ধারণ করেছে” কথাটা যথার্থ ও যৌক্তিক। কেননা উদ্দীপক এবং ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতার মর্মবাণী একই।
➠ প্রিয়জন হারানোর বেদনা বড়ই মর্মান্তিক। যে প্রিয়জন কষ্ট-দুঃখে সমব্যথী, উৎসাহ-অনুপ্রেরণায় উদার, প্রেম-ভালোবাসায় অতুলনীয়, বন্ধুত্বে অনুপম, সেই প্রিয়জনকে কখনো বিস্মৃত হওয়া যায় না। তাঁকে হারিয়ে জীবন হয়ে যায় রিক্ত-শূন্য-মূল্যহীন।
➠ উদ্দীপকে এবং ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতায় প্রিয়জন হারানোর বিষণ্ণ বেদনার রিক্ততার হাহাকার ধ্বনিত হয়েছে। এটাই এ দুটোর মর্মবাণী বা মূলসুর। উদ্দীপকের কবিতাংশে কবি যাকে ভালোবেসেছিলেন, সে তাঁর জীবন থেকে চলে গেছে চিরদিনের মতো। শুধু রয়ে গেছে মায়াভরা স্মৃতি। অপরূপ প্রকৃতি সৌন্দর্য তাঁর ভালো লাগে না। রিক্ত শূন্য একাকী জীবনে তাঁর স্মৃতিটুকুই এখন সান্ত্বনা। একইভাবে ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতার কবি তাঁর স্বামী সৈয়দ নেহাল হোসেনকে হারিয়ে রিক্ত ও শূন্য হয়ে গেছেন। কেননা, তিনিই ছিলেন তাঁর সাহিত্য সাধনার প্রধান সহায়ক ও প্রেরণাদাতা। এর ফলে তাঁর সাহিত্য সাধনায়ও নেমে আসে এক দুঃসহ বিষণ্ণতা। কবিমন আচ্ছন্ন হয়ে যায় রিক্ততার করুণ হাহাকারে।
➠ উপরিউক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, উদ্দীকপটি ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতার মর্মবাণীকেই ধারণ করেছে।


‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতার সৃজনশীল প্রশ্ন- ২

নিচের উদ্দীপকটি পড়ো এবং প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও।
আর ক’দিন পরেই পহেলা বৈশাখ। পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে প্রতিবছরই কলেজে বৈশাখী উৎসব হয়। সকলে প্রস্তুতি গ্রহণে ব্যস্ত। কিন্তু শিখা কই? শিখাকে ছাড়া সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের কথা চিন্তা করা যায় না। গান, আবৃত্তি, অভিনয় সকল শাখায়ই তার এতটা দখল যে কলেজে তার দ্বিতীয়টি নেই। সকলে মিলে শিখাকে খুঁজতে লাগল। অনেক খোঁজাখুঁজি শেষে তাকে পাওয়া গেল, পুকুর পাড়ে। জলের পানে এক দৃষ্টিতে নীরবে চেয়ে আছে। সবাই গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল ওর উপর। “কীরে, তুই এখানে? আর আমরা তোকে সারা ক্যাম্পাস খুঁজে খুঁজে হয়রান!” শিখার চিন্তায় যেন বাধা পড়ল, “হ্যাঁ তোমরা? ও বৈশাখী উৎসব তাই না? থাক না এবার না হয় নাই যোগ দিই উৎসবে।” বন্ধুরা আর পীড়াপীড়ি করে না, ওরা জানে শিখা কেন এ কথা বলছে।

ক. ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতায় কোন ঋতুর কথা বলা হয়েছে?
খ. ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতায় প্রকৃতির কোন রূপ চিত্রিত হয়েছে?
গ. ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতার কবির অনুভূতির আলোকে শিখার বৈশাখী উৎসবে যোগ না দেয়ার কারণ উদঘাটন করো।
ঘ. ‘‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতা এবং উদ্দীপকের আলোকে বাইরের আনন্দ-উৎসবের সাথে মানুষের মনের অবস্থার সম্পর্ক নির্ণয় করো।

ক. ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতায় বসন্ত ঋতুর কথা বলা হয়েছে।
খ. ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতায় বসন্তের অপরূপ রূপ চিত্রিত হয়েছে।
➠ বসন্ত ঋতুর আগমনে প্রকৃতি জুড়ে নতুন রূপের পসরা বসেছে। পত্র-পুষ্প-মঞ্জুরিতে অপরূপ সাজে সজ্জিত হয়েছে সমগ্র প্রকৃতি। বাতাসের দিক বদলে গেছে। উত্তরের হিমেল বাতাস নয়, বরং এসেছে উদাসী, মৃদু-মন্দ দখিনা বাতাস, সাথে এনেছে পৃথিবীর সমস্ত সৌরভ। ফুলের বুকে ভ্রমরের গুঞ্জন, কাননে বাতাবি লেবু ফুলের সুবাস, কুঞ্জে-কুঞ্জে আম্র মঞ্জুরির সুগন্ধ প্রকৃতিকে করে তুলেছে উন্মাতাল। নানা ফুলে শোভিত বৃক্ষরাজি, আর মাধবীর বুকে উঁকি দেয়া সদ্যজাত কুঁড়ি সগৌরবে ঘোষণা করছে বসন্তের জয়ভেরি। ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতায় বসন্তের এমন রূপই চিত্রিত হয়েছে।

গ. ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতায় প্রকৃতির সৌন্দর্যময় রূপ প্রকাশিত হলেও সেটা মুখ্য হয়ে ওঠে নি। বরং কবির আপনজন হারানোর ফলে তার মনোবেদনাই এখানে প্রধান হয়ে উঠেছে।
➠ ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতার কবি প্রকৃতিতে বসন্ত আসলেও তার সাথে যোগ দিতে পারেন নি। কারণ, একরাশ বেদনার মেঘ ছড়িয়ে আছে তাঁর মনের আকাশে। সেখানে প্রকৃতির এই আনন্দ উৎসবের কোনো প্রভাব নেই। কবি অত্যন্ত বেদনাক্রান্ত তাঁর হারিয়ে যাওয়া প্রিয়জনের কথা মনে করে। এমন উৎসবের দিনে ঐ প্রিয়জন কাছে থাকলে হয়তো সবকিছু রঙিন মনে হতো। কিন্তু এখন পরিস্থিতি সম্পূর্ণই উল্টো।
➠ কবির মতো উদ্দীপকের শিখাও বৈশাখী উৎসবে যোগ দিচ্ছে না, কারণ তার মন ভালো নেই। প্রকৃতি, প্রতিবেশ উৎসবমুখর, কিন্তু তাঁর মন উদাস। সে প্রকৃতির এই উৎসবমুখর পরিবেশের সাথে একাত্ম হতে পারছে না। কারণ, তার মনও আজ বিরহ বেদনাকাতর। এই বেদনা ও দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে আনন্দে যোগ দিলে তা সফল হয় না। তাই ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতার কবির মতো উদ্দীপকের শিখাও উৎসবে যোগ দেবে না।

ঘ. বাইরের অবস্থার সাথে মানুষের মনের সরাসরি সম্পর্ক বিদ্যমান। প্রকৃতির বিরূপ প্রভাবে মানুষের মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হতে পারে।
➠ প্রকৃতির সাথে মানুষের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক রয়েছে। প্রকৃতির প্রভাব যেমন মানুষের উপর পড়ে, তেমনি মানুষের মনের প্রভাবও প্রকৃতিতে প্রতীয়মান হয়। প্রকৃতির আনন্দ মনে শিহরন জাগায়, আবার প্রকৃতির বিমর্ষতা মনকে দুঃখভারাক্রান্ত করে।
➠ মন ভালো থাকলে সবকিছু আনন্দময় মনে হয়। কিন্তু মন যখন প্রিয়জন হারানোর বেদনায় ভারাক্রান্ত, তখন প্রকৃতির অনেক কিছুই মনকে আর স্পর্শ করে না। বরং তা থেকে কেবল প্রকৃতির এই সুন্দর মুহূর্তে প্রিয়জন সান্নিধ্যে থাকতে পারলে কী আনন্দময় হয়ে উঠত মুহূর্তগুলো, সে ভাবনায় মন উদাস হয়। সুতরাং, বাইরের আনন্দ-উৎসব মানুষের মনকে প্রভাবিত করলেও মন দুঃখভারাক্রান্ত থাকলে সবকিছু বিষাদময় মনে হয়।
➠ ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতায়ও বাইরের আনন্দ উৎসবের সাথে মনের এমন সম্পর্কের ছবিই ফুটে ওঠেছে। এখানে দেখা যায়, কবির মন প্রিয়জন হারানোর বেদনায় আক্রান্ত বলে তিনি বসন্তের উৎসবে যোগ দিতে পারছেন না। বরং তা থেকে তার মনে দুঃখের বিলাপ। একই অবস্থা প্রকাশিত হয়েছে উদ্দীপকের শিখার মাধ্যমে।


‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতার সৃজনশীল প্রশ্ন- ৩

নিচের উদ্দীপকটি পড়ো এবং প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও।
অনিতা মাঝে মাঝে কবিতা লেখে। বিশেষ বিশেষ দিবসকে সামনে রেখে কবিতা লেখা তার নৈমিত্তিক কর্ম। কলেজের ম্যাগাজিনের প্রতি সংখ্যায় তার কবিতা থাকা চাই-ই-চাই। এবার বসন্ত উপলক্ষে সংখ্যা বের হবে, তাকে কবিতা লিখতে বলা হলো। কিন্তু কই, সেতো সেরকম আনন্দের কবিতা লিখতে পারছে না। অনিতা আনন্দের কবিতা, বসন্ত বরণের কবিতা লিখতে চাইছে, কিন্তু তার কলম দিয়ে বেরিয়ে আসছে দুঃখঝরা বাণী। মনের কোণে ব্যথা টনটনিয়ে ওঠে। দুঃখভারাক্রান্ত মনে চেয়ে রয় আকাশপানে। হয়তো প্রিয়জনের স্মৃতি বার বার ডাকছে তাকে।

ক. ‘মিনতি’ শব্দটির অর্থ ও বুৎপত্তি নির্দেশ করো।
খ. বসন্তের আগমনেও কবির পুষ্পসাজ নেই কেন?
গ. অনিতা কেন আনন্দের কবিতা লিখতে পারছে না? ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতার কবির অবস্থার সাপেক্ষে আলোচনা করো।
ঘ. “অলখের পাথার বাহিয়া তরী তার এসেছে কী? বেজেছে কি আগমনী গান?” ব্যাখ্যা করো।

ক. ‘মিনতি’ শব্দের অর্থ অনুরোধ। ‘মিনতি’ শব্দটি সংস্কৃত বিনতি এবং আরবি মিনত শব্দযোগে তৈরি হয়েছে।
খ. বসন্তের আগমনে সাধারণত মানুষের মন প্রফুল্ল থাকে। কিন্তু বসন্তের আগমনে কবি সুফিয়া কামালের মন বিষণ্ন। তাই বসন্তের আগমনে তার পুষ্পসাজ নেই।
➠ বসন্তে আগমনে কবির বর্ণাঢ্য সজ্জা থাকার কথা। কিন্তু নির্বিকার কবির সে রকম কোনো সজ্জা চোখে পড়ছে না। বরং কবির মনে রিক্ত, বিমর্ষ, পুষ্পহীন বিগত শীতের অবস্থান স্থায়ী হয়ে আছে। বসন্ত তো কবির একক বন্দনার অপেক্ষা করে নাই। সকলেই তার উৎসবে মুখরিত। কবি বরং উৎসবহীন শীতের প্রতিই ধ্যানমগ্ন থাকতে চান। বর্ণহীন, পুষ্পহীন, নিরাসক্ত শীত প্রকৃতপক্ষে কবির প্রয়াত স্বামীর প্রতি কবির অনুভূতির প্রতীক। স্বামী নেই, তাই প্রকৃতির সব সজ্জা কবির কাছে অর্থহীন মনে হয়। সুতরাং, বলা যায়, প্রয়াত স্বামীর স্মৃতি-কাতরতার জন্যেই কবির পুষ্পসাজ নেই।

গ. স্বজন বিয়োগে কোনো কালই মানুষের মনে আনন্দ দিতে পারে না। তাই কবি সুফিয়া কামাল ও অনিতা স্বজন বিয়োগে মনের আনন্দে কবিতা লিখতে পারছেন না।
➠ উপরের অনুচ্ছেদে দেখা যায়, সারাজীবন নানা উৎসব উপলক্ষে কবিতা লিখে আসলেও এবার বসন্ত উপলক্ষে কবিতা লিখতে পারছে না অনিতা। অনিতার কাছে সবার প্রত্যাশা সে যেন বসন্তকে বরণ করে একটা কবিতা লিখে। কিন্তু আনন্দের যেন অবসান হয়ে গেছে অনিতার জীবনে। তার মন বিষাদগ্রস্ত তাই সে আনন্দের কবিতা লিখতে পারছে না।
➠ ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতার কবির সাথে তুলনীয় অনিতার অবস্থা। এ কবিতার কবি তার প্রয়াত স্বামীর স্মৃতিতে আচ্ছন্ন। থেকে থেকে কেবল স্বামীকে হারানোর বেদনায় ভারাক্রান্ত তার মন। তাই ভক্তের বারংবার অনুরোধ সত্ত্বেও কবিতা লিখতে পারছেন না কবি। তার মনে হচ্ছে, প্রকৃতিকে বরণ করে নেবার মতো আনন্দ তার মনে নেই।
সুতরাং, ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতার কবির সাথে তুলনায় বলা যায়, কবি যেমন তার স্বামীকে হারানোর বেদনার আচ্ছন্নতা কাটিয়ে বসন্ত বরণের কবিতা লিখতে পারছেন না, তেমনি অনিতাও প্রিয়জন হারানোর কষ্ট ভুলে আনন্দের কবিতা রচনা করতে পারছে না।

ঘ. ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতার উল্লিখিত পঙ্ক্তিতে কবি মনের বিষণœতা প্রকাশ পেয়েছে।
➠ আলোচ্য অংশটুকুর শাব্দিক অর্থ হলো, কবি প্রশ্ন করছে, সকলের অলক্ষে সমুদ্র বেয়ে তার নৌকা এসেছে কিনা, আর তার জন্য আগমনী গান বেজেছে কিনা! এখানে বসন্তের আগমনের কথা বলা হয়েছে।
➠ প্রকৃতিতে বসন্ত এসেছে নিজস্ব নিয়মে, সাড়া জাগিয়ে নয়। কবির কাছে বসন্তের আগমন বার্তা ধরা পড়ে নি। তাই কবিভক্ত তার উন্মনার কারণ জিজ্ঞেস করলে কবি উদাস মনেই প্রশ্ন করে বসন্তের আগমন সম্পর্কে। প্রকৃতিতে বসন্ত এলেও সে বসন্ত কবির মনকে ছুঁতে পারে নি। তাই কবি আনমনা।
➠ উদ্দীপকেও আমরা দেখতে পাই, অনিতা বিশেষ বিশেষ দিবসকে সামনে রেখে কবিতা লিখত। কলেজের ম্যাগাজিনের প্রতি সংখ্যায় তার কবিতা বের হতো। কিন্তু বসন্ত উপলক্ষ্যে তাকে কবিতা লিখতে বললে সে কোনো আনন্দের কবিতা লিখতে পারছে না, কেবলই তার কলম দিয়ে ঝরে পরে দুঃখের বাণী। দুঃখ ভারাক্রান্ত মন চেয়ে থাকে আকাশ পানে। তার প্রিয়জনের স্মৃতি তাকে কাতর করে তুলে। আর এজন্যই প্রকৃতিতে বসন্ত এলেও তা অনিতার মনকে ছুঁতে পারেনি। তাই বলা যায়, অনিতা আর কবির বিয়োগ ব্যথা একই সুতোয় গাঁথা।


‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতার সৃজনশীল প্রশ্ন- ৪

নিচের উদ্দীপকটি পড়ো এবং প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও।
শুধু তাকে এবং তাকেই ভালোবেসেছিল আরতি। কিন্তু ছয়মাস হলো সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারায় সে। তার স্মৃতিগুলো কুড়ে কুড়ে খায় আরতিকে। এদিকে বাসা থেকে বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছে। ছেলে ভালো, দেখতে সুদর্শন, পেশায় ইঞ্জিনিয়ার। পরিবারের সকলে এ ছেলের সাথে তার বিয়ে ঠিক করেছে এবং সকলে চায় আরতি এর সাথে মাঝে মাঝে বেড়াতে যাক।
আজ পহেলা ফাল্গুন। তবু বর আদ্রির অনুরোধ ফেলতে পারে না আরতি। রাস্তায় বের হয়ে দেখে চারিদিকে কত উৎসব! কিন্তু আরতি পারছে না সহজ হতে। আদ্রির কাছে বিষয়টি ধরা পড়ল। সে বলল, “অভিমান করেছ? চুপ করে আছ কেন? এমন দিনে তুমি চুপ থাকলে পুরো বসন্তই যে বৃথা হয়ে যাবে।” আরতি মৃদু হেসে উত্তর দেয় “না, বৃথা যাবে কেন! গাছে গাছে ফুলতো ঠিকই ফুটেছে, বসন্তকে বরে নেয়ার জন্য চারদিকে কত আয়োজন। প্রকৃতি কারো জন্য অপেক্ষায় থাকে না, সে চলে নিজের গতিতে।”

ক. ‘পুষ্পারতি’ শব্দটির অর্থ কী?
খ. কবি অভিমান করেছেন কি-না এ প্রশ্ন করার কারণ কী?
গ. “প্রকৃতি কারো জন্য অপেক্ষায় থাকে না, সে চলে নিজের গতিতে”- ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতায় এ ভাবের কী দৃষ্টান্ত ফুটে ওঠেছে?
ঘ. ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতায় প্রকৃতির সৌন্দর্য ও কবির মনের অবস্থার মধ্যে কোনটি প্রধান হয়ে উঠেছে বলে তুমি মনে করো?

ক. ‘পুষ্পারতি’ শব্দটির অর্থ হলো ফুলের বন্দনা বা নিবেদন।
খ. কবি বসন্ত উপলক্ষে কোনো কবিতা না লেখার কারণে তাকে এ প্রশ্ন করা হয়েছে।
➠ ঋতুরাজ বসন্তের আগমনে স্বভাবসিদ্ধ কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন না কবি। নেই তার পুষ্পসাজ কিংবা রচনা করছেন না কোনো কবিতা। বসন্তের প্রতি কবির ঔদাসীন্যের কারণ জিজ্ঞেস করলে কবি উত্তরে বলেন যে, প্রকৃতিতে বসন্তের আগমন তার বন্দনাগীত রচনার অপেক্ষা করে নি। তিনি বন্দনাগীত রচনা না করলেও ইতোমধ্যে প্রকৃতিতে বসন্তের আগমন ঘটেছে এবং যথানিয়মেই ঘটেছে। বসন্তকে ফাল্গুন গাছে গাছে ফুল ফুটিয়ে, পুষ্পমুকুলের গন্ধে বাতাস মুখরিত করে বরণ করে নিয়েছে। কবিমনের দুঃখের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে বসন্ত তার আগমনকে বিলম্বিত করে নি, যথানিয়মে সে এসেছে। তাই কবি নির্লিপ্ত থাকলেও তাতে বসন্তের কিছু আসে-যায় না। বসন্তের এই উদাসীনতা কবিকে আহত করেছে কি-না এখন সে প্রশ্নই দেখা দিয়েছে। না-হলে তিনি হয়তো বসন্তকে বরণ করে কোনো কবিতা লিখতেন।

গ. বসন্তে কবিমন বিষণ্ন। তাই সে কোনো কবিতা লিখে নি। কিন্তু প্রকৃতি তার আপন গতিতে চলে। উদ্দীপকে উল্লিখিত লাইনে প্রকৃতির সে ধর্মের কথা বলা হয়েছে।
➠ সময় কারো জন্য অপেক্ষা করে না। সে তার গতিতে বয়ে যায়। প্রকৃতির নিয়ম মেনে শীতের পরে বসন্ত আসে। তাতে কার মনে কী অনুভূতি হলো সেটা বিবেচ্য নয়। কেউ কেউ হয়তো কোনো দুঃসহ স্মৃতির কারণে প্রকৃতির এই পরিবর্তনের সাথে খাপ খাওয়াতে পারে না। কিন্তু তাতে প্রকৃতির কিছু আসে-যায় না। প্রকৃতির চলার স্বতন্ত্র পথ রয়েছে। প্রকৃতি সেই পথে চলে, সেই নিয়মে আবর্তিত হয়। শত বাধা দিলেও প্রকৃতি শুনবে না। কারো কোনো মান অভিমান প্রকৃতির কাছে বিবেচ্য নয়।
➠ এই ভাবটির বেশ কিছু দৃষ্টান্ত ফুটে ওঠেছে ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতায়। এখানে দেখা যায় কবি বসন্তের আগমনে কোনো পুলক অনুভব করছেন না, বসন্তকে বরণ করে নেয়ার জন্য তার কোনো প্রস্তুতি নেই। কিন্তু নানা পুষ্প, পত্রে, মঞ্জুরীতে প্রকৃতি ঠিকই বরণ করে নিয়েছে বসন্তকে। কবির মন শীতের শোক ভুলতে না পারলেও প্রকৃতি ঠিকই শীতকে ভুলে বসন্তকে বরণ করে নিয়েছে। সুতরাং, বলা যায়, প্রকৃতি কারো জন্য অপেক্ষায় থাকে না, সে চলে নিজের গতিতে।

ঘ.‘তাহাড়েই পড়ে মনে’ কবিতায় কবির মনের বিষণ্নতাই প্রধান হয়ে উঠেছে।
➠ প্রকৃতিতে ঋতুরাজ বসন্তের আগমনের আগেই কবির প্রিয়তম স্বামী চলে গেছে অনন্ত পারাপারে, পুষ্পশূন্য দিগন্তের পথে। ফলে প্রকৃতিতে বসন্তের আবির্ভাবের পূর্বেই কবির মনকে গ্রাস করছে শীতের স্থায়ী রিক্ততা। তাই বসন্তের সাড়ম্বর আবির্ভাব কবিকে ভাবোচ্ছ্বাসে আপ্লুত করতে পারে নি।
➠ বসন্ত এসেছে ঠিকই, কিন্তু মাঘের পুষ্পশূন্য রিক্ততার কথা কবি আদৌ ভুলতে পারেন নি। প্রকৃতপক্ষে শীতের নিঃস্বতার মাঝে কবি তার নিঃসঙ্গ জীবনের সাদৃশ্য খুঁজে পেয়েছেন।
➠ কুহেলি উত্তরী তলে চলে যাওয়া মাঘের বিষণ্নতা আর অনন্ত পরপারে চলে যাওয়া তার প্রিয়জনের বিয়োগব্যথা একই সুতোয় গাঁথা। তাইতো তিনি শীতকে মাঘের সন্ন্যাসী বলেছেন। মাঘের সন্ন্যাসীরূপী শীতের অপসৃয়মান মূর্তিটি কবির ভাষাকে স্তব্ধ করেছে, তাঁকে করেছে রক্তাক্ত। কবির এই হাহাকারের পাশাপাশি প্রকৃতিতে বসন্ত আগমনকালের সৌন্দর্য-বর্ণনা বিবেচনা করলে কবির হাহাকার বেশি করে আঘাত করে পাঠক হৃদয়ে। প্রকৃতির বসন্ত-সজ্জার আনন্দ নয়, বরং কবির রিক্ততাই পাঠক হৃদয়কে অধিক আপ্লুত করে। তাই বলা যায়, আলোচ্য কবিতায় বসন্ত প্রকৃতির সৌন্দর্যের চেয়ে কবির মনের রিক্ত হাহাকারই প্রধান হয়ে উঠেছে।


‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতার সৃজনশীল প্রশ্ন- ৫

নিচের উদ্দীপকটি পড়ো এবং প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও।
সৃষ্টির বিয়ে হয়েছে পাঁচদিন হলো। এটা তার দ্বিতীয় বিয়ে। প্রথম যেবার বিয়ে করেছিল তখন ছিল শীতকাল। এখন বর্ষাকাল। আকাশে মেঘ। সৃষ্টি তাকিয়ে আছে জানালার বাইরে, দৃষ্টি তার কোথায় নিবন্ধ জানে না। তার স্বামী এসে পাশে দাঁড়ায়। এমন সময় বৃষ্টি ঝরতে থাকে। স্বামী আনন্দে চিৎকার করে, “দেখো কী সুন্দর বৃষ্টি!” সৃষ্টি প্রত্যুত্তরে শুধু মৃদু হাসে। আরোও জোরে বৃষ্টি নামে। স্বামী হাত ধরে টানে, চলো ভিজি দুজনে। কিন্তু সৃষ্টি নীরব, নিথর। স্বামী তার ভাবটি বুঝতে পেরে বলে, “সৃষ্টি, তোমার এই উপেক্ষা আর আমার সহ্য হচ্ছে না। আমায় ব্যথা দিয়ে কী সুখ তুমি পাও?” সৃষ্টি আর থাকতে পারে না। স্বামীর কাছে হাত জোড় করে বলে, “ওগো, আমি যে কিছুতেই ভুলতে পারছি না, শুধু তাহারেই পড়ে মনে।”

ক. ‘উত্তরী’ শব্দের অর্থ কী?
খ. কবি কাকে কেন মাঘের সন্ন্যাসী বলেছেন?
গ. “তাহারেই পড়ে মনে”- উক্তিটি কবির সাথে কীভাবে অনুচ্ছেদের সৃষ্টিকে তুলনীয় করে তুলেছে?
ঘ. প্রিয়জনের বিরহে মানুষ শূন্যতা অনুভব করে কেন? ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতার আলোকে আলোচনা কর।

ক. ‘উত্তরী’ শব্দটি উত্তরীয় শব্দের সংক্ষিপ্ত রূপ। ‘উত্তরীয়’ অর্থ চাদর।
খ. ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতায় কবি সুফিয়া কামাল শীত ঋতুকে মাঘের সন্ন্যাসী বলেছেন।
➠ ষড়ঋতুর এই দেশে পৌষ মাঘ এ দু’মাস শীতকাল। মাঘের শেষ দিকে শীতের বিদায় ঘণ্টা বেজে ওঠে। এ সময় প্রকৃতি কুয়াশার চাদর জড়িয়ে শীতের তীব্রতায় মুছড়ে পড়ে। গাছপালা পাতাশূন্য হয়ে পড়লে প্রকৃতিকে সংসার ত্যাগী সন্ন্যাসীর মতো মনে হয়। প্রকৃত সন্ন্যাসীর যেমন রিক্ততা, নিঃস্বতা, ধন-সম্পদ হীনতার অবস্থা থাকে, তেমনি শীতকালের প্রকৃতিও রিক্ত, নিঃস্ব এবং আবরণহীন। প্রকৃতির এই অলংকারবিহীন রূপের কারণেই কবি শীতকে মাঘের সন্ন্যাসী বলেছেন।

গ. কবি জীবনের প্রাণপুরুষের বিয়োগের প্রেক্ষাপটে যেভাবে কবিতাটি লিখেছেন ঠিক সেভাবেই অনুচ্ছেদের সৃষ্টির জীবনের প্রথম স্বামী বিদায়ের বিরহ ফুটে উঠেছে।
➠ কবি তাঁর প্রয়াত প্রিয়জনকে ভুলতে পারছেন না। কবির ব্যক্তিজীবনে সাহিত্য সাধনার প্রধান সহায়ক ও উৎসাহদাতা স্বামী সৈয়দ নেহাল হোসেনের আকস্মিক মৃত্যুতে কবির জীবনে প্রচণ্ড শূন্যতা নেমে আসে। তার ব্যক্তিজীবন ও কাব্যসাধনার ক্ষেত্রে নেমে আসে এক দুঃসহ বিষণœতা। কবিমন আচ্ছন্ন হয়ে যায় রিক্ততার হাহাকারে। কবি কিছুতেই ভুলতে পারছেন না তাকে। এই হাহাকারই ফুটে ওঠেছে ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতার প্রতিটি পঙ্ক্তিতে।
➠ ঠিক একই ধরনের অনুভূতি উপরের অনুচ্ছেদের সৃষ্টিকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। বর্ষার প্রেমাতাল প্রকৃতির টান আর তার দ্বিতীয় স্বামীর আহ্বানও তাকে উদ্বেলিত করতে পারছে না। মেঘাচ্ছন্ন আকাশের দিকে তাকিয়ে তার কেবলই মনে পড়ে মৃত প্রথম স্বামীর কথা। সে বৃষ্টিকে তার কেবলই হৃদয়ের কান্না মনে হয়। তার কাছে প্রেমসিক্ত প্রকৃতির কোনো আবেদন নেই। ভীষণ শূন্যতায় তার হৃদয়টা যেন পূর্ণ হয়ে আছে। সুতরাং, বলা যায়, ‘তাহারেই পড়ে মনে’- উক্তিটি কবির অনুভূতিকে অনুচ্ছেদের সৃষ্টির অনুভূতির সাথে একাত্ম করে তুলেছে।

ঘ. মানুষ একা বাস করতে পারে না। বেঁচে থাকতে হলে কাউকে না কাউকে সুখ-দুঃখের সাথী করে নিতে হয়। দীর্ঘদিন বসবাসে সেই সঙ্গীটি অনেক সময় মানুষের সত্তার সাথে মিশে যায়। তাই যখন সঙ্গীটি হারিয়ে যায় বা ছেড়ে চলে যায়, তখন মানুষ আপন সত্তাকে পূর্ণাঙ্গভাবে অনুভব করে না তাই তার মধ্যে দেখা দেয় শূন্যতা। নিজেকে অসম্পূর্ণ মনে হয় তার।
➠ কোনো মানুষের সাথে দীর্ঘদিন বসবাসের ফলে পরস্পরের মধ্যে গড়ে উঠে মধুর সম্পর্ক। আর সে সম্পর্ক যদি হয় স্বামী-স্ত্রীর, তাহলে তা কখনই ভোলা যায় না। তাই কোনো স্বামী যদি তার স্ত্রীকে ছেড়ে পরোলোক গমন করে তাহলে তার স্ত্রীকে চরম শূন্যতায় ভুগতে হয়। কবির ক্ষেত্রে ঠিক তাই হয়েছে।
➠ ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতায় কবি তার প্রথম স্বামীকে কোনো ভাবেই মন থেকে মুছে ফেলতে পারছেন না। কবির কবিতা লেখার উৎসাহদাতা, সুখ-দুঃখের সার্বক্ষণিক সঙ্গীর স্মৃতিগুলো কবিকে বার বার ডাকছে। প্রেরণাদায়ী স্বামীর অকাল মৃত্যুতে কবির জীবনে নেমে এসেছে প্রচণ্ড শূন্যতা। তাই প্রকৃতি জুড়ে বসন্ত উৎসব শুরু হলেও কবি সে উৎসবে শামিল হতে পারছেন না। বসন্তের আগমনকে নিশ্চিত করতেই বিদায় নিতে হয়েছে শীত ঋতুকে। শীতের এই রিক্ত ও নিঃস্ব বিদায়ের সঙ্গে কবি তার প্রিয়তমের বিদায়ের এক গভীর তাৎপর্য ও মিল খুঁজে পেয়েছেন। তাই তার মন জুড়ে কেবল শীতের রিক্ততা ও বিষণ্নতার ছবি।
➠ সুতরাং, প্রিয়জনের মৃত্যুবিরহে কবি পরম শূন্যতা অনুভব করছেন। প্রকৃতিতে বসন্ত, আনন্দ-উৎসব বহমান কিন্তু কবির মন শূন্যতায় পূর্ণ। প্রিয়জনের বিরহে সবকিছু তার কাছে শূন্য মনে হচ্ছে।


‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতার সৃজনশীল প্রশ্ন- ৬

নিচের ছবিটি দেখো এবং প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও।

তাজমহল

ক. ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতাটির প্রকাশকাল কত?
খ. ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতাটির ছন্দবৈশিষ্ট্য লেখো।
গ. অনুচ্ছেদে ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতার কোনো ভাবটিকে অবলম্বন করা হয়েছে?
ঘ. “তাহারেই পড়ে মনে ভুলিতে পারি না কোনো মতে”- পঙক্তিটির আলোকে উপরের চিত্রকল্পের তাৎপর্য বিশ্লেষণ করো।

ক. সুফিয়া কামাল রচিত ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতাটি ১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দে ‘মাসিক মোহাম্মদী’ পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয়।
খ. বাংলা ভাষার অন্যতম প্রধান মহিলা কবি বেগম সুফিয়া কামাল রচিত ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতাটি অক্ষরবৃত্ত ছন্দে রচিত।
➠ এ কবিতায় ৮ ও ১০ মাত্রার পর্ব লক্ষ্য করা যায়। তবে স্তবক বিন্যাসে কিছুটা বৈচিত্র্য লক্ষ করা যায়। অক্ষরবৃত্ত ছন্দরীতি অনুযায়ী কবিতায় সুললিত ছন্দ ও মার্ধুযতার ছাপ রয়েছে।

গ. কবি সুফিয়া কামাল রচিত ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতায় প্রকাশিত ভালোবাসার অনুভবের সাথে মিল আছে উদ্দীপকের চিত্রকল্পের।
➠ ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতায় প্রিয় হারানোর বেদনার যে সুর ধ্বনিত হয়েছে, ভালোবাসার যে প্রগাঢ়তা প্রকাশ পেয়েছে তার সাথে সম্পর্ক আছে উদ্দীপকের। উদ্দীপকে তাজমহলের ছবির মধ্য দিয়ে সম্রাট শাহজাহানের প্রয়াত প্রিয়তমার প্রতি ভালোবাসা এবং স্মৃতিকাতরতা প্রকাশ পেয়েছে।
➠ ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতায়ও আমরা কবির তার প্রয়াত স্বামীর প্রতি গভীর প্রেম এবং স্মৃতিকাতরতা লক্ষ করি। প্রকৃতিতে বসন্ত এসেছে, বসন্ত বরণ করে নিতে চারিদিকে সাজসাজ রব কিন্তু কবি যোগ দিতে পারছেন না সেই উৎসবে। তার হৃদয়ের সমগ্রটা জুড়ে প্রয়াত স্বামীর জন্য শোক। তাঁর সাহিত্য সাধনার প্রধান সহায়ক ও উৎসাহদাতা স্বামী সৈয়দ নেহাল হোসেনের আকস্মিক মৃত্যুতে কবির জীবনে প্রচণ্ড শূন্যতা নেমে আসে। তাঁর ব্যক্তিজীবন ও কাব্য সাধনার ক্ষেত্রে নেমে আসে এক দুঃসহ বিষণœতা। কবির মন আচ্ছন্ন হয়ে যায় রিক্ততার হাহাকারে। ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতাকে আচ্ছন্ন করে আছে সেই বিষাদমর রিক্ততার সুর। এ রিক্ততা যেন তাজমহলের স্রষ্টা সম্রাট শাহজাহানের হৃদয়ের রিক্ততা। উভয়ই একীভূত হয়ে আছে প্রিয়জন হারানোর বেদনায়।

ঘ. ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতার উল্লিখিত উক্তিতে প্রিয়জন হারানোর যে বেদনা ও শূন্যতাবোধ ফুটে উঠেছে তা-ই এ কবিতার মূলসুর।
➠ বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মহিলা কবি সুফিয়া কামাল রচিত এ কবিতায় কবির ভালোবাসার অনুভূতির মাঝে প্রকৃতি ও জীবনের আর সব আয়োজন যেন অর্থহীন হয়ে গেছে।
➠ ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতায় ব্যক্তি কবির প্রিয়জনের প্রতি স্মৃতিকাতরতা প্রকাশ পেয়েছে। তাই প্রকৃতিতে বসন্ত এলেও কবির মন জুড়ে আছে শীতের রিক্ততা আর বিষণ্নতা। কবির হৃদয় দুঃখে ভারাক্রান্ত তাঁর কণ্ঠ নীরব। শীতের করুণ বিদায়কে তিনি কিছুতেই ভুলতে পারছেন না। তাই বসন্ত তার মনে কোনো সাড়া জাগাতে পারছে না। বসন্তের সৌন্দর্য তার মনে কোনো আবেদন জাগাতে পারছে না। কবি তার প্রিয়জন হারানোর বেদনাকে কিছুতেই মুছে দিতে পারছেন না হৃদয় থেকে। বার বার তাকে তাড়িত করছে সেই স্মৃতি। কবি তাই উদাস। কবিভক্ত তাই আজ বসন্তের আনন্দ উৎসবে যোগ দিতে বললেও মনোব্যথা প্রকৃতির প্রতিকূলে। হৃদয়ের দুঃখভারাকে তাই প্রকাশ করেছেন এই বাণীর মধ্য দিয়ে “তাহারেই পড়ে মনে, ভুলিতে পারি না কোনো মতে।”
➠ ঠিক একই বিষয় প্রকাশিত হয়েছে তাজমহল গড়ার পেছনেও। সম্রাট শাহজাহান প্রিয়তমা পত্মীর বিয়োগ ব্যথায় কাতর হয়ে তার স্মৃতিকে হৃদয়ে অমলিন করে রাখার জন্য গড়ে তুলেছিলেন তাজমহল। যমুনার তীরে গড়ে ওঠা এ সমাধিসৌধ তাজমহলের অস্তিত্ব প্রতিনিয়ত তার স্ত্রীর কথা স্মরণ করিয়ে দিতো সম্রাটকে। এক মুহূর্তের জন্যও তিনি বিস্মৃত হতে পারতেন না প্রিয়তমা স্ত্রীকে। তাজমহল প্রতীকের মধ্যে শাহজাহানের এ মনোভাব আর ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতায় কবির মনোভাবের মধ্যে এ স্মৃতিকাতর দিকটি সবিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।


‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতার সৃজনশীল প্রশ্ন- ৭:

নিচের উদ্দীপকটি পড়ো এবং প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও।
কেতকীর ক্ঞ্জুবনে গুঞ্জরিল মধুপের গান।
.....................
হেমন্ত ফুটাতে চাহি হাসি শীর্ণ কেতকীর মুখে
চমকি ফিরিয়া এল বিস্ময়ে সে ব্যথাভরা বুকে,
এত দুঃখভার
কোন দানে মুছাবে সে এ ব্যথিতা মূর্ছিতা কেয়ার।
গন্ধে হলো ভারাক্রান্ত সে নিশীতে কেয়া কুন্তবনে,
রূপগন্ধ বিকশিত। ব্যথা তার রহিল গোপন।

ক. ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতায় কী কী ফুলের উল্লেখ আছে?
খ. ‘অর্ঘ্য বিরচন’ কথাটি দ্বারা কবি কী বুঝিয়েছেন?
গ. অনুচ্ছেদের ‘হেমন্ত ফুটাতে চাহি’-অংশটুকুর সাথে ‘ফাগুন যে এসেছে ধরায়’ অংশটুকুর তুলনা কর।
ঘ. “অনুচ্ছেদটিতে ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতার ভাববস্তু পরিস্ফুটিত হয়েছে”- মন্তব্যটির পক্ষে/বিপক্ষে তোমার অবস্থান তুলে ধর।

 ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতায় বাতাবি লেবুর ফুল, আমের মুকুল, মাধবী কুঁড়ির উল্লেখ রয়েছে, এর সবগুলোই বসন্তের ফুল।
 “অর্ঘ্য” অর্থ হচ্ছে অঞ্জলি বা উপহার আর “বিরচন” শব্দটির অর্থ হলো রচনা করা।
 প্রকৃতি বিচিত্র সাজে সজ্জিত হয়ে ফুল ও তার সৌরভ উপহার দিয়ে বসন্তকে বরণ করে নেয়। কেউ স্মরণ করুক বা না করুক প্রকৃতি ঠিকই আপন রীতিতে বরণ করে নেয় বসন্তকে। এ বিষয়টিই প্রকাশিত হয়েছে অর্ঘ্য বিরচন কথাটির মধ্য দিয়ে।

 কবি বেগম সুফিয়া কামাল রচিত ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতায় ‘ফাগুন যে এসেছে ধরায়’ কথাটির মধ্যে বসন্তের যে সৌন্দর্য সমৃদ্ধির আভাস রয়েছে তার সাথে ভাবগত মিল আছে অনুচ্ছেদের ‘হেমন্ত ফুটাতে চাহি’-অংশটুকুর।
 অনুচ্ছেদটিতে প্রকৃতির আনন্দমুখর সত্তার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। হেমন্ত প্রকৃতির এক শস্যনির্ভর বর্ণিল আবর্তন। ‘হেমন্ত ফুটাতে চাহি’ কথাটি কর্তৃক প্রকৃতির আনন্দ ঘন পরিবেশের বার্তা অভিব্যক্ত। হেমন্তের আগমনে এক শস্য সমৃদ্ধ সময়ের আগমনবার্তা ধ্বনিত হয়। ঘরে ঘরে আনন্দ উপলক্ষ নিয়ে আসে হেমন্ত।
 হেমন্তের সমৃদ্ধ আভাসের মতো ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতায়ও “ফাগুন যে এসেছে ধরায়” কথাটির কর্তৃক প্রকৃতির উৎসবমুখর ক্ষণকে নির্দেশ করা হয়েছে। চারদিকে ফাগুনের আগমনে সাজসাজ রব। প্রকৃতি যেন নানা অর্ঘ্যে অভিনন্দন জানাচ্ছে বসন্তকে। ফাগুনের পরশে যেন প্রকৃতি হয়ে উঠেছে সমৃদ্ধির প্রতিচ্ছবি। সুতরাং, বলা যায় অনুচ্ছেদের ‘হেমন্ত ফুটাতে চাহি’ আর কবিতার ‘ফাগুন যে এসেছে ধরায়’ একই সুরে গাঁথা।

 ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতায় কবির প্রিয় হারানোর বেদনার সাথে অনুচ্ছেদের উল্লিখিত কবিতাংশের বেদনার সুরটি যেন একই ভাব থেকে উৎসারিত।
 ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতায় কবি সুফিয়া কামালের ব্যক্তিগত দুঃখ যেন সমস্ত পাঠকের প্রিয় হারানোর বেদনায় রূপান্তরিত হয়েছে। প্রকৃতির উৎসবের মাঝে নিজের একান্ত দুঃখ চর্চা করলেও কবি যেন সমস্ত মানবসত্তাকেই ছুঁয়ে গেছে। উপরের অনুচ্ছেদেও তাই। প্রিয় হারানোর বেদনা প্রকাশে অনুচ্ছেদ আর ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতাটি যেন একই ভাবাপন্ন।
 অনুচ্ছেদে লক্ষণীয় কেতকী অর্থাৎ কেয়ার দুঃখ ভারাক্রান্ত মন। প্রকৃতির আনন্দমুখর পরিবেশে কেতকী বিষণœ, তার হৃদয় শোকাচ্ছন্ন। কোনো গোপন ব্যথা লুকানো তার মনের গহীনে। তাই সে আনন্দময় প্রকৃতিতে সাবলীলভাবে অংশগ্রহণ করতে পারছে না। থেকে থেকে বেজে উঠছে তার ব্যথার বীণা।
 ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতায় লক্ষ করা যায়, ব্যক্তি কবি শোকে মুহ্যমান। প্রকৃতির কোনো আয়োজনই তাঁকে আলোড়িত করতে পারছে না। কবিভক্তের শত অনুরোধেও তিনি কবিতা রচনায় আত্মনিয়োগ করতে পারছেন না। বাইরের প্রকৃতি যতই বর্ণিল হোক না কেন প্রকৃতির বিষাদ স্মৃতি তাকে ঘিরে রয়েছে। এক্ষেত্রেও যেন “ব্যথা তার রহিল গোপন।” সুতরাং বলা যায়, অনুচ্ছেদের সাথে ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতার ভাববস্তুগত গভীর মিল রয়েছে।


‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতার সৃজনশীল প্রশ্ন- ৮:

নিচের উদ্দীপকটি পড়ো এবং প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও।
অনন্যার বয়স পাঁচ বছর। সে ধনীর ঘরের একমাত্র আদুরে কন্যা। পাশের বাড়ির অর্নব তার খেলার সাথী। কিন্তু অনন্যার বাবার তাতে ঘোর আপত্তি। অর্নবের মতো দরিদ্রশ্রেণির বাচ্চাদের সাথে মেলামেশা করবে কেন তার মেয়ে? অনন্যার বাবা তাই তাকে অর্নবদের বাসায় যেতে, নিষেধ করে দেন। অনন্যার তাই মন খারাপ। বাবা মন ভালো করার জন্য অনেক দামি দামি খেলনা এনে দেন, উৎসবের আয়োজন করেন কিন্তু অনন্যার মন খারাপ ভালো হলো না।

ক. “বসন্তরে আনিতে বরিয়া” এখানে ‘বরিয়া’ শব্দটির চলিত রূপ কী।
খ. “হে কবি, নীরব কেন?” এখানে কবি ‘নীরব কেন’ বলতে কী বুঝানো হয়েছে?
গ. অনুচ্ছেদের অনন্যার সাথে কবিমনের তুলনা কর।
ঘ. অনুচ্ছেদটিতে ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতার ভাববস্তু প্রতিফলিত মন্তব্যটি কতটুকু যুক্তিযুক্ত আলোচনা কর।

ক. ‘বরিয়া’ শব্দটির চলিত রূপ হলো ‘বরণ করে’।
খ. ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতাটি কবি সুফিয়া কামালের স্মৃতিচারণমূলক একটি কবিতা।
➠ ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতায় শুরুতেই কবিভক্ত কবিকে প্রশ্ন করছেন, কবি নীরব কেন, “ফাগুন যে এসেছে ধরায়।” কবির নীরবতা এখানে উদাসীনতাকে ইঙ্গিত করছে। কবি কেন কাব্য এবং গান রচনায় সক্রিয় হচ্ছেন না সেটাই প্রশ্ন রাখা হয়েছে।

গ. কবি সুফিয়া কামাল বিরচিত ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতাটি তাঁর স্মৃতিচারণমূলক একটি শোকগাঁথা।
➠ প্রিয়জন হারানো শোকার্ত মনে জাগতিক কোনো কিছুই প্রশান্তি এনে দিতে পারে না। এ কবিতায় কবিমনের উপলব্ধিতে তাই প্রকাশিত হয়েছে।
➠ অনুচ্ছেদের পাঁচ বছরের অনন্যা নামের মেয়েটির সখ্যতা গড়ে উঠেছিল পাশের বাড়ি অর্নবের সাথে। কিন্তু সামাজিক অবস্থানে সমান না হওয়ায় অনন্যার বাবা তাকে অর্নবের সাথে মিশতে নিষেধ করে দেয়। স্বাভাবিকভাবেই অনন্যার মন দুঃখভারাক্রান্ত হয়ে পড়ে। বাবা তাকে অনেক খেলনাদি এনে দিলেও তার মন পড়ে রয় অতীতের স্মৃতিতে। ঠিক ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতায় কবিমনের মতো। কবিমনও বসন্তের আগমনে জেগে উঠতে পারে নি। যোগ দিতে পারে নি উৎসব আনন্দে। তার সমগ্র মন প্রিয়জন হারানোর বেদনায় আচ্ছন্ন। এখানে অনন্যা এবং কবিমনের অবস্থা একই সুরে গাঁথা।

ঘ. ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতাটি কবি সুফিয়া কামালের ব্যক্তিজীবনের দুঃখ বেদনার একটি রূপালেখ্য।
➠ কবি সুফিয়া কামাল ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতায় বসন্তের আগমন লগ্নে দুঃখভারাক্রান্ত মন নিয়ে অতীত হয়ে যাওয়া শীতের স্মৃতিচারণ করেছেন। মানুষের মন সাধারণত প্রগতিশীল। অর্থাৎ সামনের দিকে ধাবিত হয়। কিন্তু কবির বেলায় তার ব্যতিক্রম ঘটে। অনুভূতিশীল কবিহৃদয় অতীতের শোকস্মৃতি ভুলতে পারে না কিছুতেই।
➠ ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতায় প্রকৃতি ও মানবমনের সম্পর্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক তাৎপর্যকর অভিব্যক্তি পেয়েছে। সাধারণভাবে প্রকৃতির সৌন্দর্য মানবমনের অফুরন্ত উৎস। বসন্ত প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য যে মনে আনন্দ শিহরণ জাগাবে তথা তিনি তাকে ছন্দে ফুলে ফুটিয়ে তুলবেন সেটাই প্রত্যাশিত। কিন্তু কবিমন যদি কোনো কারণে শোকাচ্ছন্ন কিংবা বেদনা-ভারাতুর থাকে তবে বসন্ত তার সমস্ত সৌন্দর্য সত্ত্বেও কবির অন্তরকে স্পর্শ করতে পারে না। কবিমন সত্যিই প্রিয়জন হারানোর বেদনায় আচ্ছন্ন। তাই তাকে কোনো আনন্দই স্পর্শ করতে পারছে না ঠিক যেন অনুচ্ছেদের অনন্যার ছোট্ট হৃদয়ের মতো। তার পিতা তার জন্য আনন্দ উৎসবের আয়োজন করলেও সে উৎফুল্লিত নয়, তার ছোট্ট হৃদয় জুড়ে রয়েছে খেলার সঙ্গী হারানোর বেদনায় আচ্ছন্ন।
➠ সুতরাং অনুচ্ছেদটিতে কবিতার ভাববস্তুর পূর্ণ প্রতিফলন ঘটেছে বলা যায়। এ কবিতায় কবির ব্যক্তিজীবনের দুঃখময় বিষয়বস্তুর বেদনাঘন উপস্থাপন রীতির মাধ্যমে গীতিময়তা প্রধান্য পেয়েছে।


‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতার সৃজনশীল প্রশ্ন- ৯:

নিচের উদ্দীপকটি পড়ো এবং প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও।
বউটার খবর? ওর কথা বলো না আর। রাহাত মুখ বাঁকাল। অন্য আর এক জায়গায় বিয়ে করেছে। সে কি! এর মধ্যে বিয়ে করে ফেলল মেয়েটা? তপু ওকে কত ভালোবাসতো। নাজিম বিড়বিড় করে বলে উঠল চাপা স্বরে। সানু বলল, “বিয়ে করবে না তো কি সারা জীবন বিধবা হয়ে থাকবে না কি মেয়েটা।” ক. ‘সমীর’ শব্দটির অর্থ কী?
খ. ‘পুষ্পশূন্য দিগন্তের পথে’ কথাটি দ্বারা কবি কী বুঝিয়েছেন?
গ. অনুচ্ছেদের ‘বউ’ -এর সাথে ব্যক্তিকবির সাদৃশ্যবৈসাদৃশ্য দেখাও।
ঘ. ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতায় কবির কার কথা মনে পড়েছে? এবং কেন মনে পড়েছে? এ কবিতায় কবির ব্যক্তিজীবনের ছায়াপাত ঘটেছে কি? আলোচনা কর।

ক. ‘সমীর’ শব্দটির অর্থ হলো বাতাস।
খ. ‘পুষ্পশূন্য দিগন্তের পথে’ কথাটি কবি সুফিয়া কামাল রচিত ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতা থেকে নেয়া হয়েছে।
➠ কবি উল্লিখিত চরণের মাধ্যমে শীতের বিদায়কে ভাবমণ্ডিত করে উপস্থাপন করেছেন। শীতে প্রকৃতি রিক্ততার রূপ নেয়। গাছের পাতা ঝরে পড়ে। গাছ হয় পুষ্পশূন্য। বসন্তের বিপরীতে শীতের এ রূপকে কবি উপস্থাপন করেছেন। কবি বুঝিয়েছেন, সর্বাধিক সন্ন্যাসীর মতো কুয়াশার চাদর পড়ে পত্রপুষ্পহীন দিগন্তের পথে চলে গেছে শীত। ঠিক যেভাবে চলে গেছে কবির প্রাণপ্রিয় স্বামী নীরবে, নিভৃতে।

গ. অনুচ্ছেদ তপুর বউ সম্পর্কে বলা হয়েছে।
➠ তপু মারা যাওয়ার কিছুকাল পর বউটা অন্যত্র বিয়ে করে। এটা যেন তপুর বন্ধুরা সহজে মেনে নিতে পারছে না।
➠ তপুর বন্ধুদের কাছে তপুর বউকে পাষাণ হৃদয়ধারী বলে অনুভূত হয়। তাদের প্রশ্ন ভালোবাসার মানুষটির মৃত্যুর কিছু দিনের মধ্যে কিভাবে সে অন্যের সাথে ঘর বাঁধতে পারে। তপুর ভালোবাসার স্মৃতিকে তাকে কখনোই আলোকিত করে না। কিন্তু ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতায় দৃশ্যত হয় বিপরীত অবস্থা। কবি মন এখানে কিছুতেই তার প্রয়াত স্বামীকে ভুলতে পারছেন না। প্রচণ্ড শূন্যতা নেমে এসেছে তার জীবনে। তাঁর ব্যক্তিজীবন ও কাব্যসাধনার ক্ষেত্রে নেমে এসেছে এক দুঃসহ বিষণœতা। প্রকৃতিতে বসন্ত আসলেও তাই কবি তাতে যোগ দিতে পারছেন না।
➠ অনুচ্ছেদের তপুর বউ এবং কবিতার কবিমনের মধ্যে এর ফলে বৈপরীত্য অবস্থা দৃশ্যমান।

ঘ. ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতায় প্রকৃতি ও মানবমনের সম্পর্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরা হয়েছে।
➠ ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতায় কবি প্রিয়জন হারানোর বেদনায় দুঃখ ভারাক্রান্ত। প্রয়াত স্বামীর স্মৃতি তাকে বার বার তাড়িত করছে।
➠ এ কবিতায় কবির ব্যক্তিজীবনের দুঃখকর ঘটনার ছায়াপাত ঘটেছে। তাঁর সাহিত্য সাধনার প্রধান সহায়ক ও উৎসাহদাতা স্বামী নেহাল হোসেনের আকস্মিক মৃত্যুতে কবির জীবনে প্রচণ্ড শূন্যতা নেমে আসে। তাঁর ব্যক্তিজীবন ও কাব্য সাধনার ক্ষেত্রে নেমে আসে এক দুঃসহ বিষণœতা। কবিমন আচ্ছন্ন হয়ে যায় রিক্ততার হাহাকারে। পুরো কবিতাকে আচ্ছন্ন করে আছে সেই বিষাদকর রিক্ততার সুর। তাই বসন্তের আগমনেও কবির উন্মাদনা। বসন্ত এলেও উদাসীন কবির অন্তর জুড়ে আছে রিক্ত শীতের করুণ বিদায়ের বেদনা। কবিআত্মা তাই শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়েছে।
➠ পরিশেষে কবির ভাষায়, “কুহেলি উত্তরী তলে মাঘের সন্ন্যাসী গিয়াছে চলিয়া ধীরে পুষ্পশূন্য দিগন্তের পথে রিক্ত হস্তে! তাহারেই পড়ে মনে ভুলিতে পারি না কোন মতে।”


‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতার সৃজনশীল প্রশ্ন- ১০:

নিচের উদ্দীপকটি পড়ো এবং প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও।
‘তোমার কাছে এসেছিলাম পদ্য শুনবো বলে। ‘কবিতা’ বললে মনে হয় ওটা আর্যদের শব্দ। আমার জন্য অনার্য পদ্যই বলো তুমি। বসন্ত তো তোমার অপেক্ষায়-তোমার দরজায় আসীন। তুমি তাকে ব্যর্থ করে দিওনা। স্বাগত জানাও তাকে। তাতে তাকে বন্দনা করা হবে। আমার পদ্য শোনাতে হবে।’
কবি নিরুত্তর বেশ কিছুক্ষণ। তারপর কাঁপা গলায় বললেন- বৃথা হবে কেন, ফুলতো ফুটেছে। ঋতুরাজ বসন্ত ফুলের আরতি পেয়ে ধন্য। মাধবী কুঁড়ির বুকে গন্ধের উপস্থিতি। বসন্ত বৃথা হয়নি। আমি বরণ করলাম না বলে ফাগুন তো তার গতি হারায়নি।

ক. ঋতুচক্রে শেষ ঋতুর নাম কী?
খ. মধুর বসন্ত কবিকে আকর্ষণ করতে পারে না কেন?
গ. উদ্দীপক অবলম্বনে বসন্তের বর্ণনা দাও।
ঘ. কবিভক্ত ও কবির মনস্তত্ত¦ বিশ্লেষণ কর।

ক. ঋতুচক্রে শেষ ঋতুর নাম বসন্ত।
খ. বসন্ত সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করে কবিকে। বসন্ত প্রকৃতিকে রঙে রঙিন করে দিয়ে অতঃপর প্রকৃতিকে দিয়ে আক্রমণ করায় জনচিত্তকে-কবিচিত্তকে।
➠ কবিচিত্ত যদি হয় সুন্দরের অধিষ্ঠানের জন্য পোষক ক্ষেত্র তাহলে প্রকৃতি তাকে ছাড়ে না। কবিকে দিয়ে লিখিয়ে নেন বন্দনাগীতি। এখানে কবি হৃদয়ের সাথে বসন্তের প্রণয় সাধিত হয়। কিন্তু কবিচিত্ত যদি হয় বেদনায় বিমূঢ় তাহলে সুন্দরকে আনন্দকে হৃদয়ে ধারণ করতে পারেন না। হৃদয়ের চার চেয়ালে থাকে বেদনার আবরণ। বেদনার সে আবরণ সরিয়ে আনন্দ সেখানে অনুরণন জাগাতে পারেনা। কবি সুফিয়া কামালের প্রথম স্বামী সৈয়দ নেহাল হোসেনের মৃত্যুর পর বেদনায় ভেঙে পড়েন তিনি। মনের চারদিকে ছিল দীর্ঘশ্বাসের কুণ্ডলী। সেসব ছাপিয়ে ফুল ফাগুনের মরসুম সেখানে পৌঁছতে পারেনি। মূলত বেদনার আপেক্ষিকতা বেশি হওয়ায় বসন্ত কবিকে তার দিকে টানতে পারেনি।

গ. প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে মেনেই বসন্ত এলো। দখিনা সমীরের সাথে গলাগলি করে, আমের মুকুলের গন্ধ আর বাতাবি লেবুর গন্ধের সাথে হাত ধরাধরি করে ফাগুন এলো। প্রতি বছর একই মাহাত্ম্যে আর্দ্র হয়ে ফাগুন আসে। আনন্দ সঞ্চারে নৈর্ব্যক্তিক পক্ষপাত থাকে বলে তার অবদান ও আবেদন কোন কিছুর সাপেক্ষ নয়। কোন সুন্দর যদি ফাগুনকে বরণ করতে অসমর্থ হয় তাহলে তাকে কিছু বলতে পারে না বসন্ত। শুধু বসন্তোৎসবের গীতি ঝঙ্কার শুনিয়ে দিতে পারে। তাই আপাতদৃষ্টিতে, কারো অংশগ্রহণ না থাকায় বসন্ত উৎসব অসফল হল বা বসন্ত ব্যর্থ হল এরকম মনে হলেও, বসন্ত আসলে ব্যর্থ হয় না। বসন্তের যা কাজ তা সে যথাযথভাবে পালন করে। ডগায় ডগায় ফুল ফুটায় বসন্ত। এবং বসন্ত ধন্য হয় সে ফুলের আরতি পেয়ে। আমের জামের মুকুল উঁকি দেয়-। বাতাবি লেবুর ফুল ফোটে। গন্ধে গন্ধে বসন্ত হয় ব্যাকুল। মাধবী ফুলের কুঁড়ির বুকে গন্ধের লুকোচুরি। এ সবই বসন্তের উস্কানিতেই হয়। বসন্ত ব্যক্তিক নয়-নৈর্ব্যক্তিক আনন্দের গীতিকার।

ঘ. প্রদত্ত উদ্দীপকে নাটকীয় সংলাপের আদলে সুন্দরপিয়াসী দুটি সত্তার অন্তর্লোক উন্মোচিত হয়েছে। একটি সত্তা হল কবিভক্ত। অন্যটি হলো একজন কবি।
➠ কবিভক্ত বসন্তকে সফল করার জন্য নিবেদিত। মধুর বসন্ত এসেছে। সুন্দরের লীলা চলবে এবং সে আনন্দ যজ্ঞে তার নিমন্ত্রণ। বসন্ত এসেছে আনন্দের বার্তা নিয়ে। এমন একটা মহতী উদ্যোগ যে নিয়ে এসেছে, তাকে কি বরণ করে নিতে হবে না। তাই সে ছুটেছে তার কাছে যার বসন্ত বরণের মত অর্ঘ্য আছে। কবির কাছে তাই তার মিনতি স্বাগত জানাও তাকে। কবিভক্ত মনের দিক দিয়ে পরিশ্রুত। কারণ সে সুন্দরের পূজারী। সুন্দর বসন্তকে অন্য এক সুন্দর বরণ করে নিক। সুন্দর কেন ফিরে যাবে বন্ধ দুয়ার থেকে? সুন্দরকে সম্মান জানানোর জন্য ব্যাকুল সে। সুন্দরের স্পর্শে, সুন্দরের প্রচেষ্টা আর একটি সুন্দর সম্ভব হয়ে উঠুক এটি তার ঐকান্তিক প্রার্থনা।
➠ কবিও সুন্দরের প্রত্যাশী। তার মনও বসন্তের জন্য প্রস্তুত। সুন্দরের সাথে তার বিরোধ নেই। কিন্তু ব্যক্তিগত কষ্টের কারণে উচ্ছ্বল বসন্তের সাথে তার সহাবস্থান সম্ভব হচ্ছে না। সুন্দরের অধিষ্ঠান হয় মনের অন্দর মহলে। কিন্তু কবির মনটা সুন্দরকে গ্রহণের জন্য প্রস্তুত নয়। তাই বসন্তকে হৃদয়ে অনুভব করে সুন্দরের সৃজনে তাঁর অক্ষমতা আছে। আবার আনন্দ যজ্ঞে অংশ নিলেন না বলে বসন্ত ব্যর্থ হলো এমনটা মনে করেন না। তিনি বরং যখন দেখলেন ফুল ফুটেছে; প্রকৃতির প্রাঙ্গন জুড়ে প্রসূনের প্রসন্ন পীড়ন, তখন মনের দিক দিয়ে তৃপ্ত হলেন তিনি।
কবি ভক্তের মনস্তত্তে¦র সার সংক্ষেপ-
- কবিভক্ত আবেগী।
- সুন্দরের প্রতি অনুরক্ত
- সুন্দরের ম্লানিমায় বিচলিত
কবির মনস্তত্ত্বের সার সংক্ষেপ
-নিয়ন্ত্রিত আবেগ কবির।
- সুন্দরের প্রতি বিদ্বিষ্ট নন।
- মনোগত সীমার ঊর্ধ্বে উঠতে চাননি।


‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতার সৃজনশীল প্রশ্ন- ১১:

নিচের উদ্দীপকটি পড়ো এবং প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও।
বার-তের বছর বয়সে নাসরিনের বিয়ে হয়। দুরন্ত নাসরিন বিবাহ সম্পর্কে কিছুই বুঝে না। প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যে সে মুগ্ধ হলেও স্বামীর প্রতি দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন নয়। সময় অতিবাহিত হওয়ার সাথে সাথে সে স্বামীর প্রতি কর্তব্যবোধ সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠে। এখন তার একমাত্র প্রিয়জন হলো তার প্রাণপ্রিয় স্বামী। একদিন বেড়াতে বের হলে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায় তার প্রাণপ্রিয় স্বামী এতে সে শোকাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। বসন্তের অপরূপ সৌন্দর্য এখন তার অন্তরকে স্পর্শ করে না।

ক. ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতাটি ‘মাসিক মোহাম্মদী’ পত্রিকার কততম সংখ্যায় প্রকাশিত হয়?
খ. ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতায় বসন্তের আগমনে কবি উদাসীন কেন?
গ. স্বামীর প্রতি নাসরিনের ভালোবাসা সুফিয়া কামালের ভালোবাসার সঙ্গে কতটুকু সাদৃশ্যপূর্ণ?-ব্যাখ্যা কর।
ঘ. ‘স্বামীর অকাল মৃত্যুতে প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য কবির মতো নাসরিনের অন্তরকেও স্পর্শ করতে পারেনি’-‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতার আলোকে বিশ্লেষণ কর।

ক. ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতাটি ‘মাসিক মোহাম্মদী’ পত্রিকার ষষ্ঠতম সংখ্যায় প্রকাশিত হয়।
খ. বসন্তের নয়নলোভা সৌন্দর্য থাকা সত্ত্বেও কবিমনে আজ তীব্র উদাসীনতা, আচরণে অনাকাক্সিক্ষত বিষণ্নতা। কেননা বসন্তের আগমনের কিছুকাল পূর্বেই যাবতীয় রিক্ততা, শূন্যতা আর নিঃস্বতা নিয়ে শীত ঋতু হারিয়ে গেছে পুষ্পশূন্য দিগন্তে। শীতের প্রকোপে বৃক্ষলতা হয়েছে পত্রহীন, পুষ্পীন, পাণ্ডুর এবং শ্রীহীন। এর আগমন ও বিদায়ে প্রকৃতি থেকেছে নীরব। শীতের এই উদার্য কবির কাছে শীতকে মহিমান্বিত করেছে। তাই কবি শীতকে ভুলতে পারেন নি।
➠ শীতের রিক্ত ও নিঃস্বভাব কবিচিত্তে যে বেদনার সঞ্চার করেছে তার আবেগেই তিনি নির্মোহ এবং নিশ্চল। একটি চরম দুঃখবোধ বা কিছু হারানোর বিলাপ কবির মানসে পূর্ণ আসন দখল করেছে। তাই কখন চুপিসারে তাঁর দ্বারে বসন্তের আগমন ঘটেছে তা তিনি লক্ষ্য করেন নি। তিনি উদাসীনভাবে বসন্তকে উপেক্ষা করেছেন। ফলে বসন্তের আগমনকে তিনি স্বাগত জানাতে পারেন নি।

গ. স্মামীর প্রতি নাসরিনের ভালোবাসা সুফিয়া কামালের ভালোবাসার সঙ্গে যথেষ্ট সাদৃশ্যপূর্ণ। কিশোরী বয়সের দুরন্তপনার দিনের শুরুত্বে নাসরিনের বিয়ে হয়ে যায়। প্রকৃতির সৌন্দর্যে মুগ্ধ হলেও স্বামীর প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে বুঝে ওঠতে পারে না সে। কিন্তু বয়স বাড়ার সাথে সাথে যতই নাসরিনের স্বামীর কাছাকাছি যেতে থাকে ততই সে নিজের জীবনে স্বামীর গুরুত্বকে উপলদ্ধি করতে শেখে। ধীরে ধীরে সে স্বামীর প্রতি করণীয় সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠে এবং স্বামীকে একান্ত আপন করে নিয়ে ভালোবাসতে শুরু করে। স্বামীর প্রতি তার ভালোবাসা গভীর হতে হতে যখন মহীরূহ আকার ধারণ করে তখন এক সড়ক দুর্ঘটানায় আকস্মিকভাবে তার প্রাণপ্রিয় স্বামীর মৃত্যু হয়। এতে সে এতটাই শোকাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে যে, যে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এক সময় তাকে মুগ্ধ করত, এখন তা আর তাকে স্পর্শও করে না। তাহারেই পড়ে মনে কবিতায় কবি সুফিয়া কামালেরও স্বামীর প্রতি অনুরূপ ভালোবাসার প্রকাশ ঘটেছে। কবির প্রথম স্বামী সৈয়দ নেহাল হোসেন আকস্মিকভাবে মৃত্যুবরণ করেন। তার স্বামীই ছিলেন তার কাব্য সাধনার প্রেরণার উৎস, উৎসাহদাতা, ভালোবাসার ধন। তাই স্বামীর মৃত্যুতে কবি শোকে বিহ্বল হয়ে পড়েন। নীরব, নিশ্চল, নিস্তব্ধ হয়ে পড়েন তিনি। স্বামী হারানোর বেদনা তার হৃদয়ে এমনভাবে বিধেছে যে, মহাসমারোহে বসন্তের আগমন তার মনে কোনো আবেদনই সৃষ্টি করতে পারেনি। প্রকৃতির সকল সৌন্দর্য সকল রূপসজ্জা একেবারেই অর্থহীন হয়ে পড়েছে তার বিরহী মনের রিক্ততার কাছে। স্বামীর প্রতি নাসরিনের ভালোবাসাও কবির অনুরূপ। আর তাই তাদের বেদনার স্বরূপও একইভাবে ফুটে ওঠেছে কবিতা ও উদ্দীপকে।

ঘ. স্বামীকে হারানোর তীব্র শোক কবি সুফিয়া কামালের মতো উদ্দীপকের নাসরিনের বসন্ত উৎসবকে নিরুৎসব করে দিয়েছে। স্বামীকে ভালোবেসে নাসরিন যে সুখের সংসার পেতেছিল তা সারা বছর জুড়েই থাকত বসন্তময়। কিন্তু সড়ক দুর্ঘটনায় স্বামী মারা গেলে বসন্তেও তার হৃদয়ে বেজে ওঠে শীতের রিক্ততার করুণ হাহাকার। ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতায় কবির হৃদয়ও একই রকম হাহাকার বসন্তের আগমনকে অর্থহীন করে তুলেছে। ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতাটিতে অন্তর্লীন হয়ে আছে কবি সুফিয়া কামালের বিষাদময় রিক্ততার সুর। কবিতায় শীতের জরাজীর্ণ ও রিক্ততার মধ্যে উৎসারিত হয়েছে কবির জীবনের পুষ্পশূন্য হৃদয়ের ব্যথা-শতরূপে, শতধারায়। সুন্দরের পসরা সাজিয়ে প্রকৃতির উদার প্রান্তরে মহাসমারোহে বসন্ত এসেছে অপূর্ব রূপরাশি ও সৌন্দর্য সম্ভারে সুসজ্জিত হয়ে। কিন্তু মধুবসন্তের এমনতর শুচিস্নিগ্ধ, চিত্তাকর্ষক ও মাধুরীমন্ডিত আন্দনমুখর পরিবেশে কবি আজ উদাসীন, উন্মানা। লেখনী তার নীরব, নিস্তব্ধ, নিশ্চল। কবির সূক্ষ্ম হৃদয়তন্ত্রীতে বসন্তের সমুদয় আয়োজন, আবেদন যেন আজ ব্যর্থ। কবির সমগ্র চিত্ত দখল করে আছে শীতের রিক্ততা। কারণ কুয়াশা ঘেরা মলিন দিনে বিচ্ছেদের জ্বালা মিলনমালাকে ছিন্ন করে শূন্যতা নিয়ে বেজেছিল কবির হৃদয়ে। কবির মনে আজও সে বিষাদময় ক্ষণটিই ঝংকৃত হয় বেদনার গীতি হয়ে। বিকশিত যৌবনের মাধুর্য থেকে বঞ্চিত প্রথম স্বামীর বেদনাঘন ছায়া কবির হৃদয়ে ও অস্থিমজ্জায় আজও সঞ্চারিত। তাই বসন্তের প্রাণ মাতানো অবেলাভূমিতে দাঁড়ানো কবির হৃদয়ে সে অনন্ত পারাপারে চলে যাওয়া প্রাণপ্রিয় মানুষটি তার আবেগের সেতার বাজিয়ে চলছে। এজন্য কবি বসন্ত বন্দনায় নিবেদিতা না হয়ে প্রত্যাবর্তন করেন অতীত স্মৃতির ক্যানভাসে। কবির মতো উদ্দীপকের নাসরিনের হৃদয়েও বসন্তের অপার সৌন্দর্য কোনো সাড়া জাগাতে পারে না। প্রিয়জন হারানোর শোকেই কবির মতো তার অন্তর শোকাচ্ছন্ন। হারানো স্বামীকে কবির মতো সেও ভুলতে পারে না। তাই কবির অন্তরের মতো নাসরিনের অন্তরও বসন্তের সৌন্দর্যকে স্বাগত জানাতে পারে না।


‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতার সৃজনশীল প্রশ্ন- ১২:

নিচের উদ্দীপকটি পড়ো এবং প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও।
উন্মনা ছিলেন তিনি। চারদিকে এত সুর এত ছন্দ, এত ফুল এত গন্ধ ভালো লাগে না তাঁর। বসন্ত সমাগত। অথচ তিনি নির্মোহ নি®প্রাণ। কথাটা তাঁকে জানালে তিনি বললেন কবে এল ফাগুন! বাতাবি লেবুর ফুল ফুটে গেছে? আমের মুকুল ফুটেছে? বাতাসে কি তার গন্ধ ছড়াচ্ছে? তার আগমনী গান কি বেজেছে? সে কি আমারে ডেকেছে তার সৌন্দর্যের সুরে? বলতে বলতে আবারো উন্মনা হয়ে গেলেন তিনি।

ক. অর্ঘ্য অর্থ কী?
খ. কবিভক্তের এরকম মনে হল কেন- ফাগুন বৃথা হল?
গ. উদ্দীপক অবলম্বনে, বসন্তের আগমনে প্রকৃতিতে যে দোলা লাগে তার বিবরণ দাও।
ঘ. উদ্দীপক অবলম্বনে সংবেদনশীল মানবচিত্তে বসন্তের প্রভাব আলোচনা কর।

ক. অর্ঘ্য অর্থ সম্মানিত ব্যক্তিকে সংবর্ধিত করার জন্য প্রদত্তমালা।
খ. অনুরক্ত কবিভক্ত বসন্তের আগমন উপলক্ষ্যে বন্দনাগীতি রচনার জন্য কবিকে মিনতি জানায় : ‘বসন্ত-বন্দনা তব কণ্ঠে শুনি-এ মোর মিনতি।’ কবিভক্তের বোধঃসুন্দর যদি সুন্দরের কাছে মূল্য না পায়, তাহলে সে সুন্দর বৃথা। সৌন্দর্যপিপাসুকে, দুঃখী-অসুখীকে আনন্দের ছোঁয়া দেওয়ার জন্য প্রকৃতির আঙিনায় বসন্ত আসে। এসেই সে চায় সুন্দর হৃদয়ের অধিকারী যারা তারা আসুক; এ আনন্দলীলায় আনন্দধারায় স্নাত হোক। যদি কেউ না আসে তাহলে তো বৃথাই হল বসন্তের আগমন। কবি ভক্তের বিশ্বাস-মদির মিলন ঘটাতে বসন্ত আসে। কবি যদি মুখ ফিরিয়ে নেয়, বিস্মৃতির জগতে বিচরণ করেন তাহলে বসন্তকে বরণ করে নেবে কে? তাই তার এই প্রতীতি জন্মেছে-কবি, বসন্তকে বরণ করে না নেওয়ায় বসন্ত বৃথা হল। যে জন্য বসন্তের আগমন, কবির নিরুৎসাহের কারণে বসন্তের সেই মন রাঙানো কাজটি সম্ভব হলো না। তাই তার ধারণা বসন্ত বৃথা হল।

গ. প্রকৃতি তার রূপ বদলায় সময়ে সময়ে। ঋতু পরিবর্তনের সাথে সাথে প্রকৃতিতেও লাগে পরিবর্তনের ছোঁয়া। ভৌত পরিবর্তনের পাশাপাশি প্রকৃতির অন্য কিছু অনুষঙ্গেও পরিবর্তন সূচিত হয়। বৃক্ষ, ফুল, ফল, নদী, পাখি ইত্যাদি ক্ষেত্রে পরিবর্তন দেখা যায়। বসন্ত ঋতুর আগমনেও সূচিত হয় পরিবর্তন। উদ্দীপকে এই পরিবর্তনের প্রতি কবি হৃদয়ের আবেগমাখা অভিমান আরোপিত হয়েছে। বসন্তের আগমনে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ু প্রবাহিত হয়। কবিরা তখন বলেন- আজি দখিনা দুয়ার খোলা। গাছে গাছে লাগে প্রাণের নাচন। পাতা ঝরানো শীত বিদায় নেওয়ার পর দখিনা হাওয়ার প্রসাদে গাছে গাছে জাগে নতুন পাতা। কোন কোন গাছে দেখা দেয় ফলের সূচনা। বাতাবী লেবুর ফুল এ সময়েই ফোটে। আমের মুকুল দেখা দেয়। আমের মুকুল থেকে উৎসারিত গন্ধে আমোদিত হয় বাতাস। দখিনা বাতাস সে গন্ধে আকুল হয়ে তাকে বয়ে নিয়ে যায় বহুদূর। যাঁরা কবি স্বভাবের তারা বসন্তের রঙে নিজেদেরকে রাঙিয়ে নেন। তাঁদের কাছে বসন্ত সুদূরের পথ বেয়ে অচিন দেশ থেকে আসা অতিথি। প্রকৃতিতে তার আগমনী গান বাজে আগে থেকেই। প্রকৃতি ফুলসাজে নববধূর বেশ ধারণ করে। এভাবে প্রকৃতিতে লাগে দোলা-সুন্দরের দোলো। সে দোলায় দোলে ফুল, পাখি, বৃক্ষ। দোলে জনচিত্তও।

ঘ. দার্শনিক, বিজ্ঞানী, জ্যোতির্বিজ্ঞানী, কবি-সবাই একবাক্যে স্বীকার করেন মানুষের মনের ওপর প্রকৃতির প্রভাব সবচেয়ে বেশি। ঋতু বদল হয়, অন্য ঋতু আসে। বদলে যায় প্রকৃতির রং ও রূপ। বদলে যায় মানব মন, মানুষের বৃত্তি-আচরণ অনেক কিছু। প্রকৃতি মানুষের ওপর প্রভাব বিস্তার করে দুই ভাবে। প্রথমত বাহ্যিক জীবনাচরণে দ্বিতীয়ত মনের গতিধারায়।
➠ বসন্তের প্রভাব মানবচিত্তে পড়ে এ দুটি ধারায়। সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে পেশা বা জীবিকায় পরিবর্তন আসতে পারে। তবে মনের ওপর বসন্তের প্রভাব সবচেয়ে বেশি। প্রকৃতিতে শীতের হাঁড় কাঁপানি যন্ত্রণা থাকেনা। দখিনা বাতাস মৌসুমী বায়ুকে সাথে নিয়ে প্রবাহিত হয়। কোমল শীতল বাতাসে শরীর জুড়ায়-মনের ক্লান্তিও কিছু পরিমাণে লাঘব হয়। গলা খোলে মানুষের। গেয়ে ওঠে গান। প্রকৃতির রূপ পরিবর্তনের সাথে সাথে প্রকৃতিরাজ্যে এসে যায় নব নব উপাদান-ফুল, ফল, গন্ধ। এগুলো নিয়ে গীতিময় হয়ে ওঠে মানুষের মন। সংবেদনশীল মানবচিত্ত ‘ফুলের মরশুম’ বসন্তকে বরণ করে নিতে চায়। নতুন পুষ্পসাজে নিজেকে সাজায় শিল্পীরা-কবিরা-বসন্তপ্রেমিরা। অমোঘ কোন কষ্ট না থাকলে কবিরা মনকে রাঙান বসন্তের রঙে। কণ্ঠে তাদের বসন্তগীতি।
➠ তবে মনের গহীনে কষ্টের প্রস্রবণ থাকলে বসন্ত সেখানে প্রভাব ফেলতে পারে না। বেদনার আপেক্ষিকতা বেশি হলে বসন্তের সুর, ছন্দ কিছুই কাজে আসে না। বিষাদ যদি মন ছুঁয়ে যায় সে মনে বসন্ত রং লাগাতে পারে না। যারা সুখী এবং বড় কোন মনোবেদনা নেই এমন মানুষের চিত্তরাজ্যে বসন্ত রঙের ঝরণাধারা সৃষ্টি করে।


‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতার সৃজনশীল প্রশ্ন- ১৩:

নিচের উদ্দীপকটি পড়ো এবং প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও।
বসন্তকাল। চারদিকে ফুল, পাখি তার দখিনা পবনের কোরাস। ফুলের এই জলসায় নীরব একজন কবি- যিনি বসন্তকে অনুভব করেন সংবেদনশীল সত্তা দিয়ে। তিনি প্রকৃতিকে হৃদয়ের গহীনে স্থান দিয়েছেন। করে নিয়েছেন আত্মার-আত্মীয়। তারপরও ‘কেন এই নীরবতা’ জানতে চাইলে তিনি বললেন- কুহেলি উত্তরী তলে মাঘের সন্ন্যাসী-গিয়াছে চলিয়া ধীরে পুষ্পশূন্য দিগন্তের পথে- রিক্ত হস্তে। তাহারেই পড়ে মনে ভুলিতে পারিনা কোন মতে।’ বোঝা গেল তার বেদনার অন্তর্গূঢ় কারণ।

ক. ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতাটির প্রকাশ মাধ্যম লেখ।
খ. কবিভক্তের বসন্তবার্তা জানানোর পর কবি বসন্তের আগমনের ব্যাপারে কী কী ইংগিতধর্মী প্রশ্ন করেছিলেন?
গ. মাঘের সন্ন্যাসী বলতে কাকে বোঝানো হয়েছে-কেন এ রকম অভিধা, বিশ্লেষণ কর।
ঘ. উদ্দীপকে কবির আত্মকথন/ব্যক্তিগত জীবন আভাসিত হয়েছে-যুক্তিসহ ব্যাখ্যা কর।

ক. ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতাটি ‘মাসিক মোহাম্মদী’ পত্রিকায় নবমবর্ষ ষষ্ঠ সংখ্যা (১৩৪২) প্রথম প্রকাশিত হয়।
খ. নন্দিত মাতৃমূর্তি সুফিয়া কামালের হৃদয়ের রক্তক্ষরণ ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতাটি। একটি ব্যক্তিক অনুভবকে শিল্পীত, পরিশীলিত উপস্থাপনা এবং যথাযোগ্য শব্দ চয়নের মধ্যে সর্বজন হৃদয়বেদ্য করেছেন এ কবিতায়।
➠ কোন এক কবিভক্তের প্রশ্নের এবং কবির উত্তরের নাটকীয় উক্তি প্রত্যুক্তির মধ্যদিয়ে তিনি নিজের দুঃখকে সবার হৃদয়ে সঞ্চার করে দিয়েছেন। ভক্তের প্রশ্ন ছিল-বসন্ত এসেছে, অথচ নিরব কেন কবি? তারই উত্তরে কবি বলেছেন-দক্ষিণ দুয়ার গেছে খুলি? বাতাবি লেবুর ফুল ফুটেছে কি? ফুটেছে কি আমের মুকুল? এখানে যে প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে তার উত্তর ‘হ্যাঁ’ হলে প্রশ্নগুলোর সরলীকৃত রূপগুলি বসন্তের আগমনী সংকেত। এরপরেও প্রশ্ন- দখিনা বাতাসে কি আমের মুকুলের গন্ধ ভেসে আসে? অর্থাৎ বসন্তে দখিনা বাতায় বয়, আমের মুকুল ধরে, বাতাসে আমের মুকুলের গন্ধ বহুদূর ছড়িয়ে যায়। বাতাবী লেবুর ফুল ফোটে। ভক্তকে ইংগিতধর্মী এসব প্রশ্নের মাধ্যমে বাসন্তী প্রকৃতিকে চিত্রিত করেছেন কবি।

গ. শীত প্রকৃতিকে উপহার দেয় রিক্ততা। বৃক্ষ হয় পত্রহীন-ফুলহীন। প্রকৃতি থাকে নীরব নিস্তেজ, সর্বরিক্ত সন্ন্যাসীর মত। শীতের এই রূপ, বসন্তের বিপরীতে স্থাপিত। প্রকৃতির আঙিনা বসন্তের বিচিত্রফুলে সাজলেও কবির মনজুড়ে থাকে শীতের রিক্ততা। শীত যেন গৃহত্যাগী সন্ন্যাসীর মতো কুয়াশার চাদর গায়ে জড়িয়ে পত্রপুষ্পশূন্য দিগন্তের পানে চলে গেছে। শীতের বিদায় স্মৃতিতে কবিচিত্ত উদ্ভ্রান্ত ও বেদনাবিধূর। কবি হৃদয় দুঃখ ভারাক্রান্ত। বসন্তের আনন্দ অপেক্ষা শীতের বিয়োগজনিত ব্যথাই কবিকে বেশি পীড়া দিচ্ছে। কবির প্রথম স্বামী সৈয়দ নেহাল হোসেন তাঁর জীবন থেকে হারিয়ে গেছে। শীত ঋতুর প্রতীকে তাঁকে কবি মাঘের সন্ন্যাসী বলেছেন। মাঘ মাসের কুয়াশার আড়াল দিয়ে সকলের অজান্তে শীত যেমন প্রকৃতির উঠোন থেকে বিদায় নেয়, কবির একান্ত প্রিয় মানুষটিও কবিকে নিঃস্ব করে দিয়ে রিক্ত হস্তে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। কবি তাই তাকে ভুলতে পারেননি।

ঘ. গীতিধর্মিতা ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতার একটি বড় গুণ। আর গীতিধর্মিতার বড় গুণ হল কবির আত্মগত ভাবানুভূতির বহিঃপ্রকাশ। কবিভক্তের ব্যাকুল প্রশ্ন চারদিকে এত ফুল এত গন্ধ, এত সুর এত ছন্দ-তারপরও নীরব কেন কবি। তার উত্তরে কবি জানিয়েছেন- ‘মাঘের সন্ন্যাসী’ বিদায় নিয়েছে- তাহাকে ভুলতে পারিনা কোন মতে। এই একটি বাক্যে এতক্ষণে অনাবি®কৃত কবিকে আবিষ্কার করা গেল। কেন উন্মনা কবি, কেন বসন্তবন্দনায় অনীহ তিনি, কেন বসন্তবিমুখতা, তা জানা গেল। সাহিত্য বা আর্ট হতে হয় নৈর্ব্যক্তিক। কবিভক্ত চেয়েছেন কবি একটা বসন্তগীতি লিখুক। নৈর্ব্যক্তিক আবেগ দিয়ে লিখলে দ্বিধা বা ইতস্তততা থাকার কথা নয়। বারবার চবৎংড়হধষ জীবনসত্য এসে কবিকে বসন্তগীতি রচনায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। সেই ব্যক্তিগত জীবন সত্যের পেছনে অবস্থান করে আছেন তাঁর প্রথম স্বামী সৈয়দ নেহাল হোসেন-যাঁর উৎসাহ ও অনুপ্রেরণায় তাঁর সাহিত্যের পথে আসা। স্বামীর মৃত্যু তার মনকে রিক্ত নিঃস্ব করে দিয়েছে। দুঃখ যদি মনকে আচ্ছন্ন করে। তাহলে কোন বিনোদনই উপাদেয় নয়। যার ফলে প্রাণ ভরিয়ে দিতে যে মধুর বসন্ত এসেছে, তার আহ্বানে সাড়া দিতে পারেন না কবি। ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতায় প্রথম থেকে বসন্ত বন্দনার ব্যাপারে কবির নিরুৎসাহের ফলে পাঠকচিত্তে যে কৌতূহল জাগে তার অবসান হয় শেষ স্তবকে। সেখানে তিনি তার ব্যক্তিগত বেদনার ঝাঁপিটি খুললেন। পাঠক জানলো চিরন্তনও অনেক সময় ব্যর্থ হয় ব্যক্তিগত দুঃখবোধ বা সুখবোধের অভিঘাতে। আমরা দাবি করতে পারি উদ্দীপক ও মূল কবিতায় কবি সুফিয়া কামালের ব্যক্তি জীবনের একটি অধ্যায় এবং তার প্রলম্বিত দুঃখবোধ আভাসিত হয়েছে।


‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতার সৃজনশীল প্রশ্ন- ১৪:

নিচের উদ্দীপকটি পড়ো এবং প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও।
পুষ্প ফুটে কোন কুঞ্জবনে।
কোন্ নিভৃতে ওরে, কোন্ গহনে।
মাতিল আকুল দক্ষিণাবায়ু সৌরব চঞ্চল সঞ্চরণে
বন্ধুহারা মম অন্ধ ঘরে
আছি বসে অবসন্ন মনে,
উৎসরাজ কোথায় বিরাজে
কে লয়ে যাবে সে ভবনে

ক. ‘বরিয়া’ শব্দের অর্থ কী?
খ. ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতায় শীতের রিক্ততার মধ্যে কবির অতীত জীবনের যে সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায় তা লেখ।
গ. উদ্দীপকটিতে ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতার কোন বিষয়টি ফুটে ওঠেছে? ব্যাখ্যা কর।
ঘ. উদ্দীপকটি ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতার প্রচ্ছন্ন রূপ-সপক্ষে যুক্তি দাও।

ক. বরিয়া শব্দের অর্থ বরণ করে।
খ. শীত ঋতু প্রকৃতিতে দেয় রিক্ততার রূপ। শীতের প্রকোপে বৃক্ষলতা পত্রহীন, পুষ্পহীন পাণ্ডুর এবং শ্রীহীন হয়ে যায়। এমন রিক্ত নিঃস্ব প্রকৃতিকে তাই সংসার ত্যাগী সন্ন্যাসীর মতো মনে হয়। রিক্ত শীতের সাথে রিক্ত সন্ন্যাসীর অপূর্ব সাদৃশ্য খুঁজে পেয়েছেন কবি তাঁর প্রিয়জন হারানো রিক্ত নিঃস্ব অনিকেত জীবনে। শীতের রিক্ততার মত কবির হৃদয় বেদনাবিধুর। কারণ কবির সাহিত্য সাধনার প্রধান সহায়ক ও উৎসাহদাতা স্বামী নেহাল হোসেনের আকস্মিক মৃত্যুতে কবির অন্তরে অনির্বচনীয় শূন্যতা নেমে আসে। তাঁর কাব্য সাধনায় ছন্দপতন ঘটতে থাকে। এক দুঃসহ বিষণœতায় কবির মন আচ্ছন্ন হয়ে আছে রিক্ততার হাহাকারে। যে রিক্ততা রয়েছে শীত প্রকৃতিতেও। তাই কবি তাঁর অতীত জীবনের রিক্ততার আশ্চর্য সাদৃশ্য খুঁজে পেয়েছেন নিঃস্ব রিক্ত শীতের মধ্যে।

গ. কবি সুফিয়া কামাল রচিত ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতায় প্রিয়জন হারানোর যে বেদনানুভূতি কবি হৃদয়কে আনন্দহীন করেছে তা উদ্দীপকের মূলভাবেও প্রতিফলিত হয়েছে। প্রিয়জন হারানোর বেদনা সব সময়ই মানুষের হৃদয়কে শোকাচ্ছন্ন করে। কখনো কখনো এ শোক এতটাই তীব্র হয় যে, তা মানবমনের সৌন্দর্যের অনুভূতিতে জাগ্রত আনন্দকেও ম্লান করে দেয়। ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতায় কবি সুফিয়া কামালের ক্ষেত্রে এমনটিই ঘটেছে। এ কবিতায় কবির ব্যক্তি জীবনের দুঃখময় ঘটনার ছায়াপাত ঘটেছে। তাঁর সাহিত্য সাধনার প্রধান সহায়ক ও উৎসাহদাতা স্বামী সৈয়দ নেহাল হোসেনের আকস্মিক মৃত্যুতে কবির জীবনে প্রচণ্ড শূন্যতা নেমে আসে। কবিমন আচ্ছন্ন হয়ে যায় রিক্ততার হাহাকারে তাই বসন্ত এলেও উদাসীন কবি তাই বসন্তের বন্দনা না করে হারানো স্বামীর বেদনার স্মৃতিকে আঁকড়ে ধরে আন্মনা হয়ে থাকেন। কবি হৃদয়ের এ বসন্ত বিমুখতা তার স্বামী হারানোর শোককেই তুলে ধরে। অন্যদিকে উদ্দীপকে ও কবির অনুভুতিতে অনুরূপ অভিব্যক্তির সকরুণ সুর বিষাদময় হয়ে উঠেছে। উদ্দীপকে দেখা যায়, বসন্তের মতো প্রকৃতি পুষ্পসাজে সজ্জিত হয়ে উঠেছে এবং তারই মধ্যে দক্ষিণাবায়ু সৌরভ মাধুর্য চঞ্চলতায় মেতে উঠেছে। কিন্তু কবির হৃদয়কে তা স্পর্শ করতে পারছে না। কারণ কবি সুফিয়া কামালের মতো তার হৃদয়ও প্রিয়জন হারানোর শোকে আচ্ছন্ন হয়ে আছে। তাই প্রকৃতির আনন্দোৎসবের মধ্যেও তিনি অবসন্ন মনে অন্ধকার ঘরে পড়ে আছেন। তার বন্ধুহারা হৃদয়ে সেতারের যে করুন সুরলহরী ঝংকৃত হচ্ছে তা কবি সুফিয়া কামালের মতো তাকেও সৌন্দর্য সুধা পান করা থেকে বিরত রেখেছে। এভাবে উদ্দীপকটিতে ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতার প্রিয়জন হারানো মর্মবেদনার বিষাদময় দিকটি ফুটে ওঠেছে।

ঘ. উদ্দীপক ও ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতায় প্রকৃতি ও মানবমনের সম্পর্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক তাৎপর্যময় অভিব্যক্তি পেয়েছে। এদিক বিবেচনায় উদ্দীপকটিকে ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতার প্রচ্ছন্ন রূপ বলা যায়। প্রচ্ছন্ন বলতে বুঝায়, সুপ্ত বা গুপ্ত। কবিতায় কবিমন শোকাচ্ছন্ন ও বেদনা-ভাবাতুর ছিল বিধায় বসন্ত তার সমস্ত সৌন্দর্যের ডালি দিয়েও কবিকে বিমোহিত করতে পারেনি। অপরদিকে, উদ্দীপকেও এমনই এক দৃশ্যপটের অবতারণা হয়েছে। ‘পুষ্প ফুটে কোন কুঞ্চবনে’ চরণটি দ্বারা উল্লখিত অংশে প্রকাশ পেয়েছে প্রকৃতির প্রতি বক্তার উদাসীনতা যা ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতার মূলভাবকেই প্রতিফলিত করছে। কবিতায় কবি শীতের করুণ বিদায়কে কিছুতেই ভুলতে পারছেন না। কেননা, রিক্ত হস্তে শীতের করুন বিদায় কবিকে মনে করিয়ে দেয় প্রিয় মানুষের চলে যাওয়ার মুহূর্ত। আর উদ্দীপকের বন্ধুহারা মম অন্ধ ঘরে, আছি বসে অবসন্ন মনে চরণটি যেন সে ইঙ্গিতই বহন করছে। ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতায় কবির মন দুঃখবারাক্রান্ত। তার কণ্ঠ নীরব, নিঃস্পৃহ। বসন্তের সৌন্দর্য তার কাছে অর্থহীন। কেননা কবির হৃদয় আচ্ছন্ন রিক্ততার হাহাকারে। শীত ঋতু যেভাবে সর্বরিক্ত সন্ন্যাসীর মতো কুয়াশার চাঁদর গায়ে পত্রপু®পহীন দিগন্তের পথে চলে গেছে তেমনি প্রিয় মানুষের অজানা গন্তব্যে পাড়ি জমানো কবিকে বিষাদময় রিক্ততার সুরে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। প্রকৃতির অমোঘ নিয়মকে মেনে নিতে ব্যথিত কবিচিত্ত তাই প্রকৃতির সৌন্দর্যকে তাহারেই পড়ে মনে কবিতার কবির মতো উল্লেখিত অংশের কবির হৃদয়েও সাড়া জাগাতে পারছে না। প্রিয় মানুষের সান্নিধ্য যে কোনো মানুষেরই কাম। কিন্তু নিঃসঙ্গতা মানুষকে করে তোলে বিবাগী, বিষাদগ্রস্ত ও উদাসীন। এর প্রত্যক্ষ প্রমাণ পাওয়া যায় ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতায় এবং উদ্দীপকে। প্রিয়জনের অনুপস্থিতি মানবমনকে যে কীভাবে আন্দোলিত করে তা সহজেই অনুভূত হয় উক্ত দুইটি প্রেক্ষাটটে। প্রকৃতির মোহাঞ্জন আবেগ, নিরূপম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, ঋতুবদলের পালায় পরিবর্তিত প্রকৃতির নবরূপ সবই যেন তখন অর্থহীন ও নি®প্রাণ মনে হয়। হৃদয়ের ভাবাবেগ মানুষকে প্রতিক্ষণে প্রিয় মানুষের স্মৃতি রোমন্থনে বাধ্য করে দেয়। তাইতো ‘ তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতায় কবি বসন্তের উপস্থিতিতে ভাবলো শহীন। শীতের রিক্ততাই যেন কবির হৃদয়কে বারবার ক্ষত-বিক্ষত করছে। প্রিয় মানুষকে হারানোর আর্তি তাঁর হৃদয়ে জেগে আছে প্রকট রূপে। আর উদ্দীপকেও এমনি মনোভঙ্গিমার আভাস পাওয়া যায়। বিষণœ হৃদয়ে প্রিয় সৌন্দর্য উপলব্ধি ব্যর্থ হয়েছেন। তাই বিষয়বস্তুর বিচারে উদ্দীপকটিকে ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতার প্রচ্ছন্ন রূপ বলা অত্যন্ত যথার্থ ও যুক্তিযুক্ত।


‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতার সৃজনশীল প্রশ্ন- ১৫:

নিচের উদ্দীপকটি পড়ো এবং প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও।
প্রকৃতির গতি স্বাভাবিক। কোনো কিছুর সাপেক্ষ নয় প্রকৃতি। কে প্রণোদিত হল, কে ব্যথিত হল; প্রকৃতিকে নিয়ে কে গান লিখলো, কে মুখ তুলে চাইলো না- এতে প্রকৃতির গতি থেমে থাকে না। শুধু প্রশ্নাকুল হয় সৌন্দর্যপিপাসু মানুষ যারা সৌন্দর্য স্রষ্টার কাছে সুন্দরের প্রত্যাশা করেন। কিন্তু অনেকেই জানে না সুন্দরের আবির্ভাব কবি মনের সুস্থতার ওপর নির্ভর করে। কবিমন যদি সুন্দরের অবস্থানের জন্য উপযুক্ত না হয় প্রকৃতি সেখানে ব্যর্থ হয়ে ফিরে যায়। কবি মনের ব্যক্তিগত বেদনা বা সুখ কবিতা বা সাহিত্য সৃষ্টির ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করে। এজন্য কবি ভক্তের আকুতি সত্ত্বেও কবি সুফিয়া কামাল বসন্ত বন্দনায় ব্যর্থ হয়েছিলেন। বসন্ত চলে গেল কিন্তু কবিচিত্ত জাগলো না সৃষ্টি বেদনা নিয়ে। কারণ কবিচিত্তের ব্যক্তি বেদনার আপেক্ষিক অনুপাত, সৃজন বেদনার চেয়ে বেশি।

ক. তাহারেই পড়ে মনে কবিতাটি কবির কোন কাব্যে স্থান পেয়েছে?
খ. বসন্তের প্রতি কবির তীব্রবিমুখতা কেন?
গ. প্রদত্ত উদ্দীপক ও মূল কবিতা অবলম্বনে কবির মনোজগৎ বিশ্লেষণ কর।
ঘ. সাহিত্য বা শিল্প, কবি বা শিল্পীর স্বতঃস্ফূর্ততার ফসল, বহিরারোপিত কোন প্রণোদনার ফসল নয়-উদ্দীপকও কবিতা অবলম্বনে এ বক্তব্যের যথার্থতা প্রতিপন্ন কর।

ক. তাহারেই পড়ে মনে কবিতাটি কবির ‘সাঁঝের মায়া’ কাব্যে স্থান পেয়েছে।
খ. বিষাদাক্রান্ত মানুষ, অনেক সময় নানা কারণে অন্তর্গত বিষাদের খবর অন্যকে জানতে দেয় না। অনেকটা, দুঃখ বিলাসে মগ্ন থাকে সে। কষ্ট বুকের মধ্যে পুষে রেখে নিঃসঙ্গ থাকতে চায়। সুখানুভবও তার কাছে খুব বেশি আবেদন সৃষ্টি করতে পারে না। এই ধরনের মনোবিকল্পনের শিকার কবি। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি একটি দুঃখকে দোসর করেছিলেন। তাঁর প্রথম স্বামী সৈয়দ নেহাল হোসেন ছিলেন তাঁর সাহিত্য সাধনার উৎসাহদাতা। তাঁর অকাল মৃত্যুতে তিনি বেদনায় মুষড়ে পড়েছিলেন। সেই কষ্ট তিনি কাটিয়ে উঠতে পারেননি। তাই বসন্তের এত উৎসবের মধ্যেও তিনি বসন্তের প্রতি মনোযোগী হতে পারেননি। বরং দুঃখের প্রাবল্যে সুখ, বিমুখ হয়ে ফিরে গেছে।

গ. ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতায় প্রকৃতিকে কেন্দ্র করে কবির ব্যক্তি জীবনের বিষাদময় স্মৃতির করুণ কাহিনী বাগ্ময় হয়ে ফুটে উঠেছে।
কবিতাটি নিসর্গ সন্দর্শনমূলক। তবে এ কবিতার মর্মমূলে বসন্তের সৌন্দর্য আভার অন্তরালে রয়েছে কবির নিজের জীবনের বেদনার বাণী বিচ্ছেদের নিদারুণ মর্মজ্বালা। শীতের জরাজীর্ণ রিক্ততার মধ্যে উৎসারিত হয়েছে কবির জীবনের পুষ্পশূন্য হৃদয়ের ব্যথা। কবিতায় বিধৃত ভাবাবেগময় ভাববস্তুর বেদনাঘন বিষণœতার সুর এবং সুললিত ছন্দ এতই মাধুর্যমণ্ডিত হয়েছে যে পাঠকের চিত্তকে তা সহজে স্পর্শ করে। আর এই সূত্রে আবি®কৃত হয়েছে কবির মনোজগৎ।
➠ বসন্ত এসেছে- ফুল ফসলের সম্ভার নিয়ে। কবিভক্ত তাই কবির কাছে এসেছে বসন্তকে ঘিরে গান রচনার তাগিদ নিয়ে। বসন্ত কবিকে অনুপ্রাণিত করবে এটা প্রত্যাশিত। কিন্তু কবি মনের বেদনাকে অস্বীকার করতে পারছেন না। ইচ্ছে করলে ভুলে থাকতে পারেন কিন্তু তেমন ইচ্ছেকে অন্তরে ঠাঁই দিতে পারছেন না। ভেতর থেকে কে যেন কবিকে নিরুৎসাহ করে রাখে। কবির বিবেকও সায় দেয়না আনন্দযজ্ঞে সামিল হতে। যে মানুষটি তার সত্তাকে জুড়ে ছিল দীর্ঘদিন তাকে স্মৃতিতে ধরে রাখাটা উচিত বলে মনে করেন কবি। প্রথম স্বামীর স্মৃতি আঁকড়ে পড়ে আছেন কবি। এটা কিছুটা হলেও কৃতজ্ঞতার পরিচায়ক। কবির মনোজগৎটা সৌন্দর্যবিমুখ নয়। বরং ভালোবাসার প্রতি সকৃতজ্ঞ-বিবেক চালিত।

ঘ. সাহিত্য বা শিল্পকে অ্যারিস্টটল বলেছেন অনুকরণ। শিল্পী মনের বাইরের কোন বস্তু বা ভাব যেভাবে শিল্পী চিত্তে প্রণোদনা সৃষ্টি করে, সেভাবে তার একটা অনুকরণ তৈরি হয় মনের মধ্যে। মন সেই বস্তু বা ভাবের প্রতীকে তৈরি করেন একটি সৌন্দর্য সত্তা যার নাম শিল্প। এজন্য অৎঃ কে বলা হয় জবভষবপঃরড়হ ড়ভ সরহফ. এক্ষেত্রে যে প্রণোদনাটি বাইরে থেকে আসে সেটি মনের ওপর প্রতিফলন ফেলে শুধু জোর খাটায় না। প্রাপ্ত প্রতিফলন মন যদি গ্রহণ করতে পারে-তাহলে গ্রহণের মুহূর্ত থেকে শুরু হয় অনুকরণের কাজ। তারপর একসময় সৃষ্টি কর্ম রূপে বেরিয়ে আসে শিল্পবস্তু। পুরো প্রক্রিয়াটা সংঘটিত হয় মনের স্বতঃপ্রণোদনায়। বাইরের কোন উদ্দীপক চাপ সৃষ্টি করলে বা অনুকরণীয় বস্তু বা ভাব শিল্পী মনের ধারণ ক্ষমতা বা বোধের বাইরের বিষয় হলে মন সেটাকে ফিরিয়ে দেয়। ফলে কিছুই সৃষ্টি হওয়ার অবকাশ থাকে না। যদি কোন অনুরোধ (যেটাকে ফরমায়েশ বলা হয়) বা দর্শন (রংস) বাইরে থেকে প্রভাব বিস্তার করে এবং মন যদি গ্রহণ করার জন্য বাধ্য হয়, তাহলে যে অৎঃ উৎপন্ন হয় শিল্পবোদ্ধারা তার নাম দিয়েছেন ইধফ ধৎঃ. এড়ড়ফ ধৎঃ সব সময় শিল্পীর বা কবির মনের স্বতঃস্ফূর্ত বহিঃপ্রকাশ হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। সহজ কথায় মনের স্বতঃস্ফূর্ততাই শিল্পের বড় উৎপাদক।
➠ উদ্দীপক এবং ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতায় শিল্প সৃষ্টিবিষয়ক এই সত্যটি কাজ করেছে। বসন্ত, শিল্প সৃষ্টির জন্য বাহ্যিক প্রণোদনা হিসেবে দ্বারলগ্ন। কবিভক্তও মিনতি জানাচ্ছেন। কিন্তু কবিচিত্ত বহিরারোপিত এই উদ্দীপকটি গ্রহণ করার জন্য প্রস্তুত নয়। কারণ তার মনের সবটাই দখল করে রেখেছে তার প্রথম স্বামীর সাথে যাপিত জীবনের স্মৃতি। তাকে কোনমতে ভুলতে পারেন না। মন সেখানেই নিবদ্ধ। তাই বসন্তকে ফিরে যেতে হয়-বসন্ত বন্দনা রচিত হয় না। বহিরারোপিত সুর ও সৌন্দর্য পারেনি কবি মনের আগল সরাতে। অর্থাৎ সারকথা হল সাহিত্য আত্মগত স্বতঃস্ফূর্ততার ব্যাপার, বহিরারোপিত কোন প্রণোদনার ফসল নয়।


‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতার সৃজনশীল প্রশ্ন- ১৬:

নিচের উদ্দীপকটি পড়ো এবং প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও।
‘স্যার, নিজের কথার এমন উত্তুঙ্গ উপস্থাপনা কি সাহিত্যের শর্ত ভঙ্গ করে না? একজন ছাত্রের তরফ থেকে এল প্রশ্ন-জামিল স্যারের দিকে। জামিল স্যার, আত্মবিশ্বাসে ঋদ্ধ তার চোখ দুটো ছাত্রদের দিকে বিছিয়ে দিয়ে বললেন- না, করে না। কবিতায় গীতিধর্মিতা থাকে। আর গীতিধর্মিতা ব্যক্তিগত দুঃখ সুখের মর্মমূল থেকে উৎসারিত। যেমন ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতায় কবি তার একজন স্বজনকে হারিয়েছেন। তাইতো প্রকৃতির কোন কিছু তাঁর চিত্তে দোলা লাগায় না। সুন্দরের পূজারী হয়েও সুন্দরের প্রতি তাঁর তীব্র বিমুখতা। আসলে তাঁর সেই স্বজনকে তিনি ভুলতে পারেন না। তাইতো সুখকর সমস্ত জীবনানুভব তাঁর কাছে বিবর্ণ, পাণ্ডুর, ধূসর।

ক. ‘Our sweetest Songs are those that tell of saddest thought’ -এই উপলব্ধিটি কোন কবির।
খ. কবি ভক্তের সৌন্দর্য সৃষ্টি অনুপ্রেরণা সত্ত্বেও কবির বসন্ত বিমুখতার কারণ কী?
গ. প্রদত্ত উদ্দীপক অনুসরণ করে কবির গীতিধর্মী কবিধর্ম বিশ্লেষণ কর।
ঘ. সাহিত্য শর্তাধীন নয়, শর্তহীন-আলোচনা কর।

ক. Our Sweetest Songs are those that tell of Saddest thought -কথাটি PB. Shelly. (Percy bysshe shelley).
খ. বিষাদাক্রান্ত মানুষ অনেক সময়, নানা কারণে অন্তর্গত বিষয়ের খবর অন্যকে জানতে দেয় না। অনেকটা, দুঃখ বিলাসে মগ্ন থাকে সে। কষ্ট বুকের মধ্যে পুষে রেখে নিঃসঙ্গ থাকতে চায়। সুখানুভব তার কাছে খুব বেশি আবেদন সৃষ্টি করতে পারে না। এই ধরনের মনোবিকলনের শিকার কবি। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি একটি দুঃখকে দোসর করেছিলেন। তাঁর প্রথম স্বামী সৈয়দ নেহাল হোসেন ছিলেন তাঁর সাহিত্য সাধনার উৎসাহ দাতা। তাঁর অকাল মৃত্যুতে তিনি মুষড়ে পড়েছিলেন। সেই কষ্টটা তিনি কাটিয়ে উঠতে পারেননি। তাই বসন্তের এত উৎসবের মধ্যেও তিনি বসন্তের প্রতি মনোযোগী হতে পারেন নি। বরং দুঃখের প্রাবল্যে সুখ বা আনন্দ বিমুখ হয়ে ফিরে গেছে। দুঃখের আঘাতে আহত হয়ে বসন্তের প্রতি বিমুখতা সৃষ্টি হয়েছে।

গ. কবিতার গীতিধর্মিতা একটি অনিন্দ্যসুন্দর অনুষঙ্গ। একসময় যখন সাহিত্যের মান বিচারে ‘Art for art shake’ -এই পরিমাপক বিদ্যমান ছিল তখন বলা হতো, সাহিত্যে নিজের কোন কথা বলা হবে না, কারণ শিল্প নৈর্ব্যক্তিক। কিন্তু পরে কবিরা মানেননি এই বিধি। নিজের হৃদয়ের ভাবোচ্ছ্বাসকে গীতিমূর্ছনার মাধ্যমে বিকাশ করার প্রয়াস পান অনেক কবি। এগুলোর সাধারণ নাম গীতিকবিতা। যে ধর্ম এই কবিতাগুলোকে বিশিষ্টতা দান করেছে তার নাম-গীতিধর্মিতা। কবি যখন তার একান্ত আত্মগত ভাবোচ্ছ্বাসকে আবেগ কম্পিত সুরে প্রকাশ করেন তখন তা হয় গীতিধর্মী। উদ্দীপকে সাধারণভাবে একজন কবির গীতিধর্মিতা বিষয়ে প্রাজ্ঞ মত প্রকাশিত হয়েছে। উদ্দীপকে প্রসঙ্গত সুফিয়া কামালের ‘তাহারেই পড়ে মনে’ এ কবিতাটির প্রসঙ্গ এসেছে। এ কবিতাটির মধ্যে গীতিধর্মিতা বিদ্যমান। এ কবিতার শেষ স্তবক থেকে জানা যায় তার এক প্রিয়জন (তাঁর প্রথম স্বামী সৈয়দ নেহাল হোসেন) তাকে রিক্ত নিঃস্ব করে দিয়ে পরলোকে পাড়ি দিয়েছেন। তাঁকে নিয়ে কবিচিত্তে যে বেদনার বাষ্প তার অভিঘাতে তিনি বসন্তকে পর্যন্ত ফিরিয়ে দিয়েছেন। অন্তরে বহমান দুঃখের ইন্ধনে দ্বারে জাগ্রত বসন্তের বিষয়ে উদাসীন উন্মনা তিনি। নানাভাবে নিজের একান্ত বিষয় সর্বজনবেদ্য করে উপস্থাপন করেছেন কবি। নিতান্ত স্বল্প পরিসরে কবি তার পূর্ণ হৃদয়কে মেলে ধরেছেন পাঠকের সামনে। এগুলো গীতিধর্মিতার গুণ। ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতায় কবির যে কবিধর্ম তা গীতিধর্মিতার লক্ষণাক্রান্ত।

ঘ. মানুষের মনের ভেতরে নিজেকে বিকাশ বা প্রকাশ করার একটা অদম্য ইচ্ছা কাজ করে। এর নাম সৃজন বেদনা। এ বেদনার বিকশিত রূপ যা মানুষের মননশীলতার ফসল-তার নাম শিল্প। শিল্পের পরিচিতি পর্ব শেষ হলে শিল্প বোদ্ধারা বললেন শিল্প হতে হবে শর্তযুক্ত। শিল্প পবিত্র বস্তু বিধায় তাতে মানুষের বা শিল্পীর একান্ত ব্যক্তিক ইচ্ছা থাকবে না। তাহলে শিল্প তার মহত্ত্ব হারাবে। এভাবে শিল্পের মহত্ত্ব রক্ষার জন্য তাকে শর্তযুক্ত করে দেয়া হল। কিন্তু শিল্প যে মনোগত বিষয় সেটা ভাবা হলনা। মনোগত বিষয় বলে ব্যক্তি মনের প্রতিফলন শিল্পে থাকবে এটাই স্বাভাবিক। এই স্বাভাবিক প্রাণ প্রবাহের ওপর শর্ত আরোপ করে দিলেন কলাকৈবল্যবাদিরা। কিন্তু কবি বা সাহিত্যিক সম্পর্কে বলা হয়-ÑPoets are the most unacknowledged Legislature of the world. কবিরা হলেন আইন ভঙ্গকারী আইন প্রণেতা। তাঁরা আইন করেন; সে আইন ভেঙে আনন্দ পান। এই প্রবণতার ফল হিসেবে একসময় ঘোষিত হল ‘Art for life shak’-জীবনের জন্য শিল্প। শিল্পের গোঁড়ালি থেকে শর্তের শেকল খুলে গেল। সাহিত্য হলো শর্তহীন। ভেবে দেখার বিষয় এই যে মনোজগতে যে সৃষ্টি সুখের ইন্ধন, তাকে কিন্তু শর্তের তর্জনী দিয়ে শাসন করা যায় না। তাহলে সৃষ্টিশীলতাই রুদ্ধ হয়ে যাবে। যখন ‘Art for life shak’-এর স্বৈরতন্ত্র বিদ্যমান ছিল তখনো কিন্তু শিল্পীরা তা মানেননি। এই না মানা এবং তাকে মেনে নেয়াটা অনুপ্ররণা হিসেবে নিলেন অন্য শিল্পীরা। ফলে শিল্প এক সময় হয়ে পড়লো শর্তহীন। সৃষ্ট হল বিপুল ব্যাপক শিল্প বস্তু। সাহিত্য শিল্পের একটা অনুষঙ্গ। সুতরাং শিল্পের যা প্রাণ ধর্ম তা সাহিত্যের প্রাণ ধর্ম। অতএব সাহিত্য শর্তাধীন নয়, শর্তহীন।


‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতার সৃজনশীল প্রশ্ন- ১৭:

নিচের উদ্দীপকটি পড়ো এবং প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও।
যারে খুব বেসেছিনু ভালো
সে মোরে ছেড়ে চলে গেল।
রেখে গেছে শুধু মায়া।
লাগে না ভালো অপরূপ প্রকৃতি
যতই করুক কেউ মিনতি।
আমি এখন রিক্ত শূন্য
মন পড়ে রয়েছে তার জন্য।
সে দিল মোরে কেমনে ফাঁকি
আমি এখন বড় একাকী।

ক. ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতায় কবি কোন গান বাজার কথা জানতে চেয়েছেন?
খ. ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতা অবলম্বনে সংক্ষেপে বসন্ত ঋতুর বর্ণনা দাও।
গ. উদ্দীপকের প্রথম দু’চরণে ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতার কোন দিকটি ফুটে ওঠেছে?-ব্যাখ্যা কর।
ঘ. উদ্দীপকের ভাব যেন ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতার কবি সুফিয়া কামালের মনোবেদনার বহিঃপ্রকাশ।-বিশ্লেষণ কর।

ক. ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতায় কবি আগমনী গান বাজার কথা জানতে চেয়েছেন।
খ. সাধারণভাবে প্রকৃতির সৌন্দর্য মানব মনের অফুরন্ত আনন্দের উৎস। সেই অফুরন্ত আনন্দের উৎস হিসেবে পৃথিবীতে বসন্তের আবির্ভাব ঘটেছে। প্রকৃতিতে ঘটে গেছে এক অনিন্দ-হিন্দোল। দখিন দুয়ার খুলে গেছে। বাগানে ফুটেছে বাতাবি লেবুর ফুল। ফুটেছে আমের মুকুল। দখিনা সমীর গন্ধে গন্ধে অধীর-আকুল হয়েছে। নতুন ফুল প্রকৃতিকে সাজিয়েছে তার পূর্ণ রূপ মাধুর্য দিয়ে। মাধবী কুঁড়ির বুকে গন্ধ ছড়িয়েছে। দখিনা বাতাস বইতে শুরু করেছে। সঙ্গে এনেছে পৃথিবীর সমস্ত সৌরভ। আমের মুকুলে মৌমাছির গুঞ্জরণ, মাধবী ফুলের কুঁড়ির নাচন আর বনে বনে ফুলের আসরে নানা পাখ-পাখালীর কণ্ঠে বসন্তের এ আগমন যেন মানবমনকে আনন্দে শিহরণে উদ্বেলিত করে তুলেছে। বনভূমি নতুন পত্রপল্লবে বিচিত্র ফুলের বাহারে হয়ে উঠেছে রঞ্জিত, নতুন সাজে সজ্জিত হয়ে উঠেছে পুলকিত স্বচ্ছলতার এক প্রগাঢ় নিকুঞ্জ।

গ. উদ্দীপকের প্রথম দু’চরণে কবি বেগম সুফিয়া কামাল রচিত ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতার প্রিয়জন হারানোর বেদনার দিকটি ফুটে ওঠেছে। কবি সুফিয়া কামাল তার প্রথম স্বামী সৈয়দ নেহাল হোসেনকে প্রচণ্ড ভালোবাসতেন। তিনিই ছিলেন কবির সাহিত্য সাধনার প্রধান সহায়ক ও উৎসাহদাতা। মনে-প্রাণে যাকে ভালোবেসেছিলেন, সেই ভালোবাসার ধনকে তিনি নিজের কাছে ধরে রাখতে পারেননি। আকস্মিকভাবেই মৃত্যুকে বরণ করেন তার স্বামী, আর কবি হয়ে পড়েন একাকী, নিঃস্ব। উদ্দীপকের কবিতাংশের প্রথম দু’টি চরণে এ বিষয়টিই ফুটে ওঠেছে। এ অংশের কবি নিজেও তাঁর প্রিয়জনকে খুব ভালোবেসেছিলেন। কিন্তু নিয়তি তাকে দিল কবি সুফিয়া কামালের মতো বেদনার আঘাত। তাঁর প্রিয়জনও তাঁকে ছেড়ে চলে গেল না ফেরার দেশে। এত ভালোবাসলেন, তবুও আটকানো গেলো না তাকে। মোটকথা যে ঘটনাকে কেন্দ্র করে পুরো ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতাটি আবর্তিত হয়েছে, সেই ঘটনাটিই উদ্দীপকের প্রথম দু’চরণে উল্লেখ করা হয়েছে এ কথাটি নির্দ্বিধায় স্বীকার করে নেয়া যায়।

ঘ. ‘তাহারেই পড়ে মনে কবিতাটি কবি বেগম সুফিয়া কামালের ব্যক্তিজীবনের দুঃসময় ঘটনার রূপকধর্মী বহিঃপ্রকাশ। উদ্দীপকটিও যেন একই দুঃখবোধকে ধারণা করে আছে। ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতায় কবি বসন্তের আগমনে, তার অপরূপ সৌন্দর্যে মোটেও আপ্লুত নন। কারণ তাঁর হৃদয় এখন শীতের মতোই রিক্ত, নিঃস্ব আর শূন্যতায় ভরপুর। বসন্তের আগমন তাঁর হৃদয়ে কোনোরকম আবেদন সৃষ্টি করতে ব্যর্থ। কেননা, কবি তাঁর প্রাণপ্রিয় স্বামী সৈয়দ নেহাল হোসেনকে হারিয়েছেন, যিনি ছিলেন কবির সাহিত্য-সাধনার প্রধান সহায়ক ও উৎসাহদাতা। কিন্তু তাঁর আকস্মিক প্রয়াণকে কবি কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না। প্রিয়জন হারানোর বেদনা তাঁর হৃদয়ে এমন গভীরভাবে বেজেছে যে প্রকৃতির কোনো পরিবর্তনই তাঁর হৃদয়ের দুয়ার খুলতে পারছে না। পুরো কবিতা জুড়েই কবি তার মনোবেদনার স্বরূপকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন, যার স্পষ্ট বহিঃপ্রকাশ আমরা দেখতে পাই উদ্দীপকের কবিতাংশে। উদ্দীপকের কবিতার কবিও তার প্রিয় মানুষকে, ভালোবাসার মানুষকে হারিয়ে আজ রিক্ত। কেননা, এ মানুষটিই ছিল তার জীবনের ছায়াসঙ্গী এবং তাঁর অবর্তমানেও এখনো তার স্মৃতি কবিকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে । আজ কবি এতটাই রিক্ত ও শূন্য যে, প্রকৃতির অপরূপ সাজও তাঁর কাছে কোনো আকর্ষণের বিষয় মনে হয় না। বরং তিনি তাঁর প্রিয় মানুষটির কথা’ স্মরণ করে একাকী নীরবে, নিভৃতে থাকেন। যে হাহাকার, যার স্পষ্ট উল্লেখ পাওয়া যায় ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতায়। সুতরাং বলা যায়, উদ্দীপকের কবিতাংশের মূলভাবের মধ্য দিয়ে কবি সুফিয়া কামালো প্রিয়জনকে হারানোর বেদনা ফুটে ওঠেছে।


‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতার সৃজনশীল প্রশ্ন- ১৮:

নিচের উদ্দীপকটি পড়ো এবং প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও।
আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে। কিন্তু কিছুই ভালো লাগেনা আমার। বিষাদ ছুঁয়েছে আজ মন ভালে নেই। ইচ্ছে ছিল বসন্তকে নিয়ে একটা গান বা কবিতা লিখবো। মনঃসংযোগ হচ্ছেনা লেখায়। কে তুমি? ও হ্যাঁ- চিনেছি। বসন্তগীতির জন্য এসেছো তুমি? কিন্তু কণ্ঠ যে সমর্থন করে না। মন যে বিক্ষিপ্ত, এবার থাক। তাছাড়া আমি বসন্তগীতি না গাইলেও সেতো ব্যর্থ হয়ে যায়নি। বরাবরের মত সে এসেছে। আমাকে কেন বেদনাবিদ্ধ কর? বসন্ততো আমার অপেক্ষা করেনি! গাছে গাছে ফুল ফুটিয়েছে। কণ্ঠে দিয়েছে গান। “আমার জন্য তো থেমে নেই বসন্তের পুষ্প রচন।”

ক. কবির প্রথম স্বামীর নাম কী?
খ. কবি কেন বসন্তকে সংবর্ধনা জানাতে পারেন নি?
গ. উদ্দীপক অবলম্বনে বসন্তের ধর্ম/বৈশিষ্ট্য লেখ।
ঘ. উদ্দীপক অবলম্বনে সৌন্দর্যপিপাসু একজন কবির মনোবেদনা বিশ্লেষণ কর।

ক. কবির প্রথম স্বামীর নাম সৈয়দ নেহাল হোসেন।
খ. ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতায় কবি সুফিয়া কামালের নিজের জীবনের বিষাদময় স্মৃতির করুণ রাগিনী যেন বাণীমূর্তি লাভ করেছে। কবিতায় নিসর্গের বর্ণময় রূপের আড়ালে রয়েছে কবির নিজের জীবনের ভাবোচ্ছ্বাস ও আত্মগত বিচ্ছেদের নিদারুণ মর্মজ¦ালা। শীতের রিক্ততার মধ্যে উৎসারিত হয়েছে কবির জীবনের পুষ্পশূন্য হৃদয় যন্ত্রণা।
প্রথম স্বামী সৈয়দ নেহাল হোসেনের আকস্মিক মৃত্যুতে কবির জীবনে নেমে এসেছে দুঃসহ এক বিষণœতা। স্বামী ছিলেন তাঁর সাহিত্য সাধনার উৎসাহদাতা। তাই তাঁর মৃত্যুতে কবির মন আচ্ছন্ন হয়ে আছে রিক্ততার হাহাকারে। এ কবিতাকে আচ্ছন্ন করে আছে এই বিষাদখিন্ন রিক্ততার সুর। তাই আনন্দের ঝর্ণাধারা নিয়ে বসন্ত এলেও উন্মনা কবির অন্তর জুড়ে বেদনার রাগিনী ধ্বনিত। তাই বসন্তকে তিনি সংবর্ধনা জানাতে পারেন নি।

গ. প্রকৃতির স্বাভাবিক ধর্মে বসন্ত একসময় এসে হাজির হয় পৃথিবীর আঙিনায়। ফুল ফুটাতে ফুটাতে তার আগমন। ➠ ফুল ছড়াতে ছড়াতে তার লীলা। সংবেদনশীল চিত্ত তার আগমনে পুলকিত হয়; তাকে নিয়ে গান রচনা করে।
আবেগতাড়িত শিল্পীরা বসন্তের অচেতন সত্তায় চেতনের গুণ আরোপ করে হৃদয় বিনিময় করার মধ্যদিয়ে বসন্তকে আপন করে নেয়। তৃষিতকে তৃপ্ত করতেই বসন্ত আসে। তাহলে দুঃখীর দুঃখ দেখলে বসন্ত কি ফিরে যাবে? এমন ঘটনা কি ঘটে? কবি মনোবেদনায় আহত; অতএব বসন্ত আসবে না! তা হয় না। কে সুখী কে দুঃখী তা দেখেনা বসন্ত। শুধু আনন্দের বার্তা জানানোর জন্য সে আসে। ফুল ফোটায়, রং ছড়ায়, গান গাওয়ায়। বসন্তোৎসব শেষ হলে বিদায় নেয়।
➠ জীবনে দুঃখই বেশি। এই দুঃখসঙ্কুল জীবনে মানুষ সুখ চায়। বসন্ত সেই সুখের গান গায়। আনন্দ যজ্ঞে সকলকে নিমন্ত্রণ করে। এর মধ্যে কেউ যদি দুঃখে থাকে বসন্ত তাকে সান্ত্বনা দিতে পারে না। কারণ সুখ সকলের দুঃখ একান্তই নিজের।

ঘ. কবির কাজ অন্তর হতে বচন আহরণ করে, আনন্দলোক সৃষ্টি করা। তাঁর আত্মগত ভাবোচ্ছ্বাস যখন অন্যকে আপ্লুত করে তখন তা হয় মহৎ কবিতা। এই উচ্ছ্বাস সুখের হতে পারে, দুঃখেরও হতে পারে। প্রদত্ত উদ্দীপকে একজন কবির কথা ব্যক্ত হয়েছে আত্মকথনের ভঙ্গিতে। তিনি আনন্দলোকের বাসিন্দা। সৌন্দর্য পিপাসু মধুর বসন্ত এসেছে। সৃষ্টির বেদনা জেগেছে মনে। কিন্তু উপযুক্ত পরিবেশ নেই। মন ভালো নেই। ইচ্ছে ছিল অন্তর হতে বচন আহরণ করে একটি মহৎ কবিতা রচনা করবেন। কিন্তু পারছেন না। কারণ কবিতা বা শিল্পের জন্য যে মন দরকার হয়, মনের সেই সুস্থতা নেই তার। তাই কবির সৃজন বেদনা ব্যর্থ হয়।
➠ শিল্পের জন্য যেমন উপলক্ষ বস্তু বা বিষয়বস্তু প্রয়োজন হয়, প্রয়োজন হয় শব্দ প্রকৌশল দক্ষতা। তবে বেশি প্রয়োজন কবির ‘মনোভূমি’ যা বাস্তবের ভিত্তিভূমি বা কল্পভূমি-এসব কিছু থেকেও সত্য। কোন এক প্রাজ্ঞজন কবিকে বলে যান-‘সেই সত্য যা রচিবে তুমি’ আর তার জন্য প্রয়োজন কবির পরিচ্ছন্ন মনোভূমি। উদ্দীপকে বর্ণিত কবির পক্ষে বসন্তগীতি রচনা করা সম্ভব হচ্ছে না-কারণ তার ‘মনোভূমি’ বসন্তগীতির জন্য উপযুুক্ত ছিলনা। কোন এক দুর্জেয় কারণে তিনি বিষণœ, অন্যমনস্ক; সময় থেকে অনেক দূরে। এজন্য কবির মনে ক্ষোভ বিদ্যমান দুঃখও আছে। কিন্তু মন যে প্রস্তুত নয়। তাই সৌন্দর্যতৃষ্ণা থাকার পরও কবি সৌন্দর্য সৃষ্টিতে ব্যর্থ হচ্ছেন। একটি সৃষ্টিশীল সত্তার পক্ষে এটা বড় যন্ত্রণার।


‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতার সৃজনশীল প্রশ্ন- ১৯:

নিচের উদ্দীপকটি পড়ো এবং প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও।
আলোচনার বিষয় ছিল : ‘মনোবেদনা এবং সঙ্গীত।’ দর্শক সারি থেকে প্রশ্ন এল- ‘বিনোদন কি মনের ওপর চেপে থাকা কষ্টের আবরণকে অপসারিত করতে পারে? আলোচকদের একজন ছিলেন সঙ্গীত বিশেষজ্ঞ কাজল। তিনি বললেন ‘হ্যাঁ পারে।’ অন্যজন ‘মনোজগত’ পত্রিকার সম্পাদক বললেন, ‘না পারে না।’ মনোবেদনা উৎসারিত হয় মনের ক্ষত থেকে। ক্ষত যত গভীর হয়, বেদনা তত প্রলম্বিত হয়। কখনো কখনো কোন স্থান, কোন প্রাকৃতিক পরিবেশ, কোন ব্যক্তির মনের গহীনে লুকিয়ে থাকা বেদনাকে মনের উপরিতলে নিয়ে আসে। বিনোদন এই কষ্টকে ভুলিয়ে রাখে মাত্র, বিলুপ্ত করতে পারে না।’ অন্য একজন আলোচক কবি সুমন বললেন- ‘কথাটা ঠিক। এজন্য সুফিয়া কামাল তার প্রথম স্বামীকে কোনদিন ভুলতে পারেন নি। বসন্ত এসেছিল, কিন্তু তাতে তার মনের গহীনে জমে থাকা কষ্ট কমেনি। কেবলই মনে হয়েছিল- সে নেই। পরবর্তী সংসারে সুখের প্রাচুর্য ভুলিয়ে রাখতে পারেনি প্রথম প্রেমের অবলম্বনকে।’

ক. বসন্ত বন্দনা অর্থ কী?
খ. কবিভক্ত কবির কাছে কি মিনতি করছেন? এরূপ মিনতির কারণ কী?
গ. প্রদত্ত উদ্দীপক এবং কবিতা অবলম্বনে দেখাও প্রকৃতির সৌন্দর্য ও কবির মনের অবস্থার মধ্যে কোনটি প্রবল।
ঘ. প্রদত্ত উদ্দীপক অবলম্বনে ভালোবাসার চিরন্তন মূল্যবোধগুলো তুলে ধর।

ক. বসন্ত বন্দনা অর্থ-বসন্তের আগমনে তারই প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে রচিত কোন গান বা কবিতা।
খ. স্রষ্টা যিনি কোনো বিষয়ের, তার কাছে বিষয়ভিত্তিক প্রার্থনা জানানো হবে এটাই স্বাভাবিক। কবি বা শিল্পী সৌন্দর্য স্রষ্টা তাই কবি বা শিল্পীর কাছে শিল্প সৃষ্টির বা সৌন্দর্য সৃষ্টির দাবি সাধারণ মানুষের। প্রকৃতির নানা অনুষঙ্গকে শিল্পে পরিণত করেন শিল্পীরা, কবিরা। এটা তাঁদের আত্মবিকাশের স্বাভাবিক ধর্ম। সৃজনশীলতার সহজাত ধারা। তাদের কাছে তাই এ ধরনের প্রত্যাশা করা অমূলক নয়, বরং স্বাভাবিক প্রত্যাশার বিষয়। কবিভক্ত তাই কবির কাছে মিনতি জানাচ্ছে ‘বসন্ত বন্দনা তব কণ্ঠে শুনি-এ মোর মিনতি’ এই আনন্দ লগ্নে বসন্ত নিয়ে গানটা রচনার জন্য মিনতি তার।
➠ সুন্দরের পক্ষে যার নিয়ত অবস্থান এবং সুন্দরের সৃষ্টিতে যার ক্লান্তি নেই তার কাছেইতো সঙ্গত দাবি জানাতে হয়। কবিভক্ত তাই কবির কাছেই বসন্তগীতি রচনার মিনতি জানিয়েছে।

গ. প্রদত্ত উদ্দীপকে এবং ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতায় প্রকৃতি ও মানব মনের সম্পর্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক তাৎপর্যময় অভিব্যক্তি পেয়েছে। তাঁর লেখনীতে বাঙ্নয় হয়ে উঠেছে প্রকৃতি। দ্বারে জাগ্রত বসন্তকে মনের মাধুরী মিশিয়ে অপরূপ রূপে মূর্ত করে তুলেছেন কবি। প্রকৃতির রূপ রং মানব মনের অফুরন্ত আনন্দের উৎস। বাসন্তী প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য কবিচিত্তে আনন্দের শিহরণ জাগাবে এবং তিনি তাকে শব্দ প্রকৌশল আর ছন্দমাধুর্যে ফুটিয়ে তুলবেন সেটাই প্রত্যাশিত। কিন্তু কবির ক্ষেত্রে বাস্তবতা হয়েছে ভিন্ন। বসন্ত এলেও উদাসীন কবির অন্তর জুড়ে রিক্তশীতের বিদায়ের করুণ রাগিনী বেজে উঠেছে। তাই বসন্ত তাঁর মনে কোন সাড়া জাগাতে পারে না। বসন্তের সৌন্দর্য তার শোকদগ্ধ হৃদয়ে কোন আবেদন সৃষ্টি করতে পারে না। এ কবিতায় প্রকৃতির সৌন্দর্যের বর্ণনার আড়ালে একটা চাপা শোকের ক্ষীণ রাগিনী বেজে উঠেছে। দেখা যায়-কবিতাটিতে কবির বসন্ত প্রকৃতির সৌন্দর্যের চেয়ে কবি মনের শূন্যতাই প্রধান হয়ে উঠেছে।
➠ প্রকৃতির অনুপম সৌন্দর্যধ্যান আছে এ কবিতায়। কিন্তু সে প্রকৃতি শান্ত স্তম্ভিত বিষাদে মৌন-অন্তত কবির চেতনায়। শীতের বিয়োগ ব্যথা কবিকে অনুক্ষণ ঘিরে রয়েছে বলে বসন্তের সৌন্দর্য কবি হৃদয়কে স্পর্শ করতে পারে না। প্রথম স্বামী সৈয়দ নেহাল হোসেনের মৃত্যুর পর কবির এই বেদনাবিধূরতা। কবি হৃদয় রিক্ততায় ভরা। কবি নিজের শোকাচ্ছন্ন মনের সঙ্গে প্রকৃতির সৌন্দর্যের সামঞ্জস্য করতে পারছেন না বলে সূক্ষ¥ হৃদয়তন্ত্রীতে বসন্তের সমুদয় আয়োজন আবেদন ব্যর্থতার পর্যবসিত হয়েছে। এজন্য কবিমনের অবস্থাই প্রবল এখানে-প্রকৃতি নয়।

ঘ. ভালোবাসা বিষয়টা পুরোটাই হৃদয়জ অনুভূতি। একটি মানবীয় সত্ত্বা আরেকটি মানবীয় সত্তাকে ভাববে-নিজের অন্তরের পূর্ণতার প্রতিপাদক হিসেবে। তার সান্নিধ্যে পুলক লাভ করবে, তার থেকে দূরে গেলে বিষাদাক্রান্ত হবে-একের প্রতি অন্যের-হার্দিক টান থাকবে। থাকবে কৃতজ্ঞতাবোধ, দায়বোধ, কর্তব্যবোধ, ত্যাগ, বোঝাপড়া, মেনে নেওয়া-মনে নেওয়া। এসব কিছুর সমষ্টি ভালোবাসা। এই ভালোবাসাবাসিতে পুরুষ নারী ভেদ নেই। মানবীয় অনুভূতিসম্পন্ন মানব মানবী, সবার জন্য সত্য এ বিধান। উদ্দীপকে মনের ওপর সঙ্গীতের প্রভাব সম্পর্কে এক পর্যায়ে বলা হয়েছে যা একান্ত মনোগত ব্যাপার, তা বাহ্যিক কোন উদ্দীপকের প্রভাবে খুব বেশি পরিবর্তিত হয় না। মানুষের ভালোবাসার বিষয়টা গভীরতর মনোগত ব্যাপার। বাইরের কোন উদ্দীপক একে খুব বেশি বদলে দিতে পারে না যদি তা সত্যিকারের ভালোবাসা হয়। সত্যিকার ভালোবাসা বিশ্বাসের কষ্টিপাথরে পরীক্ষিত। তাই যথার্থ ভালোবাসার কোনো বিকৃতি নেই। বসন্তের আগমনে তাই কবিচিত্তে কোনো দোলা লাগেনা, কারণ কবিচিত্ত ভরে আছে প্রথম স্বামীর ভালোবাসায়। বসন্ত সেখানে অনুপ্রবেশ করতে চেয়ে পারেনি।
➠ ভালোবাসা প্রকৃতপক্ষে আধেয়-মানব বা মানবী তার আধার বা পাত্র। পাত্র সরে যায় কিন্তু তা থেকে চুইয়ে পড়া ভালোবাসা ক্ষয় বা শেষ হয় না। স্মরণে মননে জাগরুক থাকে এ প্রেমবোধ। এজন্য কবির সহজ স্বীকারোক্তি ‘ভুলিতে পারিনা কোন মতে।’ প্রকৃত ভালোবাসায় আধার আধেয়-কেউ কাউকে ভুলে থাকতে পারে না। অস্বীকার করতে পারেনা অদৃশ্য কিন্তু যথার্থ সত্য।


তথ্যসূত্র :
১. সাহিত্য পাঠ: একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড, ঢাকা, ২০২৫।
২. আধুনিক বাংলা অভিধান: বাংলা একাডেমি, এপ্রিল, ২০১৮।
৩. ব্যবহারিক বাংলা অভিধান: বাংলা একাডেমি, ১৮তম, ২০১৫।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url