প্রত্যুপকার : ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর

প্রত্যুপকার : ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর
প্রত্যুপকার 

মূলপাঠ: 

আলী ইবনে আব্বাস নামে এক ব্যক্তি মামুন (আল মামুন নামেই সমধিক পরিচিত। তিনি ছিলেন সপ্তম আব্বাসীয় খলিফা এবং খলিফা হারুনর রশীদের দ্বিতীয় পুত্র।) নামক খলিফার (প্রতিনিধি। শাসনকর্তা। তিনি একাধারে রাজ্যের প্রধান শাসক ও ধর্মনেতা ছিলেন।) প্রিয়পাত্র ছিলেন। তিনি বলিয়া গিয়াছেন, আমি একদিন অপরাহ্ণে (বিকেল) খলিফার নিকটে বসিয়া আছি এমন সময়ে, হস্তপদবদ্ধ (হাত-পা বাঁধা) এক ব্যক্তি তাঁহার সম্মুখে (সামনে) নীত হইলেন (নেওয়া হয়েছে)। খলিফা আমার প্রতি এই আজ্ঞা (আদেশ) করিলেন, তুমি এ ব্যক্তিকে আপন আলয়ে (বাড়িতে) লইয়া গিয়া রুদ্ধ (বন্দি) করিয়া রাখিবে এবং কল্য (আগামীকাল। পরের দিন) আমার নিকট উপস্থিত করিবে। তদীয় (তার) ভাব দর্শনে স্পষ্ট প্রতীত (বিশ্বাস) হইল, তিনি ঐ ব্যক্তির উপর অত্যন্ত ক্রুদ্ধ (রাগান্বিত) হইয়াছেন। আমি তাঁহাকে আপন আলয়ে আনিয়া অতি সাবধানে রুদ্ধ করিয়া রাখিলাম, কারণ যদি তিনি পলাইয়া যান, আমাকে খলিফার কোপে (অসন্তোষে। ক্রোধে) পতিত (দুর্দশাপ্রাপ্ত) হইতে হইবে।।

কিয়ৎক্ষণ (কিছুক্ষণ) পরে, আমি তাঁহাকে জিজ্ঞাসিলাম, আপনার নিবাস (নিবাস) কোথায়? তিনি বলিলেন, ডেমাস্কাস (দামেস্ক। বর্তমানে দামেস্ক সিরিয়ার রাজধানী।) আমার জন্মস্থান; ঐ নগরের যে অংশে বৃহৎ মসজিদ আছে, তথায় (সেই স্থানে) আমার বাস। আমি বলিলাম, ডেমাস্কাস নগরের, বিশেষত যে অংশে আপনার বাস তাহার উপর, জগদীশ্বরের (জগতের প্রভু। আল্লাহ) শুভদৃষ্টি থাকুক। ঐ অংশের অধিবাসী এক ব্যক্তি একসময় আমার প্রাণদান (মৃতপ্রায় অবস্থা থেকে উদ্ধার।) দিয়াছিলেন।

আমার এই কথা শুনিয়া, তিনি সবিশেষ জানিবার নিমিত্ত (কারণ), ইচ্ছা প্রকাশ করিলে, আমি বলিতে আরম্ভ করিলাম: বহু বৎসর পূর্বে ডেমাস্কাসের শাসনকর্তা পদচ্যুত (পদ বা ক্ষমতা থেকে অপসারিত। ক্ষমতাচ্যুত।) হইলে, যিনি তদীয় পদে অধিষ্ঠিত (আভির্ভূত। উপস্থিত।) হন, আমি তাঁহার সমভিব্যাহারে (সঙ্গে নিয়ে। সঙ্গীসাথি সহযোগে।) তথায় গিয়াছিলাম। পদচ্যুত শাসনকর্তা বহুসংখ্যক সৈন্য লইয়া আমাদিগকে আক্রমণ করিলেন। আমি প্রাণভয়ে পলাইয়া, এক সম্ভ্রান্ত (অভিজাত; সমাদরযোগ্য) লোকের বাড়িতে প্রবিষ্ট (প্রবেশ করেছে এমন) হইলাম এবং গৃহস্বামীর (বাড়ির মালিক) নিকট গিয়া, অতি কাতর বচনে প্রার্থনা করিলাম, আপনি কৃপা (অনুগ্রহ) করিয়া আমার প্রাণ রক্ষা করুন। আমার প্রার্থনাবাক্য শুনিয়া গৃহস্বামী আমায় অভয় (ভরসা; আশ্বাস) প্রদান করিলেন। আমি তদীয় (তার) আবাসে, এক মাস কাল নির্ভয়ে ও নিরাপদে অবস্থিতি (অবস্থান) করিলাম।

একদিন আশ্রয়দাতা (যে আশ্রয় দান করে) আমায় বলিলেন, এ সময়ে অনেক লোক বাগদাদ (ইরাকের রাজধানী) যাইতেছেন। স্বদেশে প্রতিগমনের (প্রত্যাগমন; প্রত্যাবর্তন।) পক্ষে আপনি ইহা অপেক্ষা অধিক সুবিধার সময় পাইবেন না। আমি সম্মত হইলাম। আমার সঙ্গে কিছুমাত্র অর্থ ছিল না, লজ্জাবশত ()আমি তাঁহার নিকট সে কথা ব্যক্ত করিতে পারিলাম না। তিনি, আমার আকার প্রকার (চেহারা ও ভাবভঙ্গি।) দর্শনে (জ্ঞান ও যুক্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত চিন্তা), তাহা বুঝিতে পারিলেন, কিন্তু তৎকালে (তখনই; শীঘ্র) কিছু না বলিয়া, মৌনাবলম্বন (নিরবতা পালন।করিয়া রহিলেন।

তিনি আমার জন্য যে সমস্ত উদ্যোগ করিয়া রাখিয়াছিলেন, প্রস্থান দিবসে তাহা দেখিয়া আমি বিস্ময়াপন্ন (বিস্মিত; বিস্ময়ে অভিভূত) হইলাম। একটি উৎকৃষ্ট অশ্ব সুসজ্জিত হইয়া আছে, আর একটি অশ্বের পৃষ্ঠে খাদ্যসামগ্রী স্থাপিত হইয়াছে, আর পথে আমার পরিচর্যা করিবার নিমিত্ত একটি ভৃত্য (যে ব্যক্তি বেতনের বিনিময়ে কাজ করে। পরিচারক। স্ত্রীবাচক: ভৃত্যা) প্রস্থানার্থে প্রস্তুত হইয়া রহিয়াছে। প্রস্থান সময় উপস্থিত হইলে, সেই দয়াময়, সদাশয়, আশ্রয়দাতা আমার হস্তে একটি স্বর্ণমুদ্রার থলি দিলেন এবং আমাকে

যাত্রীদের নিকটে লইয়া গেলেন। তন্মধ্যে যাহাদের সহিত তাঁহার আত্মীয়তা ছিল, তাঁহাদের সঙ্গে আলাপ করাইয়া দিলেন। আমি আপনকার বসতি স্থানে এই সমস্ত উপকার প্রাপ্ত হইয়াছিলাম। এ জন্য পৃথিবীতে যত স্থান আছে ঐ স্থান আমার সর্বাপেক্ষা প্রিয়।

এই নির্দেশ করিয়া, দুঃখ প্রকাশপূর্বক আমি বলিলাম, আক্ষেপের বিষয় এই, আমি এ পর্যন্ত সেই দয়াময় আশ্রয়দাতার কখনো কোনো উদ্দেশ পাইলাম না। যদি তাঁহার নিকট কোনো অংশে কৃতজ্ঞতা প্রদর্শনের অবসর (অবকাশ; ফাঁক) পাই, তাহা হইলে মৃত্যুকালে আমার কোনো ক্ষোভ থাকে না। এই কথা শুনিবামাত্র, তিনি অতিশয় আহ্লাদিত হইয়া বলিলেন, আপনার মনস্কাম পূর্ণ হইয়াছে। আপনি যে ব্যক্তির উল্লেখ করিলেন, সে এই। এই হতভাগ্যই আপনাকে, এক মাসকাল আপন আলয়ে রাখিয়াছিল।

তাঁহার এই কথা শুনিয়া, আমি চমকিয়া উঠিলাম, সবিশেষ অভিনিবেশ (মনোযোগ; একাগ্রতা) সহকারে, কিয়ৎক্ষণ (কিছুক্ষণ) নিরীক্ষণ করিয়া, তাঁহাকে চিনিতে পারিলাম; আহ্লাদে পুলকিত হইয়া অশ্রুপূর্ণ নয়নে আলিঙ্গন করিলাম; তাঁহার হস্ত (হাত) ও পদ (পা) হইতে লৌহশৃঙ্খল (লোহার শিকল) খুলিয়া দিলাম এবং কী দুর্ঘটনাক্রমে তিনি খলিফার কোপে (ক্রোধ; রাগ) পতিত হইয়াছেন, তাহা জানিবার নিমিত্তে নিতান্ত ব্যগ্র(ব্যাকুল; আকুল) হইলাম। তখন তিনি বলিলেন, কতিপয় নীচ প্রকৃতির লোক ঈর্ষাবশত শত্রুতা করিয়া খলিফার নিকট আমার ওপর উৎকট (তীব্র) দোষারোপ করিয়াছে; তজ্জন্য তদীয় (তার) আদেশক্রমে হঠাৎ অবরুদ্ধ ও এখানে আনীত হইয়াছি; আসিবার সময় স্ত্রী, পুত্র, কন্যাদিগের সহিত (সাথে) দেখা করিতে দেয় নাই; বোধ করি আমার প্রাণদণ্ড (মৃত্যুদণ্ড) হইবে। অতএব, আপনার নিকট বিনীত বাক্যে প্রার্থনা এই, আপনি অনুগ্রহ করিয়া আমার পরিবারবর্গের নিকট এই সংবাদ পাঠাইয়া দিবেন। তাহা হইলে আমি যথেষ্ট উপকৃত হইব।

তাঁহার এই প্রার্থনা শুনিয়া আমি বলিলাম, না, না, আপনি এক মুহূর্তের জন্যও প্রাণনাশের (বধের; হত্যার) আশঙ্কা করিবেন না; আপনি এই মুহূর্ত হইতে স্বাধীন; এই বলিয়া পাথেয়স্বরূপ (পথখরচ স্বরূপ) সহস্র (এক হাজার) স্বর্ণমুদ্রার একটি থলি তাঁহার হস্তে দিয়া বলিলাম, আপনি অবিলম্বে প্রস্থান (গমন; যাত্রা) করুন এবং স্নেহাস্পদ (স্নেহভাজন) পরিবারবর্গের সহিত মিলিত হইয়া সংসারযাত্রা (গার্হস্থ্য জীবন) সম্পন্ন করুন। আপনাকে ছাড়িয়া দিলাম, এ জন্য আমার ওপর খলিফার মর্মান্তিক (হৃদয়বিদারক; নিদারুণ) ক্রোধ (রাগ) ও দ্বেষ (ঈর্ষা; হিংসা) জন্মিবে, তাহাতে সন্দেহ নাই। কিন্তু যদি আপনার প্রাণ রক্ষা করিতে পারি, তাহা হইলে সে জন্য আমি অণুমাত্র দুঃখিত হইব না।

আমার প্রস্তাব শুনিয়া তিনি বলিলেন, আপনি যাহা বলিতেছেন, আমি কখনই তাহাতে সম্মত হইতে পারিব না। আমি এত নীচাশয় (সংকীর্ণমনা) ও স্বার্থপর নহি যে, কিছুকাল পূর্বে, যে প্রাণের রক্ষা করিয়াছি, আপন প্রাণরক্ষার্থে এক্ষণে সেই প্রাণের বিনাশের কারণ হইব। তাহা কখনও হইবে না। যাহাতে খলিফা আমার ওপর অক্রোধ হন, আপনি দয়া করিয়া তাহার যথোপযুক্ত চেষ্টা দেখুন; তাহা হইলেই আপনার প্রকৃত কৃতজ্ঞতা প্রদর্শন করা হইবে। যদি আপনার চেষ্টা সফল না হয়, তাহা হইলেও আমার কোনো ক্ষোভ থাকিবে না।

পরদিন প্রাতঃকালে (অতি ভোরে) আমি খলিফার নিকট উপস্থিত হইলাম। তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, সে লোকটি কোথায়, তাহাকে আনিয়াছ? এই বলিয়া, তিনি ঘাতককে (ফাঁসুড়ে; গলায় ফাঁস পরিয়ে হত্যা করে এমন দস্যু।) ডাকাইয়া, প্রস্তুত হইতে আদেশ দিলেন। তখন আমি তাঁহার চরণে (পায়ে) পতিত হইয়া বিনীত ও কাতর বচনে বলিলাম, ধর্মাবতার, ঐ ব্যক্তির বিষয়ে আমার কিছু বক্তব্য আছে। অনুমতি হইলে সবিশেষ সমস্ত আপনকার গোচর (অবগত) করি। এই কথা শুনিবামাত্র তাঁহার কোপানল (রাগের আগুন; ক্রোধের আগুন) প্রজ্বলিত হইয়া উঠিল। তিনি রোষারক্ত (রাগে লাল চোখ) নয়নে বলিলেন, আমি শপথ করিয়া বলিতেছি, যদি তুমি তাহাকে ছাড়িয়া দিয়া থাক, এই দণ্ডে তোমার প্রাণদণ্ড হইবে। তখন আমি বলিলাম, আপনি ইচ্ছা করিলে, এই মুহূর্তে আমার ও তাহার প্রাণদণ্ড করিতে পারেন তাহার সন্দেহ কি। কিন্তু, আমি যে নিবেদন করিতে ইচ্ছা করিতেছি, কৃপা করিয়া (অনুগ্রহ করে; করুণা করে)তাহা শুনিলে, আমি চরিতার্থ হই।

এই কথা শুনিয়া খলিফা উদ্ধত বচনে (দুর্বিনীত বাক্যে) বলিলেন, কী বলিতে চাও, বল। তখন সে ব্যক্তি ডেমাস্কাস নগরে কীরূপে আশ্রয়দান ও প্রাণরক্ষা করিয়াছিলেন এবং এক্ষণে তাহাকে ছাড়িয়া দিতে চাহিলে, আমি অবধারিত (নিশ্চিত) বিপদে পড়িব, এ জন্য তাহাতে কোনোমতে সম্মত হইলেন না; এই দুই বিষয়ে সবিশেষ নির্দেশ করিয়া বলিলাম, ধর্মাবতার (বিচারককে সম্বোধনসূচক আখ্যা; ধর্মদূত), যে ব্যক্তির এরূপ প্রকৃতি ও এরূপ মতি (বুদ্ধি), অর্থাৎ যে ব্যক্তি এমন দয়াশীল, পরোপকারী, ন্যায়পরায়ণ ও সদবিবেচক তিনি কখনই দুরাচার (খারাপ আচরণকারী) নহেন। নীচপ্রকৃতি পরহিংসুক দুরাত্মারা (খারাপ লোক), ঈর্ষাবশত অমূলক (ভিত্তিহীন; কাল্পনিক) দোষারোপ করিয়া তাহার সর্বনাশ করিতে উদ্যত (ক্ষিপ্ত; উত্তোলিত) হইয়াছে; নতুবা যাহাতে প্রাণদণ্ড হইতে পারে, তিনি এরূপ কোনো দোষে দূষিত হইতে পারেন, আমার এরূপ বোধ ও বিশ্বাস হয় না। এ ক্ষেত্রে আপনার যেরূপ অভিরুচি (ইচ্ছা) হয় করুন।

খলিফা মহামতি (অত্যন্ত বুদ্ধিমান) ও অতি উন্নতচিত্ত পুরুষ ছিলেন। তিনি এই সকল কথা কর্ণগোচর (কানে এসছে এমন) করিয়া কিয়ৎক্ষণ মৌনাবলম্বন (নীরবতা পালন) করিয়া রহিলেন; অনন্তর প্রসন্ন বদনে বলিলেন, সে ব্যক্তি যে এরূপ দয়াশীল ও ন্যায়পরায়ণ, ইহা অবগত হইয়া আমি অতিশয় আহ্লাদিত হইলাম। তিনি প্রাণদণ্ড হইতে অব্যাহতি পাইলেন। বলিতে গেলে, তোমা হইতেই তাহার প্রাণরক্ষা হইল। এক্ষণে তাহাকে অবিলম্বে এই সংবাদ দাও, ও আমার নিকটে লইয়া আইস।

এই কথা শুনিয়া আহ্লাদের (আনন্দের) সাগরে মগ্ন (আত্মহারা) হইয়া আমি সত্বর (তাড়াতাড়ি; অতিদূত) গৃহে প্রত্যাগমনপূর্বক তাঁহাকে খলিফার সম্মুখে উপস্থিত করিলাম। খলিফা অবলোকনমাত্র (দেখামাত্র), প্রীতি-প্রফুল্ললোচনে (শব্দটিতে মূলত তিনটি শব্দ যুক্ত করা হয়েছে; প্রীতি, প্রফুল্ল ও লোচন-বন্ধুত্বের অনুভূতিতে আনন্দিত চোখে।), সাদর (প্রীতিপূর্ণ) বচনে (কথাতে) সম্ভাষণ করিয়া বলিলেন, তুমি যে এরূপ প্রকৃতির লোক, তাহা আমি পূর্বে অবগত ছিলাম না। দুষ্টমতি দুরাচারদিগের (খারাপ আচরণকারীদের) বাক্য বিশ্বাস করিয়া অকারণে তোমার প্রাণদণ্ড করিতে উদ্যত হইয়াছিলাম। এক্ষণে, ইহার নিকটে তোমার প্রকৃত পরিচয় পাইয়া, সাতিশয় (খুব বেশি; অত্যধিক) প্রীতিপ্রাপ্ত হইয়াছি। আমি অনুমতি দিতেছি, তুমি আপন আলয়ে (নিজ বাড়িতেপ্রস্থান কর। এই বলিয়া, খলিফা, তাহাকে মহামূল্য পরিচ্ছদ (পোশাক), সুসজ্জিত দশ অশ্ব (ঘোড়া), দশ খচ্চর (ঘোড়া ও গাধার মিলনজাত পশু), দশ উষ্ট্র (উট) উপহার দিলেন এবং ডেমাস্কাসের রাজপ্রতিনিধির নামে এক অনুরোধপত্র ও পাথেয়স্বরূপ বহুসংখ্যক অর্থ দিয়া তাহাকে বিদায় করিলেন।

শব্দার্থ ও টীকা: 

প্রত্যুপকার- উপকারীর উপকার করা। 
অভিরুচি- ইচ্ছা। 
সমভিব্যাহারে- সঙ্গে বা সাহচর্যে। 
নিষ্কৃতি- মুক্তি। 
কোপানল- কোপ ও অনল মিলে কোপানল; ক্রোধ বা রাগের আগুন। এখানে যাওয়া অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে।
প্রতীতি- বিশ্বাস; ধারণা।
পরিচ্ছদ- পোশাক। 
প্রীতিপ্রফুল্ললোচনে- শব্দটিতে মূলত তিনটি শব্দ যুক্ত করা হয়েছে; প্রীতি, প্রফুল্ল ও লোচন-বন্ধুত্বের অনুভূতিতে আনন্দিত চোখে। লোচন অর্থ চোখ।
মৌনাবলম্বন- মৌন ও অবলম্বন মিলে মৌনাবলম্বন; অর্থাৎ নিরবতা পালন।
অব্যাহতি- মুক্তি, ছাড়া পাওয়া। 
অবধারিত- নিশ্চিত। 
প্রত্যাগমন-ফিরে আসা। শব্দটি গঠিত দুটি শব্দ মিলে: প্রতি ও আগমন। 
রোষারক্ত নয়নে- ক্রোধে লাল চোখে। 
অবলোকনমাত্র- দেখামাত্র। 
সম্ভাষণ- সম্বোধন। 
উৎকট- অত্যন্ত প্রবল, তীব্র। 
অবরুদ্ধ- বন্দি। 
নিরীক্ষণ- মনোযোগ দিয়ে দেখা। 
খলিফা-প্রতিনিধি। হজরত মুহম্মদ (স.)-এর পরে মুসলিম রাষ্ট্রের সর্বপ্রধান শাসনকর্তাকে ‘খলিফা’ বলা হতো। তিনি একাধারে রাজ্যের প্রধান শাসক ও ধর্মনেতা ছিলেন।
 ডেমাস্কাস- দামেস্ক। এশিয়ার একটি প্রাচীন শহর। হজরত ইব্রাহিমের (আ.) যুগের পূর্বে এখানে শহর গড়ে উঠেছিল বলে জানা যায়। বর্তমানে দামেস্ক সিরিয়ার রাজধানী। 
মামুন- আল মামুন নামেই সমধিক পরিচিত। তাঁর পূর্ণ নাম আবুল আব্বাস আবদুল্লাহ আল মামুন (৭৮৬-৮৩৩ খ্রিষ্টাব্দ)। তিনি ছিলেন সপ্তম আব্বাসীয় খলিফা এবং খলিফা হারুনর রশীদের দ্বিতীয় পুত্র। বাগদাদ- বর্তমান ইরাকের রাজধানী। খলিফা হারুনর রশীদের সময় বাগদাদ মুসলিম সভ্যতার শ্রেষ্ঠ নগরীতে পরিণত হয়। টাইগ্রিস নদীর উভয় তীরে এবং ফুরাত বা ইউফ্রেটিস নদীর পঁচিশ মাইল উত্তরে অবস্থিত। আব্বাসীয় খলিফা মনসুর ৭৬৩ খ্রিষ্টাব্দে নগরটি প্রতিষ্ঠা করেন। 

পাঠ-পরিচিতি:

‘প্রত্যুপকার’ রচনাটি আখ্যানমঞ্জরী দ্বিতীয় ভাগ থেকে সংকলন করা হয়েছে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের আখ্যানমঞ্জরী রচিত হয় ১৮৬৮ খ্রিষ্টাব্দে। বিশ্বের নানা দেশের ইতিহাস প্রসিদ্ধ ব্যক্তিগণের জীবনের গৌরবদীপ্ত ঘটনাই এ গ্রন্থের বিভিন্ন রচনার উপজীব্য। ‘প্রত্যুপকার’ আলী আব্বাস নামক এক ব্যক্তির প্রতি-উপকারের কাহিনি। খলিফা মামুনের সময়কালে দামেস্কের জনৈক শাসনকর্তা পদচ্যুত হন। নতুন শাসনকর্তা মামুনের একজন প্রিয়পাত্র ছিলেন আলী ইবনে আব্বাস। তিনি স্থানীয় একজন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তির কাছে আশ্রয়লাভ করে জীবন রক্ষা করেন। পরবর্তীকালে আলী ইবনে আব্বাসের আশ্রয়দাতা ঐ সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিটি খলিফা মামুনের সৈন্যদল কর্তৃক বন্দি হন এবং খলিফার নির্দেশে আলী ইবনে আব্বাসের গৃহে তাকে অন্তরীণ করে রাখার ব্যবস্থা করা হয়। আলী ইবনে আব্বাস বন্দি ব্যক্তির সঠিক পরিচয় জানতে পেরে উপকারীর উপকারের জন্য নিজের জীবনের ঝুঁকি গ্রহণ করেন এবং খলিফার কাছে তার মুক্তির জন্য সুপারিশ করেন। বস্তুত এ রচনায় দুজন মহৎ ব্যক্তির কাহিনি বর্ণিত হয়েছে, তাদের একজন নিঃস্বার্থ উপকারী, অন্যজন সকৃতজ্ঞ প্রত্যুপকারী। খলিফার মহত্ত্বও এ রচনায় প্রকাশিত হয়েছে।

লেখক-পরিচিতি:

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর জেলার বীরসিংহ গ্রামে ২৬শে সেপ্টেম্বর ১৮২০ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর মূল নাম ঈশ্বরচন্দ্র বন্দোপাধ্যায়। ‘বিদ্যাসাগর’ তাঁর উপাধি। তিনি ছিলেন কলকাতা সংস্কৃত কলেজের ছাত্র। তিনি প্রথমে সংস্কৃত ও পরে ইংরেজি ভাষায় পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। দানশীলতার জন্য তিনি 'দয়ার সাগর' নামেও পরিচিত। একাধারে পণ্ডিত, শিক্ষাবিদ, সমাজ-সংস্কারক ও খ্যাতনামা লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিলেন তিনি। সুশৃঙ্খল পদবিন্যাস, যথাযথভাবে যতিচিহ্ন প্রয়োগ এবং সাহিত্যিক গদ্য রচনার জন্য তাঁকে বাংলা গদ্যের জনক বলা হয়ে থাকে। বাংলা বর্ণমালাকে নতুন বিন্যাসে সাজিয়ে ১৮৫৫ সালে বিদ্যাসাগর প্রকাশ করেন শিশুপাঠ্য বই বর্ণপরিচয়। ভাষা শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে এ বই আজও পথপ্রদর্শক বিবেচিত হয়। বেতাল পঞ্চবিংশতি, ব্যাকরণ কৌমুদী, শকুন্তলা, বিধবা বিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কি না এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব, সীতার বনবাস, ভ্রান্তিবিলাস প্রভৃতি তাঁর প্রধান গ্রন্থ। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ১৮৯১ সালের ২৯শে জুলাই মৃত্যুবরণ করেন।। আলী ইবনে আব্বাস নামে এক ব্যক্তি মামুন নামক খলিফার প্রিয়পাত্র ছিলেন। তিনি বলিয়া গিয়াছেন, আমি একদিন অপরাহ্ণে খলিফার নিকটে বসিয়া আছি এমন সময়ে, হস্তপদবদ্ধ এক ব্যক্তি তাঁহার সম্মুখে নীত হইলেন। খলিফা আমার প্রতি এই আজ্ঞা করিলেন, তুমি এ ব্যক্তিকে আপন আলয়ে লইয়া গিয়া রুদ্ধ করিয়া রাখিবে এবং কল্য আমার নিকট উপস্থিত করিবে। তদীয় ভাব দর্শনে স্পষ্ট প্রতীত হইল, তিনি ঐ ব্যক্তির উপর অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হইয়াছেন। আমি তাঁহাকে আপন আলয়ে আনিয়া অতি সাবধানে রুদ্ধ করিয়া রাখিলাম, কারণ যদি তিনি পলাইয়া যান, আমাকে খলিফার কোপে পতিত হইতে হইবে।

অনুশীলনী 

কর্ম-অনুশীলন 

১. কোনো ব্যক্তি তাঁর উপকারীর উপকার করেছেন এমন কোনো ঘটনা তোমার জানা থাকলে তা লিখ। 
২. উপকারীর উপকার না করে অপকার করেছে; এরকম একটি ঘটনার বিবরণ দাও। 

বহুনির্বাচনি প্রশ্ন 

১। খলিফা মামুন কোথাকার শাসনকর্তা ছিলেন? 
ক. বাগদাদ 
খ. ডেমাস্কাস 
গ. সিরিয়া 
ঘ. ইরান 

উদ্দীপকটি পড় এবং ২-সংখ্যক প্রশ্নের উত্তর দাও: 
সে বিস্ময়াবহ কাহিনি শুনিয়া নৃপতি (রাজা) মুগ্ধ হইলেন। বহুদিনের বিদ্বেষভাব দূরে গেল, ভক্তিতে অন্তর আর্দ্র হইল। প্রেমের জয় হইল। নৃপতির কণ্ঠে হাতেমের জয়গান। তাঁহার কণ্ঠ ভেদিয়া উত্থিত হইল- ধন্য হাতেম, ধন্য তাহার কুল। 
২। নৃপতির মাধ্যমে ‘প্রত্যুপকার’ গল্পের খলিফার কোন বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পেয়েছে? 
ক. বদান্যতা 
খ. মহানুভবতা 
গ. দানশীলতা 
ঘ. ঔচিত্যবোধ 

সৃজনশীল প্রশ্ন 

চুরির অভিযোগে কিছুলোক জনৈক ব্যক্তিকে চেয়ারম্যানের ইউনিয়ন পরিষদে হাজির করল। ঘটনার বিবরণ শুনে তিনি চৌকিদার আমজাদকে ডেকে নির্দেশ দিলেন বন্দিকে তার বাড়িতে রাখতে। ঘটনাক্রমে আমজাদ জানতে পারলেন, বন্দি ব্যক্তি আর কেউ নয়, সে দশ বছর আগে আমজাদের সন্তানকে সড়ক দুর্ঘটনা থেকে বাঁচিয়েছিল, নিজ গৃহে নিয়ে গিয়ে আহত সন্তানের সেবা করেছিল। কিন্তু আমজাদ নিজের ক্ষতি হবে ভেবে না চেনার ভান করে চুপ করে রইল। 
ক. ‘প্রত্যুপকার’ শব্দের অর্থ কী? 
খ. খলিফা মামুন কিছুক্ষণ মৌন হয়ে ছিলেন কেন? 
গ. উদ্দীপকের বন্দির ঘটনা প্রত্যুপকার গল্পের কোন ঘটনার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়? ব্যাখ্যা কর। 
ঘ. ‘আমজাদ ও আলী ইবনে আব্বাস উভয়ই বন্দি কর্তৃক উপকৃত হলেও এরা একরকম নয়’- বিশ্লেষণ কর। 
Next Post Previous Post