‘আশা‘ কবিতার মূলপাঠ, শব্দার্থ, মূলভাব, বহুনির্বাচনি প্রশ্ন ও সৃজনশীল প্রশ্ন-উত্তর
![]() |
আশা : সিকানদার আবু জাফর |
আশা
সিকানদার আবু জাফর
আমি সেই জগতে হারিয়ে যেতে চাই,
যেথায় গভীর-নিশুত রাতে
জীর্ণ বেড়ার ঘরে
নির্ভাবনায় মানুষেরা ঘুমিয়ে থাকে ভাই।।
যেথায় লোকে সোনা-রূপায়
পাহাড় জমায় না,
বিত্ত-সুখের দুর্ভাবনায়
আয়ু কমায় না;
যেথায় লোকে তুচ্ছ নিয়ে
তুষ্ট থাকে ভাই।
সারা দিনের পরিশ্রমেও
পায় না যারা খুঁজে
একটি দিনের আহার্য-সঞ্চয়,
তবু যাদের মনের কোণে
নেই দুরাশা গ্লানি,
নেই দীনতা, নেই কোনো সংশয়।
যেথায় মানুষ মানুষেরে
বাসতে পারে ভালো
প্রতিবেশীর আঁধার ঘরে
জ্বালতে পারে আলো,
সেই জগতের কান্না-হাসির
অন্তরালে ভাই
আমি হারিয়ে যেতে চাই।
উৎস নির্দেশ : |
---|
আশা’ কবিতাটি সিকানদার আবু জাফরের ‘মালবকৌশিক’ নামক গ্রন্থ থেকে নেওয়া হয়েছে। এটি ২৬শে মার্চ ১৯৫৪ সালে রচিত হয়। এই গ্রন্থে মোট ২১৪টি কবিতা রয়েছে। ‘আশা’ কবিতাটি হলো ১৯৫তম কবিতা। ‘মালবকৌশিক’ কাব্যগ্রন্থটি ৩টি অংশে বিভক্ত: ১. হৃদয়ের সুরে সুরে (১ থেকে ১৩৯), ২. পৃথিবীর তৃণে ফুলে (১৪০ থেকে ১৭৫), ৩. মানুষের কাছে কাছে (১৭৬ থেকে ২১৪)। ‘আশা’ কবিতাটি ৩য় অংশ (‘মানুষের কাছে কাছে’) থেকে নেওয়া হয়েছে। কবি এই কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলো ক্রমিক নম্বর (১ ২ ৩ ৪ ৫ ----) হিসেবে উল্লেখ করেন। |
শব্দার্থ ও টীকা : |
---|
নিশুত রাতে- গভীর রাতে। জীর্ণ- পুরাতন। নির্ভাবনায়- ভাবনাহীনভাবে। আমি সেই জগতে হারিয়ে যেতে চাই, যেথায় গভীর-নিশুত রাতে জীর্ণ বেড়ার ঘরে নির্ভাবনায় মানুষেরা ঘুমিয়ে থাকে ভাই- কে কীভাবে সুখী হবে তা নির্ধারিত নয়। মানুষ গতানুগতিক যেভাবে সুখী হয় কবি সেভাবে সুখী হওয়ার কথা এখানে বলেননি। সুখের চিন্তায় মানুষের রাতে ঘুম হয় না। কিন্তু সুখী মানুষের ঘুমের সমস্যা হয় না। সারাদিন কাজের পর বিছানায় গেলেই শান্তির ঘুম তাকে তৃপ্তি দেয়। কবিও তেমনি সে রকম এক জীবন-যাপনের মাঝে যেতে চান যেখানে ভাঙা বেড়ার ঘরেও মানুষ নির্ভাবনায় ঘুমিয়ে থাকে; ঘুমিয়ে যেতে পারে। দুর্ভাবনা- দুশ্চিন্তা বিত্ত-সুখের দুর্ভাবনায় আয়ু কমায় না- সমাজের বেশির ভাগ মানুষ টাকা-পয়সা ও সম্পদের লোভে দিনাতিপাত করে; এতে সুখ হারাম হয়ে যায়; জীবন হয় যন্ত্রণাময়। এতে তাদের জীবন দীর্ঘ না হয়ে বিভিন্ন রোগ-বালাইয়ে তারা আক্রান্ত হয় এবং মৃত্যুবরণ করে। বিত্ত-সুখের দুর্ভাবনা মানুষকে সুখ তো দেয়ই না বরং তাদের আয়ু আরও কমে যায়। আহার্য- খাবার। দীনতা- গরিব অবস্থা। দুরাশা- সহজে পাওয়া যায় না এমন কিছু লাভ করার আশা। গ্লানি- অনুতাপ। যেথায় মানুষ মানুষেরে বাসতে পারে ভালো প্রতিবেশীর আঁধার ঘরে- জ্বালতে পারে আলো জীবনের সার্থকতা কোথায় এটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। কিছু মানুষ আছে যারা অন্যের উপকার ও মঙ্গলের জন্য নিজেদের জীবন উৎসর্গ করে। মানবপ্রেম বা মানুষকে ভালোবাসতে পারার মাঝে জীবনের মহত্ত্ব নিহিত থাকে। প্রতিবেশীর দুঃখে এগিয়ে আসা, তাদের দুঃখ-কষ্ট দূর করার মাঝেও এক ধরনের তৃপ্তি আছে। কবি তাই বলেছেন যে, যেখানে মানুষকে ভালোবাসা যায়, প্রতিবেশীর দুঃখ-কষ্ট দূর করে আলো জ্বালানো যায়- সেখানেই তিনি থাকতে চান। অন্তরালে- আড়ালে। |
পাঠ-পরিচিতি : |
---|
জাগতিক এই পৃথিবী ক্রমশ জটিল হয়ে উঠছে। মানুষ ক্রমশ আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়ছে। মানুষের সঙ্গে মানুষের বাড়ছে ব্যবধান। কারও মনেই যেন শাস্তি নেই। বিত্ত-বৈভব অর্জন করা আর সুখের দুর্ভাবনায় তাদের আয়ু কমে যাচ্ছে। কিন্তু কবি এসব অতিক্রম করে যেতে চাইছেন সেইসব মানুষের কাছে যারা প্রকৃত অর্থেই মানুষ। মনুষ্যত্বের আলো যারা জ্বালিয়ে রেখেছেন। দরিদ্র হলেও এই মানুষ বিত্তের পেছনে ছোটে না। সোনা-রুপার পাহাড় গড়ে তোলে না। জীর্ণ ঘরে বসবাস করেও তারা সুখী। তুচ্ছ, ছোটো ছোটো আনন্দ অবগাহনেই কাটে তাদের দিন। সারাদিন তারা হাড়ভাঙা খাটুনি খাটে, তাতে হয়তো একটি দিনের আহার্যও জোটে না। তবু কোনো দুরাশা বা গ্লানি তাদের গ্রাস করে না। কোনো দীনতা বা সংশয়ে তাদের জীবন ক্লিষ্ট নয়। বরং দারিদ্র্যের মধ্যে থেকেও তারা মানুষকে ভালোবাসতে পারে। প্রতিবেশীকে সাহায্য করে। কবি মনুষ্যত্বের অধিকারী এসব মানুষের সান্নিধ্য পেতে চাইছেন, হারিয়ে যেতে চাইছেন তাদের মাঝে। তিনি মনে করেন, এরাই হচ্ছে সত্যিকারের মানুষ। কবিতাটিতে গণমানুষের প্রতি একাত্মতা, মানবিকতা ও মনুষ্যত্বের সুগভীর সংবেদনা প্রতিফলিত হয়েছে। |
‘আশা’ কবিতার বৈশিষ্ট্য : |
---|
১। ‘আশা’ কবিতার মূল ভাব মানুষের মহৎ গুণকে তুলে ধরা। যেসব মানুষ
দুশ্চিন্তা করে না, অতিরিক্ত সঞ্চয় করে না, পরিশ্রম করতে দ্বিধা করে না,
এবং যারা স্বার্থপর নয়, কবি তাদের ভালোবাসেন। ২। কবিতাটির চরণগুলোর শেষে বিশেষ ধরনের মিল রয়েছে। যেমন: প্রথম স্তবকে ১ম ও ৪র্থ লাইনে মিল আছে; দ্বিতীয় স্তবকে ১ম ও ৩য় এবং ২য় ও ৪র্থ লাইনে মিল আছে; আবার তৃতীয় স্তবকে ৩য় ও ৬ষ্ঠ লাইনে মিল দেখা যায়। ৩। কবিতাটি তাল দিয়ে পড়া যায়। তালগুলোর ব্যবধান কম। যেমন: /আমি/সেই জগতে/হারিয়ে যেতে/চাই, /যেথায় গভীর-/নিশুত রাতে /জীর্ণ বেড়ার/ঘরে /নির্ভাবনায়/মানুষেরা/ঘুমিয়ে থাকে/ভাই। /যেথায় লোকে/সোনা-রুপায় /পাহাড় জমায়/না, /বিত্ত-সুখের/দুর্ভাবনায় /আয়ু কমায়/না; যেথায় লোকে/তুচ্ছ নিয়ে /তুষ্ট থাকে/ভাই। ৪। এই কবিতার লয় বা গতি দ্রুত। এটি একটি ছড়া জাতীয় কবিতা। ৫। কবিতাটিতে কিছু শব্দরূপের পরিবর্তন আছে। যেমন: যেখানে-যেথায়, নিশীথ-নিশুত, মানুষকে-মানুষেরে, জ্বালাতে-জ্বালতে ইত্যাদি। |
কবি পরিচিতি : |
---|
খুলনা জেলার তেঁতুলিয়া গ্রামে ১৯১৯ সালের ১৯শে মার্চ সিকানদার আবু জাফর জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা সৈয়দ মঈনুদ্দীন হাশেমী পেশায় ছিলেন কৃষিজীবী ও ব্যবসায়ী। সিকানদার আবু জাফর ১৯৩৬ সালে তালা বি. দে. ইনস্টিটিউশন থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন এবং কলকাতার রিপন কলেজ থেকে আই. এ. পাস করেন। কর্মজীবনে তিনি ছিলেন সাংবাদিক। দেশ বিভাগের পরে তিনি স্থায়ীভাবে ঢাকায় বসবাস করেন। এ সময় তিনি রেডিও পাকিস্তানে চাকরি থেকে শুরু করে দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক মিল্লাত, মাসিক সমকাল (১৯৫৭) প্রভৃতি পত্রিকায় সাংবাদিকতা করেন। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘ছয় দফা আন্দোলন’কে বেগবান করে তোলার জন্য তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। স্বাধীনতা আন্দোলনে তিনি ছিলেন একজন একনিষ্ঠ সাংস্কৃতিক কর্মী। মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর লেখা ‘আমাদের সংগ্রাম চলবেই চলবে’ গানটি স্বাধীনতাকামী বাঙালি জাতিকে বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করে। তাঁর গণসঙ্গীত ও কবিতা মেহনতি মানুষের মুক্তির প্রেরণায় সমৃদ্ধ। সিকানদার আবু জাফরের উল্লেখযোগ্য কাব্য: প্রসন্ন শহর, বৈরী বৃষ্টিতে, তিমিরান্তিক, বৃশ্চিক লগ্ন, মালবকৌশিক ইত্যাদি। সাহিত্যকর্মে অবদানের জন্য তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৬৬) ও একুশে পদকে (মরণোত্তর) ভূষিত হন। ৫ই আগস্ট ১৯৭৫ সালে সিকানদার আবু জাফর মৃত্যুবরণ করেন। |
বহুনির্বাচনি প্রশ্ন : |
---|
১। বিত্ত-সুখের দুর্ভাবনায় কোনটি কমে? ক. সময় খ. অর্থ গ. আয়ু ঘ. ভালোবাসা ২। ‘প্রতিবেশীর আঁধার ঘরে/জ্বালতে পারে আলো’ এখানে আলো বলতে কী বোঝানো হয়েছে? ক. পারস্পরিক সম্প্রীতি খ. বিপদে সাহায্য করা গ. একে অন্যের খোঁজ নেওয়া ঘ. কাউকে তুচ্ছ না ভাবা নিচের উদ্দীপকটি পড় এবং ৩-সংখ্যক প্রশ্নের উত্তর দাও : একদা অত্যাচারী এক মোড়ল অসুস্থ হলে তার রোগমুক্তির জন্য কবিরাজ পরামর্শ দেয় সুখী মানুষের জামা পরার। অনেক খোঁজাখুঁজির পর একজন সুখী মানুষ পাওয়া গেলেও দেখা যায়, তার কোনো জামা নেই। ৩। উদ্দীপকের সুখী মানুষটির সঙ্গে ‘আশা’ কবিতায় সাদৃশ্য রয়েছে ক. ধনীদের খ. দরিদ্রদের গ. আত্মতৃপ্তদের ঘ. দুর্ভাবনাগ্রস্তদের |
জ্ঞানমূলক প্রশ্ন : |
---|
অনুধাবনমূলক প্রশ্ন : |
---|
সৃজনশীল প্রশ্ন- ১ |
---|
নিচের উদ্দীপকটি পড় এবং প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও: মাদার তেরেসা আশৈশব স্বপ্ন দেখেন মানব সেবার। এক সময় যোগ দেন খ্রিস্টান মিশনারি সংঘে। মানুষকে আরো কাছে থেকে সেবা দেওয়ার লক্ষ্যে সন্ন্যাসব্রত গ্রহণ করেন। প্রতিষ্ঠা করেন মিশনারিজ অব চ্যারিটি। তাঁর আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে আরও অনেকেই এগিয়ে আসেন এ মহান কাজে। এক সময় এ কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি লাভ করেন নোবেল পুরস্কার। সারা জীবনের তাঁর সবটুকু উপার্জনই বিলিয়ে দেন মানবের কল্যাণে। (ক) কোথায় মানুষেরা নির্ভাবনায় ঘুমিয়ে থাকে? (খ) বিত্ত-সুখের ভাবনাহীন মানুষেরা সংশয়হীন কেন? (গ) মাদার তেরেসার মানসিকতা ‘আশা’ কবিতার কোন দিকটিকে তুলে ধরেছে? ব্যাখ্যা করো। (ঘ) “মাদার তেরেসার দর্শনই যেন ‘আশা’ কবিতার ভাববস্তু” যুক্তিসহ প্রমাণ করো। |
(ক) মানুষেরা জীর্ণ বেড়ার ঘরে নির্ভাবনায় ঘুমিয়ে থাকে। (খ) বিত্ত-সুখের ভাবনাহীন মানুষেরা আত্মকেন্দ্রিক নয় এবং দুরাশার গ্লানিতে ভোগে না বলেই তারা সংশয়হীন। ➠ অর্থবিত্তের সুখ প্রকৃত সুখ নয়। প্রকৃত সুখের জন্য জীবনকে দুর্ভাবনামুক্ত করতে হয়। আর এজন্য প্রয়োজন অল্পে তুষ্ট থাকা এবং সোনা-রুপায় পাহাড় গড়ার মানসিকতা পরিহার করা। মানুষ আত্মকেন্দ্রিক হয়ে অন্যের সঙ্গে ব্যবধান তৈরি করে। এতে মানুষের প্রকৃত সুখ নষ্ট হয়, সংশয় সন্দেহ তৈরি হয়। আর সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ তা থেকে দূরে থাকে। তারা পরস্পরকে ভালোবাসে। এ কারণেই তাদের জীবন ক্লিষ্ট নয়। দরিদ্র হলেও তারা বিত্তের পিছনে ছোটে না। (গ) মাদার তেরেসার মানসিকতা ‘আশা’ কবিতার মানবপ্রেম বা মানুষকে ভালোবাসতে পারার মাঝে জীবনের মহত্ত্ব নিহিত থাকার বিষয়টির সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। ➠ আত্মস্বার্থমগ্ন হয়ে নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকা প্রকৃত মানুষের কাজ নয়। নিজের সুখ-সমৃদ্ধির জন্যই মানুষের এ পৃথিবীতে আগমন ঘটেনি। পরের কল্যাণের নিমিত্তেই মানবজীবন। আর সেই জীবনই সার্থক, যে জীবন মানবকল্যাণের সুমহান ব্রতে নিয়োজিত। তারা পৃথিবীর হিংস্রতা, হানাহানি ও বিদ্বেষের মধ্যেও মানুষকে ভালোবাসেন, মানুষের সেবায় নিজেদের উৎসর্গ করেন। উদ্দীপকে মাদার কতেরেসার মানবসেবার কথা বলা হয়েছে। মাদার তেরেসা ছিলেন একজন অসাধারণ মানবসেবী। যেখানে রোগ, শোক, দুঃখ-দারিদ্র্য, প্রাকৃতিক দুর্যোগের নির্মমতা সেখানে মাদার তেরেসা তাঁর সেবার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি জীবনে যত পুরস্কার পেয়েছেন তার সমস্ত অর্থই খরচ করেছেন মানবসেবার কাজে। তিনি দেশ, ধর্ম, জাতির পার্থক্য না করে সেবাকাজে মানুষকেই বড় করে দেখেছেন। মানুষকে ভালোবেসে তিনি মানুষের হৃদয় জয় করেছেন। তিনি নিজেও দুনিয়ার মানুষের ভালোবাসার পাত্রী হয়ে উঠেছেন। ➠‘আশা’ কবিতায় মানুষের কল্যাণে আত্মনিয়োগ এবং মানুষকে ভালোবাসার যে দিকটি প্রতিফলিত হয়েছে তার সঙ্গে উদ্দীপকটি সাদৃশ্যপূর্ণ। ‘আশা’ কবিতায় বলা হয়েছে কিছু মানুষ দুঃখ-কষ্টের মধ্যেও একে অন্যকে ভালোবাসে, মিথ্যা অহংকার করে না। বিত্তবৈভব অর্জনের জন্য দুর্ভাবনায় আয়ু কমায় না। তারা প্রতিবেশীর আঁধার ঘরে আলো জ্বালায়। (ঘ) “মাদার তেরেসার দর্শনই যেন ‘আশা’ কবিতার ভাববস্তু” মন্তব্যটি যথার্থ। ➠মহামানবদের জীবন আদর্শ এবং মহত্ত্ব আমাদের অনুপ্রাণিত করে। অসহায় মানুষের সেবা ও মুক্তির জন্য কাজ করাই মানুওেষর ধর্ম। এ ধরনের কাজের মাধ্যমেই মানুষ আত্মতৃপ্তি লাভ করে। এর মধ্য দিয়েই সমাজের কল্যাণ সাধিত হয়। মাদার তেরেসা চিরস্মরণীয় একজন মানবসেবী। তাঁর সেবামূলক কাজ কোনো একটি দেশ বা সমাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। বিশ্বব্যাপী ছিল তাঁর মানবসেবার কার্যক্রম। তাঁর জন্মস্থান সুদূর আলবেনিয়ায় হলেও তিনি ভারত ও বিভিন্ন দেশের মানুষের দুঃখ-দুর্দশায় বিচলিত হয়েছিলেন। এ কারণে তিনি ভারতবর্ষে গরিব ও অসুস্থ মানুষের জন্য বিভিন্ন সেবা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। মানবসেবার মহান ব্রত নিয়ে তিনি দুঃখী মানুষের কাছে এগিয়ে গেছেন। ➠ উদ্দীপকের এই বিষয়টির সঙ্গে ‘আশা’ কবিতায় প্রতিফলিত মানবসেবার বিষয়টি সাদৃশ্যপূর্ণ। সেখানে দারিদ্র্যক্লিষ্ট মানুষ পরস্পরকে ভালোবাসে। একে অন্যের ভাই পরিচয়ে পাশে দাঁড়ায়। কবিও মনুষ্যত্বের অধিকারী এসব মানুষের সান্নিধ্য পেতে চেয়েছেন। ‘আশা’ কবিতায় বিত্ত-বৈভব অর্জনের লোভ ত্যাগ করে মানুষকে ভালোবেসে মনুষ্যত্বসম্পন্ন মানুষ হওয়ার কথা বলা হয়েছে। সেখানে অসহায় অনাহারী মানুষের দুর্ভাবনাহীন জীবনের সঙ্গে কবি নিজেকে সম্পৃক্ত করতে চেয়ে তাদের প্রতি গভীর ভালোবাসার কথাই ব্যক্ত করেছেন। ➠ উদ্দীপকের মাদার তেরেসাও মানবসেবা এবং মানুষের প্রতি গভীর ভালোবাসার কথা বলেছেন। তিনি আজীবন মানবকল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। এসব দিক বিচারের তাই বলা যায় যে, প্রশ্নোক্ত মন্তব্যটি যথার্থ। |
সৃজনশীল প্রশ্ন- ২ |
---|
নিচের উদ্দীপকটি পড় এবং প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও: শুথু স্বপ্ন, শুধু স্মৃতি, তাই নিয়ে থাকি নিতি আর আশা নাহি রাখি সুখের দুখের। আমি যাহা দেখিয়াছি আমি যাহা পাইয়াছি এ জনম-সব জীবনের সব শূন্য আমি যাহে ভরিয়াছি তোমার তা কই! (ক) ‘আশা’ কবিতাটি কবির কোন কাব্যগ্রন্থ থেকে সংকলিত? (খ) প্রতিবেশীর অন্ধকার ঘরে কীভাবে আলো জ্বালানো যায়? ব্যাখ্যা করো। (গ) উদ্দীপকটি ‘আশা’ কবিতার কোন দিকটির সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ? ব্যাখ্যা করো। (ঘ) ‘শূন্যতার মাঝেই রয়েছে জীবনের সকল প্রাপ্তি’ যা ‘আশা’ কবিতাতেও প্রতিফলিত হয়েছে মন্তব্যটি মূল্যায়ন করো। |
(ক) ‘আশা’ কবিতাটি কবির ‘মালব কৌশিক’ কাব্যগ্রন্থ থেকে সংকলিত। (খ) মানুষের প্রতি ভালোবাসা সৃষ্টির মাধ্যমে মানবকল্যাণ সাধনে কাজ করে প্রতিবেশীর অন্ধকার ঘরে আলো জ্বালানো যায়। ➠ মানুষ দারিদ্র্যের মধ্যে থাকলেও অন্যকে সাহায্য করতে হবে। প্রতিবেশীকে সাহায্য করে প্রতিষ্ঠা করতে হবে সুখের পরিবেশ। আর এর জন্য দরকার মানুষের প্রতি মানুষের গভীর ভালোবাসা। পারস্পরিক ভালোবাসার মাধ্যমেই আমরা প্রতিবেশীর কষ্ট দূর করতে পারি। তাহলেই পৃথিবীতে মানবসমাজে যে হিংসা-বিদ্বেষ রয়েছে তা দূর করে সম্প্রীতির মাধ্যমে সুখ ও শান্তিময় সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব। (গ) ‘আশা’ কবিতার অল্পেই সুখী হওয়ার বিষয়টি উদ্দীপকের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। ➠ জীবনে সুখী হওয়ার অভিপ্রায় সবার মাঝেই বিদ্যমান। অতিরিক্ত সুখের প্রত্যাশা কখনই জীবনে সুখ বয়ে আনে না। বরং জীবনে যা পাওয়া যায় তা নিয়ে পরিতৃপ্ত থাকাতেই সুখ। উদ্দীপকে জীবনের অল্প প্রাপ্তি কীভাবে প্রকৃত সুখ বয়ে আনে তা তুলে ধরা হয়েছে। অতিরিক্ত আশা মানবজীবনে দুঃখ নিয়ে আসে আর সৎ প্রচেষ্টায় অর্জিত বিষয়ই সুখের প্রতিনিধিত্ব করে। ➠ উদ্দীপকের কবি তাই যা পেয়েছেন তাই এ জীবনের জন্য যথেষ্ট মনে করেন। ‘আশা’ কবিতাতেও কবি বলেছেন সুখের দুর্ভাবনা সুখ না নিয়ে এসে কষ্টের বোঝাকেই ভারী করে তোলে। অতিরিক্ত বিত্ত-বৈভবের প্রত্যাশাই সুখের অন্তরায়। তাই উদ্দীপকের অল্পেই সুখ সন্ধানের বিষয়টি ‘আশা’ কবিতার সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। (ঘ) ‘শূন্যতার মাঝেই রয়েছে জীবনের সকল প্রাপ্তি’ যা ‘আশা’ কবিতাতেও বর্ণিত হয়েছে মন্তব্যটি যথার্থ। ➠ বর্তমান সময়ে মানুষ ক্রমশ জটিল জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। প্রকৃত সুখী মানুষের মাঝে অতিরিক্ত সুখী হওয়ার আশা থাকে না। না পাওয়ার বেদনা তাকে কখনো আঘাত করে না। ➠ উদ্দীপকে স্বপ্ন, স্মৃতি নিয়ে বেঁচে থাকার বিষয়টি এসেছে। কবি আর সুখের দুঃখের আশা রাখেন না। তিনি যা পেয়েছেন তাতেই সন্তুষ্ট। এর মধ্য দিয়ে জীবনে যতটুকু প্রাপ্তি তার মাঝেই প্রকৃত সুখ অনুসন্ধানের বিষয়টি প্রতিফলিত হয়েছে। বরং সুখের প্রত্যাশা না করেই জীবন সুখে পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ‘আশা’ কবিতাতেও কবি সিকান্দার আবু জাফর যেসব সুখী মানুষের জগতের বর্ণনা দিয়েছেন যাদের প্রত্যাশা অনেক কম, যারা জীর্ণ বেড়ার ঘরেও নির্ভাবনায় ঘুমাতে পারে। ➠ উদ্দীপক এবং কবিতা উভয় ক্ষেত্রেই রয়েছে জীবনের আশা এবং প্রাপ্তির বিষয়টি। জীবনের শূন্যতায় অল্প একটু প্রত্যাশাই এনে দিতে পারে প্রকৃত সুখ। তাই উক্তিটি যথার্থ। |
সৃজনশীল প্রশ্ন- ৩ |
---|
নিচের উদ্দীপকটি পড় এবং প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও: লোক : দুনিয়াতে আমার মতো সুখী কে? আমি সুখের ডরাজা। আমি মস্ত বড় বাদশা। রহমত : ও বাদশা ভাই, তোমার গায়ের জামা কোথায়? ঘরের মধ্যে রেখেছ? তোমাকে একশ টাকা দেব। জামাটা নিয়ে এস। লোক : জামা! রহমত : জামা মানে জামা! এই যে, আমাদের এই জামার মতো জিনিস।... লোক : আমার তো কোনো জামা নাই ভাই! হাসু : মিছে কথা বল না। লোক : মিছে বলব কেন? আমার ঘরে কিছু নাই। সেই জন্যই তো আমি সুখী মানুষ। (ক) সিকানদার আবু জাফর কর্মজীবনে কী ছিলেন? (খ) ‘নির্ভাবনায় মানুষেরা ঘুমিয়ে থাকে ভাই’ এ কথাটি কেন বলা হয়েছে? (গ) উদ্দীপকের সঙ্গে ‘আশা’ কবিতার মিলের ক্ষেত্রটি চিহ্নিত করো। (ঘ) “উদ্দীপকের সুখী মানুষ ‘আশা’ কবিতার কবির ভাবনার প্রতিরূপ” মন্তব্যটির যথার্থতা মূল্যায়ন করো। |
(ক) সিকানদার আবু জাফর কর্মজীবনে সাংবাদিক ছিলেন। (খ) সুখী মানুষের সুখের কথা বোঝাতে কবি প্রশ্নোক্ত কথাটি বলেছেন। ➠ বাস্তবতার দিক থেকে যারা নিজেদের সুখী দাবি করে, কবি মনে করেন তারা প্রকৃত সুখী মানুষ নয়। কারণ তারা যেভাবে সুখী হওয়ার চেষ্টা করছে তাতে রাতে তাদের ঘুম হওয়ার কথা নয়। কিন্তু সাধারণ জীবনযাপনে যারা অল্পতেই সুখের সন্ধান করেন তারাই প্রকৃত সুখী। তাই শত কষ্টের মধ্যেও তারা নির্ভাবনায় রাতে ঘুমোতে যেতে পারেন। (গ) উদ্দীপকের সঙ্গে ‘আশা’ কবিতার মিলের দিকটি হলো প্রকৃত সুখী মানুষের পরিচয়। ➠ ছোট ছোট স্বপ্ন, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আশা মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে। অতিরিক্ত সম্পদচিন্তা মানুষকে অসুখী করে তোলে। যারা লোভের বশবর্তী হয়ে ছুটে বেড়ায় তারা সুখের আনন্দ থেকে বঞ্চিত হয়। উদ্দীপকের রহমত সুখী। মানুষের সন্ধান করে। তার প্রওেয়াজন সুখী মানুওেষর জামা। রহমত একজন সুখী মানুষের সন্ধান পায়, কিন্তু জামা পায় না। কারণ তার কোনো জামা নেই। তার ঘরে অসুখী হওয়ার মতো কিছু না থাকার কারণেই সে সুখী মানুষ। ➠ ‘আশা’ কবিতার কবিও যার কিছু নেই তার মধ্যে প্রকৃত সুখের সন্ধান করেছেন। কারণ কবি বলেন বিত্ত-বৈভবের দুর্ভাবনা মানুষকে কখনো সুখ এনে দেয় না। তাতে মানুষ অসুখী হয়ে মৃত্যুর দিকে ধাবিত হয়। প্রকৃত সুখী মানুষ অল্পেই তুষ্ট হয়। এই দিক থেকে প্রকৃত সুখী মানুষের পরিচয়ে উদ্দীপকের সঙ্গে ‘আশা’ কবিতার মিল রয়েছে। (ঘ) “উদ্দীপকের সুখী মানুষ ‘আশা’ কবিতার কবির ভাবনার প্রতিরূপ।” মন্তব্যটি যথার্থ। ➠ সুখ মানুষের আপেক্ষিক বিষয়। পৃথিবীতে সুখের বিষয়টি অনির্ধারিত। কাজের মধ্য দিয়েই মানুষের সুখ নির্ধারিত হয়। কাজ না করে অতিরিক্ত সুখের চিন্তা মানুষের অশান্তির কারণ হয়ে ওঠে। ➠ ‘আশা’ কবিতায় কবি তাদেরই প্রকৃত সুখী মানুষ বলেছেন যারা জীর্ণ বেড়ার ঘরেও রাতে নির্ভাবনায় ঘুমিয়ে যেতে পারে। প্রকৃত সুখী মানুষের মধ্যে সোনা-রুপার পাহাড় গড়ার প্রবণতা থাকে না। কবির ভাষায়, বিত্ত-সুখের দুর্ভাবনায় থাকলে মানুষের আয়ু কমে যায়। সারাদিনের পরিশ্রমের পর অভুক্ত থেকেও প্রকৃত সুখী মানুষ তুষ্ট থাকে। ➠ উদ্দীপকেও এমন এক সুখী মানুওেষর সন্ধান পাওয়া যায়, যার কিছুই নেই। তার কিছু নেই বলেই সে নিজেকে প্রকৃত সুখী মানুষ ভাবতে পারে। লোভের মোহ পরিহার করে অল্পেই পরিতৃপ্ত হওয়ার মাঝেই রয়েছে প্রকৃত সুখ। উদ্দীপকের সুখী মানুষ ‘আশা’ কবিতার কবির ভাবনার প্রতিরূপ হয়ে উঠেছে। এই বিবেচনায় প্রশ্নোক্ত মন্তব্যটি যথার্থ। |
সৃজনশীল প্রশ্ন- ৪ |
---|
------------- |
----------- |
তথ্যসূত্র : |
---|
১. বাংলা সাহিত্য: নবম-দশম শ্রেণি, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড,
বাংলাদেশ, ২০২৫। ২. আধুনিক বাংলা অভিধান: বাংলা একাডেমি, এপ্রিল, ২০১৮। ৩. ব্যবহারিক বাংলা অভিধান: বাংলা একাডেমি, ১৮তম , ২০১৫। |