যাব আমি তোমার দেশ : জসীমউদদীন
![]() |
যাব আমি তোমার দেশ |
যাব আমি তোমার দেশ
জসীমউদ্দীন
পল্লি-দুলাল, ভাই গো আমার যাব আমি-তোমার দেশে,
আকাশ যাহার বনের
শীষে
দিক-হারা মাঠ চরণ ঘেঁসে।
দূর দেশীয় মেঘ-কনেরা মাথায় লয়ে জলের ঝারি,
দাঁড়ায় যাহার কোলটি ঘেঁসে বিজলী-পেড়ে আঁচল নাড়ি।
বেতস কেয়ার বনে যেথায় ডাহুক মেয়ে আসর মাতায়,
পল্লি-দুলাল ভাই গো আমার, যাব সেথায়।
তোমার দেশে যাব আমি, দীঘল বাঁকা পন্থখানি,
ধান কাউনের ক্ষেতের ভেতর সরু সুতোর আঁচড় টানি,
গিয়াছে সে হাবা মেয়ের এলো মাথার সিঁথির মতো
কোথাও সিধে কোথাও বাঁকা গরুর গায়ের রেখায় ক্ষত।
গাজন-তলির মাঠ পেরিয়ে শিমুলডাঙা বনের বায়ে;
কোথাও গাঁয়ের রোদ মাখিয়া ঘুম-ঘুমায়ে গাছের ছায়ে।
* * *
তাহার পরে মুঠি ছড়িয়ে দিয়ে কদম-কলি,
কোথাও মেলে বনে পাতা গ্রাম্য মেয়ে যায় যে চলি।
সে পথ দিয়ে যাব আমি পল্লি-দুলাল তোমার দেশে,
নাম-না জানা ফুলের সুবাস বাতাসেতে আসবে ভেসে।
কোথাও মেলে বনে পাতা গ্রাম্য মেয়ে যায় যে চলি।
সে পথ দিয়ে যাব আমি পল্লি-দুলাল তোমার দেশে,
নাম-না জানা ফুলের সুবাস বাতাসেতে আসবে ভেসে।
তোমার সাথে যাব আমি, পাড়ার যত দস্যি ছেলে,
তাদের সাথে দল বাঁধিয়া হেথায় সেথায় ফিরব খেলে।
তাদের সাথে দল বাঁধিয়া হেথায় সেথায় ফিরব খেলে।
ধল-দীঘি
তে সাঁতার কেটে আনব তুলে রক্ত-কমল,
শাপলা লতায় জড়িয়ে চরণ ঢেউ-এর সাথে খাব যে দোল।
হিজল-ঝরা জলের ছিটায় গায়ের বরণ রঙিন হবে
খেলবে দীঘির ঝিলিমিল মোদের লীলা কালোৎসবে।
তোমার দেশে যাব আমি পল্লি-দুলাল ভাই গো সোনার,
সেথায় পথে ফেলতে চরণ লাগবে পরশ এই মাটি-মার।
ডাকব সেথা পাখির ডাকে, ভাব করিব পাখির সনে,
অজান ফুলের রূপ দেখিয়া মানবো তারে বিয়ের কনে।
চলতে পথে ময়না কাঁটায় উত্তরীয় জড়িয়ে যাবে,
ইটেল মাটির হোঁচট লেগে আঁচল হতে ফুল ছড়াবে।
পল্লি-দুলাল, যাব আমি-যাব আমি তোমার দেশে,
তোমার কাঁধে হাত রাখিয়া ফিরবো মোরা উদাস বেশে।
বনের পাতার ফাঁকে ফাঁকে দেখব মোরা সাঁজ-বাগানে,
ফুল ফুটেছে হাজার রঙের মেঘ তুলিকার নিখুঁত টানে।
গাছের শাখা দুলিয়ে আমি পাড়ব সে ফুল মনের আশে,
উত্তরীয়
ছড়িয়ে তুমি দাঁড়িয়ে থেকো বনের পাশে।
যে ঘাটেতে ভরবে কলস গাঁয়ের বিভোল পল্লিবালা,
সে ঘাটেরি এক ধারেতে আসবো রেখে ফুলের মালা।
দীঘির জলে ঘট বুড়াতে পথে-পাওয়া মাল্যখানি,
কুড়িয়ে নিয়ে ভাববে ইহা রেখে গেছে কেই না জানি।
চেনে-না তার হাতের মালা হয়ত সে-বা পরবে গলে,
আমরা দু'জন থাকব বসে ঢেউ দোলা সেই দীঘির কোলে।
চার পাশেতে বনের সারি এলিয়ে শাখার
কুন্তল-ভার,
দীঘির জলে ঢেউ গণিবে ফুল শুঁকিবে পদ্ম-পাতার।
বনের মাঝে ডাকবে ডাহুক, ফিরবে ঘুঘু আপন বাসে,
দিনের পিদীম ঢুলবে ঘুমে রাত জাগা কোন্
ফুলের বাসে
।
চার ধারেতে বন জুড়িয়া রাতের আঁধার বাঁধবে বেড়া,
সেই কুহেলীর
কালো কারায় দীঘির জলও পড়বে ঘেরা।
উৎস নির্দেশ : |
---|
‘যাব আমি তোমার দেশ’ কবিতাটি কবি জসীমউদ্দীনের ‘ধানক্ষেত’ কাব্যগ্রন্থ থেকে সংকলিত হয়েছে। |
শব্দার্থ ও টীকা : |
---|
পল্লি-দুলাল- পল্লি মায়ের আদরের ছেলে। পল্লির অকৃত্রিম প্রাকৃতিক পরিবেশে
যে ছেলে হয়েছে, কবি তাকে পল্লি দুলাল বলে সম্বোধন করেছেন। শীর্ষে- শীর্ষে, মাথার উপরে। বেতসবন- বেতবন। দীঘল- দীর্ঘ। পন্থ- পথ। দস্যি- দুষ্ট, দুরন্ত। ধল-দীঘি- মস্ত বড় দীঘি। শাখী- বনের বৃক্ষ। উত্তরীয়- চাদর, গায়ের কাপড়। বুড়াতে- ভরতে। কুন্তল- চুল। বাসে- গন্ধে। ফুলের বাসে- ফুলের সুগন্ধে। কুহেলী- কুয়াশা। অন্বেষণ- অনুসন্ধান করা, খোঁজ করা। |
পাঠের উদ্দেশ্য : |
---|
পাঠ-পরিচিতি : |
---|
‘যাব আমি তোমার দেশ’ কবিতায় কবি আদরের পল্লি-দুলালের দেশে অর্থাৎ
পল্লিগ্রামে যেতে চেয়েছেন। পল্লিগ্রাম, প্রকৃতি যেন তাকে ঘিরে রেখেছে।
তার বনের শীর্ষে আকাশ, পায়ের কাছে দিক-হারা মাঠ। সেখানে বেত-কেয়ার বনে
ডাহুক ডাকে। সেখানে ধান-কাউনের ক্ষেতের ভেতর দিয়ে সরু সুতার মত দীর্ঘ
বাঁকা পথ গেছে। সেই পথে গাঁয়ের মেয়ে কদম কলি ছড়িয়ে হেঁটে চলে। কবি সেই
পথে যাবেন পল্লি-দুলালের দেশে। তারপর পাড়ার দস্যি ছেলেদের সাথে খেলা
করবেন। ধল দীঘিতে সাঁতার কেটে রক্ত কমল তুলে আনবেন। মাটিতে পা ফেলে তিনি
হাঁটবেন। পাখির সাথে ডাকবেন। অজানা ফুলের রূপ দেখে মুগ্ধ হবেন। পল্লি-দুলালের কাঁধে হাত রেখে উদাস বেশে তিনি ঘুরে বেড়াবেন। গাছের শাখা দুলিয়ে হাজার রঙের ফুল তুলবেন। যে ঘাটে পল্লিবালারা কলসী ভরে পানি নেয়, সেই ঘাটের পাশে রেখে আসবেন ফুলের মালা। তারপর সন্ধ্যা নামবে। চারদিকে আঁধার আসবে ঘনিয়ে। নিরালা নিঝুম অন্ধকারে কবি পল্লি-দুলালের সাথে পল্লি মায়ের অপরূপ সৌন্দর্য অন্বেষণ করবেন। |
কবি পরিচিতি : |
---|
জসীমউদ্দীন ১৯০৩ খ্রিষ্টাব্দে ফরিদপুর জেলার তাম্বুলখানা গ্রামে
জন্মগ্রহণ করেন। কবি তাঁর কবিতায় বাংলাদেশের পল্লিপ্রকৃতি ও মানুষের সহজ
স্বাভাবিক রূপটি তুলে ধরেছেন। পল্লির মাটি ও মানুষের জীবনচিত্র তাঁর
কবিতায় নতুন মাত্রা পেয়েছে। পল্লির মানুষের আশা-স্বপ্ন-আনন্দ-বেদনা ও
বিরহ-মিলনের এমন আবেগ-মধুর চিত্র আর কোনো কবির কাব্যে খুঁজে পাওয়া ভার। এ
কারণে তিনি 'পল্লিকবি' নামে খ্যাত। কর্মজীবনের শুরুতে তিনি কিছুকাল ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন। পরে সরকারি তথ্য ও প্রচার বিভাগে উচ্চপদে
যোগদান করেন। ছাত্রজীবনেই তাঁর কবিপ্রতিভার বিকাশ ঘটে। বিশ্ববিদ্যালয়ে
অধ্যয়নকালেই তাঁর রচিত ‘কবর’ কবিতাটি প্রবেশিকা বাংলা সংকলনের
অন্তর্ভুক্ত হয়। জসীমউদ্দীনের উল্লেখযোগ্য কাব্যের মধ্যে রয়েছে
নক্সী-কাঁথার মাঠ, সোজনবাদিয়ার ঘাট, রাখালী, বালুচর, হাসু, এক পয়সার
বাঁশি, মাটির কান্না
ইত্যাদি। তাঁর ‘নক্সী-কাঁথার মাঠ’ কাব্য বিভিন্ন বিদেশি ভাষায়
অনূদিত হয়েছে। চলে মুসাফির তাঁর ভ্রমণকাহিনী। বিশ্বভারতী
বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মানসূচক ডি.লিট, ডিগ্রি প্রদান করে। এছাড়া
সাহিত্য-সাধনার স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি একুশে পদক লাভ করেন। ১৯৭৬ সালের ১৩ই মার্চ কবি ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।। |
বহুনির্বাচনি প্রশ্ন : |
---|
১. কবি কোথায় যাবার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন? ক. নিজ গ্রামে খ. বিদেশে গ. পল্লিগ্রামে ঘ. শহরে ২. কবি কাদের সাথে দল বেঁধে খেলার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন? ক. চাষির ছেলেদের খ. দস্যি ছেলেদের ঘ. খেলার সাথিদের গ. রাখাল ছেলেদের ৩. ‘যাব আমি তোমার দেশে’ কবিতার পড়ক্তিতে কবি উল্লেখ করেছেন- i. ধানক্ষেত-কাউনের ক্ষেতের ভেতর সরু সুতোর আঁচড় টানি ii. চলতে পথে ময়লা কাঁটার উত্তরীয় জড়িয়ে যাবে iii. বনের পাতার ফাঁকে দেখব মোরা সাঝ-বাগানের নিচের কোনটি সঠিক ক. i গ. i ও iii খ. i ও ii ঘ. ii ও iii ৪. ‘যাব আমি তোমার দেশে’ কবিতায় কবি গায়ের বরণ রঙিন করতে চায়- i. ধল-দীঘিতে সাঁতার কেটে ii. হিজল ঝরা জলের ছিটায় iii. ঝিলিমিলি ঢেউ খেলিয়ে নিচের কোনটি সঠিক ক. i খ. i ও ii গ. i ও iii ঘ. ii ও iii |
জ্ঞানমূলক প্রশ্ন : |
---|
অনুধাবনমূলক প্রশ্ন : |
---|
সৃজনশীল প্রশ্ন- ১ |
---|
শহরের দুই বন্ধু শফিক ও আশিক পরিকল্পনা করে এবার গ্রীষ্মের ছুটিতে তাদের
গ্রামের বন্ধু শাহেদের বাড়িতে যাবে। তারা কখনো গ্রাম দেখেনি। বইয়ের পাতায়
আর টেলিভিশনে দেখেছে বহুবার, ভালোও লেগেছে কিন্তু সশরীরে যাওয়া হয়নি
কখনো। তাই এ সুযোগ তারা কিছুতেই হাতছাড়া করবে না। তাদের ভালোলাগা আরো
শতগুণ বেড়ে গেছে শাহেদ যখন নিজ গ্রামের বন-বনানী, ফুল, পাখি, দীঘি,
শাপলা, মেঠো পথ, ছেলেমেয়েদের দুরন্তপনা ইত্যাদির নয়নাভিরাম বর্ণনা তাদের
শুনিয়েছে। ক. ‘যাব আমি তোমার দেশে’ কবিতাটি কে লিখেছেন? খ. ‘যাব আমি তোমার দেশে’ কবিতায় গ্রাম্য মেয়ে কেমন করে চলে? গ. উদ্দীপকে শহুরে দুই বন্ধুর গ্রাম দেখার যে ব্যাকুলতা প্রকাশ পেয়েছে তোমার পাঠ্য পুস্তকের কোন কবিতায় এমন অভিব্যক্তি প্রকাশ পেয়েছে- ব্যাখ্যা করো। ঘ. উদ্দীপকে শাহেদ তার গ্রামের যে নয়নাভিরাম বর্ণনা করেছেন ‘যাব আমি তোমার দেশে’ কবিতার আলোকে তার বর্ণনা দাও। |
----------- |
তথ্যসূত্র : |
---|
১. বাংলা সাহিত্য: নবম-দশম শ্রেণি, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক
বোর্ড, বাংলাদেশ, ২০২৫। ২. আধুনিক বাংলা অভিধান: বাংলা একাডেমি, এপ্রিল, ২০১৮। ৩. ব্যবহারিক বাংলা অভিধান: বাংলা একাডেমি, ১৮তম , ২০১৫। |