আমার দেশ : সুফিয়া কামাল

আমার দেশ : সুফিয়া কামাল
আমার দেশ : সুফিয়া কামাল 

আমার দেশ
সুফিয়া কামাল 

সূর্য-ঝলকে! মৌসুমী ফুল ফুটে
স্নিগ্ধ শরৎ আকাশের ছায়া লুটে
পড়ে মাঠভরা ধান্য শীর্ষ পরে
দেশের মাটিতে মানুষের ঘরে ঘরে।
আমার দেশের মাটিতে আমার প্রাণ
নিতি লভে নব জীবনের সন্ধান
এখানে প্লাবনে নুহের কিশ্রুতি ভাসে
শান্তি-কপোত বারতা লইয়া আসে।
জেগেছে নতুন চর-
সেই চরে ফের মানুষেরা সব পাশাপাশি বাঁধে ঘর।
নব অঙ্কুর জাগে-

প্রতি দিবসের সূর্য-আলোকে অন্তর অনুরাগে
আমার দেশের মাটিতে মেশানো আমার প্রাণের ঘ্রাণ
গৌরবময় জীবনের সম্মান।
প্রাণ-স্পন্দনে লক্ষ তরুর করে
জীবনপ্রবাহ সঞ্চারি মর্মরে
বক্ষে জাগায়ে আগামী দিনের আশা
আমার দেশের এ মাটি মধুর, মধুর আমার ভাষা।
নদীতে নদীতে মিলে হেথা গিয়ে ধায় সাগরের পানে
মানুষে মানুষে মিলে গিয়ে প্রাণে প্রাণে সূর্য চন্দ্র করে 

মৌসুমী ফুলে অঞ্জলি ভরে ভরে
আপন দেশের মাটিতে দাঁড়ায়ে হাসে
সূর্য-ঝলকে। জীবনের ডাক আসে
সেই ডাকে দেয় সাড়া
নদী-প্রান্তর পার হয়ে আসে লক্ষ প্রাণের ধারা
মিলিতে সবার সনে
আমার দেশের মানুষেরা সবে মুক্ত-উদার মনে
আর্ত-ব্যথিত সুধী গুণীজন পাশে
সেবা-সাম্য-প্রীতি বিনিময় আশে
সূর্য-আলোকে আবার এদেশে হাসে
নিতি নবরূপে ভরে ওঠে মন জীবনের আশ্বাসে। 

উৎস নির্দেশ:
সুফিয়া কামালের ‘উদাত্ত পৃথিবী’ কাব্যের ‘আমার দেশ’ কবিতাটি ‘সুফিয়া কামাল রচনাসংগ্রহ’ থেকে সংকলন করা হয়েছে।

শব্দার্থ ও টীকা:
সূর্য-ঝলকে- সূর্যের উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত, উদ্ভাসিত।
মৌসুমী ফুল- বিশেষ ঋতুতে (সময়ে) উৎপন্ন ফুল।
স্নিগ্ধ শরৎ- শরৎকালের উজ্জ্বলতা।
ধান্য শীর্ষ- ধানের ওপর ভাগ।
নূহের কিশতি- সেমিটিক পুরাণ অনুসারে পৃথিবীতে মহাপ্লাবনের সময়ে একজন নবির যে বড় নৌকা সবাইকে রক্ষা করেছিল।
শান্তি কপোত- শান্তির কবুতর, কবুতরকে শান্তির প্রতীক বলা হয়।
বারতা- সংবাদ, বার্তা।

পাঠের উদ্দেশ্য:

পাঠ-পরিচিতি:
বাঙালির সোনার বাংলা অসম্ভবকে সম্ভব করে, মাটি থেকে জন্ম দেয় সোনালি ফসল। চমৎকার এর জলবায়ু- সহনীয় রৌদ্রতাপ, নমনীয় জল-বৃষ্টি। তাই এর মাঠ ভরে ওঠে সোনালি ধানে, সবুজ পাটে, নানা বর্ণের ফলমূলে। এদেশের মানুষ পাশাপাশি ঘর বেঁধে তাই শান্তিতে বাস করে। দুর্যোগও যে আসে না তা নয়। কিন্তু দুর্যোগের সময়ও তা অতিক্রান্ত হওয়া মাত্র তারা আবার ঘর বাঁধে পাশাপাশি, থাকে শান্তিতে। বাংলার মানুষের মধুর ভাষা, অপার জীবনানন্দ তাদের নিয়ে যায় সম্প্রীতির মহাসাগরে। আকাশে যেমন সূর্য ওঠে, তেমনি ডাক আসে মিলনের। এদেশের মানুষ পরস্পরে মহামিলনের মধ্যেই প্রত্যহ নতুন হয়ে ওঠে। কবিতায় চিরায়ত বাংলার জীবনবাণী অসাধারণভাবে ধরা পড়েছে।

কবি পরিচিতি:
সুফিয়া কামাল ১৯১১ সালের ২০শে জুন বরিশাল জেলার শায়েস্তাবাদে মামার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। ’৫২-র ভাষা আন্দোলন থেকে ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ এবং পরবর্তীকালের প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তিনি অসামান্য ভূমিকা রাখেন। একটি প্রগতিশীল সমাজ-ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি আজীবন যুদ্ধ করেছেন। ছোটবেলা থেকেই তাঁর কবিতা লেখার হাতেখড়ি হয় এবং তাঁর কবিতা সমসাময়িক পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকে। তিনি কিছুকাল কলকাতার একটি বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। তাঁর কবিতার ভাষা সহজ সরল, ছন্দ সুললিত ও ব্যঞ্জনাময়। এই কর্মের স্বীকৃতির জন্য তাঁকে বাংলাদেশের জনগণ ‘জননী সাহসিকা’ অভিধায় অভিষিক্ত করেছে। তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্য: সাঁঝের মায়া, মায়া কাজল, উদাত্ত পৃথিবী এবং গল্পগ্রন্থ: কেয়ার কাঁটা; স্মৃতিকথামূলক গ্রন্থ: একাত্তরের ডাইরী; শিশুতোষ গ্রন্থ: ইতল বিতল ও নওল কিশোরের দরবারে। সাহিত্যকর্মে অসামান্য অবদানের জন্য তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার, একুশে পদক, Women’s Federation for World Peace Crest-সহ অনেক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত হন। ২০শে নভেম্বর ১৯৯৯ সালে এই মহীয়সী নারী মৃত্যুবরণ করেন।।

কর্ম-অনুশীলন:
১। সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের সম্প্রীতি নিয়ে একটি প্রবন্ধ রচনা করো।

বহুনির্বাচনি প্রশ্ন:
১। কে বার্তা নিয়ে আসে?
ক. স্নিগ্ধ শরৎ
খ. শান্তি কপোত
গ. নূহের কিস্তি
ঘ. নতুন চর
২। ‘আমার দেশ’ কোন জাতীয় কবিতা?
ক. স্বদেশ প্রেমমূলক
খ. জাগরণমূলক
গ. ঐতিহ্য বিষয়ক
ঘ. প্রকৃতি বিষয়ক
নিচের উদ্দীপকটি পড় এবং ৩ ও ৪-সংখ্যক প্রশ্নের উত্তর দাও:
প্রবল বন্যায় ভেসে যায় কুলিয়ারচর। ধনী, দরিদ্র, হিন্দু, মুসলিম সবাই আশ্রয়কেন্দ্রে ওঠে। সবটুকু আনন্দ-বেদনাকে তারা ভাগাভাগি করে নেয়। এ যেন নতুন এক জীবন।
৩। উদ্দীপকে ‘আমার দেশ’ কবিতার কোন বিষয়টি ফুটে উঠেছে?
ক. নতুন বসতি
খ. শুভ সংবাদ
গ. সম্প্রীতি
ঘ. প্রাণস্পন্দন
৪। উদ্দীপকে পরিবেশের যে রূপ ফুটে উঠেছে তা নিচের যে পঙ্ক্তিতে পাওয়া যায় তা হলো-
i. শান্তি-কপোত বারতা লইয়া আসে
ii. সেই চরে ফের মানুষেরা সব পাশাপাশি বাঁধে ঘর
iii. নিতি নবরূপে ভরে ওঠে মন জীবনের আশ্বাসে
নিচের কোনটি সঠিক?
ক. i
খ. ii
গ. i ও ii
ঘ. ii ও iii

জ্ঞানমূলক প্রশ্ন

অনুধাবনমূলক প্রশ্ন

সৃজনশীল প্রশ্ন- ১
ঝিঙে ফুল! ঝিঙে ফুল!
সবুজ পাতার দেশে ফিরোজিয়া ফিঙে-কুল-
ঝিঙে ফুল।
গুল্মে পর্ণে
লতিকার কর্ণে
ঢলঢল স্বর্ণে
ঝলমল দোলে দুল-
ঝিঙে ফুল ॥
ক. ‘কিশতি’ শব্দের অর্থ কী?
খ. ‘শান্তি-কপোত বারতা লইয়া আসে’ এ কথা দ্বারা কবি কী বোঝাতে চেয়েছেন?
গ. উদ্দীপক ও ‘আমার দেশ’ কবিতায় বর্ণিত বিষয়ের সাদৃশ্যের দিকটি তুলে ধর।
ঘ. “বিষয়বস্তুর বর্ণনায় উদ্দীপক ও ‘আমার দেশ’ কবিতার সাদৃশ্য থাকলেও চেতনাগত পার্থক্য স্পষ্ট”- যৌক্তিক বিশ্লেষণ কর।
-----------

তথ্যসূত্র :
১. বাংলা সাহিত্য : নবম-দশম শ্রেণি, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড, বাংলাদেশ, ২০২৫।
২. আধুনিক বাংলা অভিধান: বাংলা একাডেমি, এপ্রিল, ২০১৮।
৩. ব্যবহারিক বাংলা অভিধান: বাংলা একাডেমি, ১৮তম , ২০১৫।

Next Post Previous Post