‘মাঝি’ কবিতার মূলপাঠ, শব্দার্থ, মূলভাব, নমুনা প্রশ্ন-উত্তর
মাঝি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আমার যেতে ইচ্ছে করে
নদীটির ওই পারে-
যেথায় ধারে ধারে
বাঁশের খোঁটায় ডিঙি নৌকো
বাঁধা সারে সারে।
কৃষাণেরা পার হয়ে যায়
লাঙল কাঁধে ফেলে;
জাল টেনে নেয় জেলে,
গোরু মহিষ সাঁৎরে নিয়ে
যায় রাখালের ছেলে।
সন্ধে হলে যেখান থেকে
সবাই ফেরে ঘরে,
শুধু রাতদুপরে
শেয়ালগুলো ডেকে ওঠে
ঝাউডাঙাটার ’পরে।
মা, যদি হও রাজি,
বড়ো হলে আমি হব
খেয়াঘাটের মাঝি।
শুনেছি ওর ভিতর দিকে
আছে জলার মতো।
বর্ষা হলে গত
ঝাঁকে ঝাঁকে আসে সেথায়
চখাচখী যত।
তারি ধারে ঘন হয়ে
জন্মেছে সব শর;
মানিক-জোড়ের ঘর,
কাদাখোঁচা পায়ের চিহ্ন
আঁকে পাঁকের ’পর।
সন্ধ্যা হলে কত দিন মা,
দাঁড়িয়ে ছাদের কোণে
দেখেছি একমনে-
চাঁদের আলো লুটিয়ে পড়ে
সাদা কাশের বনে।
মা, যদি হও রাজি,
বড়ো হলে আমি হব
খেয়াঘাটের মাঝি।
এ-পার ও-পার দুই পারেতেই
যাব নৌকো বেয়ে।
যত ছেলেমেয়ে
স্নানের ঘাটে থেকে আমায়
দেখবে চেয়ে চেয়ে।
সূর্য যখন উঠবে মাথায়
অনেক বেলা হলে-
আসব তখন চলে
‘বড়ো খিদে পেয়েছে গো-
খেতে দাও মা’ বলে।
আবার আমি আসব ফিরে
আঁধার হলে সাঁঝে
তোমার ঘরের মাঝে।
বাবার মতো যাব না মা,
বিদেশে কোন্ কাজে।
মা, যদি হও রাজি,
বড়ো হলে আমি হব
খেয়াঘাটের মাঝি।
উৎস নির্দেশ : |
---|
‘মাঝি’ কবিতাটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘শিশু’ কাব্যগ্রন্থ নেওয়া হয়েছে। |
শব্দার্থ ও টীকা : |
---|
আঁধার- অন্ধকার। কাদাখোঁচা- পাখির নাম। কাশ- তৃণজাতীয় গাছ। খেয়াঘাট- নৌকা পারাপারের ঘাট। চখাচখি- এক জোড়া চক্রবাক পাখি; চখা ও চখি। জলা- জলমগ্ন ভূমি। জাল টেনে নেওয়া- জাল দিয়ে মাছ ধরা। ঝাঁকে ঝাঁকে- দলে দলে। ঝাউডাঙা- যে ডাঙায় ঝাউগাছ আছে। ডিঙি নৌকা- এক ধরনের নৌকা। তারি ধারে- তারই পাশে। ধারে ধারে- কাছাকাছি। পাঁক- কাদা। পায়ের চিহ্ন- পায়ের দাগ। পার- তীর। বাঁশের খোঁটা- বাঁশের ছোটো খুঁটি। বিদেশ- দূরে কোথাও। মানিকজোড়- পাখির নাম। রাতদুপর- রাত দুপুর; গভীর রাত। শর- নলখাগড়া গাছ। সারে সারে- সারিবদ্ধভাবে। |
কবিতা বুঝি : |
---|
শিক্ষকের নির্দেশ অনুযায়ী তোমরা দলে ভাগ হও। এই কবিতায় কী বলা হয়েছে, তা দলে আলোচনা করে বোঝার চেষ্টা করো। কোন দল কেমন বুঝতে পেরেছে, তা যাচাই করার জন্য এক দল অপর দলকে প্রশ্ন করবে। এজন্য আগেই দলে আলোচনা করে কাগজে প্রশ্নগুলো লিখে রাখো। |
কবি পরিচিতি : |
---|
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৬১ সালে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯৪১ সালে মৃত্যুবরণ করেন। কবিতা, গান, গল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ ইত্যাদি রচনায় তিনি অসামান্য দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। বলাকা, পুনশ্চ, গোরা, অচলায়তন, কালান্তর তাঁর কয়েকটি বইয়ের নাম। ‘গীতাঞ্জলি’ কাব্যের জন্য তিনি ১৯১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান। বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতটি তাঁর রচিত। |
নমুনা প্রশ্ন-উত্তর : |
---|
ক. ‘মাঝি’ কবিতায় কবির কোথায় যেতে ইচ্ছে করে? উত্তর: ‘মাঝি’ কবিতায় কবির নদীর ওপারে যেতে ইচ্ছে করে। খ. নদীর ওপারে কী আছে? উত্তর: নদীর ওপারে বাঁশের খুঁটির সঙ্গে ডিঙি নৌকা সারিবদ্ধভাবে বাঁধা রয়েছে। কিষাণেরা লাঙল কাধে করে নদী পার হয়, জেলে নদীতে জাল টেনে মাছ ধরে। গোরু-মহিষ সাঁতরে নিয়ে নদী পার হয় রাখাল। নদীর ওপারে দিনের বেলা মানুষের কোলাহল থাকলেও রাতের বেলা শেয়াল ডাকে ঝাউ ঘেরা ডাঙায়। কবি শুনেছেন সেই ঝাউডাঙার ভিতরে জলাভূমি আছে, যেখানে চখাচখি পাখির আসর বসে। সেখানকারর শরবনে মানিকজোড় পাখির বাসা রয়েছে, আর কাদায় লেপ্টে আছে। কাদাখোঁচা পাখির বিচরণের চিহ্ন। সন্ধেবেলা ঘরের ছাদের উপর দাঁড়িয়ে কবি খেয়াল করেছেন নদীর ওপারের শাদা কাশের বন, যেখানে জোসনা ছড়িয়ে পড়ে। গ. এ কবিতায় কোন বিষয়টি প্রধান হয়ে ফুটে উঠেছে? উত্তর: গ্রামবাংলার ছবি এবং কবির অন্তরের ইচ্ছা। ঘ. বড়ো হয়ে কবি কী হতে চান এবং কেন? উত্তর: বড়ো হয়ে কবি মাঝি হতে চান। তা হলে কবি সারাবেলা এপার-ওপার নৌকা পারাপার করবেন। তার নৌকাপারাপারের দৃশ্য দেখবে স্নানরত পাড়ার ছেলেমেয়েরা। মাঝিগিরি করে কবি দুপুরবেলা ঘরে ফিরে মায়ের কাছে খাবার চাইবেন। সন্ধেবেলাও কবি ঠিকঠাকমতো ঘরে ফিরবেন। কবি সব সময়ে মায়ের আশে পাশেই থাকতে চান; বাবার মতো কখনো বিদেশ-বিভুইয়ে পড়ে থাকতে চান না। তাই মা যদি রাজি থাকেন তাহলে কবি বড়ো হয়ে খেয়াঘাটের মাঝি হতে চান। ঙ. এই কবিতায় কবির সবচেয়ে বেশি ভালোবাসা কার প্রতি প্রকাশিত হয়েছে? উত্তর: মা ও মাতৃভমির প্রতি। |
তথ্যসূত্র : |
---|
১. বাংলা: সপ্তম শ্রেণি (পরীক্ষামূলক সংস্করণ), জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক
বোর্ড, বাংলাদেশ, ২০২৩। ২. আধুনিক বাংলা অভিধান: বাংলা একাডেমি, এপ্রিল, ২০১৮। ৩. ব্যবহারিক বাংলা অভিধান: বাংলা একাডেমি, ১৮তম , ২০১৫। |