‘প্রবাস বন্ধু’ ভ্রমণকাহিনির মূলপাঠ, শব্দার্থ, মূলভাব, বহুনির্বাচনি প্রশ্ন ও সৃজনশীল প্রশ্ন-উত্তর
![]() |
প্রবাস বন্ধু |
বাসা পেলুম কাবুল থেকে আড়াই মাইল দূরে খাজামোল্লা গ্রামে। বাসার সঙ্গে সঙ্গে
চাকরও পেলুম।
অধ্যক্ষ জিরার জাতে ফরাসি। কাজেই
কায়দামাফিক আলাপ
করিয়ে দিয়ে বললেন, ‘এর নাম আবদুর রহমান।
আপনার সব কাজ করে দেবে- জুতো বুরুশ থেকে খুনখারাবি।’ অর্থাৎ ইনি ‘হরফুন-মৌলা’ বা ‘সকল কাজের কাজি’।
জিরার সায়েব কাজের লোক, অর্থাৎ সমস্ত দিন কোনো-না-কোনো মন্ত্রীর দপ্তরে ঝগড়া-বচসা
করে কাটান। কাবুলে এরই নাম কাজ। ‘ও রভোয়া, বিকেলে দেখা হবে’ বলে চলে গেলেন।
কাবুল শহরে আমি দুটি নরদানব দেখেছি। তার একটি আবদুর রহমান।
পরে ফিতে দিয়ে মেপে দেখেছিলুম- ছ ফুট চার ইঞ্চি। উপস্থিত লক্ষ করলুম লম্বাই মিলিয়ে চওড়াই। দুখানা হাত হাঁটু পর্যন্ত নেমে এসে আঙুলগুলো দু কাঁদি মর্তমান কলা হয়ে ঝুলছে। পা দুখানা ডিঙি নৌকার সাইজ। কাঁধ দেখে মনে হলো, আমার বাবুর্চি আবদুর রহমান না হয়ে সে যদি আমির আবদুর রহমান হত তবে অনায়াসে গোটা আফগানিস্তানের ভার বইতে পারত। এ কান ও কান জোড়া মুখ- হ্যাঁ করলে চওড়াচওড়ি কলা গিলতে পারে। এবড়ো-থেবড়ো নাক-কপাল নেই। পাগড়ি থাকায় মাথার আকার-প্রকার ঠাহর হলো না, তবে আন্দাজ করলুম বেবি সাইজের হ্যাটও কান অবধি পৌঁছবে।
রং ফর্সা, তবে শীতে গ্রীষ্মে চামড়া চিরে ফেঁড়ে গিয়ে আফগানিস্তানের রিলিফ ম্যাপের
চেহারা ধরেছে। দুই গাল কে যেন থাবড়া মেরে লাল করে দিয়েছে- কিন্তু কার এমন বুকেট
পাটা? রুজও তো মাখবার কথা নয়।
পরনে শিলওয়ার, কুর্তা আর ওয়াসকিট।
চোখ দুটি দেখতে পেলুম না। সেই যে প্রথম দিন ঘরে ঢুকে কার্পেটের দিকে নজর রেখে
দাঁড়িয়েছিল, শেষ দিন পর্যন্ত ঐ কার্পেটের অপরূপ রূপ থেকে তাকে বড়ো একটা চোখ
ফেরাতে দেখিনি। গুরুজনদের দিকে তাকাতে নেই, আফগানিস্তানেও নাকি এই ধরনের একটা
সংস্কার আছে।
তবে তার নয়নের ভাবের খেলা গোপনে দেখেছি। দুটো চিনেমাটির ডাবরে যেন দুটো পান্তুয়া
ভেসে উঠেছে।
জরিপ করে ভরসা পেলুম, ভয়ও হলো। এ লোকটা ভীমসেনের মতো রান্না তো করবেই, বিপদে-আপদে
ভীমসেনেরই মতো আমার মুশকিল-আসান হয়ে থাকবে। কিন্তু প্রশ্ন, এ যদি কোনোদিন বিগড়ে
যায়? তবে?
রহমানকে জিজ্ঞেস করলুম, ‘পূর্বে কোথায় কাজ করেছ?’
উত্তর দিল, ‘কোথাও না, পল্টনে ছিলুম, মেসের চার্জে। এক মাস হলো খালাস পেয়েছি।’
‘রাইফেল চালাতে পার?’
একগাল হাসল।
‘কী কী রাঁধতে জানো?’
‘পোলাও, কোরমা, কাবাব, ফালুদা-।’
আমি জিজ্ঞেস করলুম, ‘ফালুদা বানাতে বরফ লাগে। এখানে বরফ তৈরি করার কল আছে?’
‘কিসের কল?’
আমি বললুম, ‘তাহলে বরফ আসে কোত্থেকে?’
বলল, ‘কেন, ঐ পাগমানের পাহাড় থেকে।’ বলে জানলা দিয়ে পাহাড়ের বরফ দেখিয়ে দিল।
তাকিয়ে দেখলুম, যদিও গ্রীষ্মকাল, তবু সবচেয়ে উঁচু নীল পাহাড়ের গায়ে সাদা সাদা বরফ
দেখা যাচ্ছে। আশ্চর্য হয়ে বললুম, ‘বরফ আনতে ঐ উঁচুতে চড়তে হয়?’
বলল, ‘না সায়েব, এর অনেক নিচে বড়ো বড়ো গর্তে শীতকালে বরফ ভর্তি করে রাখা হয়। এখন
তাই খুঁড়ে তুলে গাধা বোঝাই করে নিয়ে আসা হয়।’
বুঝলুম, খবর-টবরও রাখে। বললুম, ‘তা আমার হাঁড়িকুড়ি, বাসনকোসন তো কিছু নেই। বাজার
থেকে সব কিছু কিনে নিয়ে এসো। রাত্তিরের রান্না আজ আর বোধ হয় হয়ে উঠবে না। কাল
দুপুরে রান্না কোরো। সকালবেলা চা দিয়ো।’
টাকা নিয়ে চলে গেল।
বেলা থাকতেই কাবুল রওনা দিলুম। আড়াই মাইল রাস্তা- মৃদুমধুর ঠান্ডায় গড়িয়ে গড়িয়ে
পৌছব। পথে দেখি এক পবর্তপ্রমাণ বোঝা নিয়ে আবদুর রহমান ফিরে আসছে। জিজ্ঞেস করলুম,
‘এত বোঝা বইবার কি দরকার ছিল- একটা মুটে ভাড়া করলেই তো হত।’ যা বলল, তার অর্থ এই,
সে যে-মোট বইতে পারে না, সে-মোট কাবুলে বইতে যাবে কে?
আমি বললুম, ‘দুজনে ভাগাভাগি করে নিয়ে আসতে।’
ভাব দেখে বুঝলুম, অতটা তার মাথায় খেলেনি, অথবা ভাববার প্রয়োজনবোধ করেনি।
বোঝাটা নিয়ে আসছিল জালের প্রকাণ্ড থলেতে করে। তার ভিতর তেল-নুন-লকড়ি সবই দেখতে
পেলুম। আমি ফের চলতে আরম্ভ করলে বলল, ‘সায়েব রাত্রে বাড়িতেই খাবেন।’
খুব বেশি দূর যেতে হলো না। লব-ই-দরিয়া অর্থাৎ কাবুল নদীর পারে পৌঁছতে না পৌঁছতেই
দেখি মশিয়ে জিরার টাঙা হাঁকিয়ে টগবগাবগ করে বাড়ি ফিরছেন।
কলেজের বড়কর্তা বা বস্ হিসাবে আমাকে তিনি বেশ দু-এক প্রস্থ ধমক দিয়ে বললেন,
‘কাবুল শহরে নিশাচর হতে হলে যে তাগদ ও হাতিয়ারের প্রয়োজন, সে দুটোর একটাও তোমার
নেই।’
বসকে খুশি করবার জন্য যার ঘটে ফন্দি-ফিকিরের অভাব, তার পক্ষে কোম্পানির কাগজ
হচ্ছে তর্ক না করা। বিশেষ করে যখন বসের উত্তমার্ধ তাঁরই পাশে বসে ‘উই,
সার্তেনমাঁ, এভিদামাঁ, অর্থাৎ অতি অবশ্য, সার্টেনলি, এভিডেন্টলি’, বলে তাঁর কথায়
সায় দেন। ইংলন্ডে মাত্র একবার ভিক্টোরিয়া আলবার্ট আঁতাৎ হয়েছিল; শুনতে পাই
ফ্রান্সে নাকি নিত্যি-নিত্যি, ঘরে ঘরে।
বাড়ি ফিরে এসে বসবার ঘরে ঢুকতেই আবদুর রহমান একটা দর্শন দিয়ে গেল এবং আমি যে তার
তম্বীতেই ফিরে এসেছি, সে সম্বন্ধে আশ্বস্ত হয়ে হুট করে বেরিয়ে গেল।
তখন রোজার মাস নয়, তবু আন্দাজ করলুম সেহরির সময় অর্থাৎ রাত দুটোয় খাবার জুটলে
জুটতেও পারে।
তন্দ্রা লেগে গিয়েছিল। শব্দ শুনে ঘুম ভাঙল। দেখি আবদুর রহমান মোগল তসবিরের
গাড়ু-বদনার সমন্বয় আফতাবে বা ধারাযন্ত্র নিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে। মুখ ধুতে গিয়ে
বুঝলুম, যদিও গ্রীষ্মকাল, তবু কাবুল নদীর বরফ-গলা জলে কিছুদিন ধুলে আমার মুখও
আফগানিস্তানের রিলিফ ম্যাপের উঁচুনিচুর টক্করের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে পারবে।
খানা টেবিলের সামনে গিয়ে যা দেখলুম, তাতে আমার মনে আর কোনো সন্দেহ রইল না যে,
আমার ভৃত্য আগা আবদুর রহমান এককালে মেসের চার্জে ছিলেন।
ডাবর নয়, ছোটখাটো একটা গামলাভর্তি মাংসের কোরমা বা পেঁয়াজ-ঘিয়ের ঘন ক্বাথে
সেরখানেক দুম্বার মাংস- তার মাঝে মাঝে কিছু বাদাম কিসমিস লুকোচুরি খেলছে, এক কোণে
একটি আলু অপাঙক্তেয় হওয়ার দুঃখে ডুবে মরার চেষ্টা করছে। আরেক প্লেটে গোটা আষ্টেক
ফুল বোম্বাই সাইজের শামী-কাবাব। বারকোশ থালায় এক ঝুড়ি কোফতা-পোলাও আর তার ওপরে
বসে আছে একটি আন্ত মুর্গি-রোস্ট।
আমাকে থ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আবদুর রহমান তাড়াতাড়ি এগিয়ে অভয়বাণী দিল-
রান্নাঘরে আরো আছে।
একজনের রান্না না করে কেউ যদি তিনজনের রান্না করে, তবে তাকে ধমক দেওয়া যায়,
কিন্তু সে যদি ছ’জনের রান্না পরিবেশন করে বলে রান্নাঘরে আরো আছে তখন আর কী করার
থাকে? অল্প শোকে কাতর, অধিক শোকে পাথর।
রান্না ভালো, আমার ক্ষুধাও ছিল, কাজেই গড়পড়তা বাঙালির চেয়ে কিছু কম খাইনি। তার ওপর অদ্য রজনী প্রথম রজনী এবং আবদুর রহমানও ডাক্তারি কলেজের ছাত্র যে রকম তন্ময় হয়ে মড়া কাটা দেখে, সেই রকম আমার খাওয়ার রকম-বহর দুই-ই তার ডাবর-চোখ ভরে দেখে নিচ্ছিল।
আমি বললুম, ‘ব্যস! উৎকৃষ্ট রেঁধেছ আবদুর রহমান-।’
আবদুর রহমান অন্তর্ধান। ফিরে এল হাতে এক থালা ফালুদা নিয়ে। আমি সবিনয় জানালুম যে,
আমি মিষ্টি পছন্দ করি না।
আবদুর রহমান পুনরপি অন্তর্ধান। আবার ফিরে এল এক ডাবর নিয়ে পেঁজা বরফের গুঁড়োয়
ভর্তি। আমি বোকা বনে জিজ্ঞাসা করলুম, ‘এ আবার কি?’
আবদুর রহমান উপরের বরফ সরিয়ে দেখাল নিচে আঙুর। মুখে বলল, ‘বাগেবালার বরফি আঙুর-তামাম আফগানিস্তানে মশহুর।’ বলেই একখানা সসারে কিছু বরফ আর গোটা কয়েক আঙুর নিয়ে বসল। আমি আঙুর খাচ্ছি, ও ততক্ষণ এক-একটা করে হাতে নিয়ে সেই বরফের টুকরোয় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে অতি সন্তর্পণে ঘষে-মেয়েরা যে রকম আচারের জন্য কাগজি নেবু পাথরের শিলে ঘষেন। বুঝলুম, বরফ-ঢাকা থাকা সত্ত্বেও আঙুর যথেষ্ট হিম হয়নি বলে এই মোলয়েম কায়দা। ওদিকে তালু আর জিবের মাঝখানে একটা আঙুরে চাপ দিতেই আমার ব্রহ্মরন্দ্র পর্যন্ত ঝিনঝিন করে উঠছে। কিন্তু পাছে আবদুর রহমান ভাবে তার মনিব নিতান্ত জংলি তাই খাইবারপাসের হিম্মৎ বুকে সঞ্চয় করে গোটা আষ্টেক গিললুম। কিন্তু বেশিক্ষণ চালাতে পারলুম না; ক্ষান্ত দিয়ে বললুম, ‘যথেষ্ট হয়েছে আবদুর রহমান, এবারে তুমি গিয়ে ভালো করে খাও।’
কার গোয়াল, কে দেয় ধুয়ো। এবারে আবদুর রহমান এলেন চায়ের সাজ-সরঞ্জাম নিয়ে। কাবুলি
সবুজ চা। পেয়ালায় ঢাললে অতি ফিকে হলদে রং দেখা যায়। সে চায়ে দুধ দেওয়া হয় না।
প্রথম পেয়ালায় চিনি দেওয়া হয়, দ্বিতীয় পেয়ালায় তাও না। তারপর ঐ রকম, তৃতীয়,
চতুর্থ-কাবুলিরা পেয়ালা ছয়েক খায়, অবশ্যি পেয়ালা সাইজে খুব ছোট, কফির পাত্রের মত।
চা খাওয়া শেষ হলে আবদুর রহমান দশ মিনিটের জন্য বেরিয়ে গেল। ভাবলুম এই বেলা দরজা
বন্ধ করে দি, না হলে আবার হয়ত কিছু একটা নিয়ে আসবে। আস্ত উটের রোস্টটা হয়ত দিতে
ভুলে গিয়েছে।
ততক্ষণে আবদুর রহমান পুনরায় হাজির। এবার এক হাতে থলে-ভর্তি বাদাম আর আখরোট, অন্য
হাতে হাতুড়ি। ধীরে সুস্থে ঘরের এককোণে পা মুড়ে বসে বাদাম আখরোটের খোসা ছাড়াতে
লাগল।
এক মুঠো আমার কাছে নিয়ে এসে দাঁড়াল। মাথা নিচু করে বলল, ‘আমার রান্না হুজুরের
পছন্দ হয়নি।’
‘কে বলল, পছন্দ হয়নি?’
‘তবে ভালো করে খেলেন না কেন?’
আমি বিরক্ত হয়ে বললুম, ‘কী আশ্চর্য, তোমার বপুটার সঙ্গে আমার তনুটা মিলিয়ে দেখো
দিকিনি-তার থেকে আন্দাজ করতে পারো না, আমার পক্ষে কি পরিমাণ খাওয়া সম্ভবপর?’
আবদুর রহমান তর্কাতর্কি না করে ফের সেই কোণে গিয়ে আখরোট বাদামের খোসা ছাড়াতে
লাগল।
তারপর আপন মনে বলল, ‘কাবুলের আবহাওয়া বড়ই খারাপ। পানি তো পানি নয়, সে যেন গালানো
পাথর। পেটে গিয়ে এক কোণে যদি বসল তবে ভরসা হয় না আর কোনো দিন বেরুবে। কাবুলের
হাওয়া তো হাওয়া নয়- আতসবাজির হল্কা। মানুষের ক্ষিদে হবেই বা কী করে।’
আমার দিকে না তাকিয়েই তারপর জিজ্ঞেস করল, ‘হুজুর কখনো পানশির গিয়েছেন?’
‘সে আবার কোথায়?’
‘উত্তর-আফগানিস্তান। আমার দেশ- সে কী জায়গা! একটা আস্ত দুম্বা খেয়ে এক ঢোক পানি
খান, আবার ক্ষিদে পাবে। আকাশের দিকে মুখ করে একটা লম্বা দম নিন, মনে হবে তাজি
ঘোড়ার সঙ্গে বাজি রেখে ছুটতে পারি। পানশিরের মানুষ তো পায়ে হেঁটে চলে না, বাতাসের
ওপর ভর করে যেন উড়ে চলে যায়।
‘শীতকালে সে কী বরফ পড়ে। মাঠ পথ পাহাড় নদী গাছপালা সব ঢাকা পড়ে যায়, ক্ষেত
খামারের কাজ বন্ধ, বরফের তলায় রাস্তা চাপা পড়ে গেছে। কোনো কাজ নেই, কর্ম নেই,
বাড়ি থেকে বেরনোর কথাই ওঠে না। আহা সে কি আরাম! লোহার বারকোশে আঙার জ্বালিয়ে তার
ওপর ছাই ঢাকা দিয়ে কম্বলের তলায় চাপা দিয়ে বসবেন গিয়ে জানালার ধারে। বাইরে দেখবেন
বরফ পড়ছে, বরফ পড়ছে পড়ছে, পড়ছে- দু দিন, তিন দিন, পাঁচ দিন, সাত দিন ধরে। আপনি
বসেই আছেন, আর দেখছেন চে তৌর বর্ষ ববারদ- কী রকম বরফ পড়ে।’
আমি বললুম, ‘সাত দিন ধরে জানালার কাছে বসে থাকব?’ আবদুর রহমান আমার দিকে এমন করুণভাবে তাকালো যে, মনে হলো এ রকম বেরসিকের পাল্লায় সে জীবনে আর কখনো এতটা অপদস্থ হয়নি। স্নান হেসে বলল, ‘একবার আসুন, জানালার পাশে বসুন, দেখুন। পছন্দ না হয়, আবদুর রহমানের গর্দান তো রয়েছে।’
খেই তুলে নিয়ে বলল, ‘সে কত রকমের বরফ পড়ে। কখনো সোজা, ছেঁড়া ছেঁড়া পেঁজা তুলোর মতো, তারি ফাঁকে ফাঁকে আসমান জমিন কিছু কিছু দেখা যায়। কখনো ঘুরঘট্টি ঘন, চাদরের মতো নেবে এসে চোখের সামনে পর্দা টেনে দেয়। কখনো বয় জোর বাতাস, প্রচণ্ড ঝড়। বরফের পাঁজে যেন সে-বাতাস ডাল গলাবার চর্কি চালিয়ে দিয়েছে। বরফের গুঁড়ো ডাইনে বাঁয়ে উপর নিচে এলোপাথাড়ি ছুটোছুটি লাগায়- হু হু করে কখনো একমুখে হয়ে তাজি ঘোড়াকে হার মানিয়ে ছুটে চলে। কখনো সব ঘুটঘুটে অন্ধকার, শুধু শুনতে পাবেন সোঁ-ও-ওঁ- তার সঙ্গে আবার মাঝে মাঝে যেন দারুল আমানের ইঞ্জিনের শিটির শব্দ। সেই ঝড়ে ধরা পড়লে রক্ষে নেই, কোথা থেকে কোথায় উড়িয়ে নিয়ে চলে যাবে, না হয় বেহুঁশ হয়ে পড়ে যাবেন বরফের বিছানায়, তারই উপর জমে উঠবে ছ হাত উঁচু বরফের কম্বল গাদা গাদা, পাঁজা পাঁজা। কিন্তু তখন সে বরফের পাঁজা সত্যিকার কম্বলের মতো ওম দেয়। তার তলায় মানুষকে দু দিন পরেও জ্যান্ত পাওয়া গিয়েছে।
একদিন সকালে ঘুম ভাঙলে দেখবেন বরফ পড়া বন্ধ হয়ে গিয়েছে। সূর্য উঠেছে- সাদা বরফের উপর সে রোশনির দিকে চোখ মেলে তাকানো যায় না। কাবুলের বাজারে কালো চশমা পাওয়া যায়, তাই পরে তখন বেড়াতে বেরোবেন। যে হাওয়া দম নিয়ে বুকে ভরবেন তাতে একরত্তি ধুলো নেই, বালু নেই, ময়লা নেই ছুরির মতো ধারাল ঠান্ডা হাওয়া নাক মগজ গলা বুক চিরে ঢুকবে, আবার বেরিয়ে আসবে ভিতরকার সব ময়লা ঝেটিয়ে নিয়ে। দম নেবেন, ছাতি এক বিঘত ফুলে উঠবে-দম ফেলবেন এক বিঘত নেমে যাবে। এক এক দম নেওয়াতে এক এক বছর আয়ু বাড়বে- এক একবার দম ফেলাতে একশটা বেমারি বেরিয়ে যাবে।
‘তখন ফিরে এসে, হুজুর একটা আস্ত দুম্বা যদি না খেতে পারেন, তবে আমি আমার গোঁফ
কামিয়ে ফেলব। আজ যা রান্না করেছিলুম তার ডবল দিলেও আপনি ক্ষিদের চোটে আমায় কতল
করবেন।’
আমি বললুম, ‘হ্যাঁ আবদুর রহমান তোমার কথাই সই। শীতকালটা আমি পানশিরেই কাটাব।’
আবদুর রহমান গদগদ হয়ে বলল, ‘সে বড়ো খুশি বাৎ হবে হুজুর।’
আমি বললুম, ‘তোমার খুশির জন্য নয়, আমার প্রাণ বাঁচাবার জন্য।’
আবদুর রহমান ফ্যালফ্যাল করে আমার দিকে তাকালো।
আমি বুঝিয়ে বললুম, ‘তুমি যদি সমস্ত শীতকালটা জানালার পাশে বসে কাটাও তবে আমার
রান্না করবে কে?’
উৎস নির্দেশ : |
---|
সৈয়দ মুজতবা আলী রচিত ‘প্রবাস বন্ধু’ শীর্ষক ভ্রমণকাহিনিটি তাঁর ‘দেশে বিদেশে’ (১৯৪৮) গ্রন্থের পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ থেকে নেওয়া হয়েছে। |
শব্দার্থ ও টীকা : |
---|
➠ ও রভোয়া- ফরাসি ভাষার বাক্যবন্ধ। অর্থ আবার দেখা হবে। ➠ নরদানব- মানুষের মতো দেখতে ভয়ঙ্কর জন্তু। এখানে বিশালদেহী মানুষ বোঝানো হয়েছে। আদরার্থে। ➠ মর্তমান কলা- মায়ানমারের মার্তাবান দ্বীপে উৎপন্ন কলার জাত। ➠ রুজ- গাল রাঙানোর প্রসাধনী। ➠ পান্তুয়া- চিনির রসে ভেজানো ঘিয়ে ভাজা রসগোল্লা জাতীয় মিষ্টি। ➠ তাগদ- শক্তি। ➠ তন্বী- তিরস্কার। ➠ বারকোশ- কাঠের তৈরি কানা উঁচু বড় থালা। ➠ পুনরপি- পুনরায়। ➠ ব্রহ্মরন্ধ্র তালুর কেন্দ্রবর্তী ছিদ্র। ➠ বপু- বড় দেহ। ➠ তনু- ক্ষীণ দেহ। ➠ উত্তমার্ধ- স্ত্রী, সহধর্মিণী। |
পাঠ-পরিচিতি : |
---|
প্রতিবেশী দেশ আফগানিস্তানের ভূমি, পরিবেশ, সেখানকার মানুষ ও তাদের সহজ-সরল জীবনাচরণ, বিচিত্র খাদ্য ইত্যাদি হাস্যরসাত্মকভাবে এই রচনায় ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। লেখকের আফগানিস্তান বাসের আংশিক অভিজ্ঞতার পরিচয় আছে এখানে। আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলের সন্নিকটে খাজামোল্লা নামক গ্রামে বাসের সময় আবদুর রহমান নামের একজন তাঁর দেখভালের দায়িত্বে ছিলেন। আফগান আবদুর রহমান চরিত্রের মধ্যে সরলতা, স্বদেশপ্রেম, অতিথিপরায়ণতা ফুটে উঠেছে। আবদুর রহমানের রান্না ও পরিবেশন করা খাবারের মধ্যে আফগানিস্তানের বিচিত্র ও সুস্বাদু খাদ্যবস্তুর পরিচয় পাওয়া যায়। আফগানিস্তানের প্রস্তরভূমি এবং বরফ-শীতল জলবায়ু আকর্ষণীয়। 'প্রবাস বন্ধু' গল্পটি আমাদের দৃষ্টিকে প্রসারিত করে; একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে জীবন ও জগৎ, সমাজ ও সংস্কৃতিকে ভাবতে শেখায়। |
লেখক পরিচিতি: |
---|
সৈয়দ মুজতবা আলী ১৩ই সেপ্টেম্বর ১৯০৪ সালে আসামভুক্ত শ্রীহট্টের করিমগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি সিলেট গভর্মেন্ট হাইস্কুল ও শান্তিনিকেতনে পড়াশোনা করেন। পরে ১৯২৬ সালে বিশ্বভারতী থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। আফগানিস্তানে কাবুলের কৃষিবিজ্ঞান কলেজে অধ্যাপনা দিয়ে তাঁর কর্মজীবন শুরু হয়। এরপর বার্লিন ও বন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেন। ১৯৩২ সালে তিনি বন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন। কর্মজীবনে তিনি মিশরের আল আজাহার বিশ্ববিদ্যালয়ে ও মহীশূরের বরোদা কলেজে অধ্যাপনা করেন। তিনি ১৯৪৯ সালে বগুড়ার আজিজুল হক কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে যোগদান করেন। কিন্তু পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে প্রবন্ধ লেখার অভিযোগে তাঁকে চাকরি ছাড়তে হয়। পরে তিনি বিশ্বভারতীর রিডার নিযুক্ত হন। সৈয়দ মুজতবা আলী নিজস্ব এক গদ্যশৈলীর নির্মাতা। বিভিন্ন ভাষায় ব্যুৎপত্তি ও অসাধারণ পান্ডিত্যের সংমিশ্রণে তিনি যে গদ্য রচনা করেছেন, তা খুবই রসগ্রাহী হয়ে উঠেছে। তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনাগুলো হলো: দেশে-বিদেশে, পঞ্চতন্ত্র, চাচা কাহিনী, ময়ূরকণ্ঠী, শবনম ইত্যাদি। তিনি ১১ই ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৪ সালে ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।। |
কর্ম-অনুশীলন: |
---|
১। তোমার এলাকায় শীতকালে যে প্রাকৃতিক অবস্থা সৃষ্টি হয় তার পরিচয় দাও।
২। গ্রীষ্মকাল ও শীতকালের ভ্রমণের সুবিধা অসুবিধাগুলো লেখো। |
বহুনির্বাচনি প্রশ্ন : |
---|
১। ‘তন্বী’ শব্দের অর্থ কী? ক. বড় দেহ খ. ক্ষীণ দেহ গ. তিরস্কার ঘ. পুনরায় ২। আবদুর রহমানকে লেখক নরদানব বলেছেন কেন? ক. আচরণের জন্য খ. শারীরিক গঠনের জন্য গ. বেশি রান্নার জন্য ঘ. বেশি খাওয়ার জন্য নিচের উদ্দীপকটি পড় এবং ৩ ও ৪-সংখ্যক প্রশ্নের উত্তর দাও: শীতের ছুটিতে জেরিন সিলেটের জাফলং বেড়াতে যায়। সেখানের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, পাহাড়ি ঝরনা, নদী সবকিছু তাকে গভীরভাবে আকর্ষণ করে। সার্বিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে সে বাবাকে বলে, ‘এখানে আমাদের একটা বাড়ি বানিয়ে দেবে?’ ৩। উদ্দীপকের জেরিনের সঙ্গে গল্পের লেখকের চাওয়া একসূত্রে বাঁধা নয়, কারণ লেখক পানশির যেতে চেয়েছিলেন- ক. অবকাশ যাপনের জন্য খ. বিনোদনের জন্য গ. জীবন বাঁচাতে ঘ. সৌন্দর্য উপভোগের জন্য ৪। উদ্দীপকের জাফলং-এর সঙ্গে ‘প্রবাস বন্ধু’ গল্পের পানশিরের বিপরীত চিত্র খুঁজে পাওয়া যায়- i. প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ii. ঋতু বৈচিত্র্যে iii. জীবন যাত্রায় নিচের কোনটি সঠিক? ক. i ও ii গ. ii ও iii খ. i ও iii ঘ. i. ii ও iii |
জ্ঞানমূলক প্রশ্ন : |
---|
অনুধাবনমূলক প্রশ্ন : |
---|
সৃজনশীল প্রশ্ন- ১ |
---|
এমন স্নিগ্ধ নদী কাহার, কোথায় এমন ধূম্র-পাহাড় কোথায় এমন হরিৎক্ষেত্র আকাশতলে মেশে। এমন ধানের ওপর ঢেউ খেলে যায় বাতাস কাহার দেশে। এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি সকল দেশের রানি সে-যে আমার জন্মভূমি। (ক) অধ্যক্ষ জিরার কোন দেশের অধিবাসী ছিলেন? (খ) ‘প্রবাস বন্ধু’ ভ্রমণকাহিনিতে আবদুর রহমানকে ‘নরদানব’ বলা হয়েছে কেন? (গ) উদ্দীপকে ‘প্রবাস বন্ধু’ ভ্রমণকাহিনির আবদুর রহমানের চেতনার যে দিকটিকে ধারণ করে তা ব্যাখ্যা করো। (ঘ) বিষয় বর্ণনায় সাদৃশ্য থাকলেও উদ্দীপক ও ‘প্রবাস বন্ধু’ ভ্রমণকাহিনির মধ্যে রয়েছে বিস্তর বৈপরীত্য’ তোমার উত্তরের সপক্ষে যুক্তি দাও। |
(ক) অধ্যক্ষ জিরার ফ্রান্সের অধিবাসী ছিলেন। (খ) ‘প্রবাস বন্ধু’ ভ্রমণকাহিনিতে আবদুর রহমানকে ‘নরদানব’ বলা হয়েছে তার শারীরিক গঠনের জন্য। আবদুর রহমানের উচ্চতা ছয় ফুট চার ইঞ্চি। দুই হাত হাঁটু পর্যন্ত নেমে এসেছে। তার পায়ে সাইজ ডিঙি নৌকার মতো। কাঁধ এত চওড়া যে লেখকের মনে হয় সে বাদশা আবদুর রহমান হলে গোটা আফগানিস্তানের ভার বইতে পারত। এ কান ও কান জোড়া মুখ। এবড়ো-থেবড়ো নাক-কপাল নেই। তার এমন শারীরিক গঠনের জন্য লেখকের মনে হয় সে মানুষ নয়, কোনো বিশালদেহী ভয়ংকর জন্তু। এ কারণেই তাকে ‘নরদানব’ বলা হয়। (গ) উদ্দীপকটি ‘প্রবাস বন্ধু’ ভ্রমণকাহিনির আবদুর রহমানের স্বদেশ চেতনার দিক ধারণ করে। স্বদেশের প্রতি ভালোবাসা প্রত্যেকের মধ্যেই বিরাজ করে। প্রত্যেক মানুষের কাছেই তার স্বদেশ সব থেকে সেরা। যে দেশে তার জন্ম, বেড়ে ওঠা সে জায়গাকে তার কাছে পৃথিবীর সেরা মনে হয়। জন্মভূমির প্রতি এ ভালোবাসা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। উদ্দীপকের কবি তাঁর স্বদেশের বর্ণনা দিয়েছেন। নদী, পাহাড়, ধানের উপর ঢেউ খেলানো বাতাস প্রভৃতি বর্ণনা করে তাঁর দেশটিকেই শ্রেষ্ঠ বলে বর্ণনা দিয়েছে। লেখক শীতকালটা তার দেশে কাটাবে শুনে আবদুর রহমান খুশি হয়েছে। তাই বলা যায়, উদ্দীপকে ‘প্রবাস বন্ধু’ ভ্রমণকাহিনির স্বদেশচেতনার দিকটি প্রকাশ পেয়েছে। (ঘ) উদ্দীপক এবং ‘প্রবাস বন্ধু’ ভ্রমণকাহিনির মধ্যে প্রেক্ষাপটগত বৈপরীত্য দেখা যায়। প্রকৃতি মানুষের সবচেয়ে ভালো বন্ধু। মানুষ প্রকৃতির মাঝে খুঁজে নেয় নিজেকে। প্রকৃতির সঙ্গে মিশে থাকে মানুষের সত্তা। তাই প্রকৃতির পরিচয় থেকেও নির্দিষ্ট কোনো জাতির পরিচয় পাওয়াটা অস্বাভাবিক ককিছু নয়। উদ্দীপকে বাংলাদেশের স্নিগ্ধ প্রকৃতির সন্ধান মেলে। প্রকৃতি তার বৈচিত্র্যে কীভাবে স্বতন্ত্র তার প্রকাশ ঘটেছে এখানে। প্রকৃতির অপার মহিমা ও সৌন্দর্য ফুটে উঠেছে উদ্দীপকের চরণগুলোতে। অপরদিকে ‘প্রবাস বন্ধু’ ভ্রমণকাহিনিতে শুধু প্রকৃতির সৌন্দর্যের পরিচয়ই আমরা পাই না, বরং আফগানিস্তানের সংস্কার, তাদের পোশাক, জীবনপ্রণালি সবকিছুর পরিচয় পাই। লেখক যেন পুরো আফগানিস্তানের দৃশ্য তাঁর বর্ণনার মধ্যে চিত্রায়িত করেছেন। উদ্দীপকে শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বর্ণনা পাওয়া গেলেও আলোচ্য রচনায় আমরা নির্দিষ্ট দেশ ও জাতি সম্পর্কে আরও অনেক তথ্য পাই। এই তথ্যগুলো আমাদেরকে কাহিনিটি পাঠ করে ভালোভাবে বুঝতে সহযোগিতা করে। তাই আমরা বলতে পারি, বিষয় বর্ণনার সাদৃশ্য দেখা গেলেও প্রেক্ষাপটের দিক থেকে উদ্দীপক এবং ‘প্রবাস বন্ধু’ ভ্রমণকাহিনির মধ্যে রয়েছে বিস্তর বৈপরীত। |
সৃজনশীল প্রশ্ন- ২ |
---|
মতি মিয়ার পুরো শরীর ঘামে চকচক করছে। তবুও সে সামনের হাঁড়ি থেকে গরুর গোশত
খেয়েই চলেছে। তাকে কেউ থামতে বলছে না। একটি পুরো গরুর গোশত তাকে খেতে হবে।
নামকরা খাদক সে। বিয়েবাড়িতে বরপক্ষ তাকে নিয়ে যায় কন্যাপক্ষকে অপদস্থ করতে।
সে খেতে খেতে ক্লান্ত। তার বামপাশে একটু দূরে তার ক্ষুধার্ত তিনটি সন্তান
একটু খাবারের আশায় লালায়িত। কিন্তু মতি মিয়া এক টুকরো মাংসও দিতে পারবে না।
কারণ এতে খেলার নিয়ম ভঙ্গ হবে। (ক) পানশির আফগানিস্তানের কোন দিকে অবস্থিত? (খ) “তোমার বপুটার সঙ্গে আমার তনুটা মিলিয়ে দেখো দিকিনি” বলতে লেখক কী বুঝিয়েছেন? (গ) ‘প্রবাস বন্ধু’ ভ্রমণকাহিনির আবদুর রহমান এবং উদ্দীপকের শিশুদের আচরণে কী বৈসাদৃশ্য দেখা যায়? বুঝিয়ে লেখো? (ঘ) “উভয়েরই চিন্তা খাবারসংক্রান্ত, তবুও তাদের ভাবনায় আকাশ-পাতাল পার্থক্য।” মন্তব্যটি বিশ্লেষণ করো। |
(ক) পানশির আফগানিস্তানের উত্তর দিকে অবস্থিত। (খ) “তোমার বপুটার সঙ্গে আমার তনুটা মিলিয়ে দেখো দিকিনি” বলতে লেখক আবদুর রহমানের বিশাল শরীর ও সেই অনুযায়ী খাবারের চাহিদার সঙ্গে নিজের তুলনা করেছেন। আবদুর রহমান প্রথমবার লেখকের জন্য প্রচুর রান্না করে। লেখক তার পরিমাণ দেখে অবাক হলেও উচ্চবাচ্য করেননি। বাঙালিদের তুলনায় তিনি সেদিন একটু বেশিই খেয়েছিলেন। তবুও আবদুর রহমানের দুঃখ রয়ে গিয়েছিল। তারই কথার পরিপ্রেক্ষিতে লেখক বলেন, আবদুর রহমান বিশাল শরীরের অধিকারী। তার খাবারের চাহিদাও তেমনই হবে। কিন্তু সাধারণ বাঙালি লেখক সেই তুলনায় অতি ক্ষুদ্র। তাই আবদুর রহমানের অভিযোগের বিপরীতে লেখক উভয়ের মধ্যে তুলনা করে নিজের অবস্থান স্পষ্ট করেন। (গ) ‘প্রবাস বন্ধু’ ভ্রমণকাহিনির আবদুর রহমান চেয়েছিল তার মালিক যেন আরও বেশি খাবার খান যা উদ্দীপকের শিশুদের ভাবনার সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ নয়। মানুষ বেঁচে থাকার প্রয়োজনে খায়। এর মাঝেও কেউ কেউ অতিরিক্ত খায়, নষ্ট করে। আবার অভাবের তাড়নায় অনেকে ন্যূনতম খাবারটুকুও পায় না। ‘প্রবাস বন্ধু’ ভ্রমণকাহিনির আবদুর রহমান চেয়েছিল লেখক যেন বেশি করে খান। এতে তার রান্নার উৎকৃষ্টতা প্রমাণিত হবে। লেখক যখন খাচ্ছিলেন তখন সামনে দাঁড়িয়ে আবদুর রহমান লক্ষ রাখছিল। কারণ সে জানত লেখক তার জীবিকাদাতা। তাই লেখককে নিজের সুস্বাদু রান্না খাইয়ে সে নিজের অবস্থান পোক্ত করতে চায়। অপরদিকে উদ্দীপকে অতিরিক্ত খাওয়ায় ক্লান্ত মতি মিয়ার সন্তান তিনটি আশা করেছে তাদের বাবা আর গোশত খাবে না, বরং তাদের দিকে এগিয়ে দেবে। সেই খাবার খেয়ে তারা ক্ষুধা নিবৃত্ত করতে চেয়েছিল। তাই তারা মনে মনে আশা করছিল, তাদের বাবা যেন আর খেতে না পারে। তাই বলা যায়, আবদুর রহমানের চাওয়া ও উদ্দীপকের শিশুদের ভাবনা সাদৃশ্যপূর্ণ নয়। (ঘ) “উভয়েরই চিন্তা খাবারসংক্রান্ত, তবুও তাদের ভাবনায় আকাশ-পাতাল পার্থক্য খাবার।” মন্তব্যটি যথাযথ। মানুষ বেঁচে থাকার জন্য খাবার খায়। অনেকে প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত খাবার খায়। অনেকে আবার বেশি পরিমাণে খেতে পারায় অভ্যস্ত, যা মানুষের শারীরিক অবস্থার জন্য ক্ষতিকারক। ‘প্রবাস বন্ধু’ ভ্রমণকাহিনির আবদুর রহমানকে তুষ্ট করতে পারেননি। সামনে দাঁড়িয়ে আবদুর রহমান আশা করছিল লেখক আরও বেশি খাবেন। অপরদিকে উদ্দীপকের মতি মিয়ার সন্তানরা ক্ষুধার্ত। দতাদের সামনে বসে বাজি ধরে মতি মিয়া একটি পুরো ডগরুর এগাশত খেয়ে চলেছে। খেতে খেতে সে থেমে গেছে, খাওয়ার গতি কমেছে। সামনে বসা তার সন্তানরা ভাবছে, বাবা হয়তো ডএখনই বাজিতে হেরে যাবে, আর খেতে পারবে না। ফলে ঐ খাবারটুকু খেয়ে তারা ক্ষুধা নিবৃত্ত করবে। খাবার সামনে রেখে আবদুর রহমান আশা করছিল লেখক বেশি করে খাবেন আর এতে সে তৃপ্ত হবে। অন্যদিকে মতি মিয়ার সন্তানরা ভাবছিল যদি তাদের বাবা খেতে না পারে তবেই তাদের ক্ষুধা মিটবে। তারাও সামান্য কিছু পেয়ে তৃপ্তি লাভ করবে। পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনায় আলোচ্য মন্তব্যটি ‘প্রবাস বন্ধু’ ভ্রমণকাহিনি ও উদ্দীপকের পরিপ্রেক্ষিতে যথাযথ। |
সৃজনশীল প্রশ্ন- ৩ |
---|
মানুষ যে কেবল নিজেকেই জানিতে চায় তাহাই নহে, বাহিরের জগতের আহ্বান
প্রতিনিয়তই তাহাকে টানিতেছে। এই আহ্বানে প্রলুব্ধ হইয়া অনেক লোক দেশভ্রমণে
বহির্গত হয়। নানাজাতি, নানাদেশ, তাহাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি বিভিন্ন জনের
নিকট বিভিন্ন রূপে ধরা দেয়। বাহিরের এই বস্তুসত্তাকে লেখক মানসরসে
প্রত্যক্ষ করিয়া তথ্যসম্বলিত গ্রন্থ প্রকাশ করেন। এই জাতীয় গন্থে
বস্তুসত্তার প্রাধান্য থাকিলেও উহার মধ্যে ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি থাকিতে
পারে। (ক) ‘বারকোশ’ কী? (খ) “অল্প শোকে কাতর, অধিক শোকে পাথর” মন্তব্যটি লেখক কেন করেছিলেন? (গ) উদ্দীপকের কোন বৈশিষ্ট্যটি ‘প্রবাস বন্ধু’ ভ্রমণকাহিনির সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ? ব্যাখ্যা করো। (ঘ) “উদ্দীপকে ‘প্রবাস বন্ধু’ ভ্রমণকাহিনির সমগ্র ভাব প্রকাশিত হয়নি।” মন্তব্যটি বিশ্লেষণ করো। |
(ক) ‘বারকোশ’ হলো কাঠের তৈরি কানা উঁচু বড় থালা। (খ) প্রয়োজনের অধিক খাবার পরিবেশনের পরও আরও আছে আবদুর রহমানের আশ্বাসের কারণে লেখক মন্তব্যটি করেছিলেন। লেখক খেতে বসে কখাবারের প্রাচুর্য দেখে অবাক হন। প্রচুর মাংস, বিশালাকার কাবাব, বড় থালায় কোফতা পোলাও, আস্ত মুরগির রোস্ট দেখে লেখক থ হয়ে যান। লেখককে চুপ করে থাকতে দেখে আবদুর রহমান বলে, আরও খাবার আছে। লেখকের এটার জন্য যা খাবার সামনে ছিল, তা-ই অনেক বেশি। কিন্তু আবদুর রহমানের আশ্বাসে লেখক সম্পূর্ণ খাবারের পরিমাণ চিন্তা করে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন। তার নিজের অবস্থা বোঝাতে ব্যঞ্জনার্থে লেখক মন্তব্যটি করেছিলেন। (গ) উদ্দীপকে বর্ণিত ভ্রমণের আংশিক অর্থাৎ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মাধ্যমে আনন্দ আহরণের দিকটি ‘প্রবাস বন্ধু’ ভ্রমণকাহিনিতে ফুটে উঠেছে। কৌতূহলী মানুষ বিভিন্ন কারণে ভ্রমণ করে। ভ্রমণে নানা দেশ, জাতি, সংস্কার, মনোরম দৃশ্য অবলোকন করে মানুষ আনন্দ পায়। এই আনন্দ মানুষভেদে ভিন্ন হয়ে থাকে। উদ্দীপকে অদেখাকে দেখা আর অজানাকে জানার কৌতূহলেই মানুষ ঘর ছাড়ে। ভ্রমণের আহ্বানে আকৃষ্ট হয়ে মানুষ ঘুরে বেড়ায়। নানা জাতি, ঐতিহ্য, প্রকৃতি ইত্যাদি দেখে। দেশ-দেশান্তরে ভ্রমণ করেই মানুষ তার সৌন্দর্যপিপাসা নিবৃত্ত করে। ‘প্রবাস বন্ধু’ ভ্রমণকাহিনিতে লেখকও আফগানিস্তানের কিছু সৌন্দর্য অবলোকন করেছেন। আফগানের বরফ-ঢাকা পাহাড়, লব-ই-দরিয়া ইত্যাদি তার অন্তর্ভুক্ত। শুনেছেন আবদুর রহমানের দেশ পানশিরের বর্ণনা। আফগানিস্তানের সৌন্দর্য লেখককে মুগ্ধ করেছিল। তাই বলা যায়, উদ্দীপকে ভ্রমণের মাধ্যমে আনন্দ আহরণের বৈশিষ্ট্যটি ‘প্রবাস বন্ধু’ ভ্রমণকাহিনিতে উপস্থিত। (ঘ) “উদ্দীপকে ‘প্রবাস বন্ধু’ ভ্রমণকাহিনির সমগ্র যভাব প্রকাশিত হয়নি” মন্তব্যটি যথার্থ। অজানাকে জানা, অদেখাকে দেখার জন্য মানুষ ঘর ছেড়ে ভ্রমণের উদ্দেশ্যে রওয়না হয়। অনেককে আবার জীবিকার তাগিদে ঘুরে বেড়াতে হয়, যার মাঝে ভ্রমণ সংযুক্ত। উদ্দীপকে দেশ ভ্রমণের বৈশিষ্ট্য সংক্ষেপে বর্ণিত হয়েছে। বাইরের জগতের আহ্বান প্রতিনিয়ত মানুষকে আকর্ষণ করে। মানুষের পথিক স্বভাব। চলাতেই তার আনন্দ। প্রকৃতির সৌন্দর্যেই সে পিপাসা নিবৃত্ত করে। ‘প্রবাস বন্ধু’ ভ্রমণকাহিনিতেও লেখকের সামান্য ভ্রমণ এবং আফগানিস্তানের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বর্ণনা রয়েছে। বরফ-ঢাকা পাহাড়, নদী অথবা পানশিরের বর্ণনায় সে সৌন্দর্য প্রকাশিত। উদ্দীপকে ভ্রমণবিষয়ক যে বৈশিষ্ট্যটি ফুটে উঠেছে, তার বাইরেও ‘প্রবাস বন্ধু’ ভ্রমণকাহিনিতে আরও কিছু বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। আফগানিস্তানের মানুষের আকার-আকৃতি, খাদ্যাভ্যাস, লেখকের চাকরি, আফগানবাসীর আতিথেয়তা, সংস্কার ইত্যাদি রচনায় আলোচিত হয়েছে, যা উদ্দীপকে অনুপস্থিত। উদ্দীপকে শুধু ভ্রমণ সম্পর্কে কিছু ধারণা বর্ণিত হয়েছে, যাতে ‘প্রবাস বন্ধু’ ভ্রমণকাহিনির সমগ্র ভাব প্রকাশ পায় না। এ কারণেই প্রশ্নোক্ত মন্তব্যটি যথার্থ। |
সৃজনশীল প্রশ্ন- ৪ |
---|
কাশ্মীরের ডাল লেক পুরোটাই পাহাড়ঘেরা। যেসব পাহাড়ে কেবলই ফুলের গাছ। এমনকি
গাছের পাতা পর্যন্ত রঙিন। বসন্তে যখন গাছে গাছে ফুল ফোটে, তখন সত্যি সত্যিই
জায়গাটাকে অপার্থিব মনে হতে থাকে। মোগল বাদশারা তা দেখেই কাশ্মীরের নাম
দিয়েছিলেন ভূস্বর্গ; বানিয়েছিলেন গোটা সাম্রাজ্যের গ্রীষ্মকালীন রাজধানী।
শ্রীনগর পর্যটকদের জন্য বিচরণ কেন্দ্র। এর বাইরে দেখার মতো আরও অনেক কিছু
আছে। যেমন মোগলদের বানানো ফুলের বাগান, পরিমহল। এখান থেকে পুরো শ্রীনগর
দেখা যায়। (ক) কাবুলে লেখকের নতুন বাসস্থান কোন গ্রামে? (খ) ‘জিরার সাহেব কাজের লোক’ বলতে কী বোঝানো হয়েছে? (গ) ‘প্রবাস বন্ধু’ ভ্রমণকাহিনির কোন দিকটি উদ্দীপকে উদ্ভাসিত? ব্যাখ্যা করো। (ঘ) “উক্ত বিষয়টি মানুষকে হাতছানি দিয়ে ডাকে” মন্তব্যটি ‘প্রবাস বন্ধু’ ভ্রমণকাহিনির আলোকে মূল্যায়ন করো। |
(ক) কাবুলে লেখকের নতুন বাসস্থান খাজামোল্লা গ্রামে। (খ) ‘জিরার সাহেবকে কাজের লোক’ বলতে মূলত অকর্মণ্যই বোঝানো হয়েছে। অধ্যক্ষ জিরার জাতিতে ফরাসি। ফরাসিরা জাতি হিসেবে শৌখিন। এরা রান্নাবান্না, গল্প করে দিন কাটাতে পছন্দ করে। জিরার সাহেবও তার ব্যতিক্রম নন। তিনি সারাদিন আফগানিস্তানের বিভিন্ন মন্ত্রীর দপ্তরে ঘুরে বেড়িয়ে, ঝগড়া করে তথা আড্ডা দিয়ে বেড়ান। কাবুল শহরে একেই কাজ বলে। তাই অধ্যক্ষ জিরারের এই বিশেষ ধরনের কাজের জন্য তাকে কাজের লোক বলে আখ্যায়িত করেছেন লেখক। (গ) ‘প্রবাস বন্ধু’ ভ্রমণকাহিনির প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বর্ণনার দিকটি উদ্দীপকে উদ্ভাসিত হয়েছে। প্রকৃতি-স্রষ্টার এক অপূর্ব সৃষ্টি। প্রকৃতি তার আপন রূপ-রস-গন্ধ নিয়ে অনন্তযৌবনা, চিরন্তন, চির নতুন। এই সৌন্দর্যই প্রকৃতিকে অন্যান্য সৃষ্টির চেয়ে আলাদা স্থান দিয়েছে। ‘প্রবাস বন্ধু’ ভ্রমণকাহিনি সাহিত্যের অন্তর্গত। এ রচনায় লেখক আফগানিস্তানের প্রকৃতির রূপ ফুটিয়ে তুলেছেন। তাঁর সৃষ্ট চিত্রকল্পে আমরা চোখের সামনে বরফাবৃত পাহাড়ি একটি দেশ দেখতে পাই। এই সৌন্দর্য লেখককে মুগ্ধ করেছে। আবদুর রহমানের দেওয়া পানশিরের বর্ণনা এতে আরও নতুন মাত্রা যোগ করেছে। উদ্দীপকে ভূস্বর্গ নামে পরিচিত কাশ্মীরের চমৎকার বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। এখানকার নৈসর্গিক সৌন্দর্য মানুষকে হাতছানি দিয়ে ডাকে। তাই কাশ্মীর পরিণত হয়েছে পর্যটকদের বিচরণক্ষেত্রে। মূলত ‘প্রবাস বন্ধু’ ভ্রমণকাহিনির প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দিকটি উদ্দীপকে প্রকাশ পেয়েছে। (ঘ) “উক্ত বিষয়টি মানুষকে হাতছানি দিকে ডাকে” মন্তব্যটি ‘প্রবাস বন্ধু’ ভ্রমণকাহিনির ক্ষেত্রে তাৎপর্যমণ্ডিত। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক নিবিড়। মানুষ আদিমকাল থেকে প্রকৃতিতেই নিজের মনের শান্তি খুঁজে ফিরেছে। প্রকৃতি নানা উপাদান দিয়ে মানুষকে মমতার আলিঙ্গনে বেঁধে নিয়েছে। ‘প্রবাস বন্ধুয’ ভ্রমণকাহিনিতে আমরা দেখতে পাই লেখককে প্রকৃতিবোধে তৃপ্ত হতে। বাঙালি লেখকের দৃষ্টিতে পাহাড়ি বরফের দেশ আফগানিস্তানের সৌন্দর্য অন্য ধরনের। সেই সঙ্গে আবদুর রহমান বর্ণিত পানশিরের সৌন্দর্যের বর্ণনা অনন্য মাত্রা সৃষ্টি করেছে। এ এসৗন্দর্যের হাতছানিতে মানুষ দিনের পর দিন মুগ্ধ হয়ে থাকতে পারে। উদ্দীপকে দেখা যায়, পৃথিবীর ভূস্বর্গখ্যাত কাশ্মীরের চিত্র। সেখানে মানুষ আসে অতৃপ্ত মনকে তৃপ্ত করতে। প্রকৃতির যে সৌন্দর্য কাশ্মীরে দেখা যায়, তা মানুষকে বারবার ডাকে। এ ডাকেই মানুষ ফিরে ফিরে যায়। প্রকৃতির সৌন্দর্য মানুষকে হাতছানি দিয়ে ডাকে। যে ডাক ‘প্রবাস বন্ধু’ ভ্রমণকাহিনিতে লেখক আবদুর রহমান অথবা উদ্দীপকের পর্যটক মোগল বাদশাকে আকর্ষণ করেছে। তাই “উক্ত বৈশিষ্ট্যটি মানুষকে হাতছানি দিয়ে ডাকে” মন্তব্যটি ‘প্রবাস বন্ধু’ ভ্রমণকাহিনির আলোকে যথার্থ। |
সৃজনশীল প্রশ্ন- ৫ |
---|
একটি সাধারণ সমীক্ষায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে গড়ে প্রায় ৬০ শতাংশ লোক
গৃহকর্মী বা চাকরের ওপর নির্ভরশীল। এদের বয়সভেদে শিশু হতে বৃদ্ধ পর্যন্ত
রয়েছে। ব্যস্ততম জীবনে নগরবাসীর অন্যতম প্রয়োজন গৃহকর্মী। এদের মাঝে
স্বল্পসংখ্যক স্থায়ীভাবে কাজ করে। এরা মূলত গৃহকর্তার বাসায় প্রায় সকল কাজই
করে থাকে। আবার বেশিরভাগই অস্থায়ী ভিত্তিতেও কাজ করে। তবে কিশোর হতে যুবা
বয়সীরা অনেকেই চাকরিদাতার কাছে মানসিক এবং শারীরিকভাবে নিপীড়িত হয়, যার হার
প্রায় ৫২ শতাংশ। এই হারে উদ্বিগ্ন মানবাধিকার সংস্থাগুলো। মানবাধিকার
রক্ষায় এদের আরও বেশি সামাজিক নিশ্চয়তা প্রদান করা উচিত বলে বোদ্ধাগণ মনে
করেন। (ক) অধ্যক্ষ জিরার কোন জাতিভুক্ত? (খ) লেখকের মতে আবদুর রহমানের চেহারা কেন আফগান রিলিফ ম্যাপসদৃশ? (গ) ‘প্রবাস বন্ধু’ ভ্রমণকাহিনির আবদুর রহমান ও উদ্দীপকের গৃহকর্মীর মাঝে কী সাদৃশ্য বিদ্যমান? ব্যাখ্যা করো। (ঘ) “চাকরিদাতা হিসেবে ‘প্রবাস বন্ধু’ ভ্রমণকাহিনির লেখক ও উদ্দীপকের নিয়োগদাতা ভিন্ন মানসিকতাসম্পন্ন” মন্তব্যটি বিশ্লেষণ করো। |
(ক) অধ্যক্ষ জিরার জাতে ফরাসি। (খ) লেখকের মতে, আফগানিস্তানের অতি শীতল আবহাওয়াই আবদুর রহমানের রিলিফ ম্যাপসদৃশ চেহারার জন্য দায়ী। আবদুর রহমানের মুখের চামড়া চিরে ফেড়ে গেছে শীতে-গ্রীষ্মে। রিলিফ দেওয়ার ম্যাপে বিভিন্ন চিহ্নিত স্থান যেমন উঁচু-নিচু দেখায়, আবহাওয়ার কারণে আবদুর রহমানের চেহারাও তেমন অবস্থা ধারণ করেছে। আবদুর রহমান সাধারণ এক আফগান। তার দৃষ্টিতে এই চেহারাই সঠিক। কিন্তু বাঙালি লেখকের অভ্যস্ত দৃষ্টিসীমার বাইরে তার চেহারার বর্ণনা কিছুটা কৌতুকের সঙ্গে বর্ণিত হয়েছে। (গ) জীবিকার তাগিদে নিয়োগকর্তার সমূহ কাজ সম্পন্ন করে দেওয়ার দিক থেকে ‘প্রবাস বন্ধু’ ভ্রমণকাহিনির আবদুর রহমান ও উদ্দীপকের গৃহকর্মীর মধ্যে সাদৃশ্য বিদ্যমান। মানুষ বেঁচে থাকার প্রয়োজনে বিভিন্ন জীবিকা অবলম্বন করে। আদিম সময় থেকেই মানুষ তার চেয়ে সম্পন্ন ব্যক্তির কাজ করে দিয়ে নিজ নিজ জীবিকার সংস্থান করে। এই দিক থেকে প্রায় প্রত্যেক মানুষই কর্মী। ‘প্রবাস বন্ধু’ ভ্রমণকাহিনিতে আবদুর রহমান লেখকের জন্য সকল কাজের কাজি। সে লেখকের জন্য রান্না থেকে আরম্ভ করে হাট-বাজার, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখার সব কাজ করে। লেখকের কাজ করেই সে তার জীবিকা নির্বাহ করে। উদ্দীপকের গৃহকর্মীরাও নিজ নিজ নিয়োগদাতার জন্য কাজ করে থাকে। ব্যস্ত নগরজীবনে মানুষ অনেকাংশেই গৃহকর্মীর ওপর নির্ভরশীল। তারা সবাই নিজের অথবা পরিবারের চাহিদা পূরণ করার জন্য এই জীবিকা বেছে নিয়েছে। এই জীবিকার দিক থেকেই ‘প্রবাস বন্ধু’ ভ্রমণকাহিনিতে আবদুর রহমান ও উদ্দীপকের গৃহকর্মীর মধ্যে সাদৃশ্য দেখা যায়। (ঘ) “চাকরিদাতা হিসেবে ‘প্রবাস বন্ধু’ ভ্রমণকাহিনির লেখক ও উদ্দীপকের নিয়োগদাতা ভিন্ন মানসিকতাসম্পন্ন” মন্তব্যটি যথার্থ। মানুষ জীবিকার জন্য একে অপরের ওপর নির্ভরশীল। মানুষভেদে নিয়োগদাতা ভিন্ন চারিত্রিক স্বভাবের হয়। কেউ কেউ কর্মীর প্রতি সহানুভূতিশীল হলেও বেশিরভাগই কঠোর মানসিকতা পোষণ করে। ‘প্রবাস বন্ধু’ ভ্রমণকাহিনিতে আবদুর রহমান বলেখকের গৃহকর্মী। তার বিভিন্ন ধরনের কাজে লেখক অবাক, হতবাক এবং বিরক্ত হলেও তার প্রতি কঠোর কোনো ব্যবহার করেননি, বরং বেশিরভাগ সময়ে কৌতুকের সঙ্গে মন্তব্য ছুড়ে দিয়েছেন। অপরদিকে উদ্দীপকে দেখা যায়, গৃহকর্মীদের মাঝে শতকরা ৫২ জন তার নিয়োগদাতার হাতে নিপীড়িত হয়। এই নিপীড়ন শারীরিক ও মানসিক উভয় ধরনের হয়, যা মানবাধিকার হরণ করে। ‘প্রবাস বন্ধু’ ভ্রমণকাহিনিতে লেখক আবদুর রহমানের প্রতি সহানুভূতিশীল, যেখানে উদ্দীপকের ৫২ শতাংশ নিয়োগদাতা অত্যাচার করে গৃহকর্মীকে। তাই বলা যায়, চাকরিদাতা হিসেবে ‘প্রবাস বন্ধু’ ভ্রমণকাহিনির লেখক ভিন্ন মানসিকতাসম্পন্ন। সুতরাং মন্তব্যটি যথাযথ। |
সৃজনশীল প্রশ্ন- ৬ |
---|
------------- |
----------- |
তথ্যসূত্র : |
---|
১. সাহিত্য পাঠ: একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক
বোর্ড, বাংলাদেশ, ২০২৫। ২. দেশে বিদেশে, সৈয়দ মুজতবা আলী, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, তৃতীয় সংস্করণ(দশম মুদ্রণ), নভেম্বর ২০২০। ৩. আধুনিক বাংলা অভিধান: বাংলা একাডেমি, এপ্রিল, ২০১৮। ৪. ব্যবহারিক বাংলা অভিধান: বাংলা একাডেমি, ১৮তম, ২০১৫। |