যৌবনের গান : কাজী নজরুল ইসলাম

যৌবনের গান : কাজী নজরুল ইসলাম
যৌবনের গান : কাজী নজরুল ইসলাম

যৌবনের গান
কাজী নজরুল ইসলাম

আমার বলিতে দ্বিধা নাই যে, আমি আজ তাঁহাদেরই দলে, যাঁহারা কর্মী নন-ধ্যানী। যাঁহারা মানব জাতির কল্যাণ সাধন করেন সেবা দিয়া, কর্ম দিয়া, তাঁহারা মহৎ যদি না-ই হন, অন্তত ক্ষুদ্র নন। ইহারা থাকেন শক্তির পেছনে রুধির ধারার মতো গোপন, ফুলের মাঝে মাটির মমতা-রসের মতো অলক্ষ্যে। আমি কবি- বনের পাখির মতো স্বভাব আমার গান করার। কাহারও ভালো লাগিলেও গাই, ভালো না লাগিলেও গাহিয়া যাই। বায়স-ফিঙে যখন বেচারা গানের পাখিকে তাড়া করে, তীক্ষ্ণ চক্ষু দ্বারা আঘাত করে, তখনও সে এক গাছ হইতে উড়িয়া আন গাছে গিয়া গান ধরে। তাহার হাসিতে গান, তাহার কান্নায় গান। সে গান করে আপন মনের আনন্দে- যদি তাহাতে কাহারও অলসতন্দ্রা, মোহনিদ্রা টুটিয়া যায়, তাহা একান্ত দৈব। যৌবনের সীমা পরিক্রমণ আজও আমার শেষ হয় নাই। কাজেই আমি যে গান গাই, তাহা যৌবনের গান। তারুণ্যের ভরা-ভাদরে যদি আমার গান জোয়ার আনিয়া থাকে, তাহা আমার অগোচরে; যে চাঁদ সাগরে জোয়ার জাগায়, সে হয়ত তাহার শক্তি সম্বন্ধে আজও না-ওয়াকিফ। আমি বক্তাও নহি। আমি কমবক্তার দলে। বক্তৃতায় যাঁহারা দিগ্বিজয়ী, বক্তিয়ার খিলজি, তাঁহাদের বাক্যের সৈন্য-সামন্ত অত দ্রুতবেগে কোথা হইতে কেমন করিয়া আসে বলিতে পারি না। তাহা দেখিয়া লক্ষণ সেন অপেক্ষাও আমরা বেশি অভিভূত হইয়া পড়ি। তাঁহাদের বাণী আসে বৃষ্টিধারার মতো অবিরল ধারায়। আমাদের কবিদের বাণী বহে ক্ষীণ ভীরু ঝরনাধারার মতো। ছন্দের দুকূল প্রাণপণে আঁকড়িয়া ধরিয়া সে-সংগীত গুঞ্জন করিতে করিতে বহিয়া যায়। পদ্মা ভাগীরথীর মতো খরস্রোতা যাঁহাদের বাণী, আমি তাঁহাদের বহু পশ্চাতে।

আমার একমাত্র সম্বল- আপনাদের তরুণদের প্রতি আমার অপরিসীম ভালোবাসা, প্রাণের টান। তারুণ্যকে, যৌবনকে, আমি যেদিন হইতে গান গাহিতে শিখিয়াছি সেদিন হইতে বারে বারে সালাম করিয়াছি, সশ্রদ্ধ নমস্কার নিবেদন করিয়াছি, জবাকুসুমসঙ্কাশ তরুণ অরুণকে দেখিয়া প্রথম মানব যেমন করিয়া সশ্রদ্ধ নমস্কার করিয়াছিলেন, আমার প্রথম জাগরণ-প্রভাতে তেমন সশ্রদ্ধ বিস্ময় লইয়া যৌবনকে অন্তরের শ্রদ্ধা নিবেদন করিয়াছি, তাহার স্তবগান গাহিয়াছি। তরুণ অরুণের মতোই যে তারুণ্য তিমির-বিদারী, সে যে আলোর দেবতা। রঙের খেলা খেলিতে তাহার উদয়, রং ছড়াইতে ছড়াইতে তাহার অন্ত। যৌবন-সূর্য যথায় অস্তমিত, দুঃখের তিমির-কুন্তলা নিশীথিনীর সেই তো লীলাভূমি।

আমি যৌবনের পূজারী কবি বলিয়াই যদি আমায় আপনারা আপনাদের মালার মধ্যমণি করিয়া থাকেন, তাহা হইলে আমার অভিযোগ করিবার কিছুই নাই। আপনাদের মহাদান আমি সানন্দে শির নত করিয়া গ্রহণ করিলাম। আপনাদের দলপতি হইয়া নয়, আপনাদের দলভুক্ত হইয়া, সহযাত্রী হইয়া। আমাদের দলে কেহ দলপতি নাই, আজ আমরা শত দিক হইতে শত শত তরুণ মিলিয়া তারুণ্যের শতদল ফুটাইয়া তুলিয়াছি। আমরা সকলে মিলিয়া এক সিদ্ধি, এক ধ্যানের মৃণাল ধরিয়া বিকশিত হইতে চাই।

বার্ধক্য তাহাই- যাহা পুরাতনকে, মিথ্যাকে, মৃত্যুকে আঁকড়িয়া পড়িয়া থাকে; বৃদ্ধ তাহারাই যাহারা মায়াচ্ছন্ন নব মানবের অভিনব জয় যাত্রার শুধু বোঝা নয়, বিঘ্ন; শতাব্দীর নব যাত্রীর চলার ছন্দ ছন্দ মিলাইয়া যাহারা কুচকাওয়াজ করিতে জানে না, পারে না; যাহারা জীব হইয়াও জড়; যাহারা অটল সংস্কারের পাষাণস্তূপ আঁকড়িয়া পড়িয়া আছে। বৃদ্ধ তাহারাই যাহারা নব অরুণোদয় দেখিয়া নিদ্রাভঙ্গের ভয়ে দ্বার রুদ্ধ করিয়া পড়িয়া থাকে। আলোক-পিয়াসী প্রাণচঞ্চল শিশুদের কল-কোলাহলে যাহারা বিরক্ত হইয়া অভিসম্পাত করিতে থকে, জীর্ণ পুঁথি চাপা পড়িয়া যাহাদের নাভিশ্বাস বহিতেছে, অতি জ্ঞানের অগ্নিমান্দ্যে যাহারা আজ কঙ্কালসার- বৃদ্ধ তাহারাই। ইহাদের ধর্মই বার্ধক্য। বার্ধক্যকে সব সময় বয়সের ফ্রেমে বাঁধা যায় না। বহু যুবককে দেখিয়াছি যাহাদের যৌবনের উর্দির নিচে বার্ধক্যের কঙ্কাল মূর্তি। আবার বহু বৃদ্ধকে দেখিয়াছি- যাঁহাদের বার্ধক্যের জীর্ণাবরণের তলে মেঘলুপ্ত সূর্যের মতো প্রদীপ্ত যৌবন। তরুণ নামের জয়-মুকুট শুধু তাহারই- যাহার শক্তি অপরিমাণ, গতিবেগ ঝঞ্ঝার ন্যায়, তেজ নির্মেঘ আষাঢ় মধ্যাহ্নের মার্তণ্ডপ্রায়, বিপুল যাহার আশা, ক্লান্তিহীন যাহার উৎসাহ, বিরাট যাহার ঔদার্য, অফুরন্ত যাহার প্রাণ, অটল যাহার সাধনা, মৃত্যু যাহার মুঠিতলে। তারুণ্য দেখিয়াছি আরবের বেদুইনদের মাঝে, তারুণ্য দেখিয়াছি মহাসমরের সৈনিকের মুখে, কালাপাহাড়ের অসিতে, কামাল-করিম-মুসোলিনি- সানইয়াৎ-লেনিনের শক্তিতে। যৌবন দেখিয়াছি তাহাদের মাঝে- যাহারা বৈমানিকরূপে অনন্ত আকাশের সীমা খুঁজিতে গিয়া প্রাণ হারায়, আবিষ্কারকরূপে নব-পৃথিবীর সন্ধানে গিয়া আর ফিরে না, গৌরীশৃঙ্গ কাঞ্চনজঙ্ঘার শীর্ষদেশ অধিকার করিতে গিয়া যাহারা তুষার-ঢাকা পড়ে, অতল সমুদ্রের নীল মঞ্জুষার মণি আহরণ করিতে গিয়া সলিলসমাধি লাভ করে, মঙ্গলগ্রহে, চন্দ্রলোকে যাইবার পথ আবিষ্কার করিতে গিয়া নিরুদ্দেশ হইয়া যায়। পবন-গতিকে পশ্চাতে ফেলিয়া যাহারা উড়িয়া যাইতে চায়, নব নব গ্রহ-নক্ষত্রের সন্ধান করিতে করিতে যাহাদের নয়ন-মণি নিভিয়া যায়- যৌবন দেখিয়াছি সেই দুরন্তদের মাঝে। যৌবনের মাতৃরূপ দেখিয়াছি- শব বহন করিয়া যখন সে যায় শ্মশানঘাটে, গোরস্থানে, অনাহারে থাকিয়া যখন সে অন্ন পরিবেশন করে দুর্ভিক্ষ-বন্যা-পীড়িতদের মুখে, বন্ধুহীন রোগীর শয্যাপার্শ্বে যখন সে রাত্রির পর রাত্রি জাগিয়া পরিচর্যা করে, যখন সে পথে পথে গান গাহিয়া ভিখারি সাজিয়া দুর্দশাগ্রস্তদের জন্য ভিক্ষা করে, যখন দুর্বলের পাশে বল হইয়া দাঁড়ায়, হতাশের বুকে আশা জাগায়।

ইহাই যৌবন, এই ধর্ম যাহাদের তাহারাই তরুণ। তাহাদের দেশ নাই, জাতি নাই, অন্য ধর্ম নাই। দেশ-কাল- জাতি-ধর্মের সীমার ঊর্ধ্বে ইহাদের সেনানিবাস। আজ আমরা মুসলিম তরুণেরা যেন অকুণ্ঠিত চিত্তে মুক্তকণ্ঠে বলিতে পারি- ধর্ম আমাদের ইসলাম, কিন্তু প্রাণের ধর্ম আমাদের তারুণ্য, যৌবন। আমরা সকল দেশের, সকল জাতির, সকল ধর্মের, সকল কালের। আমরা মুরিদ যৌবনের। এই জাতি-ধর্ম-কালকে অতিক্রম করিতে পারিয়াছে যাঁহাদের যৌবন, তাঁহারাই আজ মহামানব, মহাত্মা, মহাবীর। তাহাদিগকে সকল দেশের সকল ধর্মের সকল লোক সমান শ্রদ্ধা করে।

পথ-পার্শ্বের ধর্ম-অট্টালিকা আজ পড় পড় হইয়াছে, তাহাকে ভাঙিয়া ফেলিয়া দেওয়াই আমাদের ধর্ম, ঐ জীর্ণ অট্টালিকা চাপা পড়িয়া বহু মানবের মৃত্যুর কারণ হইতে পারে। যে-ঘর আমাদের আশ্রয় দান করিয়াছে, তাহা যদি সংস্কারাতীত হইয়া আমাদেরই মাথায় পড়িবার উপক্রম করে, তাহাকে ভাঙিয়া নূতন করিয়া গড়িবার দুঃসাহস আছে একা তরুণেরই। খোদার দেওয়া এই পৃথিবীর নিয়ামত হইতে যে নিজেকে বঞ্চিত রাখিল, সে যত মোনাজাতই করুক, খোদা তাহা কবুল করিবেন না। খোদা হাত দিয়াছেন বেহেশত ও বেহেশতি চিজ অর্জন করিয়া লইবার জন্য, ভিখারির মতো হাত তুলিয়া ভিক্ষা করিবার জন্য নয়। আমাদের পৃথিবী আমরা আমাদের মনের মতো করিয়া গড়িয়া লইব। ইহাই হউক তরুণের সাধনা।

উৎস নির্দেশ :
১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দে সিরাজগঞ্জে মুসলিম যুব সমাজের অভিনন্দনের উত্তরে তাদের উদ্দেশ্যে কাজী নজরুল ইসলাম যে প্রাণোচ্ছল ভাষণ দিয়েছিলেন ‘যৌবনের গান’ রচনাটি তারই পরিমার্জিত লিখিত রূপ।

শব্দার্থ ও টীকা :
➠ দ্বিধা- সংকোচ, সংশয়, কুণ্ঠা।
➠ রুধির ধারা- রক্তপ্রবাহ।
➠ অলক্ষ্যে- দৃষ্টির অগোচরে।
➠ বায়স- কাক।
➠ বেচারা গানের পাখিকে- কোকিলকে।
➠ চঞ্চু- ঠোঁট।
➠ অলসতন্দ্রা- আলস্য থেকে সৃষ্ট ঘুমের ভাব।
➠ মোহনিন্দ্রা- আসক্তি বা মোহরূপ নিদ্রা, অচেতনতা, জড়তা।
➠ দৈব- আকস্মিক।
➠ পরিক্রমণ- পরিভ্রমণ, প্রদক্ষিণ।
➠ ভরা-ভাদরে- পরিপূর্ণ ভাদ্রে। পরিপূর্ণ অবস্থায়। ভাদ্র মাসে নদীনালা বর্ষার জলে যেমন কানায় কানায় ভরে ওঠে তেমনি।
➠ অগোচরে- অলক্ষে, দৃষ্টির বাইরে।
➠ না-ওয়াকিফ- অনভিজ্ঞ, অজ্ঞাত।
➠ কমবক্তা- অল্পভাষী, যিনি কম কথা বলেন।
➠ বক্তিয়ার খিলজি- মুহম্মদ বখতিয়ার খিলজি ছিলেন ইতিহাসখ্যাত আফগান সেনানায়ক। তিনি মাত্র সতেরো জন সৈন্য নিয়ে অতর্কিত আক্রমণে নদীয়া দখল করেন। রাজা লক্ষ্মণ সেন ভয়ে পলায়ন করলে বখতিয়ার খিলজি বাংলাদেশে প্রথম মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা করেন (১২০৩/০৪)। এখানে কৌতুকভরে বক্তৃতা প্রদানকারীদেরকে ‘বখতিয়ার খিলজি’ বলা হয়েছে।
➠ লক্ষ্মণ সেন- বাংলার সেন বংশের শেষ রাজা। বখতিয়ার খিলজি মাত্র সতেরো জন অশ্বারোহীসহ রাজপ্রাসাদ আক্রমণ করলে তিনি পেছন দরজা দিয়ে পালিয়ে আত্মরক্ষা করেন। এভাবে বাংলায় সেন বংশের পতন এবং মুসলিম শাসনের সূচনা হয়।
➠ অভিভূত- ভাবাবেগে বিহ্বল, ভাবাবিষ্ট।
➠ ছন্দের দুকুল- ভাব ও ভাষা বোঝাতে ব্যবহৃত।
➠ জবাকুসুমসঙ্কাশ- জবাফুলের মতো।
➠ প্রথম জাগরণ-প্রভাতে- সচেতনতার সূচনালগ্নে।
➠ তিমিরবিদারী- অন্ধকার বিদীর্ণ করে যা, সূর্য।
➠ আলোর দেবতা- সূর্য।
➠ তিমিরকুন্তলা- অন্ধকার যার চুল, রাত্রি।
➠ লীলাভূমি- বিচরণস্থান, ক্রীড়াক্ষেত্র।
➠ জীর্ণ পুঁথি চাপা পড়িয়া- সংস্কার ও প্রথাবদ্ধতার চাপে পিষ্ট হয়ে।
➠ নাভিশ্বাস- মৃত্যুকালীন শ্বাসকষ্ট। মরণাপন্ন অবস্থা।
➠ অগ্নিমান্দ্য- খাদ্যদ্রব্য পাকস্থলীতে হজম না হওয়ার রোগ, অজীর্ণতা, ক্ষুধামন্দা।
➠ উর্দি- কর্মচারীদের জন্য নির্দিষ্ট বিশেষ পোশাক।
➠ জীর্ণাবরণ- জরাজীর্ণ আচ্ছাদন।
➠ মার্তণ্ডপ্রায়- সূর্যের মতো।
➠ কালাপাহাড়- ব্রাহ্মণ থেকে মুসলমানে ধর্মান্তরিত বিখ্যাত মুসলিম যোদ্ধা। সুলেমান ও দায়দ কররানির সেনাপতি, ওরফে রাজু। ইসলাম ধর্ম গ্রহণের পর প্রচণ্ড হিন্দু বিদ্বেষী হন। ১৫৬৮ খ্রিষ্টাব্দে পুরী আক্রমণ করে বহু মন্দির ও দেবদেবীর মূর্তি ধ্বংস করেন। ইতিহাসে তিনি বিকট, ভয়ংকর ও প্রলয়ংকর ধ্বংসের প্রতীক হয়ে আছেন।
➠ কামাল- মুস্তাফা কামাল আতাতুর্ক পাশা (১৮৮১-১৯৩৮)। আধুনিক তুরস্কের জনক ও তুরস্ক প্রজাতন্ত্রের প্রথম রাষ্ট্রপতি। তাঁর পরিচালনা ও নেতৃত্বে তুরস্ক আসন্ন পতনের হাত থেকে রক্ষা পায় এবং সত্যিকার উন্নতির পথে অগ্রসর হয়। ধর্ম, সমাজ, শিক্ষা সবক্ষেত্রেই তিনি আমূল ও বৈপ্লবিক সংস্কার সাধন করেন। আইন-কানুন সংস্কার, আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থার প্রবর্তন, নারীর সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা, পর্দা প্রথার উচ্ছেদ, স্বাধীন অর্থনৈতিক বিকাশ, নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি ইত্যাদির মাধ্যমে তিনি আধুনিক তুরস্কের ভিত্তি স্থাপন করেন। দেশবাসী কৃতজ্ঞতার নিদর্শন হিসেবে তাঁকে ‘আতাতুর্ক’ বা ‘তুরস্কের জনক’ উপাধিতে ভূষিত করেন।
➠ মুসোলিনী- সিনর বেনিতো মুসোলিনি (১৮৮৩-১৯৪৫) ইতালির একনায়ক এবং সেখানকার ফ্যাসিবাদী দলের নেতা ছিলেন। উগ্র জাত্যভিমান থেকে তিনি ইতালিকে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ শক্তিশালী জাতিতে পরিণত করার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করেন। সমগ্র জাতীয় জীবনে কঠোর নিয়ন্ত্রণ এবং আগ্রাসী বৈদেশিক নীতির অনুসারী মুসোলিনী ১৯৩৫ সালে আবিসিনিয়া আক্রমণ করেন। এই ঘটনার সূত্রে ফ্যাসিবাদী হিটলারের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব হয়। ১৯৪০ সালে জার্মানির মিত্র হিসেবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তাঁর নেতৃত্বে ইতালি বৃটেন ও ফ্রান্সের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। যুদ্ধে ইতালির পরাজয় হলে তিনি পদচ্যুত ও বন্দি হন। পরে মুক্তি পেলেও আততায়ীর হাতে নিহত হন।
➠ সানইয়াত- সান-ইয়াত-সেন (১৮৬৭-১৯২৫) চীনের জননন্দিত বিপ্লবী রাজনীতিবিদ ও নব্য চীনের জন্মদাতা। উনিশ শতকের শেষ দিকে এবং বিশ শতকের গোড়ায় চীনের মাঞ্চু সম্রাটদের শাসন-শোষণ নির্যাতনের বিরুদ্ধে বেশ কিছু বিপ্লবী আন্দোলন হয়। সান-ইয়াত-সেন এগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। ১৯১২ সালের বিপ্লবে মাঞ্চু সাম্রাজ্যের পতন হলে তিনি নানকিং প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। দ্বিতীয় বিপ্লব ব্যর্থ হওয়ায় তাঁকে নির্বাসনে যেতে হয়। পরে দেশে প্রত্যাবর্তন করে তিনি বিভক্ত চীনের দক্ষিণ চীন প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি হন। সাম্যবাদ ও বিপ্লবে সুগভীর আস্থা, চীনের জাতীয় কমূসূচি প্রণয়ন, মাঞ্চু রাজতন্ত্রের বিরোধিতা এবং সংস্কার নীতির জন্য চীনের ইতিহাসে তাঁর নাম অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
➠ লেনিন- নেতৃত্বে ১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লবের সাফল্যে জারের রাজতন্ত্রের পতন ঘটে এবং পৃথিবীর প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্ম হয়। আমৃত্যু তিনি ছিলেন সোভিয়েত রাষ্ট্রের ভ্লাদিমির ইলিচ উইলিয়ানোফ (১৮৭০-১৯২৪) বিপ্লবী কাজে জড়িত থাকাকালে ‘লেনিন’ ছদ্মনাম নেন তিনি রুশ বিপ্লবের সংগঠক, পরিকল্পক ও নেতা। তাঁর রাষ্ট্রপ্রধান। ব্যাংক ও সম্পত্তি জাতীয়করণ, দরিদ্র জনগণের মধ্যে ভূমি বণ্টন, গণশিক্ষার প্রসার, সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির মূল ভিত্তি রচনার মাধ্যমে তিনি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের রূপকার হিসেবে বিশ্ববিখ্যাত হয়ে আছেন। তিনি ছিলেন প্রথম সফল মার্কসবাদী বিপ্লবী, মার্কসবাদী দর্শনের প্রথম কাতারের তাত্ত্বিক। তাঁর রচিত গ্রন্থাবলি ইতিহাস, দর্শন, অর্থনীতি ও সমাজতত্ত্ব সম্পর্কে তাঁর প্রগাঢ় জ্ঞান ও বিশ্লেষণ-শক্তির পরিচয়বহ হয়ে আছে।
➠ নীল মঞ্জুষার মণি- সমুদ্রের এক রকম মূল্যবান রত্নপাথর।
➠ যৌবনের মাতৃরূপ- যৌবনের কোমল সেবাপরায়ণ দিক।
➠ মুরিদ- শিষ্য।
➠ সংস্কারাতীত- সংস্কার বা মেরামত করা সম্ভব নয় এমন।
➠ নিয়ামত- ধন-সম্পদ, অনুগ্রহ।

পাঠ-পরিচিতি :
১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দে সিরাজগঞ্জে মুসলিম যুব সমাজের অভিনন্দনের উত্তরে তাদের উদ্দেশ্যে কাজী নজরুল ইসলাম যে প্রাণোচ্ছল ভাষণ দিয়েছিলেন ‘যৌবনের গান’ রচনাটি তারই পরিমার্জিত লিখিত রূপ।
এই অভিভাষণে কবি দুরন্ত-দুর্বার যৌবনের প্রশন্তি উচ্চারণ করেছেন। কারণ যৌবন হচ্ছে অফুরন্ত প্রাণশক্তির আধার। যৌবন মানুষের জীবনকে করে গতিশীল ও প্রত্যাশাময়। দুর্বার উদ্দীপনা, ক্লান্তিহীন উদ্যম, অপরিসীম ঔদার্য, অফুরন্ত প্রাণচঞ্চলতা ও অটল সাধনার প্রতীক যৌবন মৃত্যুকে তুচ্ছ করে সংস্কারের বেড়াজাল ছিন্নভিন্ন করে সকল বাধা পেরিয়ে এগিয়ে যায় সমাজ-প্রগতি ও নতুন স্বপ্নময় মুক্তজীবনের পথে। আর বিপন্ন মানবতার পাশে সে দাঁড়ায় সেবাব্রতী ভূমিকা নিয়ে। পক্ষান্তরে রক্ষণশীলতা, জড়তা, সংস্কারাচ্ছন্নতা ও পশ্চাৎপদতাময় বার্ধক্য বাধা হয়ে দাঁড়ায় জীবনের প্রাণবন্ত অগ্রগতির পথে। তাই স্বভাব-বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে যে যৌবন দেশ-জাতি-কাল ও ধর্মের বাঁধন মানে না সেই যৌবন-শক্তিকে কবি উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন সমন্ত জীর্ণ পুরানো সংস্কারকে ধ্বংস করে মনের মতো নতুন জগৎ রচনার সাধনায় অগ্রসর হতে।

লেখক পরিচিতি :
কাজী নজরুল ইসলাম ১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৫শে মে, ১৩০৬ সনের ১১ই জ্যৈষ্ঠ, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ছেলেবেলায় তিনি লেটো গানের দলে যোগ দেন। পরে বর্ধমান ও ময়মনসিংহের ত্রিশাল থানার দরিরামপুর হাই স্কুলে লেখাপড়া করেন। ১৯১৭ সালে তিনি সেনাবাহিনীর বাঙালি পল্টনে যোগ দিয়ে করাচি যান। সেখানেই তাঁর সাহিত্য জীবনের সূচনা ঘটে। তাঁর লেখায় তিনি সামাজিক অবিচার ও পরাধীনতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন। এজন্য তাঁকে 'বিদ্রোহী কবি' বলা হয়। বাংলা সাহিত্য জগতে তাঁর আবির্ভাব এক নতুন দিগন্তের উন্মোচন করে। মাত্র তেতাল্লিশ বছর বয়সে কবি দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হয়ে বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেন। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর অসুস্থ কবিকে ঢাকায় আনা হয় এবং পরে তাঁকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করা হয়। তাঁকে স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় কবির মর্যাদায় ভূষিত করা হয়। তাঁর রচিত কাব্যগুলোর মধ্যে অগ্নি-বীণা, বিষের বাঁশি, ছায়ানট, প্রলয়-শিখা, চক্রবাক, সিন্ধু-হিন্দোল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ব্যথার দান, রিক্তের বেদন, শিউলিমালা, মৃত্যুক্ষুধা ইত্যাদি তাঁর রচিত গল্প ও উপন্যাস। যুগবাণী, দুর্দিনের যাত্রী, রুদ্র-মঙ্গল ও রাজবন্দীর জবানবন্দী তাঁর উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধগ্রন্থ। ১৯৭৬ সালের ২৯শে আগস্ট কবি ঢাকায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদ প্রাঙ্গণে তাঁকে পরিপূর্ণ সামরিক মর্যাদায় সমাহিত করা হয়।

বহুনির্বাচনি প্রশ্ন :
১. ‘যৌবনের গান’ প্রবন্ধে লেখক কী হয়ে তরুণদের মহাদান গ্রহণ করতে চান?
ক. মধ্যমণি
খ. দলপতি
গ. সহযাত্রী
ঘ. পূজারী
২. ‘আমি কবি- বনের পাখির মতো স্বভাব আমার গান করার’- উক্তিটিতে বোঝানো হয়েছে
ক. যৌবনের উচ্ছলতা
খ. মানবকল্যাণে ব্রতী হওয়া
গ. তারুণ্যের প্রতি অকুণ্ঠ পক্ষপাত
ঘ. গানের পাখির সাথে কবিতার তুলনা
অনুচ্ছেদটি পড় এবং ৩ ও ৪ সংখ্যক প্রশ্নের উত্তর দাও।
পূর্বকালে ইউরোপে আইন দ্বারা কুষ্ঠরোগীদের নির্বাসন দেওয়া হতো। মানবপ্রেমিক দানিয়েল যৌবনের ভোগ- লালসা ত্যাগ করে মালাকো দ্বীপে কুষ্ঠরোগীদের সেবায় ব্রতী হলেন। তিনি ঈশ্বরকে বললেন, প্রভু! আজ আমার প্রেম সকল পূর্ণতায় সফল ও সার্থক হলো।
৩. অনুচ্ছেদে 'যৌবনের গান' প্রবন্ধে বর্ণিত তারুণ্যের কোন বৈশিষ্ট্যের সর্বাধিক প্রতিফলন ঘটেছে?
ক. উদ্যম
খ. ঔদার্য
গ. মাতৃরূপ
ঘ. সাধনা
৪. নিচের কোন বাক্যে অনুচ্ছেদের ভাব সবচেয়ে ভালোভাবে ধরা পড়েছে?
ক. ইহারা থাকে শক্তির পিছনে রুধির ধারার মতো গোপন
খ. রং ছড়াইতে ছড়াইতে তাহাদের অন্ত
গ. যখন দুর্বলের পাশে বল হইয়া দাঁড়ায়
ঘ. তাহার হাসিতে গান, তাহার কান্নায় গান
অনুচ্ছেদটি পড় এবং ৫ ও ৬ সংখ্যক প্রশ্নের উত্তর দাও।
‘বার্ধক্য কিছু কাড়তে পারে না বলে কিছু ছাড়তে পারে না- দুটি কালো চোখের জন্যও নয়, বিশ কোটি কালো লোকের জন্যও নয়।’
৫. এখানে 'যৌবনের গান' প্রবন্ধে বৃদ্ধের যে বৈশিষ্ট্যের পরিচয় পাওয়া যায়, তা হলো-
i পশ্চাৎপদতা
ii রক্ষণশীলতা
iii স্থবিরতা
নিচের কোনটি সঠিক?
ক. i ও ii
খ. ii ও iii
গ. i ও iii
ঘ. i, ii ও iii
৬. অনুচ্ছেদে বর্ণিত বার্ধক্যের বিপরীত ভাষ্য কোনটি?
ক. শক্তির পেছনে রুধির ধারার মতো গোপন
খ. সে রাত্রির পর রাত্রি জাগিয়া পরিচর্যা করে
গ. তরুণ অরুণের মতোই যে তারুণ্য তিমির বিদারী
ঘ. অনন্ত আকাশের সীমা খুঁজিতে গিয়া প্রাণ হারায়

জ্ঞানমূলক প্রশ্ন :

অনুধাবনমূলক প্রশ্ন :

সৃজনশীল প্রশ্ন- ১
অবসরপ্রাপ্ত ফারুক সাহেবের কাঁচাপাকা চুল, মুখে বয়সের ছাপ। দেখলে মনে হয় তার যথেষ্ট বয়স হয়েছে। কিন্তু রাস্তার দুই ধারে গাছ লাগানো, রাস্তার গর্ত ভরাট করা প্রভৃতি জনকল্যাণমূলক কাজে নিরবচ্ছিন্ন পরামর্শ প্রদানে তার কোনো ক্লান্তি নেই। এছাড়া পাড়ার ছেলেমেয়েদের নিয়ে বাল্যবিবাহ রোধ, স্কুলগামী মেয়েদের স্কুলে পাঠানো, অসুস্থ রোগীকে হাসপাতালে পাঠানো- এ সমস্ত মানবিক কাজে তিনি সহযোগিতা করে থাকেন। মাদকবিরোধী সামাজিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন।
ক. গানের পাখিকে তাড়া করে কে?
খ. আমি আজ তাঁহাদেরই দলে, যাহারা কর্মী নন- ধ্যানী, এখানে ‘ধ্যানী’ বলতে কাদের বোঝানো হয়েছে এবং কেন?
গ. উদ্দীপকে ফারুক সাহেবের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ‘যৌবনের গান’ প্রবন্ধের আলোকে ব্যাখ্যা করো।
ঘ. “বার্ধক্যকে সমসময় বয়সের ফ্রেমে বাঁধা যায় না”- উক্তিটি উদ্দীপকের ফারুক সাহেবের প্রসঙ্গে ‘যৌবনের গান’ প্রবন্ধ অনুসরণে আলোচনা কর।
-----------

সৃজনশীল প্রশ্ন- ২
যুবকেরা পাগল, বারুদের মতো সহজেই তাদের মনে প্রতিবাদী চেতনার সৃষ্টি হয়। কারাগারে ফাঁসিতে কিছুতেই তাদের দর্পিত প্রাণ কাবু হয় না। এদের স্থিরতা, বীরত্ব, গাম্ভীর্য, ধর্মভয়, বিনয় জ্ঞান বলতে কিছু নেই। ওরা সত্যিই পাগল, বাষ্পীয় ইঞ্জিনে আবদ্ধ শক্তি বলা যায়।
ক. ‘বনের পাখির মতো গান করা স্বভাব’- কার?
খ. কবি তরুণদের দলভুক্ত হতে চেয়েছেন কেন?
গ. অনুচ্ছেদে ‘যৌবনের গান’ প্রবন্ধে বর্ণিত যুবকের কোন রূপটি প্রকাশ পেয়েছে তা ব্যাখ্যা করো।
ঘ. “অনুচ্ছেদে ‘যৌবনের গান’ প্রবন্ধে আংশিক বক্তব্য প্রতিফলিত হয়েছে”- মন্তব্যটির যৌক্তিক মূল্যায়ন করো।
-----------

সৃজনশীল প্রশ্ন- ৩
-------------
-----------

তথ্যসূত্র :
১. সাহিত্য পাঠ: একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড, বাংলাদেশ, ২০২৫।
২. আধুনিক বাংলা অভিধান: বাংলা একাডেমি, এপ্রিল, ২০১৮।
৩. ব্যবহারিক বাংলা অভিধান: বাংলা একাডেমি, ১৮তম, ২০১৫।

Next Post Previous Post