আমি সাগর পাড়ি দেবো : কাজী নজরুল ইসলাম

আমি সাগর পাড়ি দেবো : কাজী নজরুল ইসলাম
আমি সাগর পাড়ি দেবো : কাজী নজরুল ইসলাম

আমি সাগর পাড়ি দেবো
কাজী নজরুল ইসলাম

আমি সাগর পাড়ি দেবো, আমি সওদাগর।
সাত সাগরে ভাসবে আমার সপ্ত মধুকর।
আমার ঘাটের সওদা নিয়ে যাব সবার ঘাটে,
চলবে আমার বেচাকেনা বিশ্বজোড়া হাটে।
ময়ূরপঙ্খি বজরা আমার 'লাল বাওটা' তুলে
ঢেউয়ের দোলায় মরাল সম চলবে দুলে দুলে।
সিন্ধু আমার বন্ধু হয়ে রতন মানিক তার
আমার তরি বোঝাই করে দেবে উপহার।
দ্বীপে দ্বীপে আমার আশায় রাখবে পেতে থানা,
শুক্তি দেবে মুক্তামালা আমারে নজরানা।
চারপাশে মোর গাংচিলেরা করবে এসে ভিড়
হাতছানিতে ডাকবে আমায় নতুন দেশের তীর।

আসবে হাঙর কুমির তিমি-কে করে তায় ভয়;
বলব, 'ওরে, ভয় পায় যে-এ সে ছেলেই নয়।'
সপ্ত সাগর রাজ্য আমার, আমি বণিক বীর,
খাজনা জোগায় রাজ্যে আমার হাজার নদীর নীর।
ভয় করি না তোদের দুটো দন্ত নখর দেখে,
জল-দস্যু, তোদের তরে পাহারা গেলাম রেখে
সিন্ধু-গাজি মাল্লামাঝি, নৌ-সেনা ঐ জেলে,
বর্শা দিয়ে বিধবে তারা, রাজ্যে আমার এলে।
দেশে দেশে দেয়াল গাঁথা রাখব নাকো আর,
বন্যা এনে ভাঙব বিভেদ করব একাকার।
আমার দেশে থাকলে সুধা তাদের দেশে নেবো,
তাদের দেশের সুধা এনে আমার দেশে দেবো।
বলব মাকে, 'ভয় কী গো মা, বাণিজ্যেতে যাই!
সেই মণি মা দেবো এনে তোর ঘরে যা নাই।
দুঃখিনী তুই, তাই তো মা এ দুখ ঘুচাব আজ,
জগৎ জুড়ে সুখ কুড়াব-ঢাকব মা এ লাজ।
লাল জহরত পান্নাচুনি মুক্তামালা আনি
আমি হব রাজার কুমার, মা হবে রাজরানি।

উৎস নির্দেশ:
‘আমি সাগর পাড়ি দেব’ কবিতাটি কাজী নজরুল ইসলামের ‘জাগো সুন্দর চিরকিশোর’ নাটিকা থেকে সংকলিত হয়েছে।

শব্দার্থ ও টীকা:
➠ খাজনা- কর।
➠ গাংচিল- পাখির নাম।
➠ চুনি- মূল্যবান পাথর।
➠ জলদস্যু- যারা সমুদ্রে ডাকাতি করে।
➠ জহরত- মূল্যবান পাথর।
➠ তরি- নৌকা।
➠ থানা- আস্তানা।
➠ দন্ত- দাঁত।
➠ নখর- নখ।
➠ নজরানা- উপহার।
➠ নীর- পানি।
➠ নৌ-সেনা- নৌবাহিনীর সদস্য।
➠ পাড়ি দেওয়া- পার হওয়া।
➠ পান্না- মূল্যবান পাথর।
➠ বণিক- ব্যবসায়ী।
➠ বাণিজ্য- ব্যবসা।
➠ বিভেদ- পার্থক্য।
➠ ময়ূরপঙ্খি বজরা- সামনের দিকে ময়ূরের আকৃতিযুক্ত বড়ো নৌকা।
➠ মরাল- রাজহাঁস।
➠ লাল বাওটা- লাল রঙের পাল।
➠ সওদাগর- বড়ো ব্যবসায়ী।
➠ সপ্ত মধুকর- বাণিজ্যতরির নাম।
➠ সিন্ধু- সাগর।
➠ সিন্ধু-গাজি- সাগরের বীর।
➠ সুধা- এক ধরনের পানীয়।
➠ শুক্তি- ঝিনুক।
➠ হাতছানি- হাত দিয়ে ইশারা করা।
➠ সওদা- পণ্য।

মূল কবিতা:

আমি সাগর পাড়ি দেবো, হব সওদাগর।
সাত সাগরে ভাসবে আমার সপ্ত মধুকর।
আমার ঘাটের সওদা নিয়ে যাব সবার ঘাটে,
চলবে আমার বেচা-কেনা বিশ্ব-জোড়া হাটে।
ময়ূরপঙ্খী বজরা আমার লাল রাঙা পাল তুলে
ঢেউ-এর দোলায় হাঁসের মতন চলবে হেলে দুলে।
চারপাশে মোর গাঙ-চিলেরা করবে এসে ভিড়,
হাতছানিতে ডাকবে আমায় নতুন দেশের তীর।

সপ্ত সাগর রাজ্য আমার, হব সিন্ধুপতি;
আমার রাজ্যে কর জোগাবে রেবা ইরাবতী।
            কত সিন্ধু ভাগীরথী ।।
রক্ত-রাঙা পলার দ্বীপে রাজধানী মোর হবে,
জয়-গান মোর উঠবে নিতুই সাগর-রোলের স্তবে।
সপ্তদ্বীপা পৃথিবীরে রইবে সদা ঘিরে
যেন কোলের খোকার মতো আমার সাগর-নীরে!
সাগর-তলের সপ্ত পাতাল নাই সন্ধান যার
জয় করব, আমি তারে করব আবিষ্কার।

Next Post Previous Post