‘অভাগীর স্বর্গ’ গল্পের মূলপাঠ, শব্দার্থ, মূলভাব, বহুনির্বাচনি প্রশ্ন ও সৃজনশীল প্রশ্ন-উত্তর

অভাগীর স্বর্গ
অভাগীর স্বর্গ

অভাগীর স্বর্গ
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

ঠাকুরদাস মুখুয্যের বর্ষীয়সী স্ত্রী সাতদিনের জ্বরে মারা গেলেন। বৃদ্ধ মুখোপাধ্যায় মহাশয় ধানের কারবারে অতিশয় সঙ্গতিপন্ন। তাঁর চার ছেলে, তিন মেয়ে, ছেলেমেয়েদের ছেলেপুলে হইয়াছে, জামাইরা-প্রতিবেশীর দল, চাকর-বাকর সে যেন একটা উৎসব বাঁধিয়া গেল। সমস্ত গ্রামের লোক ধুমধামের শবযাত্রা ভিড় করিয়া দেখিতে আসিল। মেয়েরা কাঁদিতে কাঁদিতে মায়ের দুই পায়ে গাঢ় করিয়া আলতা এবং মাথায় ঘন করিয়া সিন্দুর লেপিয়া দিল, বধূরা ললাট চন্দনে চর্চিত করিয়া বহুমূল্য বস্ত্রে শাশুড়ির দেহ আচ্ছাদিত করিয়া দিয়া আঁচল দিয়া তাঁহার শেষ পদধূলি মুছাইয়া লইল। পুষ্পে, পত্রে, গন্ধে, মাল্যে, কলরবে মনে হইল না এ কোনো শোকের ব্যাপার-এ যেন বড়বাড়ির গৃহিণী পঞ্চাশ বর্ষ পরে আর একবার নূতন করিয়া তাঁহার স্বামীগৃহে যাত্রা করিতেছেন। বৃদ্ধ মুখোপাধ্যায় শান্তমুখে তাঁহার চিরদিনের সঙ্গিনীকে শেষ বিদায় দিয়া অলক্ষে দুফোঁটা চোখের জল মুছিয়া শোকার্ত কন্যা ও বধূগণকে সান্ত্বনা দিতে লাগিলেন। প্রবল হরিধ্বনিতে প্রভাত-আকাশ আলোড়িত করিয়া সমস্ত গ্রাম সঙ্গে সঙ্গে চলিল। আর একটি প্রাণী একটু দূরে থাকিয়া এই দলের সঙ্গী হইল। সে কাঙালীর মা। সে তাহার কুটির-প্রাঙ্গণে গোটা-কয়েক বেগুন তুলিয়া এই পথে হাটে চলিয়াছিল, এই দৃশ্য দেখিয়া আর নড়িতে পারিল না। রহিল তাহার হাটে যাওয়া, রহিল তাহার আঁচলে বেগুন বাঁধা, সে চোখের জল মুছিতে মুছিতে সকলের পিছনে শ্মশানে আসিয়া উপস্থিত হইল। গ্রামের একান্তে গরুড়-নদীর তীরে শ্মশান। সেখানে পূর্বাহ্নেই কাঠের ভার, চন্দনের টুকরা, ঘৃত, মধু, ধূপ, ধুনা প্রভৃতি উপকরণ সঞ্চিত হইয়াছিল, কাঙালীর মা ছোটজাত, দুলের মেয়ে বলিয়া কাছে যাইতে সাহস পাইল না, তফাতে একটা উঁচু ঢিপির মধ্যে দাঁড়াইয়া সমস্ত অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া প্রথম হইতে শেষ পর্যন্ত উৎসুক আগ্রহে চোখ মেলিয়া দেখিতে লাগিল। প্রশস্ত ও পর্যাপ্ত চিতার পরে যখন শব স্থাপিত করা হইল তখন তাঁহার রাঙা পা-দুখানি দেখিয়া তাহার দু'চক্ষু জুড়াইয়া গেল, ইচ্ছা হইল ছুটিয়া গিয়া একবিন্দু আলতা মুছাইয়া লইয়া মাথায় দেয়। বহুকণ্ঠের হরিধ্বনির সহিত পুত্রহস্তের মন্ত্রপূত অগ্নি যখন সংযোজিত হইল তখন তাহার চোখ দিয়া ঝরঝর করিয়া জল পড়িতে লাগিল, মনে মনে বারংবার বলিতে লাগিল, ভাগ্যিমানী মা, তুমি সগ্যে যাচ্চো-আমাকেও আশীর্বাদ করে যাও, আমিও যেন এমনি কাঙালীর হাতের আগুনটুকু পাই। ছেলের হাতের আগুন। সে ত সোজা কথা নয়! স্বামী, পুত্র, কন্যা, নাতি, নাতনী, দাস, দাসী পরিজন-সমস্ত সংসার উজ্জ্বল রাখিয়া এই যে স্বর্গারোহণ- দেখিয়া তাহার বুক ফুলিয়া ফুলিয়া উঠিতে লাগিল, এ সৌভাগ্যের সে যেন আর ইয়ত্তা করিতে পারিল না। সদ্য-প্রজ্বলিত চিতার অজস্র ধুয়া নীল রঙের ছায়া ফেলিয়া ঘুরিয়া ঘুরিয়া আকাশে উঠিতেছিল, কাঙালীর মা ইহারই মধ্যে ছোট একখানি রথের চেহারা যেন স্পষ্ট দেখিতে পাইল। গায়ে তাহার কত না ছবি আঁকা, চূড়ায় তাহার কত না লতাপাতা জড়ানো। ভিতরে কে যেন বসিয়া আছে-মুখ তাহার চেনা যায় না, কিন্তু সিঁথায় তাঁহার সিঁদুরের রেখা, পদতল- দুটি আলতায় রাঙানো। ঊর্ধ্বদৃষ্টে চাহিয়া কাঙালীর মায়ের দুই চোখে অশ্রুর ধারা বহিতেছিল, এমন সময়ে একটি বছর চোদ্দ-পনরর ছেলে তাহার আঁচলে টান দিয়া কহিল, হেথায় তুই দাঁড়িয়ে আছিস মা, ভাত রাঁধবি নে?

মা চমকিয়া ফিরিয়া চাহিয়া কহিল, রাঁধবো'খন রে! হঠাৎ উপরে অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া ব্যগ্রস্বরে কহিল, দ্যাখ দ্যাখ বাবা,-বামুন-মা ওই রথে চড়ে সগ্যে যাচ্ছে!

ছেলে বিস্ময়ে মুখ তুলিয়া কহিল, কৈ? ক্ষণকাল নিরীক্ষণ করিয়া শেষে বলিল, তুই ক্ষেপেছিস! ও ত ধুয়া! রাগ করিয়া কহিল, বেলা দুপুর বাজে, আমার ক্ষিদে পায় না বুঝি? এবং সঙ্গে সঙ্গে মায়ের চোখে জল লক্ষ করিয়া বলিল, বামুনদের গিন্নি মরছে তুই কেন কেঁদে মরিস মা?

কাঙালীর মার এতক্ষণে হুঁশ হইল। পরের জন্য শ্মশানে দাঁড়াইয়া এইভাবে অশ্রুপাত করায় সে মনে মনে লজ্জা পাইল, এমন কি, ছেলের অকল্যাণের আশঙ্কায় মুহূর্তে চোখ মুছিয়া ফেলিয়া একটুখানি হাসিবার চেষ্টা করিয়া বলিল, কাঁদব কিসের জন্যে রে! চোখে ধোঁ লেগেছে বৈ ত নয়!

হাঃ-ধোঁ লেগেছে বৈত না! তুই কাঁদতেছিলি!

মা আর প্রতিবাদ করিল না। ছেলের হাত ধরিয়া ঘাটে নামিয়া নিজেও স্নান করিল, কাঙালীকেও স্নান করাইয়া ঘরে ফিরিল,-শ্মশান-সৎকারের শেষটুকু দেখা আর তার ভাগ্যে ঘটিল না।

সন্তানের নামকরণকালে পিতামাতার মূঢ়তায় বিধাতাপুরুষ অন্তরীক্ষে থাকিয়া অধিকাংশ সময়ে শুধু হাস্য করিয়াই ক্ষান্ত হন না, তীব্র প্রতিবাদ করেন। তাই তাহাদের সমস্ত জীবনটা তাহাদের নিজের নামগুলোকেই যেন আমরণ ভ্যাঙচাইয়া চলিতে থাকে। কাঙালীর মার জীবনের ইতিহাস ছোটো, কিন্তু সেই ছোট্ট কাঙালজীবনটুকু বিধাতার এই পরিহাসের দায় হইতে অব্যাহতি লাভকরিয়াছিল। তাহাকে জন্ম দিয়া মা মরিয়াছিল, বাপ রাগ করিয়া নাম দিল অভাগী। মা নাই, বাপ নদীতে মাছ ধরিয়া বেড়ায়, তাহার না আছে দিন, না আছে রাত। তবু যে কি করিয়া ক্ষুদ্র অভাগী একদিন কাঙালীর মা হইতে বাঁচিয়া রহিল সে এক বিস্ময়ের বস্তু। যাহার সহিত বিবাহ হইল তাহার নাম রসিক বাঘ, বাঘের অন্য বাঘিনী ছিল, ইহাকে লইয়া সে গ্রামান্তরে উঠিয়া গেল, অভাগী তাহার অভাগ্য ও শিশুপুত্র কাঙালীকে লইয়া গ্রামেই পড়িয়া রহিল।

তাহার সেই কাঙালী বড়ো হইয়া আজ পনরয় পা দিয়াছে। সবেমাত্র বেতের কাজ শিখিতে আরম্ভকরিয়াছে, অভাগীর আশা হইয়াছে আরও বছরখানেক তাহার অভাগ্যের সহিত যুঝিতে পারিলে দুঃখ ঘুচিবে। এই দুঃখ যে কি, যিনি দিয়াছেন তিনি ছাড়া আর কেহই জানে না।

কাঙালী পুকুর হইতে আঁচাইয়া আসিয়া দেখিল তাহার পাতের ভুক্তাবশেষ মা একটা মাটির পাত্রে ঢাকিয়া রাখিতেছে, আশ্চর্য হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, তুই খেলি নে মা?

বেলা গড়িয়ে গেছে বাবা, এখন আর ক্ষিদে নেই।

ছেলে বিশ্বাস করিল না, বলিল, না, ক্ষিদে নেই বৈ কি! কৈ, দেখি তোর হাঁড়ি?

এই ছলনায় বহুদিন কাঙালীর মা কাঙালীকে ফাঁকি দিয়া আসিয়াছে। সে হাঁড়ি দেখিয়া তবে ছাড়িল। তাহাতে আর একজনের মত ভাত ছিল। তখন সে প্রসন্নমুখে মায়ের কোলে গিয়া বসিল। এই বয়েসের ছেলে সচরাচর এরূপ করে না, কিন্তু শিশুকাল হইতে বহুকাল যাবৎসে রুগ্ন ছিল বলিয়া মায়ের ক্রোড় ছাড়িয়া বাহিরের সঙ্গীসাথিদের সহিত মিশিবার সুযোগ পায় নাই। এইখানে বসিয়াই তাহাকে খেলাধুলার সাধ মিটাইতে হইয়াছে।

একহাতে গলা জড়াইয়া, মুখের উপর মুখ রাখিয়াই কাঙালী চকিত হইয়া কহিল, মা, তোর গা যে গরম, কেন তুই অমন রোদে দাঁড়িয়ে মড়া-পোড়ানো দেখতে গেলি? কেন আবার নেয়ে এলি? মড়া-পোড়ানো কি তুই-

মা শশব্যস্তে ছেলের মুখে হাত চাপা দিয়া কহিল, ছি বাবা, মড়া-পোড়ানো বলতে নেই, পাপ হয়। সতী-লক্ষ্মী মা-ঠাকরুন রথে করে সগ্যে গেলেন।

ছেলে সন্দেহ করিয়া কহিল, তোর এক কথা মা। রথে চড়ে কেউ নাকি আবার সগ্যে যায়।

মা বলিল, আমি যে চোখে দেখনু কাঙালী, বামুন-মা রথের উপরে বসে। তেনার রাঙা পা-দুখানি যে সবাই চোখ মেলে দেখলে রে!

সবাই দেখলে?

সব্বাই দেখলে।

কাঙালী মায়ের বুকে ঠেস দিয়া বসিয়া ভাবিতে লাগিল। মাকে বিশ্বাস করাই তাহার অভ্যাস, বিশ্বাস করিতেই সে শিশুকাল হইতে শিক্ষা করিয়াছে, সেই মা যখন বলিতেছে সবাই চোখ মেলিয়া এত বড়ো ব্যাপার দেখিয়াছে, তখন অবিশ্বাস করিবার আর কিছু নাই। খানিক পরে আস্তে আস্তে কহিল, তাহলে তুইও ত মা সগ্যে যাবি? বিন্দির মা সেদিন রাখালের পিসিকে বলতেছিল, ক্যাল্লার মার মত সতী-লক্ষ্মী আর দুলে-পাড়ায় নেই।

কাঙালীর মা চুপ করিয়া রহিল, কাঙালী তেমনি ধীরে ধীরে কহিতে লাগিল, বাবা যখন তোরে ছেড়ে দিলে, তখন তোরে কত লোকে ত নিকে করতে সাধাসাধি করলে। কিন্তু তুই বললি, না। বললি, ক্যাঙালী বাঁচলে আমার দুঃখু ঘুচবে, আবার নিকে করতে যাবো কিসের জন্যে? হাঁ মা, তুই নিকে করলে আমি কোথায় থাকতুম? আমি হয়ত না খেতে পেয়ে এতদিনে কবে মরে যেতুম।

মা ছেলেকে দুই হাতে বুকে চাপিয়া ধরিল। বস্তুত সেদিন তাহাকে এ পরামর্শ কম লোকে দেয় নাই, এবং যখন সে কিছুতেই রাজি হইল না, তখন উৎপাত-উপদ্রবও তাহার প্রতি সামান্য হয় নাই, সেই কথা স্মরণ করিয়া অভাগীর চোখ দিয়া জল পড়িতে লাগিল। ছেলে হাত দিয়া মুছাইয়া দিয়া বলিল, ক্যাঁতাটা পেতে দেব মা, শুবি?

মা চুপ করিয়া রহিল। কাঙালী মাদুর পাতিল, কাঁথা পাতিল, মাচার উপর হইতে ছোট বালিশটি পাড়িয়া দিয়া হাত ধরিয়া তাহাকে বিছানায় টানিয়া

লইয়া যাইতে, মা কহিল, কাঙালী, আজ তোর আর কাজে গিয়ে কাজ নেই।

কাজ কামাই করিবার প্রস্তাব কাঙালীর খুব ভালো লাগিল, কিন্তু কহিল, জলপানির পয়সা দুটো ত তা হলে দেবে না মা!

না দিক গে, আয় তোকে রূপকথা বলি।

আর প্রলুব্ধ করিতে হইল না, কাঙালী তৎক্ষণাৎ মায়ের বুক ঘেঁষিয়া শুইয়া পড়িয়া কহিল, বল্ তা হলে।

রাজপুত্তুর, কোটালপুত্তুর আর সেই পক্ষীরাজ ঘোড়া-

অভাগী রাজপুত্র, কোটালপুত্র আর পক্ষীরাজ ঘোড়ার কথা দিয়া গল্প আরম্ভ করিল। এ-সকল তাহার পরের কাছে কতদিনের শোনা এবং কতদিনের বলা উপকথা। কিন্তু মুহূর্ত-কয়েক পরে কোথায় গেল তাহার রাজপুত্র, আর কোথায় গেল তাহার কোটালপুত্র-সে এমন উপকথা শুরু করিল যাহা পরের কাছে তাহার শেখা নয়- নিজের সৃষ্টি। জ্বর তাহার যত বাড়িতে লাগিল, উষ্ণ রক্তস্রোত যত দ্রুতবেগে মস্তিষ্কে বহিতে লাগিল, ততই সে যেন নব নব উপকথার ইন্দ্রজাল রচনা করিয়া চলিতে লাগিল। তাহার বিরাম নাই, বিচ্ছেদ নাই- কাঙালীর স্বল্প দেহ বার বার রোমাঞ্চিত হইতে লাগিল। ভয়ে, বিস্ময়ে, পুলকে সে সজোরে মায়ের গলা জড়াইয়া তাহার বুকের মধ্যে যেন মিশিয়া যাইতে চাহিল।

বাহিরে বেলা শেষ হইল, সূর্য অস্ত গেল, সন্ধ্যার স্নান ছায়া গাঢ়তর হইয়া চরাচর ব্যাপ্ত করিল, কিন্তু ঘরের মধ্যে আজ আর দীপ জ্বলিল না, গৃহস্থের শেষ কর্তব্য সমাধা করিতে কেহ উঠিল না, নিবিড় অন্ধকারে কেবল রুগ্ন মাতার অবাধ গুঞ্জন নিস্তব্ধ পুত্রের কর্ণে সুধাবর্ষণ করিয়া চলিতে লাগিল। সে সেই শশ্মশান ও শ্মশানযাত্রার কাহিনি। সেই রথ, সেই রাঙ্গা পা-টি, সেই তাঁর স্বর্গে যাওয়া। কেমন করিয়া শোকার্ত স্বামী শেষ পদধুলি দিয়া কাঁদিয়া বিদায় দিলেন, কি করিয়া হরিধ্বনি দিয়া ছেলেরা মাতাকে বহন করিয়া লইয়া গেল, তার পরে সন্তানের হাতের আগুন। সে আগুন ত আগুন নয় কাঙালী, সে ত হরি! তার আকাশজোড়া ধুয়ো ত ধুয়ো নয় বাবা, সেই ত সগ্যের রথ! কাঙালীচরণ, বাবা আমার!

কি মা?

তোর হাতের আগুন যদি পাই বাবা, বামুন-মার মত আমিও সগ্যে যেতে পাবো।

কাঙালী অস্ফুটে শুধু কহিল, যাঃ-বলতে নেই।

মাসে কথা বোধ করি শুনিতেই পাইল না, তপ্তনিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিতে লাগিল, ছোটোজাত বলে তখন কিন্তু কেউ ঘেন্না করতে পারবে না-দুঃখী বলে কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না। ইস! ছেলের হাতের আগুন, রথকে যে আসতেই হবে।

ছেলে মুখের উপর মুখ রাখিয়া ভগ্নকণ্ঠে কহিল, বলিস নে মা, বলিস নে, আমার বড্ড ভয় করে।

মা কহিল, আর দেখ কাঙালী, তোর বাবাকে একবার ধরে আনবি, অমনি যেন পায়ের ধুলো মাথায় দিয়ে আমাকে বিদায় দেয়। অমনি পায়ে আলতা, মাথায় সিঁদুর দিয়ে, কিন্তু কে বা দেবে? তুই দিবি, না রে কাঙালী? তুই আমার ছেলে, তুই আমার মেয়ে, তুই আমার সব! বলিতে বলিতে সে ছেলেকে একেবারে বুকে চাপিয়া ধরিল।

অভাগীর জীবন-নাট্যের শেষ অঙ্ক পরিসমাপ্ত হইতে চলিল। বিস্তৃতি বেশি নয়, সামান্যই। বোধ করি ত্রিশটা বৎসর আজও পার হইয়াছে কি হয় নাই, শেষও হইল তেমনি সামান্যভাবে। গ্রামে কবিরাজ ছিল না, ভিন্ন গ্রামে তাঁহার বাস। কাঙালী গিয়া কাঁদাকাটি করিল, হাতে-পায়ে পড়িল, শেষে ঘটি বাঁধা দিয়া তাঁহাকে এক টাকা প্রণামী দিল। তিনি আসিলেন না, গোটা-চারেক বড়ি দিলেন। তাহার কত কি আয়োজন। খল, মধু আদার সত্ত্ব, তুলসীপাতার রস-কাঙালীর মা ছেলের প্রতি রাগ করিয়া বলিল, কেন তুই আমাকে না বলে ঘটি বাঁধা দিতে গেলি বাবা। হাত পাতিয়া বড়ি কয়টি গ্রহণ করিয়া মাথায় ঠেকাইয়া উনানে ফেলিয়া দিয়া কহিল, ভালো হই ত এতেই হবো, বাগদি-দুলের ঘরে কেউ কখনো ওষুধ খেয়ে বাঁচে না।

দিন দুই-তিন এমনি গেল। প্রতিবেশীরা খবর পাইয়া দেখিতে আসিল, যে যাহা মুষ্টিযোগ জানিত, হরিণের শিঙ-ঘষা জল, গেঁটে-কড়ি পুড়াইয়া মধুতে মাড়িয়া চাটাইয়া দেওয়া ইত্যাদি অব্যর্থ ঔষধের সন্ধান দিয়া যে যাহার কাজে গেল। ছেলেমানুষ কাঙালী ব্যতিব্যস্ত হইয়া উঠিতে, মা তাহাকে কাছে টানিয়া লইয়া কহিল, কোবরেজের বড়িতে কিছু হলো না বাবা আর ওদের ওষুধে কাজ হবে? আমি এমনি ভালো হবো।

কাঙালী কাঁদিয়া কহিল, তুই বড়ি ত খেলি নে মা, উনুনে ফেলে দিলি। এমনি কি কেউ সারে?

আমি এমনি সেরে যাবো। তার চেয়ে তুই দুটো ভাতে-ভাত ফুটিয়ে নিয়ে খা দিকি, আমি চেয়ে দেখি।

কাঙালী এই প্রথম অপটু হস্তে ভাত রাঁধিতে প্রবৃত্ত হইল। না পারিল ফ্যান ঝাড়িতে, না পারিল ভালো করিয়া ভাত বাড়িতে। উনান তাহার জ্বলে না-ভিতরে জল পড়িয়া ধুয়া হয়; ভাত ঢালিতে চারিদিকে ছড়াইয়া পড়ে; মায়ের চোখ ছলছল করিয়া আসিল। নিজে একবার উঠিবার চেষ্টা করিল, কিন্তু মাথা সোজা করিতে পারিল না, শয্যায় লুটাইয়া পড়িল। খাওয়া হইয়া গেলে ছেলেকে কাছে লইয়া কি করিয়া কি করিতে হয় বিধিমতে উপদেশ দিতে গিয়া তাহার ক্ষীণকণ্ঠ থামিয়া গেল, চোখ দিয়া কেবল অবিরলধারায় জল পড়িতে লাগিল।

গ্রামে ঈশ্বর নাপিত নাড়ী দেখিতে জানিত, পরদিন সকালে সে হাত দেখিয়া তাহারই সুমুখে মুখ গম্ভীর করিল, দীর্ঘশ্বাস ফেলিল এবং শেষে মাথা নাড়িয়া উঠিয়া গেল। কাঙালীর মা ইহার অর্থ বুঝিল, কিন্তু তাহার ভয়ই হইল না। সকলে চলিয়া গেলে সে ছেলেকে কহিল, এইবার একবার তাকে ডেকে আনতে পারিস বাবা?

কাকে মা?

ওই যে রে-ও-গাঁয়ে যে উঠে গেছে-

কাঙালী বুঝিয়া কহিল, বাবাকে?

অভাগী চুপ করিয়া রহিল।

কাঙালী বলিল, সে আসবে কেন মা?

অভাগীর নিজেরই যথেষ্ট সন্দেহ ছিল, তথাপি আস্তে আস্তে কহিল, গিয়ে বলবি, মা শুধু একটু তোমার পায়ের ধুলো চায়।

সে তখনি যাইতে উদ্যত হইলে সে তাহার হাতটা ধরিয়া ফেলিয়া বলিল, একটু কাঁদাকাটা করিস বাবা, বলিস মা যাচ্চে।

একটু থামিয়া কহিল, ফেরবার পথে অমনি নাপতে-বৌদির কাছ থেকে একটু আলতা চেয়ে আনিস কাঙালী, আমার নাম করলেই সে দেবে। আমাকে বড় ভালোবাসে।

ভালো তাহাকে অনেকেই বাসিত। জ্বর হওয়া অবধি মায়ের মুখে সে এই কয়টা জিনিসের কথা এতবার এতরকম করিয়া শুনিয়াছে যে, সে সেইখান হইতে কাঁদিতে কাঁদিতে যাত্রা করিল।

পরদিন রসিক দুলে সময়মত যখন আসিয়া উপস্থিত হইল তখন অভাগীর আর বড় জ্ঞান নাই। মুখের পরে মরণের ছায়া পড়িয়াছে, চোখের দৃষ্টি এ সংসারের কাজ-সারিয়া কোথায় কোন্ অজানা দেশে চলিয়া গেছে।

কাঙালী কাঁদিয়া কহিল, মাগো! বাবা এসেছে-পায়ের ধুলো নেবে যে!

মা হয়ত বুঝিল, হয়ত বুঝিল না, হয়ত বা তাহার গভীর সঞ্চিত বাসনা সংস্কারের মত তাহার আচ্ছন্ন চেতনায় ঘা দিল। এই মৃত্যুপথ-যাত্রী তাহার অবশ বাহুখানি শয্যার বাহিরে বাড়াইয়া হাত পাতিল।

রসিক হতবুদ্ধির মত দাঁড়াইয়া রহিল। পৃথিবীতে তাহারও পায়ের ধুলোর প্রয়োজন আছে, ইহাও কেহ নাকি চাহিতে পারে তাহা তাহার কল্পনার অতীত। বিন্দির পিসি দাঁড়াইয়া ছিল, সে কহিল, দাও বাবা, দাও একটু পায়ের ধুলো।

রসিক অগ্রসর হইয়া আসিল। জীবনে যে স্ত্রীকে সে ভালোবাসা দেয় নাই, অশন-বসন দেয় নাই, কোন খোঁজখবর করে নাই, মরণকালে তাহাকে সে শুধু একটু পায়ের ধুলা দিতে গিয়া কাঁদিয়া ফেলিল।

রাখালের মা বলিল, এমন সতীলক্ষ্মী বামুন-কায়েতের ঘরে না জন্মে, ও আমাদের দুলের ঘরে জন্মালে কেন!

এইবার ওর একটু গতি করে দাও বাবা-ক্যাঙালার হাতের আগুনের লোভে ও যেন প্রাণটা দিলে।

অভাগীর অভাগ্যের দেবতা অগোচরে বসিয়া কি ভাবিলেন জানি না, কিন্তু ছেলেমানুষ কাঙালীর বুকে গিয়া এ কথা যেন তীরের মত বিধিল।

সেদিন দিনের বেলাটা কাটিল, প্রথম রাত্রিটা কাটিল, কিন্তু প্রভাতের জন্য কাঙালীর মা আর অপেক্ষা করিতে পারিল না। কি জানি, এত ছোটজাতের জন্যও স্বর্গে রথের ব্যবস্থা আছে কি না, কিংবা অন্ধকারে পায়ে হাঁটিয়াই তাহাদের রওনা হইতে হয়, কিন্তু এটা বুঝা গেল, রাত্রি শেষ না হইতেই এ দুনিয়া সে ত্যাগ করিয়া গেছে।

কুটির-প্রাঙ্গণে একটা বেলগাছ, একটা কুড়ল চাহিয়া আনিয়া রসিক তাহাতে ঘা দিয়াছে কি দেয় নাই, জমিদারের দারোয়ান কোথা হইতে ছুটিয়া আসিয়া তাহার গালে সশব্দে একটা চড় কষাইয়া দিল; কুড়ল কাড়িয়া লইয়া কহিল, শালা, একি তোর বাপের গাছ আছে যে কাটতে লেগেছিস?

রসিক গালে হাত বুলাইতে লাগিল, কাঙালী কাঁদ-কাঁদ হইয়া বলিল, বাঃ, এ যে আমার মায়ের হাতে-পোঁতা গাছ, দারোয়ানজী। বাবাকে খামোকা তুমি মারলে কেন?

হিন্দুস্থানী দারোয়ান তাহাকেও একটা অশ্রাব্য গালি দিয়া মারিতে গেল, কিন্তু সে নাকি তাহার জননীর মৃতদেহ স্পর্শ করিয়া বসিয়াছিল, তাই অশৌচের ভয়ে তাহার গায়ে হাত দিল না। হাঁকাহাঁকিতে একটা ভিড় জমিয়া উঠিল, কেহই অস্বীকার করিল না যে বিনা অনুমতিতে রসিকের গাছ কাটিতে যাওয়াটা ভালো হয় নাই। তাহারাই আবার দারোয়ানজীর হাতে-পায়ে পড়িতে লাগিল, তিনি অনুগ্রহ করিয়া যেন একটা হুকুম দেন। কারণ, অসুখের সময় যে-কেহ দেখিতে আসিয়াছে কাঙালীর মার তাহারই হাতে ধরিয়া তাহার শেষ অভিলাষ ব্যক্ত করিয়া গেছে।

দারোয়ান ভুলিবার পাত্র নহে, সে হাত-মুখ বাড়িয়া জানাইল, এ-সকল চালাকি তাহার কাছে খাটিবে না।

জমিদার স্থানীয় লোক নহেন; গ্রামে তাঁহার একটা কাছারি আছে, গোমস্তা অধর রায় তাহার কর্তা। লোকগুলো যখন হিন্দুস্থানিটার কাছে ব্যর্থ অনুনয়-বিনয় করিতে লাগিল, কাঙালী ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়িয়া একেবারে কাছারি বাড়িতে আসিয়া উপস্থিত হইল। সে লোকের মুখে মুখে শুনিয়াছিল, পিয়াদারা ঘুষ লয়, তাহার নিশ্চয় বিশ্বাস হইল অতবড় অসঙ্গত অত্যাচারের কথা যদি কর্তার গোচর করিতে পারে ত ইহার প্রতিবিধান না হইয়াই পারে না। হায় রে অনভিজ্ঞ। বাংলাদেশের জমিদার ও তাহার কর্মচারীকে সে চিনিত না। সদ্যমাতৃহীন বালক শোকে ও উত্তেজনায় উদভ্রান্ত হইয়া একেবারে উপরে উঠিয়া আসিয়াছিল, অধর রায় সেইমাত্র সন্ধ্যাহ্নিক ও যৎসামান্য জলযোগান্তে বাহিরে আসিয়াছিলেন, বিস্মিত ও ক্রুদ্ধ হইয়া কহিলেন, কে রে?

আমি কাঙালী। দারোয়ানজী আমার বাবাকে মেরেছে।

বেশ করেচে। হারামজাদা, খাজনা দেয়নি বুঝি?

কাঙালী কহিল, না বাবুমশায়, বাবা গাছ কাটতেছিল, আমার মা মরেচে-বলিতে বলিতে সে কান্না আর চাপিতে পারিল না।

এই কান্নাকাটিতে অধর অত্যন্ত বিরক্ত হইলেন। ছোঁড়াটা মড়া ছুঁইয়া আসিয়াছে, কি জানি এখানকার কিছু ছুঁইয়া ফেলিল নাকি! ধমক দিয়া বলিলেন, মা মরেচে ত যা নীচে নেবে দাঁড়া। ওরে কে আছিস রে, এখানে একটু গোবরজল ছড়িয়ে দে! কি জাতের ছেলে তুই?

কাঙালী সভয়ে প্রাঙ্গণে নামিয়া দাঁড়াইয়া কহিল, আমরা দুলে।

অধর কহিলেন, দুলে দুলের মড়ার কাঠ কি হবে শুনি?

কাঙালী বলিল, মা যে আমাকে আগুন দিতে বলে গেছে! তুমি জিজ্ঞেস কর না বাবুমশায়, মা যে সবাইকে বলে গেছে, সক্কলে শুনেছে যে!

মায়ের কথা বলিতে গিয়া তাহার অনুক্ষণের সমস্ত অনুরোধ উপরোধ মুহূর্তে স্মরণ হইয়া কণ্ঠ যেন তাহার কান্নায় ফাটিয়া পড়িতে চাহিল।

অধর কহিলেন, মাকে পোড়াবি ত গাছের দাম পাঁচটা টাকা আন্ গে। পারবি?

কাঙালী জানিত তাহা অসম্ভব। তাহার উত্তরীয় কিনিবার মূল্যস্বরূপ তাহার ভাত খাইবার পিতলের কাঁসিটি বিন্দির পিসি একটি টাকায় বাঁধা দিতে গিয়াছে সে চোখে দেখিয়া আসিয়াছে, সে ঘাড় নাড়িল, বলিল, না।

অধর মুখখানা অত্যন্ত বিকৃত করিয়া কহিলেন, না ত, মাকে নিয়ে নদীর চড়ায় পুঁতে ফেল গে যা। কার বাবার গাছে তোর বাপ কুড়ুল ঠেকাতে যায়-পাজি, হতভাগা, নচ্ছার!

কাঙালী বলিল, সে যে আমাদের উঠানের গাছ বাবুমশায়! সে যে আমার মায়ের হাতে পোঁতা গাছ।

হাতে পোঁতা গাছ! পাঁড়ে, ব্যাটাকে গলাধাক্কা দিয়ে বার করে দে ত!

পাঁড়ে আসিয়া গলাধাক্কা দিল, এবং এমন কথা উচ্চারণ করিল যাহা কেবল জমিদারের কর্মচারীরাই পারে।

কাঙালী ধুলা ঝাড়িয়া উঠিয়া দাঁড়াইল, তার পরে ধীরে ধীরে বাহির হইয়া গেল। কেন সে যে মার খাইল, কি তাহার অপরাধ, ছেলেটা ভাবিয়াই পাইল না। গোমস্তার নির্বিকার চিত্তে দাগ পর্যন্ত পড়ি ল না। পড়িলে এ চাকরি তাহার জুটিত না। কহিলেন, পরেশ, দেখ ত হে, এ ব্যাটার খাজনা বাকি পড়েছে কি না। থাকে ত জাল-টাল কিছু একটা কেড়ে এনে যেন রেখে দেয়, -হারামজাদা পালাতে পারে।

মুখুয্যে-বাড়িতে শ্রাদ্ধের দিন-মাঝে কেবল একটা দিন মাত্র বাকি। সমারোহের আয়োজন গৃহিণীর উপযুক্ত করিয়াই হইতেছে। বৃদ্ধ ঠাকুরদাস নিজে তত্ত্বাবধান করিয়া ফিরিতেছিলেন, কাঙালী আসিয়া তাঁহার সম্মুখে দাঁড়াইল, কহিল, ঠাকুরমশাই, আমার মা মরে গেছে।

তুই কে? কি চাস তুই?

আমি কাঙালী। মা বলে গেছে তেনাকে আগুন দিতে।

তা দি গে না।

কাছারির ব্যাপারটা ইতিমধ্যেই মুখে মুখে প্রচারিত হইয়া পড়িয়াছিল, একজন কহিল, ও বোধ হয় একটা গাছ চায়। এই বলিয়া সে ঘটনাটা প্রকাশ করিয়া কহিল।

মুখুয্যে বিস্মিত ও বিরক্ত হইয়া কহিলেন, শোন আবদার। আমারই কত কাঠের দরকার,-কাল বাদে পরশু কাজ। যা যা, এখানে কিছু হবে না-এখানে কিছু হবে না। এই বলিয়া অন্যত্র প্রস্থান করিলেন। ভট্টাচার্য মহাশয় অদূরে বসিয়া ফর্দ করিতেছিলেন, তিনি বলিলেন, তোদের জেতে কে কবে আবার পোড়ায় রে? যা, মুখে একটু নুড়ো জ্বেলে দিয়ে নদীর চড়ায় মাটি দে গে।

মুখোপাধ্যায় মহাশয়ের বড় ছেলে ব্যস্তসমস্তভাবে এই পথে কোথায় যাইতেছিলেন, তিনি কান খাড়া করিয়া একটু শুনিয়া কহিলেন, দেখচেন ভট্টচার্যমশায়, সব ব্যাটারাই এখন বামুন-কায়েত হতে চায়। বলিয়া কাজের ঝোঁকে আর কোথায় চলিয়া গেলেন।

কাঙালী আর প্রার্থনা করিল না। এই ঘণ্টা-দুয়েকের অভিজ্ঞতায় সংসারে সে যেন একেবারে বুড়া হইয়া গিয়াছিল। নিঃশব্দে ধীরে ধীরে তাহার মরা মায়ের কাছে গিয়া উপস্থিত হইল।

নদীর চরে গর্ত খুঁড়িয়া অভাগীকে শোয়ান হইল। রাখালের মা কাঙালীর হাতে একটা খড়ের আঁটি জ্বালিয়া দিয়া তাহারই হাত ধরিয়া মায়ের মুখে স্পর্শ করাইয়া ফেলিয়া দিল। তার পরে সকলে মিলিয়া মাটি চাপা দিয়া কাঙালীর মায়ের শেষ চিহ্ন বিলুপ্ত করিয়া দিল। সবাই সকল কাজে ব্যস্ত, শুধু সেই পোড়া খড়ের আঁটি হইতে যে স্বল্প ধুয়াটুকু ঘুরিয়া ঘুরিয়া আকাশে উঠিতেছিল, তাহারই প্রতি পলকহীন চক্ষু পাতিয়া কাঙালী উর্ধ্বদৃষ্টে স্তব্ধ হইয়া চাহিয়া রহিল।

উৎস নির্দেশ :
সুকুমার সেন সম্পাদিত ‘শরৎ সাহিত্যসমগ্র’ গ্রন্থের প্রথম খণ্ড থেকে ‘অভাগীর স্বর্গ’ নামক গল্পটি সংকলন করা হয়েছে।

শব্দার্থ ও টীকা :
➠ মুখুয্যে- মুখোপাধ্যায় পদবীর কথ্যরূপ।
➠ বর্ষীয়সী- অতি বৃদ্ধ, সকলের মধ্যে বয়সে বড়, স্ত্রীবাচক শব্দ হিসেবে ব্যবহৃত।
➠ সঙ্গতিপন্ন- অর্থ-সম্পদের অধিকারী।
➠ অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া- মৃত ব্যক্তির সৎকার, মৃত্যের জন্য অন্তিম বা শেষ অনুষ্ঠান।
➠ সগ্য- স্বর্গ শব্দের কথ্যরূপ।
➠ অন্তরীক্ষ- আকাশ, গগন।
➠ ভুক্তাবশেষ- ভোজন বা খাওয়ার পরে পাতে যা পড়ে থাকে।
➠ প্রসন্ন- সন্তুষ্ট, খুশি।
➠ প্রসন্নমুখ- খুশি ভরা মুখ।
➠ ক্রোড়- কোল।
➠ শশব্যস্ত- খরগোশ বা শশকের মতো ব্যস্ত।
➠ তেনার- তার, তাঁর।
➠ দুলে- পালকি বহনকারী হিন্দু সম্প্রদায়বিশেষ, নিচু জাতের মানুষ বলে অভিহিত।
➠ ইন্দ্রজাল- জাদুবিদ্যা, এখানে গল্পের মাধ্যমে মুগ্ধ বা মোহিত করে রাখার ক্ষমতাকে বোঝানো হয়েছে।
➠ রোমাঞ্চ- শিহরণ, অনুভূতির আধিক্যে গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যাওয়া।
➠ ভগ্নকন্ঠ- বিকৃত স্বর, এখানে অতি আবেগে কাঙালীর ভাঙা বা বিকৃত স্বরে কথা বলা বোঝানো হয়েছে।
➠ প্রণামী- পুরোহিত বা দেব-দেবীকে দেওয়া সালামি। এখানে কবিরাজকে চিকিৎসা ফি হিসেবে দেওয়া টাকা বোঝানো হয়েছে।
➠ মুষ্টিযোগ- টোটকা চিকিৎসা।
➠ গেঁটে কড়ি-কাঁটাযুক্ত শামুক জাতীয় প্রাণি।
➠ নিস্তব্ধ- নিশ্চল, নিঃসাড়। নির্বাক।
➠ হরিধ্বনি- হরি নামের ধ্বনি। হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা মৃতদেহ বহন করার সময় সমবেতকণ্ঠে দেবতা হরির নাম উচ্চেঃসরে বলে থাকে একে হরিধ্বনি বলে।
➠ সংস্কার- বিশ্বাস, ঝোঁক, আজন্ম লালিত ধারণা।
➠ অশন- খাদ্যদ্রব্য, আহারের বস্তু।
➠ সন্ধ্যাহ্নিক- সন্ধ্যাবেলায় হিন্দু সম্প্রদায়ের নিত্যকরণীয় পূজা।

কর্ম-অনুশীলন :
১. তোমার দেখা ধনী পরিবারের কারো মৃত্যু ও গরিব পরিবারের কারো মৃত্যুর তুলনামূলক বিবরণ দাও।
২. কাঙালী যে মাতৃভক্তি দেখিয়েছে, এরকম কোনো ঘটনা লিপিবদ্ধ করো।

পাঠ-পরিচিতি :
‘অভাগীর স্বর্গ’ গল্পে গরিব-দুখী নীচু শ্রেণির ছেলে কাঙালী। তার মা অভাগী। প্রতিবেশী উঁচু জাতের বাড়ির গৃহকত্রীর মৃত্যুর পর সৎকারের দৃশ্য দেখে অভাগীর ভেতরকার ভাবানুভূতি প্রকাশের মাধ্যমে শুরু হয় এ গল্প। মৃতের শবযাত্রার আড়ম্বরতা ও সৎকারের ব্যাপকতা দেখে অভাগীও নিজের মৃত্যু মুহূর্তের স্বপ্ন দেখে। চন্দন, সিঁদুর, আলতা, মালা, ঘৃত, মধু, ধূপ, ধুনা, অগ্নির ধোঁয়ায় মুখুয্যে বাড়ির গিন্নি স্বর্গে গমন করেছেন। দুখিনী অভাগীও ভাবে তার মৃত্যুর সময় স্বামীর পায়ের ধূলি নিয়ে মৃত্যু শেষে পুত্র মুখাগ্নি করলে সেও স্বর্গে যাবে। মৃত্যুর সময় কাঙালী তার বাবাকে হাজির করতে পারলেও পারেনি কাঠের অভাবে মায়ের সৎকার করতে। 'অভাগীর স্বর্গ' গল্পে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় অমানবিক জাতিভেদ প্রথা এবং জমিদারি ব্যবস্থার শোষণ-নির্যাতনের ছবি এঁকেছেন। এ গল্প জাতি, ধর্ম, বর্ণ ও শ্রেণি নিবিশেষে মানবিক হওয়ার শিক্ষা দেয়।

লেখক পরিচিতি :
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের হুগলি জেলার দেবানন্দপুর গ্রামে ১৫ই সেপ্টেম্বর ১৮৭৬ সালে জন্মগ্রহণ করেন। আর্থিক সংকটের কারণে এফ.এ. শ্রেণিতে পড়ার সময় তাঁর ছাত্রজীবনের অবসান ঘটে। তিনি কিছুদিন ভবঘুরে হয়ে বিভিন্ন জায়গায় ভ্রমণ করেন। পরে ১৯০৩ সালে ভাগ্যের সন্ধানে বার্মা যান এবং রেঙ্গুনে অ্যাকাউন্ট্যান্ট জেনারেলের অফিসে কেরানি পদে চাকরি করেন। প্রবাস জীবনেই তাঁর সাহিত্য-সাধনা শুরু এবং তিনি অল্পদিনেই খ্যাতি লাভ করেন। ১৯১৬ সালে তিনি কলকাতায় ফিরে আসেন এবং নিয়মিতভাবে সাহিত্য-সাধনা করতে থাকেন। গল্প, উপন্যাস রচনার পাশাপাশি তিনি কিছু প্রবন্ধ রচনা করেন। তিনি রাজনৈতিক আন্দোলনেও যোগ দিয়েছিলেন, কিন্তু পরে তা ত্যাগ করেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ: বড়দিদি, বিরাজ বৌ, রামের সুমতি, দেবদাস, বিন্দুর ছেলে, পরিণীতা, পণ্ডিতমশাই, মেজদিদি, পল্লিসমাজ, বৈকুণ্ঠের উইল, শ্রীকান্ত, চরিত্রহীন, দত্তা, ছবি, গৃহদাহ, দেনা পাওনা, পথের দাবী, শেষ প্রশ্ন ইত্যাদি।
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ১৬ই জানুয়ারি ১৯৩৮ সালে মৃত্যুবরণ করেন।।

বহুনির্বাচনি প্রশ্ন :

প্রশ্ন থেকে

অভিনন্দন!
আপনি পেয়েছেন -এর মধ্যে!
যা


জ্ঞানমূলক প্রশ্ন :
১. শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কত সালে জন্মগ্রহণ করেন?
উত্তর : শরৎচন্দ্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র চট্টোপাধ্যায় ১৮৭৬ সালে জন্মগ্রহণ করেন।
২. শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডি.লিট. উপাধি লাভ করেন কত সালে?
উত্তর : শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডি.লিট. উপাধি লাভ করেন ১৯৩৬ সালে।
৩. শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কত সালে মৃত্যুবরণ করেন?
উত্তর : শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ১৯৩৮ সালে মৃত্যুবরণ করেন।
৪. ঠাকুরদাস মুখুয্যের বর্ষীয়সী স্ত্রী কয়দিনের জ্বরে মারা গেলেন?
উত্তর : ঠাকুরদাস মুখুয্যের বর্ষীয়সী স্ত্রী সাত দিনের জ্বরে মারা গেলেন।
৫. ঠাকুরদাস মুখুয্যের কয় ছেলে?
উত্তর : ঠাকুরদাস মুখুয্যের চার ছেলে।
৬. ‘অভাগীর স্বর্গ’ গল্পে বর্ণিত শ্মশান কোন নদীর তীরে অবস্থিত?
উত্তর : ‘অভাগীর স্বর্গ’ গল্পে বর্ণিত শ্মশান গরুড় নদীর তীরে অবস্থিত।
৭. কাঙালীর বয়স কত?
উত্তর : কাঙালীর বয়স পনেরো বছর।
৮. কাঙালীর মায়ের নাম কী?
উত্তর : কাঙালীর মায়ের নাম অভাগী।
৯. অভাগীর স্বামীর নাম কী?
উত্তর : অভাগীর স্বামীর নাম রসিক দুলে।
১০. কাঙালী কিসের কাজ শিখতে আরম্ভ করেছে?
উত্তর : কাঙালী বেতের কাজ শিখতে আরম্ভ করেছে।
১১. অভাগী কাকে রূপকথা বলতে চায়?
উত্তর : অভাগী তার ছেলেকে রূপকথা বলতে চায়।
১২. কার হাতের আগুন পেলে অভাগী স্বর্গে যেতে পারবে বলে মনে করে?
উত্তর : কাঙালীর হাতের আগুন পেলে অভাগী স্বর্গে যেতে পারবে বলে মনে করে।
১৩. কাঙালী ভিন গ্রামের কবিরাজকে কয় টাকা প্রণামী দিল?
উত্তর : কাঙালী ভিন গ্রামের কবিরাজকে এক টাকা প্রণামী দিল।
১৪. কাঙালী কী বাঁধা দিয়ে কবিরাজকে প্রণামী দিল?
উত্তর : কাঙালী ঘটি বাঁধা দিয়ে কবিরাজকে প্রণামী দিল।
১৫. কাঙালীর আনা বড়িগুলো অভাগী কোথায় ফেলে দিল?
উত্তর : কাঙালীর আনা বড়িগুলো অভাগী চুলায় ফেলে দিল।
১৬. গ্রামে কে নাড়ি দেখতে জানত?
উত্তর : গ্রামে ঈশ্বর নাপিত নাড়ি দেখতে জানত।
১৭. অভাগী কাঙালীকে কার কাছ থেকে আলতা চেয়ে আনতে বলল?
উত্তর : অভাগী কাঙালীকে নাপতে বৌদির কাছ থেকে আলতা চেয়ে আনতে বলল।
১৮. অভাগী কার পায়ের ধুলো নিতে চায়?
উত্তর : অভাগী রসিক দুলের পায়ের ধুলো নিতে চায়।
১৯. রসিক কী গাছ কাটতে যায়?
উত্তর : রসিক বেলগাছ কাটতে যায়।
২০. ‘অভাগীর স্বর্গ’ গল্পে গ্রামের স্থানীয় কাছারির কর্তা কে?
উত্তর : ‘অভাগীর স্বর্গ’ গল্পে গ্রামের স্থানীয় কাছারির কর্তা গোমস্তা অধর রায়।
২১. ‘অন্তরীক্ষ’ শব্দের অর্থ কী?
উত্তর : ‘অন্তরীক্ষ’ শব্দের অর্থ আকাশ।
২২. অভাগী কোন সম্প্রদায়ের নারী?
উত্তর : অভাগী দুলে সম্প্রদায়ের নারী।
২৩. কাঙালীকে কাছারি থেকে গলাধাক্কা দিল কে?
উত্তর : কাঙালীকে কাছারি থেকে গলাধাক্কা দিল পাঁড়ে।
২৪. অধর রায় গাছের দাম কত চায়?
উত্তর : অধর রায় গাছের দাম পাঁচ টাকা চায়।
২৫. ‘অভাগীর স্বর্গ’ গল্পে বর্ণিত বেলগাছটি কার হাতের পোঁতা?
উত্তর : ‘অভাগীর স্বর্গ’ গল্পে বর্ণিত বেলগাছটি অভাগীর হাতের পোঁতা।

অনুধাবনমূলক প্রশ্ন :

১. “সে যেন একটা উৎসব বাধিয়া গেল।”- লেখক এ কথা বলেছেন কেন?
উত্তর : ঠাকুরদাস মুখুয্যের স্ত্রীর মৃত্যুতে বাড়িতে স্বজনদের উপস্থিতিতে সৃষ্ট অবস্থা বর্ণনায় লেখক প্রশ্নোক্ত কথাটি বলেছেন।
➠ ‘অভাগীর স্বর্গ’ গল্পে ঠাকুরদাস মুখুয্যে একজন পয়সাওয়ালা লোক। তার স্ত্রীর মৃত্যুতে বাড়িতে অনেক লোকজন উপস্থিত হয়েছে। ছেলে-মেয়ে, নাতিপুতি এলাকার মানুষ সকলেই বর্ষীবয়সী গিন্নির লাশ দেখতে এসেছে। আর এত মানুষের উপস্থিতিতে বাড়ি গমগম করছিল। তাই লেখক বলেছেন, “সে যেন একটা উৎসব বাধিয়া গেল।”

২. অভাগী একটু দূরে থেকে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া দেখল কেন?
উত্তর : অভাগী ছোট জাতের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় একটু দূরে থেকে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া দেখল।
➠ আভাগী ছিল দুলে সম্প্রদায়ের নারী। তাদেরকে সমাজে ছোট জাত মনে করা হয়। সমাজের সৃষ্ট এই কুসংস্কারের কারণে ছোট জাতের লোকেরা কখনো উঁচু জাতের মানুষের কাছে আসতে সাহস করে না। গল্পের অভাগী ছিল নীচু জাতের আর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া হচ্ছিল উঁচু জাতের মানুষের। তাই অভাগী একটু দূরে দাঁড়িয়ে থেকে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া দেখল।

৩. বামুন ঠাকরুণের শ্মশান সৎকারের শেষটুকু দেখা অভাগীর ভাগ্যে আর ঘটল না কেন?
উত্তর : কাঙালীর সাথে বাড়ি ফিরে আসায় বামুন ঠাকরুণের শ্মশান সৎকারের শেষটুকু দেখা অভাগীর ভাগ্যে আর ঘটল না।
➠ অভাগী ঠাকুরদাস মুখুয্যের স্ত্রীর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া দূর থেকে দেখছিল। সে ছোট জাতের হওয়ায় নিজেরও অমন করে স্বর্গে যাওয়ার বাসনা নিয়ে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া দেখছিল। কিন্তু শেষবেলা কাঙালী এসে তাকে ডাকায় এবং ক্ষুধার কথা বলায় তাকে তখনই বাড়িতে ফিরতে হয়। তাই শ্মশান সৎকারের শেষটুকু তার আর দেখা হয় না।

৪. কাঙালীর মায়ের নাম অভাগী রাখা হয়েছিল কেন?
উত্তর : জন্মের সময় মা মরে যাওয়ায় কাঙালীর মায়ের নাম অভাগী রাখা হয়েছিল।
➠ অভাগীর বাবা অভাগীর এই নাম রেখেছিলেন। অভাগীর যখন জন্ম হয় তখন তার মা মারা যায়। ফলে বাবা রাগ করে মা-মরা মেয়ের নাম রাখেন অভাগী। মূলত মা-মরা মেয়ে হওয়ার কারণেই তার নাম অভাগী রাখা হয়েছিল।

৫. কাঙালীর ভাত রান্না দেখে অভাগীর চোখ ছলছল করে উঠল কেন?
উত্তর : কাঙালীর ভাত রান্নার অপটুতা দেখে ছেলের প্রতি মমতায় অভাগীর চোখ ছলছল করে উঠল।
➠ অভাগী অসুস্থ হওয়ায় সে বিছানা থেকে উঠতে পারছিল না। তাই ছেলে কাঙালীকে ভাত রান্না করে নিতে বলে। কাঙালী অদক্ষ হাতে রাঁধতে গিয়ে নানা অসুবিধার সম্মুখীন হয়। ফেন ঝাড়তে পারে না, ভাত বাড়তে পারে না। এমন অপটুতা দেখে অভাগীর মায়া হয়। তাই তার চোখ ছলছল করে ওঠে।

৬. ঈশ্বর নাপিত অভাগীর নাড়ি দেখে মুখ গম্ভীর করল কেন?
উত্তর : অভাগীর অবস্থা ভালো না হওয়ায় ঈশ্বর নাপিত অভাগীর নাড়ি দেখে সে মুখ গম্ভীর করল।
➠ অভাগী বেশ কয়েক দিনের জ্বরে শয্যাশায়ী। তার অবস্থার ক্রমেই অবনতি হয়। নাড়ি পরীক্ষা করে গ্রামের ঈশ্বর নাপিত বুঝতে পারল অভাগীর অবস্থা ভালো নয়। তার বাঁচার আশা ক্ষীণ। অভাগীর নাড়ি দেখে তাই সে মূুখ গম্ভীর করল।


সৃজনশীল প্রশ্ন- ১

এই নিষ্ঠুর অভিযোগে গফুর যেন বাক্রোধ হইয়া গেল। ক্ষণেক পরে ধীরে ধীরে কহিল, কাহন খানেক খড় এবার ভাগে পেয়েছিলাম। কিন্তু গেল সনের বকেয়া বলে কর্তামশায় সব ধরে রাখলেন? কেঁদে কেটে হাতে পায়ে পড়ে বললাম, বাবু মশাই, হাকিম তুমি, তোমার রাজত্ব ছেড়ে আর পালাব কোথায়? আমাকে পণদশেক বিচুলি না হয় দাও। চালে খড় নেই। বাপ বেটিতে থাকি, তাও না হয় তালপাখার গোঁজাগাঁজা দিয়ে এ বর্ষাটা কাটিয়ে দেব, কিন্তু না খেতে পেয়ে আমার মহেশ যে মরে যাবে।

ক. কাঙালীর বাবার নাম কী?
খ. ‘তোর হাতের আগুন যদি পাই, আমিও সগ্যে যাব’ উক্তিটি ব্যাখ্যা করো।
গ. উদ্দীপকে ‘অভাগীর স্বর্গ’ গল্পের যে সমাজচিত্রের ইঙ্গিত রয়েছে তা ব্যাখ্যা করো।
ঘ. কাঙালীর সঙ্গে উদ্দীপকের গফুরের সাদৃশ্য থাকলেও কাঙালী সম্পূর্ণরূপে গফুরের প্রতিনিধিত্ব করে না - মন্তব্যটির যথার্থতা নিরূপণ করো।

ক. কাঙালীর বাবার নাম রসিক বাঘ।
খ. ‘তোর হাতের আগুন যদি পাই, আমিও সগ্যে যাব’- মা গভীর ধর্মবিশ্বাস থেকে কাঙালীকে এ উক্তিটি করেছিল।
➠ মুখুয্যে বাড়ির গৃহকর্ত্রীর মৃত্যুর পর সৎকারের দৃশ্য দেখে অভাগীর ভেতরে এক ধরনের ভাবানুভূতির সৃষ্টি হয়। মৃতের শবযাত্রার আড়ম্বরতা ও সৎকারের ব্যাপকতা দেখে অভাগী বিস্মিত হয়। ভাবে, তার মৃত্যুর সময় স্বামীর পায়ের ধূলি নিয়ে মৃত্যুর পর পুত্র কাঙালী মুখাগ্নি করলে সেও স্বর্গে যাবে। তাই অভাগী তার সেই শেষ ইচ্ছার কথাই সন্তানের কাছে বলে।

গ. উদ্দীপকে ‘অভাগীর স্বর্গ’ গল্পে বর্ণিত সামন্তবাদী সমাজচিত্রের ইঙ্গিত রয়েছে।
➠ ‘অভাগীর স্বর্গ’ শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের অসামান্য সৃষ্টি। এখানে অভাগী ও কাঙালীর জবানিতে বর্ণভেদ প্রথা ও দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত মানুষের গভীর আর্তনাদ ও সমাজপতিদের নির্মম নির্যাতনের চিত্র ফুটে উঠেছে। নীচু জাতের দরিদ্র অভাগীর মৃত্যুর পর তার সৎকারের জন্য সামান্য একটু কাঠ তারা পায়নি। কাঙালী জমিদারের গোমস্তা অধর রায়ের কাছে গেলে তাকে সেখান থেকে গলাধাক্কা দিয়ে বের করে দেওয়া হয়। অন্য সমাজপতিররাও করে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য। এভাবে ‘অভাগীর স্বর্গ’ গল্পে বারবার সমান্তবাদী সমাজের নির্মমতা প্রকাশ পেয়েছে।
➠ উদ্দীপকের গফুর দারিদ্র্যের নির্মম কষাঘাতে জর্জরিত। যেখানে বাপ-বেটির অন্ন জোটে না সেখানে অবলা প্রাণী মহেশকে খাওয়াবে কী? মহেশকে বাঁচানোর জন্য পণদশেক বিচুলির জন্য গফুর কর্তামশাইয়ের পায়ে পড়ে কাকুতি মিনতি করেছে। এই কর্তাবাবুদের প্রবল প্রতিপত্তি থাকা সত্ত্বেও গফুরদের কষ্টে ও বুকফাটা আহাজারিতে তাদের প্রাণ কাঁদেনি। ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য সে সমাজে সুস্পষ্ট দেয়াল তুলে দিয়েছিল। এই বৈষম্যপূর্ণ সমাজের চিত্র ‘অভাগীর স্বর্গ’ গল্পে আরো বিস্তৃতভাবে আলোচিত হয়েছে। তাই বলা যায়, সামন্তবাদের নির্মম রূপ উদ্দীপকের সাথে ‘অভাগীর স্বর্গ’ গল্পের সমাজব্যবস্থাকে সাদৃশ্যময় করে তুলেছে।

ঘ. কাঙালী ও গফুর উভয়েই শোষিত শ্রেণির প্রতিনিধি হলেও উভয়ের হৃদয়-বেদনার মাঝে গুণগত পার্থক্য রয়েছে।
➠ ‘অভাগীর স্বর্গ’ গল্পে কাঙালী নিম্নবর্ণের হওয়ার কারণে সমাজপতিরা তার মৃত মায়ের সৎকারে কাঠ ব্যবহার করতে দেয়নি। অভাগী ছেলের হাতের আগুন পেয়ে স্বর্গে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু তারা নিম্নবর্ণের হওয়ার কারণে কাঙালী বারবার ধরনা দিয়েও একটু কাঠ জোগাড় করতে পারেনি। শেষমেশ নদীর চরে অভাগীকে পুঁতে ফেলতে হয়েছে। এতে কাঙালীর কিশোর হৃদয়ে কঠিন আঘাত লেগেছে।
➠ উদ্দীপকে দরিদ্র গফুর ভাগে যেটুকু খড় পেয়েছিল কর্তামশাই গতবারের পাওনার অজুহাতে তা কেড়ে নিয়েছে। বাপ-বেটি না হয় তালপাখার গোঁজাগাজাঁ দিয়ে বর্ষাটা কাটিয়ে দিতে পারবে। কিন্তু মহেশের কী হবে? মহেশ যে না খেয়ে মরে যাবে। এই মানসিক দুর্ভাবনায় আচ্ছন্ন গফুর। দরিদ্র ও মুসলমান হওয়ার কারণেই তার প্রতি জমিদারদের এমন ব্যবহার। সে সমাজে যেন তার মতো গরিবের বাঁচবার অধিকারই নেই।
➠ ‘অভাগীর স্বর্গ’ গল্পে কাঙালীকে মৃত মায়ের সৎকারের জন্য কাঠ দেওয়া হয়নি। দেওয়া হয়েছে গলাধাক্কা । এমন অত্যাচার করা হয়েছে শুধু নীচু জাতের মানুষ হওয়ার অজুহাতে। মাতৃহারা আশ্রয়হীন একটি শিশুর কাকুতি মিনতি সমাজপতিদের মনে কোনো আবেদন সৃষ্টি করেনি। অন্যদিকে গরিব মুসলমান হওয়ার কারণে কর্তাবাবুরা নানা ছুতানাতায় গফুরকে বঞ্চিত করেছে। তবে এখানে গফুর ও কাঙালীর মধ্যে মানসিক যন্ত্রণা ও বেদনার গুণগত পার্থক্য বিদ্যমান। একজন মায়ের সৎকারে কাঠ জোগাড় করতে পারেনি অন্যজন একটি অবোধ প্রাণীর জন্য খড় সংগ্রহ করতে পারেনি। একজনের মাঝে লক্ষ করা যায় মাতৃভক্তি, অন্যজনের মাঝে প্রাণীপ্রীতি।


সৃজনশীল প্রশ্ন- ২

দশ বছরের মা-মরা মেয়ে রাবেয়া গৃহকর্মীর কাজ করে নিজের এবং অসুস্থ বাবার অন্ন সংস্থান করে। চিকিৎসার অভাবে রাবেয়াকে ছেড়ে একদিন বাবা ইহধাম ত্যাগ করেন। দাফন কাফনের খরচ এবং কবরের জায়গা না থাকায় রাবেয়া গাঁয়ের মোড়লের সহযোগিতা চেয়ে খালি হাতে ফিরে আসে। অনন্যোপায় হয়ে বাবার মৃতদেহের পাশে বসে কাঁদতে থাকে। প্রতিবেশী মনসুর এ খবর পেয়ে রাবেয়ার পাশে দাঁড়ায় এবং যাবতীয় ব্যবস্থা করে।

ক. গ্রামের শ্মশানটি কোন নদীর তীরে অবস্থিত?
খ. “তোর হাতের আগুন যদি পাই বাবা, বামুন মার মত আমিও সগ্যে যেতে পাবো।”- উক্তিটি বুঝিয়ে লেখো।
গ. উদ্দীপকে মনসুর এবং ‘অভাগীর স্বর্গ’ গল্পের গোমস্তা অধর রায় একে অন্যের বিপরীত- ব্যাখ্যা করো।
ঘ. উদ্দীপকে ফুটে ওঠা বিষয়টি ছাড়াও ‘অভাগীর স্বর্গ’ গল্পে অন্যান্য বিষয়ের আলোচনা রয়েছে- মন্তব্যটি বিশ্লেষণ করো।

ক. গ্রামের শ্মশানটি গরুড় নদীর তীরে অবস্থিত।
খ. [১ নং সৃজনশীল প্রশ্নের ‘খ’ নং উত্তর দেখো]

গ. ‘অভাগীর স্বর্গ’ গল্পে গোমস্তা অধর রায় অসহায়ের পাশে না দাঁড়ালেও উদ্দীপকের মনসুর রাবেয়াকে সহযোগিতা করে অধর রায়ের বিপরীত চরিত্রকে ধারণ করে।
➠ ‘অভাগীর স্বর্গ’ গল্পে জমিদারের গোমস্তা অধর রায়ের মাঝে সামন্তবাদের নির্মম রূপের প্রকাশ ঘটেছে। সামন্তবাদীরা কখনো হতদরিদ্র মানুষের দুঃখ-দুর্দশা বুঝতে চেষ্টা করে না। তারা সব সময় মানুষকে শোষণ করে নিজের লাভের চিন্তায় মগ্ন থাকে। ফলে অসহায়ের আর্তনাদ তাদের কানে পৌঁছায় না। গল্পের গোমস্তা অধর রায় তেমনই একটি চরিত্র।
➠ উদ্দীপকের মনসুর সামন্তবাদী চরিত্রের বিপরীত রূপকে ধারণ করে। কেননা সামন্তবাদীরা নিজের স্বার্থবাদী চিন্তায় মগ্ন থাকলেও মনসুর তা করেনি। সে প্রতিবেশী অসহায় রাবেয়ার পাশে দাঁড়িয়েছে। রাবেয়া মৃত বাবার দাফনের জন্য যখন কোনো সহযোগিতা পায়নি তখন মনসুর সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু ‘অভাগীর স্বর্গ’ গল্পে অধর রায়কে আমরা অসহায়ের পাশে দাঁড়াতে দেখিনি। সে উল্টো সাহায্যপ্রার্থীকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। তাই বলা যায়, উদ্দীপকের মনসুর এবং ‘অভাগীর স্বর্গ’ গল্পের গোমস্তা অধর রায় একে অন্যের বিপরীত চরিত্র।

ঘ. উদ্দীপকে ফুটে ওঠা সামন্তবাদী সমাজচিত্র ছাড়াও ‘অভাগীর স্বর্গ’ গল্পে কাঙালীর মাতৃভক্তি এবং সমাজের নীচু শ্রেণির মানুষের দুর্দশার চিত্র দরদি ভাষায় বর্ণিত হয়েছে।
➠ ‘অভাগীর স্বর্গ’ গল্পে কাঙালী সমাজের হতদরিদ্র মানুষের প্রতিনিধি। সমাজের সামন্তবাদী মানসিকতা একটি কিশোরের হৃদয়ে কীভাবে সমাজের প্রতি নেতিবাচক ধারণা তৈরি করে তার সকরুণ চিত্র গল্পে অঙ্কিত হয়েছে। এছাড়া কাঙালীর মাতৃভক্তি এবং মায়ের শেষ ইচ্ছা পূরণে সচেষ্ট এক কিশোরের কাহিনি এই গল্পের প্রতিপাদ্য।
➠ উদ্দীপকে দরিদ্র মানুষের অসহায়ত্বের চিত্র রূপায়িত হলেও ‘অভাগীর স্বর্গ’ গল্পটি আরও নানা দিক থেকে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। গল্পের কাঙালীর মাতৃভক্তি পাঠক হৃদয়ে যে চেতনার অবতারণা ঘটায় উদ্দীপকে তা অনুপস্থিত। তাছাড়া গল্পে মুখুয্যেবাড়ির আড়ম্বরতা ও সৎকারের ব্যাপকতা সমাজের ধনী শ্রেণির বিলাসিতার চিত্র তুলে ধরে, যা উদ্দীপকে আলোচনা করা হয়নি। উদ্দীপকে কেবল একটি অসহায় মানুষের আহাজারির চিত্র অঙ্কিত হয়েছে।
➠ ‘অভাগীর স্বর্গ’ গল্পে প্রকাশিত হয়েছে সমাজের অন্ত্যজ শ্রেণির মানুষের মর্মবেদনার স্বরূপ। তাদের প্রতি সমাজপতিদের নির্মম আচরণের পরিচয়ও তুলে ধরা হয়েছে। উদ্দীপকটি এদিক থেকে গল্পের সাথে মিলে যায়। কিন্তু গল্পে কাঙালীর মাতৃভক্তি, মানুষের ধর্মবিশ্বাস ইত্যাদি বিষয় উঠে এলেও উদ্দীপকে তেমন কিছুর উল্লেখ নেই। তাই বলা যায়, মন্তব্যটি যথার্থ।


সৃজনশীল প্রশ্ন- ৩

ফটিক বারো-তেরো বছরের এক কিশোর বালক। নতুনকে জানার দুর্বার আকর্ষণ নিয়ে সে কলকাতায় আসে। কিন্তু এখানকার পরিবেশের সঙ্গে গ্রামের ফটিক খাপ খাওয়াতে পারে না। তার বারবার মনে পড়ে স্নেহময়ী ময়ের কথা। মায়ের কোলে ফিরে যাওয়ার তীব্র ইচ্ছায় সে একদিন সকল বন্ধন ছিন্ন করে। মায়ের কাছে ফিরে যাওয়ার আশায় থেকে একদিন সবার কাছ থেকে চিরদিনের জন্য ছুটি নিয়ে অসীমের পথে যাত্রা করে।

ক. ‘অশন’ শব্দটির অর্থ কী?
খ. মরণকালে স্ত্রীকে পায়ের ধুলো দিতে গিয়ে রসিক কেঁদে ফেলল কেন?
গ. উদ্দীপকের ফটিকের সঙ্গে ‘অভাগীর স্বর্গ’ গল্পের কাঙালী চরিত্রের সাদৃশ্য ব্যাখ্যা করো।
ঘ. উক্ত সাদৃশ্যের দিকটি ‘অভাগীর স্বর্গ’ গল্পের সমাজবাস্তবতাকে তুলে ধরতে সহায়তা করলেও উদ্দীপকে তা ঘটেনি। উক্তিটি বিশ্লেষণ করো।

ক. ‘অশন’ শব্দটির অর্থ হলো খাদ্যদ্রব্য।
খ. অভাগীকে পায়ের ধুলা দিতে গিয়ে তার প্রতি নিজের অবহেলার অনুশোচনায় রসিক দুলে কেঁদে ফেলল।
➠ রসিক দুলে অভাগীকে ফেলে আরেকটা বিয়ে করে অন্য গ্রামে চলে গিয়েছিল। কিন্তু অভাগী ছেলেকে বুকে জড়িয়ে একাই গ্রামে থেকে যায়। মৃত্যুকালে সে সেই স্বামীর পায়ের ধুলা নিতেই উদগ্রীব হয়ে ওঠে। কিন্তু যে স্ত্রীকে রসিক দুলে ভাত-কাপড় দেয়নি; কখনো যার খোঁজখবর নেয়নি তার এই পতিভক্তি রসিক দুলেকে অনুশোচনায় পোড়ায়। এজন্য পায়ের ধুলা দিতে গিয়ে সে গভীর কষ্টে কেঁদে ফেলে।

গ. মাতৃভক্তির দিক থেকে উদ্দীপকের ফটিকের সঙ্গে ‘অভাগীর স্বর্গ’ গল্পের কাঙালীর সাদৃশ্য রয়েছে।
➠ ‘অভাগীর স্বর্গ’ গল্পের কাঙালী পনেরো বছরের এক কিশোর। এ পৃথিবীতে মা তার একমাত্র আপনজন । মাকে সে ভালোবাসে প্রচণ্ডভাবে। তাই মায়ের অসুস্থতার সময় সে ব্যাকুল হয়ে কবিরাজের কাছে গিয়েছে। এমনকি মায়ের শেষ ইচ্ছা পূরণ করতে গিয়ে জমিদারের গোমস্তা দ্বারা লাঞ্ছনা ও অত্যাচারের শিকার হয়েছে।
➠ উদ্দীপকের ফটিক গ্রামের এক দুরন্ত কিশোর। মাকে গভীরভাবে ভালোবাসে বলেই মাকে ছেড়ে শহরে এসে সে থাকতে পারেনি। বারবার মায়ের কাছে ফিরে যেতে চেয়েছে। মায়ের কাছে ফিরে যাওয়ার তীব্র ইচ্ছায় সে একদিন সকল বন্ধন ছিন্ন করে পৃথিবী থেকে চলে যায়। মায়ের প্রতি ভালোবাসার দিক থেকে উদ্দীপকের ফটিক ও ‘অভাগীর স্বর্গ’ গল্পের কাঙালীর চরিত্রটি সাদৃশ্যপূর্ণ।

ঘ. মায়ের কথা রাখতে গিয়ে কাঙালি সমাজের জাতিভেদ প্রথার নিষ্ঠুরতাকে উপলব্ধি করেছে। কিন্তু উদ্দীপকে তেমন কোনো চিত্র আমরা পাই না।
➠ ‘অভাগীর স্বর্গ’ গল্পে পনেরো বছরের কিশোর কাঙালী। এ পৃথিবীতে তার মা ছাড়া আর আপন কেউ ছিল না। মা ছিল তার সব কিছু। মায়ের মৃত্যুর পর মায়ের শেষ ইচ্ছা পূরণ করতে গিয়ে কাঙালী সামন্তবাদের নির্মম রূপ দেখে। মায়ের প্রতি অগাধ ভালোবাসার সূত্র ধরেই সে পরিচিত হয় স্বার্থমগ্ন সমাজব্যবস্থার নির্মমতার সঙ্গে।
➠ উদ্দীপকের ফটিক অত্যন্ত মাতৃভক্ত। মাকে ছেড়ে শহরে এসে সে একা হয়ে যায়। তার কিশোর হৃদয় মাকে দেখার জন্য, মাকে কাছে পাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে। মাকে দেখার তীব্র ইচ্ছায় একদিন সে পৃথিবীর সঙ্গে সকল বন্ধন ছিন্ন করে স্বর্গে পাড়ি জমায়। ‘অভাগীর স্বগর্’ গল্পে মায়ের জন্য এমন গভীর অনুরাগের কথা বলা হলেও গল্পে বর্ণিত সমাজব্যবস্থার ঘৃণ্য মনোভাবের চিত্র প্রকাশ পায়নি উদ্দীপকে।
➠ গল্পের কাঙালী মায়ের শেষ ইচ্ছা পূরণ করতে গিয়ে দেখেছে সমাজের বিত্তবানরা কতটুকু নির্মম হয়। গল্পকার কাঙালীর অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে আমাদের সামনে জাতভেদ ও মানুষের সংকীর্ণ মানসিকতার চিত্র তুলে ধরেছেন। ছেলের হাতের আগুনটুকু পাবেন- এইটুকুই ছিল কাঙালীর মায়ের অন্তিম আকাক্সক্ষা। অথচ সামান্য কাঠের অভাবে কাঙালী পারল না মায়ের কথা রাখতে। রক্ষণশীল হিন্দু সমাজের ঘৃণ্য জাতিপ্রথা আর স্বার্থান্ধ মানুষের অমানবিকতার শিকার হয় সে পদে পদে। অল্প সময়ের ব্যবধানেই বুঝে যায় তাদের মতো হতদরিদ্র, নীচু জাতির মানুষের আশা-আকাক্সক্ষার কোনো মূল্য নেই এই সমাজে। কিন্তু উদ্দীপকে রয়েছে কেবল মায়ের জন্য গভীর মমত্ববোধের কথা। সে মমতার টানে ফটিক নিজের জীবন বিসর্জন দেয়। সমাজের বিশেষ কোনো অসংগতির চিত্র উদ্দীপকে নেই। তাই বলা যায়, আলোচ্য উক্তিটি যথার্থ।


সৃজনশীল প্রশ্ন- ৪

মালেক সাহেবের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির দেখাশোনা করেন সামাদ। প্রতিবছর তিনি মালিকের পক্ষ থেকে ভাড়াটিয়াদের মাঝে ঈদে-পূজায় বস্ত্র ও খাদ্য বিতরণ করেন। প্রয়োজনে দারোয়ানকে ভাড়াটিয়াদের মেয়ের বিয়ে, ছেলেমেয়েদের স্কুলে আনা-নেওয়া, বাজার করা, দাফন-কাফনসহ সব কাজে ব্যবহার করান।

ক. কাঙালীর মা কোন জাতের মেয়ে ছিল?
খ. দারোয়ান রসিক দুলেকে চড় মারল কেন?
গ. উদ্দীপকের সামাদ ও ‘অভাগীর স্বর্গ’ গল্পের জমিদারের গোমস্তার বৈসাদৃশ্য দেখাও।
ঘ. গল্পের উল্লিখিত গ্রামের পরিস্থিতি যদি উদ্দীপকের সাথে মিলতো তাহলে গল্পের পরিণতি এমন হতো না-উক্তিটি বিশ্লেষণ করো।

ক. কাঙালীর মা দুলে জাতের মেয়ে ছিল।
খ. রসিক দুলে অনুমতি ছাড়া বেলগাছ কাটতে যাওয়ায় দারোয়ান তাকে চড় মারল।
➠ অভাগী মৃত্যুর সময় কাঙালীর হাতের আগুন পাওয়ার অভিলাষ ব্যক্ত করে গেছে। তার সৎকারের জন্য কাঠ প্রয়োজন ছিল। রসিক দুলে স্ত্রীর শেষ ইচ্ছা পূরণের জন্য বাড়ির উঠানের বেলগাছটা তাই কাটতে গিয়েছিল। কিন্তু সামন্তবাদী নিয়মে জমিদারের অনুমতি ছাড়া সে গাছ কাটতে পারবে না। এমনকি নিজ বাড়ির আঙিনায় নিজ হাতে পোঁতা হলেও নয়। এজন্য বেলগাছটি কাটতে গেলে দারোয়ান তাকে চড় মেরে বসে।

গ. মানুষের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শনের দিক থেকে উদ্দীপকের সামাদের সাথে জমিদারের গোমস্তার চরিত্র পুরোপুরি বিপরীত।
➠ ‘অভাগীর স্বর্গ’ গল্পে বর্ণিত কাঙালীর মা মারা গেলে তাকে দাহ করার জন্য গাছের আবেদন জানাতে কাঙালী ছুটে যায় জমিদার গোমস্তার বাড়িতে। একটা বেলগাছের জন্য অনেক অনুরোধ করে গোমস্তাকে। গাছটি ছিল কাঙালীর মায়ের হাতে লাগানো। অথচ কাঙালী তাও পেল না ঘুষ দিতে না পারায়। গোমস্তা অধর রায় গাছ তো দিলই না উল্টো কাঙালীকে গালমন্দ ও প্রহার করে তাড়িয়ে দিল। কাঙালী নীচু জাতের জানার পর তার প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করল।
➠ উদ্দীপকে বর্ণিত সামাদ পরোপকারী ব্যক্তি। তার মধ্যে কোনো ধর্মীয় ভেদাভেদ ছিল না। ভাড়াটিয়াদের যেকোনো কাজে সে এগিয়ে আসত। বাড়িওয়ালার প্রতিনিধি হলেও সে মনুষ্যত্ববোধের অধিকারী ছিল। কিন্তু গল্পের জমিদারের গোমস্তা ছিল শোষক ও বর্ণবাদী শ্রেণির অন্তর্গত।

ঘ. ‘অভাগীর স্বর্গ’ গল্পে বর্ণিত গ্রামের মানুষরা যদি উদ্দীপকের সামাদের মতো মানবতাসম্পন্ন হতো তবে গল্পের পরিণতি এমন দুঃখভরা হতো না।
➠ ‘অভাগীর স্বর্গ’ গল্পে মুখুয্যের স্ত্রীর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার আতিশয্য দেখে কাঙালীর মা স্বপ্ন দেখে স্বর্গে যাওয়ার। তারও ইচ্ছে জাগে ছেলের হাতের মুখাগ্নি পাওয়ার। কাঙালীর মা ছিল তথাকথিত দুলে জাতের মেয়ে। নীচু জাতের ধোঁয়া তুলে কেড়ে নেওয়া হয় তার স্বপ্ন। কাঙালী যখন মায়ের ইচ্ছে পূরণে জমিদার বাড়িতে কাঠ চাইতে যায় তখন হেনস্তা হতে হয় তাকে। একদিকে জমিদারের গোমস্তার অসহযোগিতা অন্যদিকে অন্ধ সমাজ। কাঙালীর মায়ের অন্তিম ইচ্ছা আর পূরণ হয় না। ➠ উদ্দীপকের সামাদ মানবিকবোধে উজ্জ্বল। মালেক সাহেব তাঁকে সমস্ত সম্পত্তি দেখাশোনার দায়িত্বে নিয়োজিত করেছেন। কিন্তু সামাদ সেই ক্ষমতার অপব্যবহার করেন না। বরং ভাড়াটিয়াদের নানা কাজে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। তাঁর অধীনে থাকা দারোয়ানকেও নানা সেবামূলক কাজে লাগান। কিন্তু ‘অভাগীর স্বর্গ’ গল্পে বর্ণিত গ্রামের চিত্র এর তুলনায় সম্পূর্ণই বিপরীত।
➠ ‘অভাগীর স্বর্গ’ গল্পে দেখা যায় সামন্তবাদের নির্মম রূপ। ক্ষমতার অহংকারে জমিদারের গোমস্তা হয়ে ওঠে মহাপ্রতাপশালী। মানুষকে সে মানুষ বলে মনে করে না। এমনকি তার চাকর ও দারোয়ানরাও ক্ষমতার অপব্যবহার করে। সমাজে জাতিভেদপ্রথার কারণে তথাকথিত নীচু জাতের মানুষের সাথে জন্তুর মতো আচরণ করা হয়। কিন্তু উদ্দীপকে আমরা দেখতে পাই মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসার উদাহরণ। মানুষের সেবা করার ক্ষেত্রে সামাদ বিবেচনা করেননি কে হিন্দু কে মুসলিম। মালিক অনুপস্থিত থাকলেও তার সুযোগ নেননি তিনি। বরং নিজের অধীন কর্মকারীদের ভালো কাজে ব্রতী করেছেন। গল্পে বর্ণিত গ্রামের মানুষেরা এমন মনোভাব পোষণ করলে মূল্য পেত কাঙালীর মায়ের অন্তিম ইচ্ছা। কিশোর কাঙালীকে বরণ করতে হতো না নির্মম মানসিক ও শারীরিক যাতনা। গোটা সমাজই হতো মানবিক, সুন্দর।


সৃজনশীল প্রশ্ন- ৫

মন্টু বাসে বাসে চকলেট বিক্রি করে। তার বোনের বিয়ের জন্য বেশ কিছু টাকার প্রয়োজন। সেদিন বাসে এক ভদ্রলোকের হাত ধরে দুটো চকলেট নেওয়ার জন্য অনুনয় করে মন্টু। “এই ছোটলোকের বাচ্চা, আমার গায়ে হাত দিলি কেন?” বলেই লোকটি মন্টুর গলায় সজোরে ধাক্কা দেয়। পড়ে গিয়ে মন্টু মাথায় ভীষণ আঘাত পায়। তিন মাস ধরে জমানো সব টাকা খরচ হয়ে যায় চিকিৎসায়। বোনটাকে আর বিয়ে দেওয়া হয় না তার।

ক. কাঙালীর বাবা কোন গাছ কাটতে উদ্যত হয়েছিল?
খ. ‘দুলের মড়ার কাঠ কী হবে শুনি?’- অধর রায় এ কথা কেন বললেন?
গ. উদ্দীপকে ‘অভাগীর স্বর্গ’ গল্পের যে দিকটি ফুটে উঠেছে তা ব্যাখ্যা করো।
ঘ. উদ্দীপকের মণ্টুর স্বপ্নভঙ্গের কারণটি ‘অভাগীর স্বর্গ’ গল্পের আলোকে বিশ্লেষণ করো।

ক. কাঙালীর বাবা বেলগাছ কাটতে উদ্যত হয়েছিল।
খ. সামন্তবাদী চেতনার ধারক হওয়ায় অধর রায় প্রশ্নোক্ত কথাটি বলেছেন।
➠ ‘অভাগীর স্বর্গ’ গল্পে সামন্তবাদী সমাজবাস্তবতার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। সেখানে কাঙালী মায়ের মৃতদেহ সৎকারের জন্য কাঠ পাওয়ার আশায় বিভিন্ন জায়গায় ধরনা দেয়। কিন্তু সবাই তাকে নিরাশ করে। কারণ কাঙালীরা দুলে। আর দুলেরা নীচু জাত হওয়ায় সমাজপতিদের মতে তাদের মড়া পোড়ানোর প্রয়োজন নেই। এমন বর্ণবাদী চেতনা পোষণ করার কারণেই অধর রায় কাঙালীকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্নোক্ত কথাটি বলেন।

গ. উদ্দীপকে ‘অভাগীর স্বর্গ’ গল্পের জাতভেদ প্রথার দিকটি ফুটে উঠেছে।
➠ ‘অভাগীর স্বর্গ’ গল্পে আমরা লক্ষ করি সমাজের উঁচু শ্রেণির মানুষের মৃত্যুর পর তাদের সৎকার হয় মহা আয়োজনে। কিন্তু দরিদ্র ও নীচু জাত হওয়ার কারণে অভাগীর মুখাগ্নি করার জন্য তার ছেলে কাঙালী কাঠ সংগ্রহ করতে পারেনি। বরং কাঠ সংগ্রহ করতে গেলে কাঙালী ও তার বাবা অপমানিত ও নিগৃহীত হয়।
➠ উদ্দীপকে বর্ণিত মন্টু বোনের বিয়ে দেওয়ার জন্য বাসে বাসে চকলেট বিক্রি করে। বাসে এক ভদ্রলোকের হাত ধরে অনুনয়-বিনয় করলে ‘কথিত’ ভদ্রলোকটি তাকে ছোটলোক বলে অপমান ও তিরস্কার করে। শুধু তাই নয়, সজোরে গলাধাক্কা দিলে মন্টু পড়ে গিয়ে মারাত্মক আহত হয়। মন্টুকে নিজের চিকিৎসায় জমানো সব টাকা খরচ করতে হয়। কথিত ভদ্রলোকটির আচরণ ‘অভাগীর স্বর্গ’ গল্পের সামন্ত জমিদারের মতোই অমানবিক ও নিষ্ঠুর। উদ্দীপকে ভদ্রলোকটির কারণে মন্টু তার অসহায় অবস্থা থেকে আরো অসহায় হয়ে পড়ল। তার দরিদ্রতার জন্য ওই লোকটি তাকে ছোটলোকের বাচ্চা বলে গালি দিয়েছিল। ‘অভাগীর স্বর্গ’ গল্পের কাঙালী তার মায়ের অন্তিম ইচ্ছে পূরণ করতে পারেনি জমিদার ও তার লোকদের কারণে। নীচু জাত বলে মায়ের মুখাগ্নি পর্যন্ত করতে পারেনি। উল্টো তাকে শারীরিক ও মানসিকভাবে নিগৃহীত হতে হয়েছে। তাই উদ্দীপকে ‘অভাগীর স্বর্গ’ গল্পের জাতভেদ প্রথার দিকটি উল্লিখিত হয়েছে।

ঘ. ‘অভাগীর স্বর্গ’ গল্পে উল্লিখিত জাতভেদ প্রথার নির্মমতার শিকার হওয়াই মন্টুর স্বপ্নভঙ্গের কারণ।
➠ সমাজে উঁচু-নীচু আর জাতভেদ প্রথা কীভাবে মানুষের জীবনকে বিষিয়ে তোলে, কীভাবে নিষ্ঠুরতা আর অপমান বিষণœতার জন্ম দেয়, তার প্রমাণ ‘অভাগীর স্বর্গ’ গল্প। নীচু জাত বলে মায়ের মুখাগ্নি করার কাঠ পর্যন্ত সংগ্রহ করতে পারেনি কাঙালী। অভাগীর হাতে লাগানো উঠানের বেলগাছ কাটতে গেলে কাঙালীর বাবার গালে কষে চড় মারে জমিদারের লোক। কাঠের জন্য কাঙালী জমিদারের গোমস্তার কাছে ছুটে গেলেও তার কপালে জুটেছে গালি আর লাঞ্ছনা। মৃত মায়ের অন্তিম ইচ্ছে পূরণ করতে না পারার যন্ত্রণায় সে দগ্ধ হয়েছে।
➠ সমাজে গরিব দুঃখী অনাথদের দেখে নাক সিঁটকানো, অবজ্ঞা বা দুর্ব্যবহার করার অভ্যাস কারো কারো মাঝে বিদ্যমান। উদ্দীপকে বর্ণিত ভদ্রলোকের মাঝে যেমনটা রয়েছে। অসহায় হয়ে মন্টু হাত ধরে দুটো চকলেট নেওয়ার আবদার করায় তাকে গলা ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়ে লোকটি যে পশুত্বের পরিচয় দিয়েছে তা নিন্দনীয় ও বড় ধরনের অপরাধ।
➠ কাঙালী তার দুঃখীনি মায়ের অন্তিম ইচ্ছে পূরণ করতে পারেনি সমাজের মিথ্যে আভিজাত্যের অহংকারে নিমগ্ন কিছু নির্দয় মানুষের কারণে। বংশগৌরব ও আভিজাত্য তাদের পশুর স্তরে নিয়ে গিয়েছে। কাঙালীর ভেতরের কষ্ট ও আর্তনাদ তাদের বিবেককে এতটুকু নাড়া দিতে পারেনি। একইভাবে উদ্দীপকে বর্ণিত ভদ্রলোক নামধারী লোকটির নিষ্ঠুরতায় মন্টুর স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। বোনের বিয়ে দূরে থাক তার জীবন নিয়েই সংকটে পড়ে সে। এ ধরনের নরপিশাচরাই সমাজে নানা অনাচারের সৃষ্টি করে থাকে। জাতিভেদ প্রথার কারণে একদিকে কাঙালী তার মায়ের শেষ ইচ্ছে পূরণে ব্যর্থ হয়েছে অন্যদিকে মন্টুরও স্বপ্ন ভেঙেছে তার বোনকে বিয়ে দিয়ে সুখী করতে না পারায়।


সৃজনশীল প্রশ্ন- ৬

জাত গেল, জাত গেল বলে
একি আজব কারখানা।
সত্য কাজে কেউ নয় রাজি,
সবই দেখি তা না না না।

ক. কাঙালী কোন জাতের অন্তর্ভুক্ত?
খ. কাঙালী তার মাকে আগুন দিতে পারল না কেন?
গ. উদ্দীপকটি কোন দিক থেকে ‘অভাগীর স্বর্গ’ গল্পের প্রতিনিধিত্ব করে? ব্যাখ্যা করো।
ঘ. “উদ্দীপকটির মূলভাব ‘অভাগীর স্বর্গ’ গল্পের পূর্ণাঙ্গ ভাবের প্রকাশক”। মতামত দাও।

ক. কাঙালী দুলে জাতের অন্তর্ভুক্ত।
খ. সামন্তবাদী সমাজব্যবস্থার নিষ্ঠুরতার কারণে কাঙালী তার মাকে আগুন দিতে পারল না।
➠ কাঙালীর মায়ের শখ ছিল মৃত্যুর পর মুখুয্যে বাড়ির গিন্নির মতো ছেলের হাতের আগুন পাওয়ার। কিন্তু তার মৃত্যুর পর ছেলে কাঙালী মায়ের সেই আশা পূরণ করতে পারে না। কাঙালীরা নীচু জাতের মানুষ হওয়ায় সামন্তবাদী সমাজে মৃতদেহ সৎকারে আগুন দেওয়ার নিয়ম নেই। তবুও কাঙালী নানাভাবে থাকে আগুন দেয়ার জন্য কাঠ সংগ্রহের চেষ্টা করলে সকলেই তাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে। জমিদারের গোমস্তা ঘুষ চায়। অবশেষে বাধ্য হয়ে কাঙালীরা অভাগীকে নদী চড়ায় পুঁতে ফেলে।

গ. উদ্দীপকের ভাবটি জাতভেদ প্রথা পালনের দিক থেকে ‘অভাগীর স্বর্গ’ গল্পকে প্রতিনিধিত্ব করে।
➠ ‘অভাগীর স্বর্গ’ গল্পে বর্ণিত অভাগী মুখুয্যে বাড়ির গৃহকর্ত্রীর মৃত্যুর পর সৎকারের দৃশ্য দেখে ভেবেছিল মৃত্যুর পর গেলে পুত্র মুখাগ্নি করলে সেও স্বর্গে যাবে। কাঙালী বাবাকে হাজির করতে পারলেও পারেনি মায়ের সৎকারের কাঠ জোগাড় করতে। পারে নি জাতভেদ প্রথার নিষ্ঠুরতার শিকার হওয়ায়।
➠ উদ্দীপকের রচয়িতা জাতভেদ প্রথা দেখে বিস্মিত হয়েছেন। মানুষ জাতভেদ প্রথার বশবর্তী হয়ে যে কর্মকাণ্ড করে তাকে হাস্যকর বলে জ্ঞান করেছেন। মানুষ তার সত্য কাজ বা কর্তব্য কাজকে ফলে রেখে অনর্থক বা অপ্রয়োজনীয় বিষয় নিয়ে ব্যস্ত রয়েছে। জাতভেদ প্রথায় মানুষ মানুষকে হেয়প্রতিপন্ন করে। এই জাতভেদ প্রথার কারণেই গল্পের কাঙালীর কচি মন ভেঙে চুরমার হয়ে গিয়েছে। তাঁর মমতাময়ী মাকে যথাযথভাবে শেষকৃত্য না করে মাটিচাপা দেওয়া হয়েছে। তাই উদ্দীপকের ভাবটি জাতভেদ প্রথা পালনের দিক থেকে ‘অভাগীর স্বর্গ’ গল্পকে প্রতিনিধিত্ব করে।

ঘ. উদ্দীপক ও ‘অভাগীর স্বর্গ’ গল্পের মূলকথা সমাজে উঁচু-নীচু জাতভেদ প্রথার ভয়াবহতার দিকটি তুলে ধরা। আলোচ্য উদ্দীপক তাই অভাগীর স্বর্গ গল্পের পূর্ণাঙ্গ ভাবের প্রকাশক।
➠ ‘অভাগীর স্বর্গ’ গল্পে গরিব-দুঃখী নীচু শ্রেণির এক নারী অভাগী। উঁচু জাতের মুখুয্যেবাড়ির গৃহকর্ত্রীর মৃত্যুর পর তার সৎকার করা হয়েছিল আড়ম্বরপূর্ণ পরিবেশে। নীচু জাতের বলে অভাগীকে তা দূরে দাঁড়িয়ে দেখতে হয়। স্বর্গপ্রাপ্তির আশায় অভাগী তার ছেলে কাঙালীকে বলেছিল তাকে মৃত্যুর পর মুখাগ্নি করতে। প্রচলিত সমাজব্যবস্থার নিয়ম ভেঙে কাঙালী নীচু জাতের হয়ে মায়ের সৎকার করতে পারেনি, পারেনি মুখাগ্নি করতে।
➠ উদ্দীপকে জাতভেদ নিয়ে জীবনের চরম সত্যকে তুলে ধরা হয়েছে। যারা জাত গেল জাত গেল বলে চিৎকার করে তারা কখনও সমাজের মঙ্গল চিন্তা করতে পারে না। তারা জাতের নামে সমাজকে বহুধা বিভক্ত করে রাখে। তারা মনুষ্যত্ব ও মানসিকতাকে বিকশিত করতে দেয় না। তাই সমাজে এত ভাঙন, বিপর্যয় ও বিশৃঙ্খলা।
➠ একই রক্তমাংসের মানুষ হয়েও মানুষে মানুষে অসংখ্য ভেদাভেদ। একদল আরেক দলকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে দূর দূর করে। ‘অভাগীর স্বর্গ’ গল্পে দেখি একটি সামান্য সৎকার করার কাজ নিয়ে কত বিপত্তি ঘটে গেল। নিজের বাড়ির উঠানের বেলগাছ কাটতে দিল না শক্তির উন্মত্ততায় আর বংশের আভিজাত্যতায়। নীচু জাতের মানুষের যেন ধর্মীয় ও মানবিক অধিকার নেই। উদ্দীপকেও একই ভাবে জাতভেদ প্রথার কথা তুলে ধরা হয়েছে। তাই উদ্দীপকটির মূলভাব ‘অভাগীর স্বর্গ’ গল্পের পূর্ণাঙ্গ ভাবের প্রকাশক।


তথ্যসূত্র :
১. বাংলা সাহিত্য: নবম-দশম শ্রেণি, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড, ঢাকা, ২০২৫।
২. আধুনিক বাংলা অভিধান: বাংলা একাডেমি, এপ্রিল, ২০১৮।
৩. ব্যবহারিক বাংলা অভিধান: বাংলা একাডেমি, ১৮তম, ২০১৫।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url