‘মমতাদি’ গল্পের মূলপাঠ, শব্দার্থ, মূলভাব, বহুনির্বাচনি প্রশ্ন ও সৃজনশীল প্রশ্ন-উত্তর

মমতাদি
মমতাদি

মমতাদি
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়

শীতের সকাল। রোদে বসে আমি স্কুলের পড়া করছি, মা কাছে বসে ফুলকপি কুটছেন। সে এসেই বলল, আপনার রান্নার জন্য লোক রাখবেন? আমি ছোটো ছেলে-মেয়েও রাখব।

নিঃসঙ্কোচ আবেদন। বোঝা গেল সঙ্কোচ অনেক ছিল, প্রাণপণ চেষ্টায় অতিরিক্ত জয় করে ফেলেছে। তাই যেটুকু সঙ্কোচ নিতান্তই থাকা উচিত তাও এর নেই।

বয়স আর কত হবে, বছর তেইশ। পরনে সেলাই করা ময়লা শাড়ি, পাড়টা বিবর্ণ লাল। সীমান্ত পর্যন্ত ঘোমটা, ঈষৎ বিশীর্ণ মুখে গাঢ় শ্রান্তির ছায়া, স্থির অচঞ্চল দুটি চোখ। কপালে একটি ক্ষত-চিহ্ন-আন্দাজে পরা টিপের মতো।

মা বললেন, তুমি রাঁধুনি?

চমকে তার মুখ লাল হলো। সে চমক ও লালিমার বার্তা বোধহয় মার হৃদয়ে পৌঁছল, কোমল স্বরে বললেন, বোসো বাছা।

সে বসল না। অনাবশ্যক জোর দিয়ে বলল, হ্যাঁ আমি রাঁধুনি। আমায় রাখবেন? আমি রান্না ছাড়া ছোটো ছোটো কাজও করব।

মা তাকে জেরা করলেন। দেখলাম সে ভারি চাপা। মার প্রশ্নের ছাঁকা জবাব দিল, নিজে থেকে বাড়ি থেকে খানিক দূরে একটি কথা বেশি কইল না। সে বলল, তার নাম মমতা। আমাদের জীবনময়ের গলি, গলির ভেতরে সাতাশ নম্বর বাড়ির একতলায় সে থাকে। তার স্বামী আছে আর একটি ছেলে। স্বামীর চাকরি নেই চার মাস, সংসার আর চলে না, সে তাই পর্দা ঠেলে উপার্জনের জন্য বাইরে এসেছে। এই তার প্রথম চাকরি। মাইনে? সে তা জানে না। দুবেলা রেঁধে দিয়ে যাবে, কিন্তু খাবে না।

পনের টাকা মাইনে ঠিক হলো। সে বোধহয় টাকা বারো আশা করেছিল, কৃতজ্ঞতায় দুচোখ সজল হয়ে উঠল। কিন্তু সমস্তটুকু কৃতজ্ঞতা সে নীরবেই প্রকাশ করল, কথা কইল না।

মা বললেন, আচ্ছা, তুমি কাল সকাল থেকে এসো।

সে মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানিয়ে তৎক্ষণাৎ চলে গেল। আমি গেটের কাছে তাকে পাকড়াও করলাম।

শোন। এখুনি যাচ্ছ কেন? রান্নাঘর দেখবে না? আমি দেখিয়ে দিচ্ছি এসো।

কাল দেখবো, বলে সে এক সেকেন্ড দাঁড়াল না, আমায় তুচ্ছ করে দিয়ে চলে গেল। ওকে আমার ভালো লেগেছিল, ওর সঙ্গে ভাব করতে ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলাম, তবু, আমি ক্ষুণ্ণ হয়ে মার কাছে গেলাম। একটু বিস্মিত হয়েও। যার অমন মিষ্টি গলা, চোখে মুখে যার উপচে পড়া স্নেহ, তার ব্যবহার এমন রূঢ়!

মা বললেন, পিছনে ছুটেছিলি বুঝি ভাব করতে? ভাবিস না, তোকে খুব ভালোবাসবে। বার বার তোর দিকে এমন করে তাকাচ্ছিলো!

শুনে খুশি হলাম। রাঁধুনি পদপ্রার্থিনীর স্নেহ সেদিন অমন কাম্য মনে হয়েছিল কেন বলতে পারি না।

পরদিন সে কাজে এল। নীরবে নতমুখে কাজ করে গেল। যে বিষয়ে উপদেশ পেল পালন করল, যে বিষয়ে উপদেশ পেল না নিজের বুদ্ধি খাটিয়ে সুন্দরভাবে সম্পন্ন করল- অনর্থক প্রশ্ন করল না, নির্দেশের অভাবে কোনো কাজ ফেলে রাখল না। সে যেন বহুদিন এ বাড়িতে কাজ করছে বিনা আড়ম্বরে এমন নিখুঁত হলো তার কাজ।

কাজের শৃঙ্খলা ও ক্ষিপ্রতা দেখে সকলে তো খুশি হলেন, মার ভবিষ্যৎ বাণী সফল করে সে যে আমায় খুব ভালোবাসবে তার কোনো লক্ষণ না দেখে আমি হলাম ক্ষুণ্ণ। দুবার খাবার জল চাইলাম, চার পাঁচ বার রান্নাঘরে গিয়ে দাঁড়ালাম, কিন্তু কিছুতেই সে আমায় ভালোবাসল না। বরং রীতিমতো উপেক্ষা করল। শুধু আমাকে নয় সকলকে। কাজগুলিকে সে আপনার করে নিল, মানুষগুলির দিকে ফিরেও তাকাল না। মার সঙ্গে মৃদুস্বরে দু একটি দরকারি কথা বলা ছাড়া ছটা থেকে বেলা সাড়ে দশটা অবধি একবার কাশির শব্দ পর্যন্ত করল না। সে যেন ছায়াময়ী মানবী, ছায়ার মতোই স্লানিমার ঐশ্বর্যে মহীয়সী কিন্তু ধরাছোঁয়ার অতীত শব্দহীন অনুভূতিহীন নির্বিকার।

রাগ করে আমি স্কুলে চলে গেলাম। সে কি করে জানবে মাইনে করা রাঁধুনির দূরে থাকাটাই সকলে তার কাছে আশা করছে না, তার সঙ্গে কথা কইবার জন্য বাড়ির ছোটোকর্তা ছটফট করেছে!

সপ্তাহখানেক নিজের নতুন অবস্থায় অভ্যস্ত হয়ে যাওয়ার পর সে আমার সঙ্গে ভাব করল।

বাড়িতে সেদিন কুটুম এসেছিল, সঙ্গে এসেছিল এক গাদা রসগোল্লা আর সন্দেশ। প্রকাশ্য ভাগটা প্রকাশ্যে খেয়ে ভাঁড়ার ঘরে গোপন ভাগটা মুখে পুরে চলেছি, কোথা থেকে সে এসে খপ করে হাত ধরে ফেলল। রাগ করে মুখের দিকে তাকাতে সে এমন ভাবে হাসল যে লজ্জা পেলাম।

বলল, দরজার পাশ থেকে দেখছিলাম, আর কটা খাচ্ছ গুনছিলাম। যা খেয়েছ তাতেই বোধহয় অসুখ হবে, আর খেয়ো না। কেমন?

ভর্ৎসনা নয়, আবেদন। মার কাছে ধরা পড়লে বকুনি খেতাম এবং এক খাবলা খাবার তুলে নিয়ে ছুটে পালাতাম। এর আবেদনে হাতের খাবার ফেলে দিলাম। সে বলল, লক্ষ্মী ছেলে। এসো জল খাবে।

বাড়ির সকলে কুটুম নিয়ে অন্যত্র ব্যস্ত ছিল, জল খেয়ে আমি রান্নাঘরে আসন পেতে তার কাছে বসলাম। এতদিন তার গম্ভীর মুখই শুধু দেখেছিলাম, আজ প্রথম দেখলাম, সে নিজের মনে হাসছে।

আমি বললাম, বামুনদি-

সে চমকে হাসি বন্ধ করল। এমন ভাবে আমার দিকে তাকাল যেন আমি তাকে গাল দিয়েছি। বুঝতে না পেরেও অপ্রতিভ হলাম।

কি হলো বামুনদি?

সে এদিক ওদিক তাকাল। ডালে খানিকটা নুন ফেলে দিয়ে এসে হঠাৎ আমার গা ঘেঁষে বসে পড়ল। গম্ভীর মুখে বলল, আমায় বামুনদি বোলো না খোকা। শুধু দিদি বোলো। তোমার মা রাগ করবেন দিদি বললে?

আমি মাথা নাড়লাম। সে ছোট এক নিঃশ্বাস ফেলে আমাকে এত কাছে টেনে নিল যে আমার প্রথম ভারি লজ্জা করতে লাগল।

তারপর কিছুক্ষণ আমাদের যে গল্প চলল সে অপূর্ব কথোপকথন মনে করে লিখতে পারলে সাহিত্যে না হোক আমার কাছে সবচেয়ে মূল্যবান লেখা হয়ে উঠত। হঠাৎ মা এলেন। সে দুহাতে আমাকে একরকম জড়িয়েই ধরে ছিল, হাত সরিয়ে ধরা পড়া চোরের মতো হঠাৎ বিব্রত হয়ে উঠল, দুচোখে ভয় দেখা দিল। কিন্তু সে মুহূর্তের জন্য। পরক্ষণে আমার কপালে চুম্বন করে মাকে বলল, এত কথা কইতে পারে আপনার ছেলে।

তখন বুঝিনি, আজ বুঝি স্নেহে সে আমায় আদর করেনি, নিজের গর্ব প্রতিষ্ঠার লোভে। মা যদি বলতেন, খোকা উঠে আয়, যদি কেবল মুখ কালো করে সরে যেতেন, পরদিন থেকে সে আর আসত না। পনের টাকার খাতিরেও না, স্বামীপুত্রের অনাহারের তাড়নাতেও না।

মা হাসলেন। বললে, ও ওইরকম। সারাদিন বকবক করে। বেশি আস্কারা দিও না, জ্বালিয়ে মারবে। বলে মা চলে গেলেন।

তার দুচোখ দিয়ে দুফোঁটা দুর্বোধ্য রহস্য টপ টপ করে ঝরে পড়ল। মা অপমান করলে তার চোখ হয়তো শুকনোই থাকত, সম্মানে, চোখের জল ফেলল! সে সম্মানের আগাগোড়া করুণা ও দয়া মাখা ছিল, সেটা বোধহয় তার সইল না।

তিন চার দিন পরে তার গালে তিনটে দাগ দেখতে পেলাম। মনে হয়, আঙুলের দাগ। মাস্টারের চড় খেয়ে একদিন অবনীর গালে যে রকম দাগ হয়েছিল তেমনি। আমি ব্যস্ত হয়ে প্রশ্ন করলাম, তোমার গালে আঙুলের দাগ কেন? কে চড় মেরেছে?

সে চমকে গালে হাত চাপা দিয়া বলল, দূর! তারপর হেসে বলল, আমি নিজে মেরেছি! কাল রাত্রে গালে একটা মশা বসেছিল, খুব রেগে-

মশা মারতে গালে চড়! বলে আমি খুব হাসলাম। সেও প্রথমটা আমার সঙ্গে হাসতে আরম্ভ করে গালে হাত ঘষতে ঘষতে আনমনা ও গম্ভীর হয়ে গেল। তার মুখ দেখে আমারও হাসি বন্ধ হয়ে গেল। চেয়ে দেখলাম, ভাতের হাঁড়ির বুদবুদফাটা বাষ্পে কি দেখে যেন তার চোখ পলক হারিয়েছে, নিচের ঠোঁট দাঁতে দাঁতে কামড়ে ধরেছে, বেদনায় মুখ হয়েছে কালো।

সন্দিগ্ধ হয়ে বললাম, তুমি মিথ্যে বলছো দিদি। তোমায় কেউ মেরেছে।

সে হঠাৎ কাঁদ কাঁদ হয়ে বলল, না ভাই, না। সত্যি বলছি না। কে মারবে?

এ প্রশ্নের জবাব খুঁজে না পেয়ে আমাকে চুপ করে থাকতে হলো। তখন কি জানি তার গালে চড় মারার অধিকার একজন মানুষের আঠার আনা আছে! কিন্তু চড় যে কেউ একজন মেরেছে সে বিষয়ে আমার সন্দেহ ঘুচল না। শুধু দাগ নয়, তার মুখ চোখের ভাব, তার কথার সুর সমস্ত আমার কাছে ওকথা ঘোষণা করে দিল। বিবর্ণ গালে তিনটি রক্তবর্ণ দাগ দেখতে দেখতে আমার মন খারাপ হয়ে গেল। আমি গালে হাত বুলিয়ে দিতে গেলাম কিন্তু সে আমার হাতটা টেনে নিয়ে বুকে চেপে ধরল।

চুপি চুপি বলল, কারো কাছে যা পাই না, তুমি তা দেবে কেন?

আমি অবাক হয়ে বললাম, কি দিলাম আমি?

এ প্রশ্নের জবাব পেলাম না। হঠাৎ সে তরকারি নামাতে ভারি ব্যস্ত হয়ে পড়ল। পিঁড়িতে বসামাত্র খোঁপা খুলে পিঠ ভাসিয়ে একরাশি চুল মেঝে পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ল কি একটা অন্ধকার রহস্যের আড়ালে সে যেন নিজেকে লুকিয়ে ফেলল।

রহস্য বৈকি। গালে চড়ের দাগ, চিরদিন যে ধৈর্যময়ী ও শান্ত তার ব্যাকুল কাতরতা, ফিসফিস করে ছোটো ছেলেকে শোনানো; কারও কাছে যা পাই না তুমি তা দেবে কেন? বুদ্ধির পরিমাণের তুলনায় এর চেয়ে বড় রহস্য আমার জীবনে কখনো দেখা দেয়নি! ভেবেচিন্তে আমি তার চুলগুলি নিয়ে বেণী পাকাবার চেষ্টা আরম্ভ করে দিলাম। আমার আশা পূর্ণ হলো সে মুখ ফিরিয়ে হেসে রহস্যের ঘোমটা খুলে সহজ মানুষ হয়ে গেল।

বিকালে আমি জিজ্ঞাসা করলাম, আচ্ছা, তোমার বরের চাকরি হলে তুমি কী করবে?

তুমি কী করতে বল? হরির লুট দেব? না তোমায় সন্দেশ খাওয়াব।

ধেৎ তা বলছি না। তোমার বরের চাকরি নেই বলে আমাদের বাড়ি কাজ করছ, তা তো চাকরি হলে করবে না?

সে হাসল, করব। এখন করছি যে!

তোমার বরের চাকরি হয়েছে।

হয়েছে বলে সে গম্ভীর হয়ে গেল।

আহা স্বামীর চাকরি নেই বলে ভদ্রলোকের মেয়ে কষ্টে পড়েছে, পাড়ার মহিলাদের কাছে মার এই মন্তব্য শুনে মমতাদির বরের চাকরির জন্য আমি দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে উঠেছিলাম। তার চাকরি হয়েছে শুনে পুলকিত হয়ে মাকে সংবাদটা শুনিয়ে দিলাম।

মা তাকে ডেকে পাঠালেন, তোমার স্বামীর চাকরি হয়েছে?

সে স্বীকার করে বলল, হয়েছে। বেশি দিন নয়, ইংরাজি মাসের পয়লা থেকে।

মা বললেন, অন্য লোক ঠিক করে দিতে পারছ না বলে কি তুমি কাজ ছেড়ে দিতে ইতস্তত করছ? তার কোনো দরকার নেই। আমরা তোমায় আটকে রাখব না। তোমার কষ্ট দূর হয়েছে তাতে আমরাও খুব সুখী। তুমি ইচ্ছে করলে এবেলাই কাজ ছেড়ে দিতে পার, আমাদের অসুবিধা হবে না।

তার চোখে জল এল, সে শুধু বলল, আমি কাজ করব।

মা বললেন, স্বামীর চাকরি হয়েছে, তবু?

সে বলল, তাঁর সামান্য চাকরি, তাতে কুলবে না মা। আমায় ছাড়বেন না। আমার কাজ কি ভালো হচ্ছে না?

মা ব্যস্ত হয়ে বললেন, অমন কথা তোমার শত্রুও বলতে পারবে না মা। সেজন্য নয়। তোমার কথা ভেবেই আমি বলছিলাম। তোমার ওপর মায়া বসেছে, তুমি চলে গেলে আমাদেরও কি ভালো লাগবে?

সে একরকম পালিয়ে গেল। আমি তার পিছু নিলাম। রান্নাঘরে ঢুকে দেখলাম সে কাঁদছে। আমায় দেখে চোখ মুছল।

আচমকা বলল, মিথ্যে বললে কি হয় খোকা?

মিথ্যে বললে কি হয় জানতাম। বললাম, পাপ হয়।

গুরুনিন্দা বাঁচাতে মিথ্যে বললে?

এটা জানতাম না। গুরুনিন্দা পাপ, মিথ্যা বলা পাপ। কোনটা বেশি পাপ সে জ্ঞান আমার জন্মায়নি। কিন্তু না জানা কথা বলেও সান্ত্বনা দেওয়া চলে দেখে বললাম, তাতে একটুও পাপ হয় না। সত্যি! কাঁদছ কেন?

তখন তার চাকরির এক মাস বোধহয় পূর্ণ হয়নি। একদিন স্কুল থেকে বাড়ি ফেরবার সময় দেখলাম জীবনময়ের গলির মোড়ে ফেরিওয়ালার কাছে কমলা লেবু কিনছে।

সঙ্গে নেবার ইচ্ছে নেই টের পেয়েও এক রকম জোর করেই বাড়ি দেখতে গেলাম। দুটি লেবু কিনে আমাকে সঙ্গে নিয়ে সে গলিতে ঢুকল। বিশ্রী নোংরা গলি। কে যে ঠাট্টা করে এই যমালয়ের পথটার নাম জীবনময় লেন রেখেছিল! গলিটা আস্ত ইট দিয়ে বাঁধানো, পায়ে পায়ে ক্ষয় হয়ে গেছে। দুদিকের বাড়ির চাপে অন্ধকার, এখানে ওখানে আবর্জনা জমা করা আর একটা দূষিত চাপা গন্ধ। আমি সঙ্কুচিত হয়ে তার সঙ্গে চলতে লাগলাম। সে বলল, মনে হচ্ছে পাতালে চলেছ, না?

সাতাশ নম্বরের বাড়িটা দোতলা নিশ্চয়, কিন্তু যত ক্ষুদ্র দোতলা হওয়া সম্ভব। সদর দরজার পরেই ছোটো একটি উঠান, মাঝামাঝি কাঠের প্রাচীর দিয়ে দুভাগ করা। নিচে ঘরের সংখ্যা বোধহয় চার, কারণ মমতাদি আমায় যে ভাগে নিয়ে গেল সেখানে দুখানা ছোটো ছোটো কুঠরির বেশি কিছু আবিষ্কার করতে পারলাম না। ঘরের সামনে দুহাত চওড়া একটু রোয়াক, একপাশে একশিট করোগেট আয়রনের ছাদ ও চটের বেড়ার অস্থায়ী রান্নাঘর। চটগুলি কয়লার ধোঁয়ায় কয়লার বর্ণ পেয়েছে।

সে আমাকে শোবার ঘরে নিয়ে গিয়ে টুলে বসাল। ঘরে দুটি জানালা আছে এবং সম্ভবত সেই কারণেই শোবার ঘর করে অন্য ঘরখানার চেয়ে বেশি মান দেওয়া হয়েছে। কিন্তু জানালা দুটির এমনি অবস্থান যে আলো যদিও কিছু কিছু আসে, বাতাসের আসা-যাওয়া একেবারে অসম্ভব। সুতরাং পক্ষপাতিত্বের যে খুব জোরালো কারণ ছিল তা বলা যায় না। সংসারের সমস্ত জিনিসই প্রায় এঘরে ঠাঁই পেয়েছে। সব কম দামি শ্রীহীন জিনিস। এই শ্রীহীনতার জন্য সযত্নে গুছিয়ে রাখা সত্ত্বেও মনে হচ্ছে বিশৃঙ্খলতার অন্ত নেই। একপাশে বড়ো চৌকি, তাতে গুটানো মলিন বিছানা। চৌকির তলে একটি চরকা আর ভাঙা বেতের বাস্কেট চোখে পড়ে, অন্তরালে হয়তো আরও জিনিস আছে। ঘরের এক কোণে পাশাপাশি রক্ষিত দুটি ট্রাংক- দুটিরই রং চটে গেছে, একটির তালা ভাঙা। অন্য কোণে কয়েকটা মাজা বাসন, বাসনের ঠিক ঊর্ধ্বে কোনাকুনি টাঙ্গানো দড়িতে খানকয়েক কাপড়। এই দুই কোণের মাঝামাঝি দেওয়াল ঘেঁষে পাতা একটি ভাঙা টেবিল, আগাগোড়া দড়ির ব্যান্ডেজের জোরে কোনমতে দাঁড়িয়ে আছে। টেবিলে কয়েকটা বই-খাতা, একটি অল্প দামি টাইমপিস, কয়েকটা ওষুধের শিশি, একটা মেরামত করা আর্সি, কয়েকটা ভাঁজ করা সংবাদপত্র, এই সব টুকিটাকি জিনিস। টেবিলের উর্ধ্বে দেওয়ালের গর্তের তাকে কতকগুলি বই।

ঘরে আর একটি জিনিস ছিল- একটি বছর পাঁচেকের ছেলে। চৌকিতে শুধু মাদুরের ওপরে উপুড় হয়ে শুয়ে সে ঘুমিয়ে ছিল। মমতাদি ঘরে ঢুকেই ব্যস্ত হয়ে ছেলেটির গায়ে হাত দিল, তারপর গুটানো বিছানার ভেতর থেকে লেপ আর বালিশ টেনে বার করল। সন্তর্পণে ছেলেটির মাথার তলে বালিশ দিয়ে লেপ দিয়ে গা ঢেকে দিল।

বলল, কাল সারারাত পেটের ব্যথায় নিজেও ঘুমোয়নি, আমাকেও ঘুমোতে দেয়নি। উনি তো রাগ করে-কই, তুমি লেবু খেলে না?

আমি একটা লেবু খেলাম। সে চুপ করে খাওয়া দেখে বলল, মুড়ি ছাড়া ঘরে কিছু নেই, দোকানের বিষও দেব না, একটা লেবু খাওয়াতে তোমাকে ডেকে আনলাম! আমি বললাম, আর একটা লেবু খাব দিদি।

সে হেসে লেবু দিল, বলল, কৃতার্থ হলাম। সবাই যদি তোমার মতো ভালোবাসত!

ঘরে আলো ও বাতাসের দীনতা ছিল। খানিক পরে সে আমায় বাইরে রোয়াকে মাদুর পেতে বসাল। কথা বলার সঙ্গে সংসারের কয়েকটা কাজও করে নিল। ঘর ঝাঁট দিল, কড়াই মাজল, পানি তুলল, তারপর মশলা বাটতে বসল। হঠাৎ বলল, তুমি এবার বাড়ি যাও ভাই। তোমার খিদে পেয়েছে।

উৎস নির্দেশ :
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘সরীসৃপ’(১৯৩৯) গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত ‘মমতাদি’ গল্প।

শব্দার্থ ও টীকা :
➠ বাছা- বৎস বা অল্পবয়সী সন্তান।
পর্দা ঠেলে উপার্জন- এখানে নারীদের অন্তঃপুরে থাকার প্রথাভঙ করে বাইরে এসে আয়-রোজগার করা বোঝাচ্ছে।
➠ অনাড়ম্বর- জাঁকজমকহীন।
➠ বামুনদি- ব্রাহ্মণদিদির সংক্ষিপ্ত রূপ। আগে রান্না বা গৃহকর্মে যে ব্রাহ্মণকন্যাগণ নিয়োজিত হতেন তাদের কথ্যরীতিতে বামুনদি ডাকা হতো।
➠ অপ্রতিভ অপ্রস্তুত।
পরদিন থেকে সে আর আসত না- না আসার কারণ আত্মসম্মান। মমতাদি টাকার জন্য অন্যের বাড়িতে কাজ নিয়েছে সত্য কিন্তু তাকে অসম্মান করলে বা সন্দেহের চোখে দেখলে নিজে অপমান বোধ করে চাকরি ত্যাগের সাহস তার ছিল।
হরির লুট- ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দান করা। সংকীর্তনের পর হরির নামে যেভাবে বাতাসা ছড়ানো হয়।

কর্ম-অনুশীলন :
স্নেহ-ভালোবাসা ‘ধনী-গরিবের সমান’-এ বিষয়ে একটি অনুচ্ছেদ লেখো

পাঠ-পরিচিতি :
‘মমতাদি’ গল্পে গৃহকর্মে নিয়োজিত মানুষের প্রতি মানবিক আচরণের দিকটি প্রাধান্য পেয়েছে। স্কুল পড়ুয়া একটি ছেলে যখন দেখে তাদের বাড়িতে মমতাদি নামে এক গৃহকর্মী আসে, তখন সে আনন্দিত হয়। তাকে নিজের বাড়ির একজন বলে ভাবতে শুরু করে ছেলেটি। মমতাদির সংসারে অভাব আছে বলেই মর্যাদাসম্পন্ন ঘরের নারী হয়েও তাকে অপরের বাড়িতে কাজ নিতে হয়। এই আত্মমর্যাদাবোধ তার সবসময়ই সমুন্নত ছিল। সে নিজে যেমন আদর ও সম্মানপ্রত্যাশী, তেমনি অন্যকেও স্নেহ ও ভালোবাসা দেবার ক্ষেত্রে তার মধ্যে দ্বিধা ছিল না। স্কুলপড়ুয়া ছেলেটি তাই মমতাদির কাছে ছোটো ভাইয়ের মর্যাদা লাভ করে। তাকে নিজ বাসায় নিয়ে গিয়ে যথাসামর্থ্য আপ্যায়ন করে মমতাদি। সম্মান ও সহমর্মিতা নিয়ে মমতাদির পাশেও দাঁড়ায় স্কুলপড়ুয়া ঐ ছেলে ও তার পরিবার। প্রকৃতপক্ষে, আমাদের গৃহকর্মে যাঁরা সহায়তা করে থাকেন তাঁদের সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করা জরুরি। আত্মসম্মানবোধ তাদেরও আছে। ‘মমতাদি’ গল্পটি আমাদের এই শিক্ষা দেয় যে, সামাজিক শ্রেণি মানবিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় কোনো বাধা সৃষ্টি করতে পারে না; যে কোনো পেশার যে কোনো মানুষকে দেখতে হবে শ্রদ্ধা ও মর্যাদার দৃষ্টিতে।

লেখক পরিচিতি :
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯০৮ সালে বিহারের সাঁওতাল পরগনায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর নাম প্রবোধ কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর পৈতৃক বাড়ি মুন্সীগঞ্জের বিক্রমপুর অঞ্চলের মালবদিয়া গ্রাম এবং মায়ের বাড়ি একই অঞ্চলের গাঁওদিয়া গ্রাম। তিনি মেদিনীপুর জিলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক ও বাঁকুড়া ওয়েসলিয় মিশন কলেজ থেকে আইএসসি পাশ করেন। তারপর গণিতে অনার্স নিয়ে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে বি. এসসি ক্লাসে ভর্তি হন। কিন্তু বন্ধুদের সঙ্গে বাজি ধরে অতসীমামী নামক গল্প বিচিত্রা পত্রিকায় প্রকাশিত হলে লেখক হিসেবে তাঁর যত্রা শুরু হয়। এ সময় তিনি লেখা নিয়ে এতই মগ্ন থাকেন যে, অসাধারণ এই কৃতী ছাত্রের আর অনার্স পাস করা হয়নি। মাত্র একুশ বছর বয়সে তিনি তাঁর বিখ্যাত ‘দিবারাত্রির কাব্য’ রচনা করেন। এরপর তিনি লেখালেখিকেই জীবিকার একমাত্র অবলম্বন হিসেবে গ্রহণ করেন। পদ্মা নদীর মাঝি ও পুতুল নাচের ইতিকথা লিখে তিনি বাংলা কথাসাহিত্যের সিংহাসনে আরোহণ করেন। জননী, চিহ্ন, সহরতলী, অহিংস, চতুষ্কোণ প্রভৃতি তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাস।
১৯৫৬ সালের ৩রা ডিসেম্বর এই মহান লেখক মৃত্যুবরণ করেন।

বহুনির্বাচনি প্রশ্ন :

প্রশ্ন থেকে

অভিনন্দন!
আপনি পেয়েছেন -এর মধ্যে!
যা


জ্ঞানমূলক প্রশ্ন :
১. মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বন্ধুদের সাথে বাজি ধরে কোন গল্প রচনা করেন?
উত্তর : মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বন্ধুদের সাথে বাজি ধরে ‘অতসীমামী’ নামক গল্প রচনা করেন।
২. মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় কতটি উপন্যাস রচনা করেন?
উত্তর : মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় পঞ্চাশটিরও অধিক উপন্যাস রচনা করেন।
৩. মমতাদি কোথায় থাকেন?
উত্তর : মমতাদি জীবনময়ের গলিতে থাকেন।
৪. মমতাদির স্বামীর কয় মাস ধরে চাকরি নেই?
উত্তর : মমতাদির স্বামীর চাকরি নেই চারমাস।
৫. মমতাদির কত টাকা মাইনে ঠিক হলো?
উত্তর : মমতাদির পনেরো টাকা মাইনে ঠিক হলো।
৬. মমতাদির কী দেখে সকলে খুশি হলো?
উত্তর : মমতাদির কাজের শৃঙ্খলা ও ক্ষিপ্রতা দেখে সকলে খুশি হলো।
৭. ‘মমতাদি’ গল্পে বাড়িতে কী নিয়ে কুটুম এসেছিল?
উত্তর : ‘মমতাদি’ গল্পে বাড়িতে রসগোল্লা ও সন্দেশ নিয়ে কুটুম এসেছিল।
৮. ‘মমতাদি’ গল্পে কার গালে তিনটি আঙুলের দাগ দেখা যায়?
উত্তর : ‘মমতাদি’ গল্পে মমতাদির গালে তিনটি আঙুলের দাগ দেখা যায়।
৯. ‘মমতাদি’ গল্পে ছোট ছেলেটি কার চুলে বেণী পাকাবার চেষ্টা করে?
উত্তর : ‘মমতাদি’ গল্পে ছোট ছেলেটি মমতাদির চুলে বেণী পাকাবার চেষ্টা করে।
১০. কবে থেকে মমতাদির বরের চাকরি হয়েছে?
উত্তর : ইংরেজি মাসের পয়লা থেকে মমতাদির বরের চাকরি হয়েছে।
১১. মিথ্যে বললে কী হয়?
উত্তর : মিথ্যে বললে পাপ হয়।
১২. মমতাদি জীবনময়ের গলির কয় নম্বর বাড়িতে থাকেন?
উত্তর : মমতাদি জীবনময়ের গলির সাতাশ নম্বর বাড়িতে থাকেন।
১৩. সাতাশ নম্বর বাড়িটি কয় তলা?
উত্তর : সাতাশ নম্বর বাড়িটি দোতলা।
১৪. জীবনময়ের গলির মোড়ে ফেরিওয়ালার কাছ থেকে কে কমলালেবু কিনেছিলেন?
উত্তর : জীবনময়ের গলির মোড়ে ফেরিওয়ালার কাছ থেকে মমতাদি কমলালেবু কিনেছিলেন।
১৫. মমতাদির বাড়িতে চটের বেড়া দিয়ে কী তৈরি করা হয়েছে?
উত্তর : মমতাদির বাড়িতে চটের বেড়া দিয়ে অস্থায়ী রান্নাঘর তৈরি করা হয়েছে।
১৬. মমতাদি ছোট ছেলেটিকে কোন ঘরে নিয়ে গিয়ে টুলে বসাল?
উত্তর : মমতাদি ছোট ছেলেটিকে শোবার ঘরে নিয়ে গিয়ে টুলে বসাল।
১৭. মমতাদির শোবার ঘরে কয়টি জানালা আছে?
উত্তর : মমতাদির শোবার ঘরে দুটি জানালা আছে।
১৮. মমতাদির সংসারের প্রায় সমস্ত জিনিস কোন ঘরে ঠাঁই পেয়েছে?
উত্তর : মমতাদির সংসারের প্রায় সমস্ত জিনিস শোবার ঘরে ঠাঁই পেয়েছে।
১৯. মমতাদির কয় বছর বয়সী একটি ছেলে রয়েছে?
উত্তর : মমতাদির পাঁচ বছর বয়সী একটি ছেলে রয়েছে।
২০. মমতাদির ঘরে টেবিলের ঊর্ধ্বে দেয়ালের গর্তের তাকে কী রয়েছে?
উত্তর : মমতাদির ঘরে টেবিলের ঊর্ধ্বে দেয়ালের গর্তের তাকে কতকগুলো বই রয়েছে।
২১. মমতাদির বাড়িতে কে সারারাত পেটের ব্যথায় ঘুমায়নি?
উত্তর : মমতাদির বাড়িতে মমতাদির ছেলে সারারাত পেটের ব্যথায় ঘুমায়নি।
২২. মমতাদির বাড়িতে ছোট ছেলেটি কয়টি কমলালেবু খেল?
উত্তর : মমতাদির বাড়িতে ছোট ছেলেটি দুটি কমলালেবু খেল।
২৩. ‘মমতাদি’ গল্পে কার ঘরে মুড়ি ছাড়া খাওয়ার জিনিস কিছু নেই?
উত্তর : ‘মমতাদি’ গল্পে মমতাদির ঘরে মুড়ি ছাড়া খাওয়ার জিনিস কিছু নেই।
২৪. মমতাদি ছোট ছেলেটিকে কোথায় মাদুর পেতে বসতে দিল?
উত্তর : মমতাদি ছোট ছেলেটিকে বাইরে রোয়াকে মাদুর পেতে বসতে দিল।
২৫. ‘মমতাদি’ গল্পটি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কোন গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত?
উত্তর : ‘মমতাদি’ গল্পটি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘সরীসৃপ’ নামক গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত।
২৬. ‘মমতাদি’ গল্পে স্কুলপড়ুয়া ছেলেটি মমতাদির কাছে ছোট ভাইয়ের মর্যাদা লাভ করে।
উত্তর : ‘মমতাদি’ গল্পে স্কুলপড়ুয়া ছেলেটি মমতাদির কাছে ছোট ভাইয়ের মর্যাদা লাভ করে।
২৭. মমতাদি কাকে নিজ বাসায় নিয়ে গিয়ে যথাসামর্থ্য আপ্যায়ন করেন?
উত্তর : মমতাদি স্কুলপড়ুয়া ছেলেটিকে নিজ বাসায় নিয়ে গিয়ে যথাসামর্থ্য আপ্যায়ন করেন।
২৮. সম্মান ও সহমর্মিতা নিয়ে স্কুল পড়ুয়া ছেলে ও তার পরিবার কার পাশে দাঁড়ায়?
উত্তর : সম্মান ও সহমর্মিতা নিয়ে স্কুলপড়ুয়া ছেলে ও তার পরিবার মমতাদির পাশে দাঁড়ায়।

অনুধাবনমূলক প্রশ্ন :

১. কাজ চাইতে গিয়ে মমতাদির যেটুকু সংকোচ থাকা দরকার ছিল তাও একেবারে নেই- কেন?
উত্তর : সংকোচ কাটানোর জন্য প্রাণপণ চেষ্টায় অতিরিক্ত জয় করে ফেলার কারণে মমতাদি কাজ চাইতে গিয়ে একেবারে সংকোচ হারিয়ে ফেলেছিলেন।
➠ মমতাদি একজন মর্যাদাসম্পন্ন ঘরের নারী। তা সত্ত্বেও তাকে অভাবের তাড়নায় বাধ্য হয়ে রান্নার কাজ খুঁজতে হয়। এজন্য তাঁকে সকল লজ্জা-সংকোচ উপেক্ষা করে কাজ চাইতে হয়। আর এই সংকোচ কাটানোর জন্য অতিরিক্ত চেষ্টার ফলেই তিনি সংকোচের মাত্রা একেবারেই অতিক্রম করে গেছেন। ফলে কাজ চাইতে গিয়ে তাঁর যেটুকু সংকোচ থাকা দরকার ছিল তাও নেই।

২. মমতাদির ওপর বাড়ির সকলে খুশি হলেন কেন?
উত্তর : মমতাদির কাজের শৃঙ্খলা ও ক্ষিপ্রতা দেখে বাড়ির সকলে তার ওপর খুশি হলেন।
➠ মমতাদি মর্যাদাসম্পন্ন ঘরের নারী হয়েও অভাবের তাড়নায় রান্নার কাজ করতে এসেছেন। তিনি কাজ করতে এসে নীরবে নতমুখে সকল কাজ সম্পন্ন করেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে উপদেশ না পেলেও নিজের বুদ্ধি খাটিয়ে সুন্দরভাবে কাজ সম্পাদন করেন। আর তাঁর কাজও হয় অত্যন্ত পরিপাটি ও নিখুঁত। এজন্য বাড়ির সকলে মমতাদির ওপর খুশি হলেন।

৩. মমতাদির ওপর ছোট ছেলেটি ক্ষুব্ধ হলো কেন?
উত্তর : মমতাদির সাথে ভাব করতে গিয়ে উপেক্ষিত হওয়ায় ছোট ছেলেটি মমতাদির ওপর ক্ষুব্ধ হলো।
➠ মমতাদি রান্নার কাজ করতে এসে কাজগুলোকেই আপন করে নিয়েছিলেন। তিনি নীরবে নতমুখে সকল কাজ সম্পন্ন করেন। নতুন জায়গায় এলে প্রথম দিকে বাড়ির কারো সাথে তিনি মিশতে পারলেন না। গৃহকর্মী হলেও তাঁর আলাদা ব্যক্তিত্ব ছিল। তাই ছোট ছেলেটি ভাব জমাতে গিয়ে সফল হয় না। বেশ কয়েকবার রান্নাঘরে গিয়ে দাঁড়ালেও মমতাদি ছেলেটিকে উপেক্ষা করেন। তাই ছেলেটি মমতাদির ওপর ক্ষুব্ধ হলো।

৪. মমতাদি ছোট ছেলেটিকে বামুনদি বলতে নিষেধ করেন কেন?
উত্তর : মমতাদি মর্যাদাসম্পন্ন ঘরের নারী হওয়ায় ছোট ছেলেটি তাকে বামুনদি বললে তিনি তাকে বামুনদি বলতে নিষেধ করেন।
➠ একসময় রান্না বা গৃহকর্মে নিয়োজিত ব্রাহ্মণ নারীদের কথ্যরীতিতে বামুনদি বলা হতো। গল্পের ছোট ছেলেটিও তাই মমতাদিকে বামুনদি বলে। কিন্তু মমতাদি কখনোই গৃহকর্মী ছিলেন না। তিনি অভাবের তাড়নায় বাধ্য হয়ে এ কাজে এসেছেন। তাই তাঁকে বামুনদি বললে তাঁর আত্মমর্যাদায় বাধে। এ কারণেই মমতাদি ছোট ছেলেটিকে বামুনদি বলতে নিষেধ করেন।

৫. মমতাদি তাঁর চড় খাওয়ার বিষয়টি গোপন করেছিলেন কেন?
উত্তর : মমতাদি আত্মসম্মানবোধের কারণে তার চড় খাওয়ার বিষয়টি গোপন করেছিলেন।
➠ মমতাদি একজন মর্যাদাসম্পন্ন ঘরের নারী। আত্মমর্যাদাবোধও তাঁর প্রখর। তিনি কোনোভাবে চাননি যে তাঁর ঘরের খবর অন্য কেউ জানতে পারুক। নিজের আত্মমর্যাদা সমুন্নত রেখে মমতাদি কাজ করতে চেয়েছেন। এজন্য গালে চড়ের দাগ স্পষ্ট হওয়া সত্ত্বেও মমতাদি ছোট ছেলেটির কাছে চড় খাওয়ার বিষয়টি গোপন রাখতে চেয়েছিলেন।

৬. মমতাদির বরের চাকরির জন্য ছোট ছেলেটি দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল কেন?
উত্তর : বরের চাকরি নেই বলে মমতাদি ভদ্র ঘরের মেয়ে হয়েও গৃহকর্মীর কাজ করছে ভেবে ছোট ছেলেটি তাঁর বরের চাকরির জন্য দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল।
➠ মমতাদি একান্ত বাধ্য হয়েই গৃহকর্মীর কাজ করেন। কেননা তাঁর স্বামী চার মাস ধরে বেকার। মমতাদির এই দুর্গতির কথা ছোট ছেলেটিও জানত। ছেলেটির সাথে মমতাদির একটি সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এজন্য ছেলেটি মনেপ্রাণে চায় মমতাদির বরের বেকারত্ব যেন দ্রুতই ঘুচে যায়।

৭. ‘পরদিন থেকে সে আর আসত না’- কেন?
উত্তর : মমতাদির আত্মসম্মানে আঘাত লাগলে মমতাদি পরদিন থেকে আর আসত না।
➠ মমতাদির আত্মসম্মানবোধ ছিল প্রবল। তিনি অভাবের তাড়নায় কাজ করতে এসেছেন সত্য কিন্তু তিনি অপমানিত হলে কাজ ছেড়ে দেয়ার ক্ষমতাও তার ছিল। ফলে গৃহকর্ত্রী কোনো কারণে তাকে সন্দেহের চোখে দেখলে বা অসম্মান করলে পরদিন থেকে মমতাদি আর আসত না।


সৃজনশীল প্রশ্ন- ১

রাসেল ড্রাইভার হিসেবে যেমন দক্ষ তেমনি সৎ। প্রকৌশলী এমারত সাহেব তাকে ব্যক্তিগত ড্রাইভার হিসেবে নিয়োগ দেন। ইফতি, সনাম ও শিলাকে স্কুলে নিয়ে যাওয়া-আসাই তার প্রধান কাজ। ঘরের সবাই ওকে ভীষণ ভালোবাসে। ইফতিরা ওকে ভাইয়া বলে ডাকে, একসাথে খায়, গল্প করে, বেড়াতে যায়। রাসেলের প্রতি সন্তানদের এই আচরণে এমারত সাহেব ভীষণ খুশি।

ক. মমতাদির বয়স কত ছিল?
খ. মমতাদির চোখ সজল হয়ে উঠেছিল কেন?
গ. উদ্দীপকে রাসেলের মাঝে বিদ্যমান মমতাদির বিশেষ গুণটি ব্যাখ্যা করো।
ঘ. রাসেল ও মমতাদির প্রতি দুই পরিবারের আচরণের ফুটে ওঠা দিকটি সামাজিক সংহতি সৃষ্টিতে কতটুকু প্রভাব ফেলে? যুক্তিসহ বিশ্লেষণ করো।

ক. মমতাদির বয়স ছিল ২৩ বছর।
খ. আশাতিরিক্ত মাইনে নির্ধারণ করায় মাইনের কথা জেনে মমতার দুচোখ কৃতজ্ঞতায় সজল হয়ে উঠল।
➠ মমতা অভাবের তাড়নায় পর্দা ঠেলে উপার্জনের জন্য বাইরে এসেছে। তার স্বামীর চার মাস ধরে চাকরি নেই। তাই সে গৃহকর্মীর কাজ নেয়। সে এই কাজ করতে গিয়ে সর্বোচ্চ বারো টাকার মতো বেতন আশা করেছিল। কিন্তু গৃহকর্ত্রী পনেরো টাকা বেতন নির্ধারণ করেন। এ কারণে কৃতজ্ঞাতায় মমতার দুচোখ সজল হয়ে উঠল।

গ. উদ্দীকের রাসেলের মধ্যে বিদ্যমান মমতাদির বিশেষ গুণটি হচ্ছে দক্ষতা ও সততা।
➠ ‘মমতাদি’ গল্পের মমতাদি দরিদ্র হলেও সে ছিল অত্যন্ত সৎ। গৃহকর্ত্রীর বাড়িকে নিজের বাড়ি মনে করে সুনিপুণভাবে সব কাজ সম্পন্ন করেছে। কখনও ফাঁকি দেওয়ার কথা ভাবেনি। সে ছিল অত্যন্ত সৎ এবং নিজ কাজে ছিল অত্যন্ত দক্ষ। নিখুঁতভাবে সকল কাজ সম্পন্ন করত সে।
➠ উদ্দীপকের রাসেল একজন দরিদ্র ড্রাইভার হলেও সে ছিল অত্যন্ত সৎ এবং দক্ষ। সে তার কর্তব্যনিষ্ঠা ও সততা দিয়ে মালিক এমারত সাহেব ও তার পরিবারের আস্থাভাজন হয়ে উঠেছে। এমারত সাহেবের সন্তানেরা তাকে পরিবারের একজন হিসেবে মনে করেছে। ফলে সকলের সাথে তার গড়ে উঠেছে গভীর সম্পর্ক। সুতরাং গল্পের মমতাদি চরিত্রের দক্ষতা এবং সততার গুণটিই উদ্দীপকে রাসেলের মধ্যে বিদ্যমান।

ঘ. রাসেল ও মমতাদির প্রতি দুই পরিবারের সৌহার্দ্যপূর্ণ আচরণ সামাজিক সংহতি সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।
➠ ‘মমতাদি’ গল্পের মমতাদি চরিত্রটি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের এক অসাধারণ সৃষ্টি। মর্যাদাসম্পন্ন ঘরের নারীর হয়েও সে অভাবের তাড়নায় অন্যের বাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ নেয়। তার সততা, চরিত্র মাধুর্য ও কর্মদক্ষতায় সে সহজেই গৃহকর্ত্রীসহ সকলের মন জয় করে নেয়। গৃহকর্ত্রীও ছিলেন অত্যন্ত উদার মনের মানুষ। মমতাদিকে কখনও গৃহকর্মী ভেবে তুচ্ছ জ্ঞান করেননি। বরং যথাযথ মর্যাদাপূর্ণ ও সম্মানজনক আচরণ করেছেন।
➠ উদ্দীপকের ড্রাইভার রাসেল যেমন সৎ তেমনি দক্ষ। এমরাত সাহেবের সন্তানদের স্কুলে আনা-নেওয়াই তার কাজ। সে তার সব কাজ নিষ্ঠা ও দক্ষতার সাথে করেছে। শিশুরা তাকে ভাইয়া বলে ডকে। একসাথে খেলে, ঘোরে, গল্প করে। সন্তানদের আচরণে এমারত সাহেবও খুশি। মোটকথা একজন ড্রাইভারের সাথে তার পরিবার অত্যন্ত মানবিক আচরণ করেছে। তার নিজের পরিবারের সদস্যের মতো ব্যবহার করেছে।
➠ ‘মমতাদি’ গল্পে স্কুল-পড়–য়া ছেলেটির পরিবার যেমন মমতাদির সাথে মানবিক ও মর্যাদাপূর্ণ আচরণ করেছে উদ্দীপকের ড্রাইভার রাসেলের সাথেও এমারত সাহেবের পরিবার ও সন্তানেরা অত্যন্ত সৌহার্দ্যপূর্ণ আচরণ করেছে। দুটি পরিবারের এই আচরণ সামাজিক সংহতি সৃষ্টিতে যথেষ্ট ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। উঁচু-নীচু প্রভেদ ভুলে প্রতিটি মানুষের সাথে এমনি করে মানবিক আচরণ করলে সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে। আভিজাত্য ও প্রতিপত্তির মিথ্যা অহংকারেই সমাজে সব অনাচার ও অশান্তি সৃষ্টি হয়। মমতাদি ও ড্রাইভার রাসেলের সাথে যে আচরণ করা হয়েছে তাতে মনুষ্যত্বেরই জয় ঘোষিত হয়েছে। তাই সবাইকে এ ধরনের আচরণেই অভ্যস্ত হওয়া প্রয়োজন।


সৃজনশীল প্রশ্ন- ২

দারিদ্র্যের কারণে নিলুফা বেশি পড়াশোনা করতে পারেনি। এসএসসি পাস করে সে একটি হাসপাতালে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী হিসেবে কাজ করছে। কাজের প্রতি তার দায়িত্বশীলতা দেখে প্রতিষ্ঠানের প্রায় সবাই তার প্রশংসা করে। তবে মাঝেমধ্যে কারও কটু কথা শুনলে তার মনে খুব দুঃখ লাগে। সে মর্মাহত হয়।

ক. মমতাদির বয়স কত?
খ. মমতাদি লেখকের বাড়িতে কাজ নিয়েছিল কেন বুঝিয়ে লেখো।
গ. উদ্দীপকের নিলুফা ও ‘মমতাদি’ গল্পের মমতাদি চরিত্রের সাদৃশ্যপূর্ণ দিকটি ব্যাখ্যা করো।
ঘ. “উদ্দীপকের বিষয়বস্তু ‘মমতাদি’ গল্পের সামগ্রিক ভাব ধারণ করে না।”- যুক্তিসহকারে উক্তিটি ব্যাখ্যা করো।

ক. মমতাদির বয়স তেইশ বছর।
খ. সংসারে দারিদ্র্যের কারণে মমতাদি লেখকের বাড়িতে কাজ নিয়েছিলো।
ক্ষ মমতাদি একজন মর্যাদাসম্পন্ন ঘরের নারী। কিন্তু সংসারে প্রচণ্ড অভাবের কারণে তাকে পর্দা ঠেলে বাইরে আসতে হয়েছে। তার স্বামীর চার মাস ধরে চাকরি নেই। ঘরে খাবার নেই। তীব্র অভাবে বাধ্য হয়ে মমতাদি বাইরে এসেছে এবং কাজ খুঁজতে বেরিয়েছে। আর এই প্রেক্ষাপটেই তিনি লেখকের বাড়িতে কাজ নিয়েছেন।

গ. কাজের প্রতি আন্তরিকতা ও দায়িত্বশীলতার দিক থেকে উদ্দীপকের নিলুফা ও ‘মমতাদি’ গল্পের মমতাদি চরিত্রটি সাদৃশ্যপূর্ণ।
➠ ‘মমতাদি’ গল্পে লেখক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় মমতাদি নামক এক গৃহকর্মীর আত্মমর্যাদাবোধ ও দায়িত্বশীলতা সুনিপুণ দক্ষতায় ফুটিয়ে তুলেছেন। মমতাদি একজন আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন ও পরিশ্রমী নারী। তিনি লেখকের বাড়িতে কাজ নিয়ে দক্ষতা ও আন্তরিকতার সাথে তার দায়িত্ব পালন করেছেন। নিজের প্রতি অর্পিত দায়িত্বকে তিনি আপন করে নিয়েছেন। সুনিপুণ দক্ষতায় কাজ সম্পন্ন করার কারণে বাড়ির সকলের প্রশংসা কুড়িয়েছেন।
➠ উদ্দীপকের নিলুফা ‘মমতাদি’ গল্পের মমতাদির মতোই একজন দায়িত্বপরায়ণ নারী। তিনি কর্মজীবনে তার প্রতি অর্পিত দায়িত্ব দক্ষতার সাথে পালন করেছেন। নিজের কর্মদক্ষতায় সকলের প্রশংসার পাত্র হয়েছেন। কাজের প্রতি আন্তরিকতা, ভালোবাসা ও অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করার মানসিকতা উদ্দীপকের নিলুফা এবং গল্পের মমতাদি কারোরই মধ্যে কমতি ছিল না। ফলে এদিক থেকে মমতাদি এবং উদ্দীপকের নিলুফা একই সুতোয় গাঁথা।

ঘ. ‘মমতাদি’ গল্পে গৃহকর্মীদের সাথে মানবিক আচরণের বিষয়টি প্রাধান্য লাভ করলেও উদ্দীপকে তা অনুপস্থিত থাকায় উদ্দীপকটি ‘মমতাদি’ গল্পের সামগ্রিক ভাবকে ধারণ করে না।
➠ ‘মমতাদি’ গল্পে মমতাদির আত্মমর্যাদাবোধ সবসময়ই সমুন্নত ছিল। তিনি অন্যের বাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ করলেও তাঁর মর্যাদার কোনো ঘাটতি হয়নি। বরং সকলের সাথে তার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। নিজের ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে তিনি সকলের মন জয় করেছেন। লেখকের পরিবারের সকলের সাথে মমতাদির সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
➠ উদ্দীপকের প্রেক্ষাপট ‘মমতাদি’ গল্পের প্রেক্ষাপট থেকে আলাদা। দায়িত্বশীলতা ও আন্তরিতার দিক থেকে উদ্দীপকের নিলুফা এবং ‘মমতাদি’ গল্পের মমতাদির কিছুটা মিল থাকলেও তাঁরা ভিন্ন প্রেক্ষাপটে কাজ করেছেন। তাছাড়া গল্পে মমতাদির কর্মদক্ষতায় সকলে মুগ্ধ হয়ে সৌহার্দ্যপূর্ণ ব্যবহার করলেও উদ্দীপকে কিছুটা ব্যতিক্রম ঘটে। সেখানে নিলুফা কর্মক্ষেত্রে দক্ষতা দেখালেও তাকে কারও কারও কাছ থেকে কটু কথা শুনতে হয়। কর্মস্থলে মমতাদির মর্যাদাহানি না ঘটলেও নিলুফার ক্ষেত্রে ঘটেছে।
➠ মমতাদি একজন প্রখর আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন নারী। তিনি নিজের আত্মসম্মানে আঘাত লাগলে আর কখনোই লেখকের বাড়িতে কাজে আসতেন না। কিন্তু উদ্দীপকের নিলুফাকে কটু কথা শোনার পরও সেখানে কাজ করতে হয়। ফলে এক্ষেত্রে মমতাদি এবং নিলুফা ভিন্ন ভাবধারায় পরিচালিত। তাই নিশ্চিতভাবে বলা যায়, উদ্দীপকের বিষয়বস্তু ‘মমতাদি’ গল্পের সামগ্রিক ভাব ধারণ করে না।


সৃজনশীল প্রশ্ন- ৩

বিয়ের ছয় মাস পর নাজমার স্বামী মারা যায়। সন্তানহীনা নাজমা সংসারে অভাব আছে বলেই মর্যাদাসম্পন্ন নারী হয়েও কবির সাহেবের বাড়িতে কাজ নেয়। কবির সাহেবের মাতৃহারা শিশুসন্তান রনি ও রানাকে নাজমা সন্তানের স্নেহে লালন-পালন করে। উচ্চ শিক্ষিত রনি ও রানা এখন নাজমাকে মায়ের মতো সম্মান করে। কবির সাহেবের সংসারে স্বর্গসুখ এনে দিয়েছে নাজমা।

ক. গৃহকর্মে মমতাদির মাইনে কত টাকা ঠিক হয়েছিল?
খ. “বেশী আস্কারা দিও না। জ্বালিয়ে মারবে”- ব্যাখ্যা করো।
গ. উদ্দীপকে নাজমা ‘মমতাদি’ গল্পের কোন চরিত্রের প্রতিচ্ছবি? ব্যাখ্যা করো।
ঘ. উদ্দীপকের কবির সাহেবের পরিবারে স্বর্গসুখ এনে দিতে নাজমার যে ভূমিকা ছিল, তা ‘মমতাদি’ গল্পের সমগ্র মূলভাবকে ধারণ করে- যৌক্তিক মতামত দাও।

ক. গৃহকর্মে মমতাদির মাইনে পনেরো টাকা ঠিক করা হয়েছিল।
খ. স্কুলপড়ুয়া ছেলেটির চঞ্চলতা বোঝানোর জন্য গৃহকর্ত্রী প্রশ্নোক্ত মন্তব্য করেছেন।
➠ ‘মমতাদি’ গল্পে স্কুল-পড়ুয়া ছেলেটি শিশুসুলভ আচরণ করে। সে মমতাদির কাছে ছোট ভাইয়ের মর্যাদা লাভ করে। মমতাদিও ছেলেটির কাছে বড় বোনের মর্যাদা পায়। ছেলেটিকে কাছে নিয়ে আদর করতে গেলে গৃহকর্ত্রী ছেলেটির শিশুসুলভ চঞ্চলতার কথা মমতাদিকে জানিয়েছেন।

গ. নিয়োগকারীর পরিবারের সদস্যদের আপন করে নেওয়া, মানবিক আচরণপ্রাপ্তি এবং আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন হওয়ার দিক থেকে ‘মমতাদি’ গল্পের মমতাদির সাথে উদ্দীপকের নাজমার সাদৃশ্য আছে।
➠ মমতাদি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত ‘মমতাদি’ গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র। সংসারের অনটনের কারণে ভদ্র ঘরের নারী হলেও অন্যের বাড়িতে কাজ নিতে বাধ্য হয় সে। তবে তার আত্মমর্যাদাবোধ সবসময়ই ছিল সমুন্নত। নিয়োগকর্ত্রীর পরিবারের সাথে সে নিজেকে সহজেই মানিয়ে নেয়। তাঁর স্কুলপড়ুয়া ছেলেটিকে ছোট ভাইয়ের মতো ভালোবাসে। পরিবারটিও মমতাদির সাথে সৌহার্দ্যপূর্ণ আচরণ করে।
➠ উদ্দীপকের নাজমা অভাবের সাথে যুদ্ধ করার প্রত্যয়ে অন্যের বাড়িতে গৃহকর্মে আত্মনিয়োগ করে। ওই বাড়ির সন্তানহীনা শিশুদের সে মাতৃস্নেহে লালন-পালন করে। তারা বড় হয়ে নাজমার সে ভালোবাসার মর্যাদা রাখে। গৃহকর্মীর কাজ করলেও নাজমার আত্মসম্মানবোধ অটুট ছিল। উদ্দীপকের নাজমা চরিত্রের এ দিকগুলো গল্পের মমতাদির সাথে মিলে যায়।

ঘ. উদ্দীপকের কবির সাহেবের পরিবারে স্বর্গসুখ এনে দিতে নাজমা যে মাতৃময়ী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় তা ‘মমতাদি’ গল্পের আংশিক ভাব ধারণ করে।
➠ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত ‘মমতাদি’ গল্পে গৃহকর্মে নিয়োজিত মানুষের সাথে আমাদের সম্পর্কের নানা দিক উঠে এসেছে। এ গল্পে বর্ণিত মমতাদি সংসারে অভাব বিরাজ করায় মানুষের বাড়িতে কাজ নিতে বাধ্য হয় । নিয়োগর্ত্রীর বাড়ির সমস্ত কাজ সে সুচারুরূপে সম্পন্ন করে। বাড়ির সবাইকে ভালোবাসে। নিয়োগকর্ত্রীর পরিবারও তার প্রতি সন্তুষ্ট হয় এবং তাঁকে যথাসাধ্য সহযোগিতা করে।
➠ উদ্দীপকের নাজমা বিয়ের ছয় মাসের মাথায় স্বামীকে হারায়। দারিদ্র্যের পীড়নে তাই কবির সাহেবের বাসায় কাজ নেয় সে। গৃহকর্মী হলেও ওই বাড়ির মাতৃহারা শিশুদের প্রতি তার আচরণ ছিল মাতৃসুলভ। পরিবারেরই একজন হয়ে সে বাড়িটিতে সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যে ভরিয়ে তোলে। ‘মমতাদি’ গল্পে বর্ণিত গৃহকর্মীর আচরণ একই ধরনের হলেও গল্পের মূল কেন্দ্রে রয়েছে ভিন্ন বিষয়।
➠ ‘মমতাদি’ গল্পের মমতাদির প্রতি তার নিয়োগকর্ত্রীর পরিবারের সবাই অত্যন্ত সহানুভূতিশীল ছিল। নিয়োগকর্ত্রী মমতাদিকে ভালোবেসে মাইনে বাড়িয়ে ঠিক করল। নিজের ছেলেকে দেখাশোনার দায়িত্ব হাসিমুখে মমতাদির ওপর দিল। মমতাদি তাঁর পরিবারের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে উঠেছিল। গৃহকর্মে নিয়োজিত মানুষের প্রতি এমন মানবিক আচরণের দিকটিই ‘মমতাদি’ গল্পে প্রাধান্য পেয়েছে। আলোচ্য প্রশ্নে যে দিকটির অবতারণা করা হয়েছে তা কেবল উদ্দীপকে বর্ণিত গৃহকর্মী নাজমার কর্মনৈপুণ্য ও ব্যক্তিত্বের সাথে সম্পর্কিত, যা ‘মমতাদি’ গল্পের আংশিক ভাবের প্রকাশক। নাজমার প্রতি তার নিয়োগকারী কবির সাহেবের পরিবারের আচরণের বিষয়টি উদ্দীপকে থাকলেও প্রশ্নটি উক্ত বিষয়সংশ্লিষ্ট নয়। তাই কবির সাহেবের পরিবারে স্বর্গসুখ এনে দিতে নাজমার ভূমিকার বিষয়টি মমতাদি গল্পের সমগ্র মূলভাবকে ধারণ করে না।


সৃজনশীল প্রশ্ন- ৪

দরিদ্র কিশোরী শিল্পী গৃহকর্মী হিসেবে কাজ নেয় নরসিংদী শহরের এক ব্যবসায়ীর বাসায়। গৃহকর্ত্রী ওইটুকুন মেয়ের ওপর বাসার সমস্ত কাজের বোঝা চাপিয়ে দেন। রুটি বানানো, কাপড় ধোয়া, থালা-বাসন মাজা, ঘর ঝাড়-মোছা আরো কত কী! মেয়েটি শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়লে গৃহকর্ত্রী তার শরীরের বিভিন্ন স্থানে গরম খুন্তির ছ্যাঁকা দিয়ে দিয়ে পৈশাচিক নির্যাতন চালান।

ক. ‘মমতাদি’ গল্পের রচয়িতা কে?
খ. রাঁধুনী বলায় চমকে মমতাদির মুখ লাল হলো কেন?
গ. উদ্দীপকের কিশোরী শিল্পী ও ‘মমতাদি’ গল্পের মমতাদির সাথে গৃহকর্ত্রীর আচরণের বৈসাদৃশ্য নিরূপণ করো।
ঘ. শিল্পীর প্রতি তার গৃহকর্ত্রীর আচরণ কেমন হওয়া উচিত? ‘মমতাদি’ গল্পের আলোকে তোমার মতামত দাও।

ক. ‘মমতাদি’ গল্পের রচয়িতা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়।
খ. মর্যাদাসম্পন্ন ঘরের নারী হয়েও মমতাদি বাধ্য হয়ে রাঁধুনীর কাজ করতে এসে এই প্রথম রাঁধুনী নামে সম্বোধিত হওয়ায় চমকে তাঁর মুখ লাল হলো।
➠ মমতাদি অভাবের তাড়নায় বাধ্য হয়ে রাঁধুনীর কাজ করতে এসেছেন। স্বামীর বেকারত্ব এবং সংসারের অভাব তাঁকে উপার্জনের জন্য পর্দা ঠেলে বাইরে আসতে বাধ্য করেছে। তিনি কখনো রাঁধুনীর কাজ করেননি। তিনি কখনোই রাঁধুনী নামে সম্বোধিত হওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। তাই জীবনে প্রথম তাঁকে কেউ রাঁধুনী বলে সম্বোধন করায় চমকে তার মুখ লাল হলো।

গ. ‘মমতাদি’ গল্পের মমতাদি গৃহকর্ত্রীর কাছ থেকে মানবিক আচরণ পেলেও উদ্দীপকে কিশোরী শিল্পী গৃহকর্ত্রীর কাছ থেকে পেয়েছে অমানবিক আচরণ।
➠ ‘মমতাদি’ গল্পের মমতাদি মর্যাদাসম্পন্ন ঘরের মেয়ে। সংসারে অভাব অনটন বিরাজ করায় তাঁকে অন্যের বাড়িতে কাজ করতে হয়। কর্মস্থলে সকলেই তাঁকে পরিবারেরই একজন মনে করে তাঁর সাথে আন্তরিক ও মানবিক ব্যবহার করে। কেউ তাঁকে অবহেলা বা ছোট করে দেখেনি। কখনও তাঁর প্রতি কারো সামান্য কটূক্তি কিংবা বিরক্তি প্রকাশ করতে দেখা যায়নি।
➠ অন্যদিকে উদ্দীপকে বর্ণিত গৃহকর্মী শিল্পীর প্রতি মানবিক আচরণ করা হয়নি। বরং তার প্রতি নিষ্ঠুরতা প্রদর্শন করা হয়েছে। তার ওপর চাপানো হয়েছে কাজের বোঝা। চালানো হয়েছে অকথ্য শারীরিক নির্যাতন। ‘মমতাদি’ গল্পের মমতাদি ভালোবাসা ও সম্মান পেলেও উদ্দীপকের শিল্পী পেয়েছে নিষ্ঠুর অমানবিক আচরণ। সেদিক থেকে উদ্দীপকের কিশোরী শিল্পীর গৃহকর্ত্রীর সাথে ‘মমতাদি’ গল্পের মমতাদির গৃহকর্ত্রীর বৈসাদৃশ্য বিদ্যমান।

ঘ. শিল্পীর প্রতি তার গৃহকর্ত্রীর আচরণ হওয়া উচিত মমতাদির গৃহকর্ত্রীর মতোই মানবিক ও আন্তরিকতাপূর্ণ।
➠ ‘মমতাদি’ গল্পের মমতাদি সংসারের অভাব-অনটনের কারণে অন্যের বাসায় গৃহকর্মীর কাজ নেন। মমতাদির গৃহকর্ত্রী তাঁর প্রত্যাশার চেয়ে বেশি মাইনে ধার্য করেন। তাঁকে পরিবারের সবাই আপন করে নেয়। স্কুলপড়–য়া ছেলেটিকেও ছোট ভাইয়ের মতো আদর করার অধিকার দেওয়া হয়।
➠ উদ্দীপকে উল্লিখিত শিল্পীর গৃহকর্ত্রী শিল্পীর ওপর যে অমানুষিক কাজ করেছে তা খুবই গর্হিত কাজ। গৃহকর্মী শিল্পী নিতান্ত পেটের দায়ে অন্যের বাড়িতে কাজ নেয়। গৃহকর্ত্রী একটি ছোট মেয়ের ওপর বাসার সকল কাজের বোঝা চাপিয়ে দেয়। কাজের বোঝা বইবার ক্ষমতা হারিয়ে ফেললে তার ওপর অকথ্য নির্যাতন চালানো হয়। যা আজকের এই সভ্য সমাজে কল্পনা করা যায় না। এ ধরনের কাজ সামাজিক ও নৈতিকতার দিক থেকে যেমন ঘৃণ্য তেমনি আইনের দৃষ্টিতেও বড় ধরনের অপরাধ।
➠ উদ্দীপকে উল্লিখিত শিল্পীর গৃহকর্ত্রীর আচরণ হওয়া উচিত মমতাদির গৃহকর্ত্রীর মতোই সৌহার্দ্যপূর্ণ। স্কুল পড়–য়া ছেলেটির পরিবারের সকলের ভালোবাসা ও আন্তরিক আচরণে মমতাদি তাদের পরিবারেরই একজন হয়ে উঠেছিল। শিল্পীর গৃহকর্ত্রী যদি শিল্পীকে নিজের মেয়ের মতো মনে করত তবে এমন নির্দয় আচরণ করা তার পক্ষে সম্ভব হতো না। মানুষকে হতে হবে মানুষেরই জন্য। কারো অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে তার প্রতি অন্যায় আচরণের পরিবর্তে তার পাশে দাঁড়ানোই মনুষ্যত্বের ধর্ম।


সৃজনশীল প্রশ্ন- ৫

সুবল কয়েক মাস ধরে একটি বাড়িতে নিষ্ঠার সাথে কাজ করছে। বাড়ির লোকজন কারণে-অকারণে প্রায়ই তাকে বকাবকি করে। বাড়ির কর্তা দু-একবার তার গায়ে হাতও তুলেছে। সুবল মনের দুঃখে গোপনে চোখের জল ফেলে।

ক. মমতাদি বাড়িতে আসার কতদিন পর তার সাথে লেখকের ভাব হলো?
খ. মমতাদি প্রথা ভঙ্গ করে উপার্জনের জন্য বাইরে এসেছেন কেন?
গ. উদ্দীপকের সুবলের গৃহকর্মের পরিবেশের সাথে ‘মমতাদি’ গল্পের মমতাদির প্রাপ্ত পরিবেশের অমিল ব্যাখ্যা করো।
ঘ. প্রেক্ষাপট ভিন্ন হলেও উদ্দীপকে ‘মমতাদি’ গল্পের মূলসুরই প্রকাশিত হয়েছে- তোমার মতামতের সপক্ষে যুক্তি দেখাও।

ক. মমতাদি বাড়িতে আসার সপ্তাহখানেক পর তার সাথে লেখকের ভাব হলো।
খ. মমতাদি অভাবের তাড়নায় প্রথা ভঙ্গ করে উপার্জনের জন্য বাইরে এসেছেন।
➠ মমতাদি একজন মর্যাদাসম্পন্ন ঘরের নারী। তার স্বামী চার মাস যাবৎ বেকার। এ অবস্থায় সংসার চালানোর জন্য মমতাদিকে প্রথাভঙ্গ করতে হয়। সামাজিক প্রথামতো নারীদের অন্তঃপুরে থাকার কথা। কিন্তু অভাব মমতাদির জীবনে এর ব্যত্যয় ঘটায়। তিনি বাধ্য হন বাড়ি বাড়ি রান্নার কাজ খুঁজতে।

গ. উদ্দীপকের সুবলের গৃহকর্মের পরিবেশে অমানবিকতার দিকটি প্রকাশ পেলেও ‘মমতাদি’ গল্পে গৃহকর্মীর সাথে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের দিকটি প্রকাশ পেয়েছে।
➠ ‘মমতাদি’ গল্পে গৃহকর্মে নিয়োজিত মানুষের প্রতি মানবিক আচরণ করার দিকটি প্রাধান্য পেয়েছে। ‘মমতাদি’ গল্পে একটি সুন্দর ও বন্ধুত্বপূর্ণ গৃহপরিবেশের কথা বর্ণিত হয়েছে। সেখানে মমতাদি গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করলেও তার আত্মমর্যাদা সমুন্নত রয়েছে। তাকে বাড়ির সকলেই আপন করে নিয়েছে।
➠ উদ্দীপকে সুবলের গৃহপরিবেশে ‘মমতাদি’ গল্পের গৃহপরিবেশের বিপরীত চিত্র ফুটে উঠেছে। সুবল গৃহকর্মী হিসেবে নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করেও গৃহকর্তার অমানবিক আচরণ লাভ করে। তাকে নীরবে চোখের জল ফেলতে হয়। মমতাদি কর্মস্থলে যথার্থ মর্যাদা ও সহানুভূতি লাভ করলেও উদ্দীপকের সুবল তার বিপরীত আচরণ প্রত্যক্ষ করে।

ঘ. দুটি ভিন্ন প্রেক্ষাপটে উদ্দীপক এবং ‘মমতাদি’ গল্পে গৃহকর্মীদের সাথে মানবিক আচরণের দিকটি ফুটে উঠেছে।
➠ ‘মমতাদি’ গল্পে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় গৃহকর্মে নিয়োজিতদের প্রতি আচরণের দিকটিকে প্রধান করে তুলেছেন। আমাদের গৃহকর্মে যারা নিয়োজিত রয়েছে তাদের সাথে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কে স্থাপনের প্রতি লেখক ইঙ্গিত করেছেন। মমতাদির প্রতি তাঁর নিয়োগকারী সুন্দর আচরণ করেছেন। ফলে মমতাদিও নিঃশঙ্কচিত্তে সবাইকে আপন ভাবতে পেরেছেন।
➠ উদ্দীপকে গৃহকর্মীর সাথে আচরণের দিকটিকে তুলে ধরা হয়েছে। আমাদের গৃহকর্মে নিয়োজিতদেরও যে আত্মমর্যাদা আছে সেই দিকটিকে বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে সুবলের চরিত্রের মাঝে। সুবল যেমন গৃহকর্তার কাছে মানবিক আচরণ প্রত্যাশী তেমনি ‘মমতাদি’ গল্পের মমতাদিও মানবিক আচরণ প্রত্যাশী। সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করলে গৃহকর্মীরা গৃহের কাজের প্রতি দায়িত্বশীল এবং আন্তরিক হয়।
➠ যারা গৃহকর্মে কাজ করে তারাও মানুষ। ফলে তারা গৃহকর্তার কাছে নিজের আত্মসম্মান অটুট থাকবে বলে আশা করে। ‘মমতাদি’ গল্প এবং উদ্দীপক উভয়ই গৃহকর্মীর সাথে মানবিক আচরণ করার আবেদনকে মূর্ত করে তুলেছে। গল্পে গৃহকর্মীর সাথে ভালো আচরণের যে শিক্ষা দেওয়া হয়েছে উদ্দীপকে তার প্রয়োজনীয়তাই ফুটে উঠেছে। তাই বলা যায়, প্রেক্ষাপট ভিন্ন হলেও উদ্দীপকে ‘মমতাদি’ গল্পের মূলসুরই প্রকাশিত হয়েছে।


সৃজনশীল প্রশ্ন- ৬

জয়গুণ কাশিয়াডাঙা গ্রামের তালুকদার বাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ করে। প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বাড়ির সকল কাজই তাকে করতে হয়। সারাদিন একটু দম ফেলার ফুরসতও তার হয় না। এত কাজ করেও জয়গুণ তালুকদার বাড়ির কারো মন পায় না। বাড়ির গৃহকর্ত্রী সাহানা বেগম প্রায়ই তার সাথে দুর্ব্যবহার করেন। একটু পান থেকে চুন খসলেই জয়গুণের বিপদ। অমনি সাহানা বেগম তাকে পাঁচকথা শুনিয়ে দেন।

ক. মমতাদির জন্য মাইনে ঠিক হলো কত টাকা?
খ. মমতাদি ভাঁড়ার ঘরে ছোট ছেলেটিকে রসগোল্লা ও সন্দেশ খেতে বাধা দিলেন কেন?
গ. উদ্দীপকের জয়গুণের সাথে ‘মমতাদি’ গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্রের কোন দিক থেকে সাদৃশ্য রয়েছে? ব্যাখ্যা করো।
ঘ. “কিছুটা সাদৃশ্য থাকলেও উদ্দীপকটি ‘মমতাদি’ গল্পের মূলভাবকে ধারণ করে না”- উক্তিটি বিশ্লেষণ করো।

ক. মমতাদির জন্য মাইনে ঠিক হলো পনেরো টাকা?
খ. অতিরিক্ত খাওয়ার ফলে অসুখ হবে ভেবে মমতাদি ভাঁড়ার ঘরে ছোট ছেলেটিকে রসগোল্লা ও সন্দেশ খেতে বাধা দিলেন।
➠ ‘মমতাদি’ গল্পে বাড়িতে অনেক সন্দেশ ও রসগোল্লা নিয়ে বাড়িতে কুটুম আসে। ভাঁড়ার ঘরে গিয়ে বাড়ির ছোট ছেলেটি সেই রসগোল্লা ও সন্দেশ অনবরত মুখে পুরে চলে। মমতাদি এটি দরজার পাশ থেকে দেখে বাধা দেন। কেননা মাত্রাতিরিক্ত মিষ্টি খেলে ছেলেটির পেট খারাপ করতে পারে। এজন্য মমতাদি বাদ সাধেন।

গ. কর্মদক্ষতার দিক থেকে উদ্দীপকের জয়গুণের সাথে ‘মমতাদি’ গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র মমতার সাদৃশ্য ফুটে ওঠে।
➠ ‘মমতাদি’ গল্পে মমতা নামের এক দরিদ্র নারীর কাহিনি বর্ণিত হয়েছে। তিনি অভাবের তাড়নায় অন্যের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করেন। সেখানে বিনা আড়ম্বরে নিখুঁতভাবে বাড়ির সব কাজ করেন। কোনো কাজ তিনি ফেলে রাখেন না। তাঁর কর্মদক্ষতা দেখে বাড়ির সকলেই মুগ্ধ হয়।
➠ উদ্দীপকের জয়গুণ ‘মমতাদি’ গল্পের মমতার মতোই কর্মদক্ষ। সে তালুকদার বাড়িতে গৃহকর্মনিপুণার মতো সারাদিন সকল কাজই করে। মমতা যেমন নীরবে নতমুখে বাড়ির কাজ করে তেমনি উদ্দীপকের জয়গুণও সকল কাজ করে তার কর্মদক্ষতার পরিচয় দেয়। আর এই কর্মদক্ষতার ক্ষেত্রেই জয়গুণ ও মমতার সাদৃশ্য ফুটে ওঠে।

ঘ. ‘মমতাদি’ গল্পে গৃহকর্মীদের সাথে সদ্ব্যবহারের দিকটি প্রধান হয়ে উঠলেও উদ্দীপকে তা অনুপস্থিত।
➠ ‘মমতাদি’ গল্পে গৃহকর্মে নিয়োজিত মানুষের প্রতি মানবিক আচরণ করার দিকটি প্রাধান্য পেয়েছে। কাজের লোক হলেও মমতাদিকে সবাই নিজের বাড়ির একজন বলেই মনে করে। ফলে গৃহকর্মীর সাথে পরিবারের সদস্যদের সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপিত হয়।
➠ উদ্দীপকে গৃহকর্মীদের সাথে মানবিক আচরণ করার দিকটি ফুটে ওঠেনি। সেখানে পরিবারের কেউই গৃহকর্মী জয়গুণের সাথে ভালো ব্যবহার করে না। বিশেষ করে গৃহকর্ত্রী প্রায়ই জয়গুণের সাথে দুর্ব্যবহার করেন। এর মাধ্যমে তালুকদার বাড়ির লোকদের নীচু মানসিকতার প্রকাশ ঘটেছে।
➠ ‘মমতাদি’ গল্পের মূল বক্তব্য হলো মানবিক আচরণ। মমতাদির সংসারে অভাব ছিল বলেই মর্যাদাসম্পন্ন ঘরের নারী হয়েও তাকে অন্যের বাড়িতে কাজ করতে হয়। কর্মস্থলে তাঁর এই আত্মমর্যাদাবোধ তার সবসময়ই সমুন্নত ছিল। ফলে এই দিক থেকে গল্পের সাথে উদ্দীপকের অমিল রয়েছে। আমাদের গৃহকর্মে যারা কাজ করেন তাদের সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করা জরুরি। তাদের আত্মসম্মানবোধকে শ্রদ্ধা করলে তারাও গৃহস্থের পরিবারকে নিজ পরিবার হিসেবে গণ্য করে। আর এটিই গল্পের মূল বক্তব্য, যা উদ্দীপকে অনুপস্থিত। তাই প্রশ্নোক্ত উক্তিটি যথার্থ।


সৃজনশীল প্রশ্ন- ৭

রানু এক ধনী পরিবারে গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করে। বাড়ির লোকজন রানুকে বাইরের একজন লোক হিসেবেই দেখে। একদিন বাড়ি থেকে কিছু টাকা চুরি হয়। কেউ কিছু না বললেও রানু বুঝতে পারে যে কেউ কেউ ওকে সন্দেহ করছে। রানুর সাথে তারা আগের মতো স্বাভাবিক আচরণ করছে না। তাই গৃহকর্ত্রীকে সে কাজ ছেড়ে দেওয়ার কথা জানায়। গৃহকর্ত্রী রানুকে ছাড়তে না চাইলেও সে তার সিদ্ধান্তে অটল থাকে। এমনকি গৃহকর্ত্রী তাকে ঈদের বোনাসসহ সেই মাসের বেতন বুঝিয়ে দিতে গেলে রানু তা নিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে চলে আসে।

ক. ‘বাছা’ শব্দের অর্থ কী?
খ. ‘দু ফোঁটা দুর্বোধ্য রহস্য’ বলতে লেখক কী বোঝাতে চেয়েছেন? ব্যাখ্যা করো।
গ. গৃহকর্মীর প্রতি আচরণের দিক থেকে উদ্দীপক ও ‘মমতাদি’ গল্পের মাঝে অমিল তুলে ধরো।
ঘ. ‘রানু ও মমতাদি দুজনেই আত্মসম্মানবোধে সমুজ্জ্বল’ - উদ্দীপক ও গল্পের আলোকে মতামত দাও।

ক. বাছা শব্দের অর্থ হলো বৎস বা অল্পবয়সী সন্তান।
খ. দু-ফোঁটা দুর্বোধ্য রহস্য বলতে লেখক বোঝাতে চেয়েছেন গৃহকর্ত্রীর কাছে ভালো ব্যবহার পাওয়ার কৃতজ্ঞতায় ফেলা মমতাদির চোখের জলকে।
➠ গৃহকর্ত্রী যখন মমতাদিকে খোকাকে আদর করার পূর্ণ অধিকার দিয়ে গেলেন তখন মমতাদির মনে গভীর ভাবাবেগের উদয় হলো। ভালো লাগা, মর্যাদা আর আত্মগৌরবে তার চোখের জল টপটপ করে ঝরে পড়ল। খোকাকে আদর করার কারণে সে অপমানিত হলে হয়তো তার চোখ শুকনোই থাকত। এজন্যই তার চোখের জলকে ‘দু’ফোটা দুর্বোধ্য রহস্য’ বলা হয়েছে।

গ. মমতাদি গল্পের মমতাদি গৃহকর্মে নিয়োজিত থাকাকালীন যথাযোগ্য সম্মান ও সহায়তা পেলেও উদ্দীপকের রানু পায় অবহেলা ও অমর্যাদা।
➠ ‘মমতাদি’ গল্পের মমতাদি গৃহকর্মী হলেও স্কুলপড়ুয়া ছেলে ও তার পরিবার তাঁকে পরিবারের সদস্যের মর্যদা দিয়েছে। মমতাদি তাদের কাছ থেকে পেয়েছে মানবিক আচরণ, ভালোবাসা ও সম্মান। যার ফলে আত্মমর্যাদাবোধ টিকিয়ে রেখে মমতাদি জীবিকা অর্জন করতে সক্ষম হন।
➠ উদ্দীপকের গৃহকর্মী রানু উপযুক্ত মর্যাদা ও সম্মান পায়নি। টাকা চুরি হওয়ার ঘটনায় গৃহকর্ত্রীসহ সকলেই তাকে সন্দেহের চোখে দেখেছে। তার সাথে অমানবিক ও অস্বাভাবিক আচরণ করায় সে সীমাহীন অপমানবোধ করেছে। এক্ষেত্রে ‘মমতাদি’ গল্পে গৃহকর্মীর প্রতি সদ্ব্যবহার পরিলক্ষিত হলেও উদ্দীপকে তা অনুপস্থিত।

ঘ. উদ্দীপকের রানু ও মমতাদি গল্পের মমতাদি উভয়েই দারিদ্র্যের কাছে মাথানত না করে নিজেদের সততা ও আত্মসম্মানবোধের দৃষ্টান্ত তুলে ধরেছে।
➠ ‘মমতাদি’ গল্পে প্রাধান্য পেয়েছে গৃহকর্মে নিয়োজিতদের প্রতি মানবিক আচরণের দিকটি। এর পাশাপাশি এখানে মূর্ত হয়ে উঠেছে দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত হয়েও কীভাবে মমতাদি ধৈর্যের সাথে নিজের আত্মসম্মানকে টিকিয়ে রেখেছেন। এক্ষেত্রে তাঁর কর্মস্থলের মানুষদের সহানুভূতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
➠ অনুরূপভাবে উদ্দীপকের রানুর চরিত্রটিও আত্মসম্মানবোধে দেদীপ্যমান। উদ্দীপকের রানু দারিদ্র্যজয়ের সংগ্রামে অবতীর্ণ। চুরির মিথ্যা অপবাদের খোটা তাকে বেদনাহত করেছে। তার আত্মসম্মানের কাছে কোনো কিছুই বড় নয়। তাই সে বেতন বোনাস নিতেও অস্বীকৃতি জানায়।
➠ উদ্দীপকের রানু এবং মমতাদির চরিত্র বিশ্লেষণ করলে মনে হয় দারিদ্র্য যেন তাদের মহান করে তুলেছে। সমাজের অপরাপর দারিদ্র্যপীড়িত মানুষের জন্য তারা উদাহরণ হয়ে উঠেছে। মর্যাদাসম্পন্ন ঘরের মেয়ে হলেও মমতাদির জীবনে দারিদ্র্য কতটা প্রকট হয়ে উঠেছিল তা তার জীবনময়ের গলির শ্রীহীন ঘরটি দেখলেই বোঝা যায়। কিন্তু মমতাদি কারো করুণা বা দায় বহন না করে নিজেদের মতো করে দারিদ্র্যকে জয় করার চেষ্টা করেছে। উদ্দীপকের রানুও আত্মমর্যাদা বিসর্জন দেয়নি টাকা বা চাকরি রক্ষার লোভে। শত দারিদ্র্যের মাঝে কীভাবে আত্মসম্মানবোধে রাজটীকা পরে থাকা যায় রানু ও মমতাদি আমাদের কাছে সেই দৃশ্যকল্পই তুলে ধরেছে। তাই প্রশ্নোক্ত মন্তব্যটি যথার্থ।

তথ্যসূত্র :
১. বাংলা সাহিত্য: নবম-দশম শ্রেণি, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড, ঢাকা, ২০২৫।
২. আধুনিক বাংলা অভিধান: বাংলা একাডেমি, এপ্রিল, ২০১৮।
৩. ব্যবহারিক বাংলা অভিধান: বাংলা একাডেমি, ১৮তম, ২০১৫।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url