‘মমতাদি’ গল্পের মূলপাঠ, শব্দার্থ, মূলভাব, বহুনির্বাচনি প্রশ্ন ও সৃজনশীল প্রশ্ন-উত্তর
![]() |
মমতাদি |
মমতাদি
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
শীতের সকাল। রোদে বসে আমি স্কুলের পড়া করছি, মা কাছে বসে ফুলকপি কুটছেন। সে এসেই বলল, আপনার রান্নার জন্য লোক রাখবেন? আমি ছোটো ছেলে-মেয়েও রাখব।
নিঃসঙ্কোচ আবেদন। বোঝা গেল সঙ্কোচ অনেক ছিল, প্রাণপণ চেষ্টায় অতিরিক্ত জয় করে ফেলেছে। তাই যেটুকু সঙ্কোচ নিতান্তই থাকা উচিত তাও এর নেই।
বয়স আর কত হবে, বছর তেইশ। পরনে সেলাই করা ময়লা শাড়ি, পাড়টা বিবর্ণ লাল। সীমান্ত পর্যন্ত ঘোমটা, ঈষৎ বিশীর্ণ মুখে গাঢ় শ্রান্তির ছায়া, স্থির অচঞ্চল দুটি চোখ। কপালে একটি ক্ষত-চিহ্ন-আন্দাজে পরা টিপের মতো।
মা বললেন, তুমি রাঁধুনি?
চমকে তার মুখ লাল হলো। সে চমক ও লালিমার বার্তা বোধহয় মার হৃদয়ে পৌঁছল, কোমল স্বরে বললেন, বোসো বাছা।
সে বসল না। অনাবশ্যক জোর দিয়ে বলল, হ্যাঁ আমি রাঁধুনি। আমায় রাখবেন? আমি রান্না ছাড়া ছোটো ছোটো কাজও করব।
মা তাকে জেরা করলেন। দেখলাম সে ভারি চাপা। মার প্রশ্নের ছাঁকা জবাব দিল, নিজে থেকে বাড়ি থেকে খানিক দূরে একটি কথা বেশি কইল না। সে বলল, তার নাম মমতা। আমাদের জীবনময়ের গলি, গলির ভেতরে সাতাশ নম্বর বাড়ির একতলায় সে থাকে। তার স্বামী আছে আর একটি ছেলে। স্বামীর চাকরি নেই চার মাস, সংসার আর চলে না, সে তাই পর্দা ঠেলে উপার্জনের জন্য বাইরে এসেছে। এই তার প্রথম চাকরি। মাইনে? সে তা জানে না। দুবেলা রেঁধে দিয়ে যাবে, কিন্তু খাবে না।
পনের টাকা মাইনে ঠিক হলো। সে বোধহয় টাকা বারো আশা করেছিল, কৃতজ্ঞতায় দুচোখ সজল হয়ে উঠল। কিন্তু সমস্তটুকু কৃতজ্ঞতা সে নীরবেই প্রকাশ করল, কথা কইল না।
মা বললেন, আচ্ছা, তুমি কাল সকাল থেকে এসো।
সে মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানিয়ে তৎক্ষণাৎ চলে গেল। আমি গেটের কাছে তাকে পাকড়াও করলাম।
শোন। এখুনি যাচ্ছ কেন? রান্নাঘর দেখবে না? আমি দেখিয়ে দিচ্ছি এসো।
কাল দেখবো, বলে সে এক সেকেন্ড দাঁড়াল না, আমায় তুচ্ছ করে দিয়ে চলে গেল। ওকে আমার ভালো লেগেছিল, ওর সঙ্গে ভাব করতে ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলাম, তবু, আমি ক্ষুণ্ণ হয়ে মার কাছে গেলাম। একটু বিস্মিত হয়েও। যার অমন মিষ্টি গলা, চোখে মুখে যার উপচে পড়া স্নেহ, তার ব্যবহার এমন রূঢ়!
মা বললেন, পিছনে ছুটেছিলি বুঝি ভাব করতে? ভাবিস না, তোকে খুব ভালোবাসবে। বার বার তোর দিকে এমন করে তাকাচ্ছিলো!
শুনে খুশি হলাম। রাঁধুনি পদপ্রার্থিনীর স্নেহ সেদিন অমন কাম্য মনে হয়েছিল কেন বলতে পারি না।
পরদিন সে কাজে এল। নীরবে নতমুখে কাজ করে গেল। যে বিষয়ে উপদেশ পেল পালন করল, যে বিষয়ে উপদেশ পেল না নিজের বুদ্ধি খাটিয়ে সুন্দরভাবে সম্পন্ন করল- অনর্থক প্রশ্ন করল না, নির্দেশের অভাবে কোনো কাজ ফেলে রাখল না। সে যেন বহুদিন এ বাড়িতে কাজ করছে বিনা আড়ম্বরে এমন নিখুঁত হলো তার কাজ।
কাজের শৃঙ্খলা ও ক্ষিপ্রতা দেখে সকলে তো খুশি হলেন, মার ভবিষ্যৎ বাণী সফল করে সে যে আমায় খুব ভালোবাসবে তার কোনো লক্ষণ না দেখে আমি হলাম ক্ষুণ্ণ। দুবার খাবার জল চাইলাম, চার পাঁচ বার রান্নাঘরে গিয়ে দাঁড়ালাম, কিন্তু কিছুতেই সে আমায় ভালোবাসল না। বরং রীতিমতো উপেক্ষা করল। শুধু আমাকে নয় সকলকে। কাজগুলিকে সে আপনার করে নিল, মানুষগুলির দিকে ফিরেও তাকাল না। মার সঙ্গে মৃদুস্বরে দু একটি দরকারি কথা বলা ছাড়া ছটা থেকে বেলা সাড়ে দশটা অবধি একবার কাশির শব্দ পর্যন্ত করল না। সে যেন ছায়াময়ী মানবী, ছায়ার মতোই স্লানিমার ঐশ্বর্যে মহীয়সী কিন্তু ধরাছোঁয়ার অতীত শব্দহীন অনুভূতিহীন নির্বিকার।
রাগ করে আমি স্কুলে চলে গেলাম। সে কি করে জানবে মাইনে করা রাঁধুনির দূরে থাকাটাই সকলে তার কাছে আশা করছে না, তার সঙ্গে কথা কইবার জন্য বাড়ির ছোটোকর্তা ছটফট করেছে!
সপ্তাহখানেক নিজের নতুন অবস্থায় অভ্যস্ত হয়ে যাওয়ার পর সে আমার সঙ্গে ভাব করল।
বাড়িতে সেদিন কুটুম এসেছিল, সঙ্গে এসেছিল এক গাদা রসগোল্লা আর সন্দেশ। প্রকাশ্য ভাগটা প্রকাশ্যে খেয়ে ভাঁড়ার ঘরে গোপন ভাগটা মুখে পুরে চলেছি, কোথা থেকে সে এসে খপ করে হাত ধরে ফেলল। রাগ করে মুখের দিকে তাকাতে সে এমন ভাবে হাসল যে লজ্জা পেলাম।
বলল, দরজার পাশ থেকে দেখছিলাম, আর কটা খাচ্ছ গুনছিলাম। যা খেয়েছ তাতেই বোধহয় অসুখ হবে, আর খেয়ো না। কেমন?
ভর্ৎসনা নয়, আবেদন। মার কাছে ধরা পড়লে বকুনি খেতাম এবং এক খাবলা খাবার তুলে নিয়ে ছুটে পালাতাম। এর আবেদনে হাতের খাবার ফেলে দিলাম। সে বলল, লক্ষ্মী ছেলে। এসো জল খাবে।
বাড়ির সকলে কুটুম নিয়ে অন্যত্র ব্যস্ত ছিল, জল খেয়ে আমি রান্নাঘরে আসন পেতে তার কাছে বসলাম। এতদিন তার গম্ভীর মুখই শুধু দেখেছিলাম, আজ প্রথম দেখলাম, সে নিজের মনে হাসছে।
আমি বললাম, বামুনদি-
সে চমকে হাসি বন্ধ করল। এমন ভাবে আমার দিকে তাকাল যেন আমি তাকে গাল দিয়েছি। বুঝতে না পেরেও অপ্রতিভ হলাম।
কি হলো বামুনদি?
সে এদিক ওদিক তাকাল। ডালে খানিকটা নুন ফেলে দিয়ে এসে হঠাৎ আমার গা ঘেঁষে বসে পড়ল। গম্ভীর মুখে বলল, আমায় বামুনদি বোলো না খোকা। শুধু দিদি বোলো। তোমার মা রাগ করবেন দিদি বললে?
আমি মাথা নাড়লাম। সে ছোট এক নিঃশ্বাস ফেলে আমাকে এত কাছে টেনে নিল যে আমার প্রথম ভারি লজ্জা করতে লাগল।
তারপর কিছুক্ষণ আমাদের যে গল্প চলল সে অপূর্ব কথোপকথন মনে করে লিখতে পারলে সাহিত্যে না হোক আমার কাছে সবচেয়ে মূল্যবান লেখা হয়ে উঠত। হঠাৎ মা এলেন। সে দুহাতে আমাকে একরকম জড়িয়েই ধরে ছিল, হাত সরিয়ে ধরা পড়া চোরের মতো হঠাৎ বিব্রত হয়ে উঠল, দুচোখে ভয় দেখা দিল। কিন্তু সে মুহূর্তের জন্য। পরক্ষণে আমার কপালে চুম্বন করে মাকে বলল, এত কথা কইতে পারে আপনার ছেলে।
তখন বুঝিনি, আজ বুঝি স্নেহে সে আমায় আদর করেনি, নিজের গর্ব প্রতিষ্ঠার লোভে। মা যদি বলতেন, খোকা উঠে আয়, যদি কেবল মুখ কালো করে সরে যেতেন, পরদিন থেকে সে আর আসত না। পনের টাকার খাতিরেও না, স্বামীপুত্রের অনাহারের তাড়নাতেও না।
মা হাসলেন। বললে, ও ওইরকম। সারাদিন বকবক করে। বেশি আস্কারা দিও না, জ্বালিয়ে মারবে। বলে মা চলে গেলেন।
তার দুচোখ দিয়ে দুফোঁটা দুর্বোধ্য রহস্য টপ টপ করে ঝরে পড়ল। মা অপমান করলে তার চোখ হয়তো শুকনোই থাকত, সম্মানে, চোখের জল ফেলল! সে সম্মানের আগাগোড়া করুণা ও দয়া মাখা ছিল, সেটা বোধহয় তার সইল না।
তিন চার দিন পরে তার গালে তিনটে দাগ দেখতে পেলাম। মনে হয়, আঙুলের দাগ। মাস্টারের চড় খেয়ে একদিন অবনীর গালে যে রকম দাগ হয়েছিল তেমনি। আমি ব্যস্ত হয়ে প্রশ্ন করলাম, তোমার গালে আঙুলের দাগ কেন? কে চড় মেরেছে?
সে চমকে গালে হাত চাপা দিয়া বলল, দূর! তারপর হেসে বলল, আমি নিজে মেরেছি! কাল রাত্রে গালে একটা মশা বসেছিল, খুব রেগে-
মশা মারতে গালে চড়! বলে আমি খুব হাসলাম। সেও প্রথমটা আমার সঙ্গে হাসতে আরম্ভ করে গালে হাত ঘষতে ঘষতে আনমনা ও গম্ভীর হয়ে গেল। তার মুখ দেখে আমারও হাসি বন্ধ হয়ে গেল। চেয়ে দেখলাম, ভাতের হাঁড়ির বুদবুদফাটা বাষ্পে কি দেখে যেন তার চোখ পলক হারিয়েছে, নিচের ঠোঁট দাঁতে দাঁতে কামড়ে ধরেছে, বেদনায় মুখ হয়েছে কালো।
সন্দিগ্ধ হয়ে বললাম, তুমি মিথ্যে বলছো দিদি। তোমায় কেউ মেরেছে।
সে হঠাৎ কাঁদ কাঁদ হয়ে বলল, না ভাই, না। সত্যি বলছি না। কে মারবে?
এ প্রশ্নের জবাব খুঁজে না পেয়ে আমাকে চুপ করে থাকতে হলো। তখন কি জানি তার গালে চড় মারার অধিকার একজন মানুষের আঠার আনা আছে! কিন্তু চড় যে কেউ একজন মেরেছে সে বিষয়ে আমার সন্দেহ ঘুচল না। শুধু দাগ নয়, তার মুখ চোখের ভাব, তার কথার সুর সমস্ত আমার কাছে ওকথা ঘোষণা করে দিল। বিবর্ণ গালে তিনটি রক্তবর্ণ দাগ দেখতে দেখতে আমার মন খারাপ হয়ে গেল। আমি গালে হাত বুলিয়ে দিতে গেলাম কিন্তু সে আমার হাতটা টেনে নিয়ে বুকে চেপে ধরল।
চুপি চুপি বলল, কারো কাছে যা পাই না, তুমি তা দেবে কেন?
আমি অবাক হয়ে বললাম, কি দিলাম আমি?
এ প্রশ্নের জবাব পেলাম না। হঠাৎ সে তরকারি নামাতে ভারি ব্যস্ত হয়ে পড়ল। পিঁড়িতে বসামাত্র খোঁপা খুলে পিঠ ভাসিয়ে একরাশি চুল মেঝে পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ল কি একটা অন্ধকার রহস্যের আড়ালে সে যেন নিজেকে লুকিয়ে ফেলল।
রহস্য বৈকি। গালে চড়ের দাগ, চিরদিন যে ধৈর্যময়ী ও শান্ত তার ব্যাকুল কাতরতা, ফিসফিস করে ছোটো ছেলেকে শোনানো; কারও কাছে যা পাই না তুমি তা দেবে কেন? বুদ্ধির পরিমাণের তুলনায় এর চেয়ে বড় রহস্য আমার জীবনে কখনো দেখা দেয়নি! ভেবেচিন্তে আমি তার চুলগুলি নিয়ে বেণী পাকাবার চেষ্টা আরম্ভ করে দিলাম। আমার আশা পূর্ণ হলো সে মুখ ফিরিয়ে হেসে রহস্যের ঘোমটা খুলে সহজ মানুষ হয়ে গেল।
বিকালে আমি জিজ্ঞাসা করলাম, আচ্ছা, তোমার বরের চাকরি হলে তুমি কী করবে?
তুমি কী করতে বল? হরির লুট দেব? না তোমায় সন্দেশ খাওয়াব।
ধেৎ তা বলছি না। তোমার বরের চাকরি নেই বলে আমাদের বাড়ি কাজ করছ, তা তো চাকরি হলে করবে না?
সে হাসল, করব। এখন করছি যে!
তোমার বরের চাকরি হয়েছে।
হয়েছে বলে সে গম্ভীর হয়ে গেল।
আহা স্বামীর চাকরি নেই বলে ভদ্রলোকের মেয়ে কষ্টে পড়েছে, পাড়ার মহিলাদের কাছে মার এই মন্তব্য শুনে মমতাদির বরের চাকরির জন্য আমি দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে উঠেছিলাম। তার চাকরি হয়েছে শুনে পুলকিত হয়ে মাকে সংবাদটা শুনিয়ে দিলাম।
মা তাকে ডেকে পাঠালেন, তোমার স্বামীর চাকরি হয়েছে?
সে স্বীকার করে বলল, হয়েছে। বেশি দিন নয়, ইংরাজি মাসের পয়লা থেকে।
মা বললেন, অন্য লোক ঠিক করে দিতে পারছ না বলে কি তুমি কাজ ছেড়ে দিতে ইতস্তত করছ? তার কোনো দরকার নেই। আমরা তোমায় আটকে রাখব না। তোমার কষ্ট দূর হয়েছে তাতে আমরাও খুব সুখী। তুমি ইচ্ছে করলে এবেলাই কাজ ছেড়ে দিতে পার, আমাদের অসুবিধা হবে না।
তার চোখে জল এল, সে শুধু বলল, আমি কাজ করব।
মা বললেন, স্বামীর চাকরি হয়েছে, তবু?
সে বলল, তাঁর সামান্য চাকরি, তাতে কুলবে না মা। আমায় ছাড়বেন না। আমার কাজ কি ভালো হচ্ছে না?
মা ব্যস্ত হয়ে বললেন, অমন কথা তোমার শত্রুও বলতে পারবে না মা। সেজন্য নয়। তোমার কথা ভেবেই আমি বলছিলাম। তোমার ওপর মায়া বসেছে, তুমি চলে গেলে আমাদেরও কি ভালো লাগবে?
সে একরকম পালিয়ে গেল। আমি তার পিছু নিলাম। রান্নাঘরে ঢুকে দেখলাম সে কাঁদছে। আমায় দেখে চোখ মুছল।
আচমকা বলল, মিথ্যে বললে কি হয় খোকা?
মিথ্যে বললে কি হয় জানতাম। বললাম, পাপ হয়।
গুরুনিন্দা বাঁচাতে মিথ্যে বললে?
এটা জানতাম না। গুরুনিন্দা পাপ, মিথ্যা বলা পাপ। কোনটা বেশি পাপ সে জ্ঞান আমার জন্মায়নি। কিন্তু না জানা কথা বলেও সান্ত্বনা দেওয়া চলে দেখে বললাম, তাতে একটুও পাপ হয় না। সত্যি! কাঁদছ কেন?
তখন তার চাকরির এক মাস বোধহয় পূর্ণ হয়নি। একদিন স্কুল থেকে বাড়ি ফেরবার সময় দেখলাম জীবনময়ের গলির মোড়ে ফেরিওয়ালার কাছে কমলা লেবু কিনছে।
সঙ্গে নেবার ইচ্ছে নেই টের পেয়েও এক রকম জোর করেই বাড়ি দেখতে গেলাম। দুটি লেবু কিনে আমাকে সঙ্গে নিয়ে সে গলিতে ঢুকল। বিশ্রী নোংরা গলি। কে যে ঠাট্টা করে এই যমালয়ের পথটার নাম জীবনময় লেন রেখেছিল! গলিটা আস্ত ইট দিয়ে বাঁধানো, পায়ে পায়ে ক্ষয় হয়ে গেছে। দুদিকের বাড়ির চাপে অন্ধকার, এখানে ওখানে আবর্জনা জমা করা আর একটা দূষিত চাপা গন্ধ। আমি সঙ্কুচিত হয়ে তার সঙ্গে চলতে লাগলাম। সে বলল, মনে হচ্ছে পাতালে চলেছ, না?
সাতাশ নম্বরের বাড়িটা দোতলা নিশ্চয়, কিন্তু যত ক্ষুদ্র দোতলা হওয়া সম্ভব। সদর দরজার পরেই ছোটো একটি উঠান, মাঝামাঝি কাঠের প্রাচীর দিয়ে দুভাগ করা। নিচে ঘরের সংখ্যা বোধহয় চার, কারণ মমতাদি আমায় যে ভাগে নিয়ে গেল সেখানে দুখানা ছোটো ছোটো কুঠরির বেশি কিছু আবিষ্কার করতে পারলাম না। ঘরের সামনে দুহাত চওড়া একটু রোয়াক, একপাশে একশিট করোগেট আয়রনের ছাদ ও চটের বেড়ার অস্থায়ী রান্নাঘর। চটগুলি কয়লার ধোঁয়ায় কয়লার বর্ণ পেয়েছে।
সে আমাকে শোবার ঘরে নিয়ে গিয়ে টুলে বসাল। ঘরে দুটি জানালা আছে এবং সম্ভবত সেই কারণেই শোবার ঘর করে অন্য ঘরখানার চেয়ে বেশি মান দেওয়া হয়েছে। কিন্তু জানালা দুটির এমনি অবস্থান যে আলো যদিও কিছু কিছু আসে, বাতাসের আসা-যাওয়া একেবারে অসম্ভব। সুতরাং পক্ষপাতিত্বের যে খুব জোরালো কারণ ছিল তা বলা যায় না। সংসারের সমস্ত জিনিসই প্রায় এঘরে ঠাঁই পেয়েছে। সব কম দামি শ্রীহীন জিনিস। এই শ্রীহীনতার জন্য সযত্নে গুছিয়ে রাখা সত্ত্বেও মনে হচ্ছে বিশৃঙ্খলতার অন্ত নেই। একপাশে বড়ো চৌকি, তাতে গুটানো মলিন বিছানা। চৌকির তলে একটি চরকা আর ভাঙা বেতের বাস্কেট চোখে পড়ে, অন্তরালে হয়তো আরও জিনিস আছে। ঘরের এক কোণে পাশাপাশি রক্ষিত দুটি ট্রাংক- দুটিরই রং চটে গেছে, একটির তালা ভাঙা। অন্য কোণে কয়েকটা মাজা বাসন, বাসনের ঠিক ঊর্ধ্বে কোনাকুনি টাঙ্গানো দড়িতে খানকয়েক কাপড়। এই দুই কোণের মাঝামাঝি দেওয়াল ঘেঁষে পাতা একটি ভাঙা টেবিল, আগাগোড়া দড়ির ব্যান্ডেজের জোরে কোনমতে দাঁড়িয়ে আছে। টেবিলে কয়েকটা বই-খাতা, একটি অল্প দামি টাইমপিস, কয়েকটা ওষুধের শিশি, একটা মেরামত করা আর্সি, কয়েকটা ভাঁজ করা সংবাদপত্র, এই সব টুকিটাকি জিনিস। টেবিলের উর্ধ্বে দেওয়ালের গর্তের তাকে কতকগুলি বই।
ঘরে আর একটি জিনিস ছিল- একটি বছর পাঁচেকের ছেলে। চৌকিতে শুধু মাদুরের ওপরে উপুড় হয়ে শুয়ে সে ঘুমিয়ে ছিল। মমতাদি ঘরে ঢুকেই ব্যস্ত হয়ে ছেলেটির গায়ে হাত দিল, তারপর গুটানো বিছানার ভেতর থেকে লেপ আর বালিশ টেনে বার করল। সন্তর্পণে ছেলেটির মাথার তলে বালিশ দিয়ে লেপ দিয়ে গা ঢেকে দিল।
বলল, কাল সারারাত পেটের ব্যথায় নিজেও ঘুমোয়নি, আমাকেও ঘুমোতে দেয়নি। উনি তো রাগ করে-কই, তুমি লেবু খেলে না?
আমি একটা লেবু খেলাম। সে চুপ করে খাওয়া দেখে বলল, মুড়ি ছাড়া ঘরে কিছু নেই, দোকানের বিষও দেব না, একটা লেবু খাওয়াতে তোমাকে ডেকে আনলাম! আমি বললাম, আর একটা লেবু খাব দিদি।
সে হেসে লেবু দিল, বলল, কৃতার্থ হলাম। সবাই যদি তোমার মতো ভালোবাসত!
ঘরে আলো ও বাতাসের দীনতা ছিল। খানিক পরে সে আমায় বাইরে রোয়াকে মাদুর পেতে বসাল। কথা বলার সঙ্গে সংসারের কয়েকটা কাজও করে নিল। ঘর ঝাঁট দিল, কড়াই মাজল, পানি তুলল, তারপর মশলা বাটতে বসল। হঠাৎ বলল, তুমি এবার বাড়ি যাও ভাই। তোমার খিদে পেয়েছে।
উৎস নির্দেশ : |
---|
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘সরীসৃপ’(১৯৩৯) গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত ‘মমতাদি’ গল্প। |
শব্দার্থ ও টীকা : |
---|
➠ বাছা- বৎস বা অল্পবয়সী সন্তান। ➠ পর্দা ঠেলে উপার্জন- এখানে নারীদের অন্তঃপুরে থাকার প্রথাভঙ করে বাইরে এসে আয়-রোজগার করা বোঝাচ্ছে। ➠ অনাড়ম্বর- জাঁকজমকহীন। ➠ বামুনদি- ব্রাহ্মণদিদির সংক্ষিপ্ত রূপ। আগে রান্না বা গৃহকর্মে যে ব্রাহ্মণকন্যাগণ নিয়োজিত হতেন তাদের কথ্যরীতিতে বামুনদি ডাকা হতো। ➠ অপ্রতিভ অপ্রস্তুত। ➠ পরদিন থেকে সে আর আসত না- না আসার কারণ আত্মসম্মান। মমতাদি টাকার জন্য অন্যের বাড়িতে কাজ নিয়েছে সত্য কিন্তু তাকে অসম্মান করলে বা সন্দেহের চোখে দেখলে নিজে অপমান বোধ করে চাকরি ত্যাগের সাহস তার ছিল। ➠ হরির লুট- ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দান করা। সংকীর্তনের পর হরির নামে যেভাবে বাতাসা ছড়ানো হয়। |
কর্ম-অনুশীলন : |
---|
স্নেহ-ভালোবাসা ‘ধনী-গরিবের সমান’-এ বিষয়ে একটি অনুচ্ছেদ লেখো |
পাঠ-পরিচিতি : |
---|
‘মমতাদি’ গল্পে গৃহকর্মে নিয়োজিত মানুষের প্রতি মানবিক আচরণের দিকটি প্রাধান্য পেয়েছে। স্কুল পড়ুয়া একটি ছেলে যখন দেখে তাদের বাড়িতে মমতাদি নামে এক গৃহকর্মী আসে, তখন সে আনন্দিত হয়। তাকে নিজের বাড়ির একজন বলে ভাবতে শুরু করে ছেলেটি। মমতাদির সংসারে অভাব আছে বলেই মর্যাদাসম্পন্ন ঘরের নারী হয়েও তাকে অপরের বাড়িতে কাজ নিতে হয়। এই আত্মমর্যাদাবোধ তার সবসময়ই সমুন্নত ছিল। সে নিজে যেমন আদর ও সম্মানপ্রত্যাশী, তেমনি অন্যকেও স্নেহ ও ভালোবাসা দেবার ক্ষেত্রে তার মধ্যে দ্বিধা ছিল না। স্কুলপড়ুয়া ছেলেটি তাই মমতাদির কাছে ছোটো ভাইয়ের মর্যাদা লাভ করে। তাকে নিজ বাসায় নিয়ে গিয়ে যথাসামর্থ্য আপ্যায়ন করে মমতাদি। সম্মান ও সহমর্মিতা নিয়ে মমতাদির পাশেও দাঁড়ায় স্কুলপড়ুয়া ঐ ছেলে ও তার পরিবার। প্রকৃতপক্ষে, আমাদের গৃহকর্মে যাঁরা সহায়তা করে থাকেন তাঁদের সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করা জরুরি। আত্মসম্মানবোধ তাদেরও আছে। ‘মমতাদি’ গল্পটি আমাদের এই শিক্ষা দেয় যে, সামাজিক শ্রেণি মানবিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় কোনো বাধা সৃষ্টি করতে পারে না; যে কোনো পেশার যে কোনো মানুষকে দেখতে হবে শ্রদ্ধা ও মর্যাদার দৃষ্টিতে। |
লেখক পরিচিতি : |
---|
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯০৮ সালে বিহারের সাঁওতাল পরগনায় জন্মগ্রহণ
করেন। তাঁর নাম প্রবোধ কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর পৈতৃক বাড়ি
মুন্সীগঞ্জের বিক্রমপুর অঞ্চলের মালবদিয়া গ্রাম এবং মায়ের বাড়ি একই
অঞ্চলের গাঁওদিয়া গ্রাম। তিনি মেদিনীপুর জিলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক ও
বাঁকুড়া ওয়েসলিয় মিশন কলেজ থেকে আইএসসি পাশ করেন। তারপর গণিতে অনার্স
নিয়ে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে বি. এসসি ক্লাসে ভর্তি হন। কিন্তু
বন্ধুদের সঙ্গে বাজি ধরে অতসীমামী নামক গল্প বিচিত্রা পত্রিকায়
প্রকাশিত হলে লেখক হিসেবে তাঁর যত্রা শুরু হয়। এ সময় তিনি লেখা নিয়ে
এতই মগ্ন থাকেন যে, অসাধারণ এই কৃতী ছাত্রের আর অনার্স পাস করা হয়নি।
মাত্র একুশ বছর বয়সে তিনি তাঁর বিখ্যাত ‘দিবারাত্রির কাব্য’ রচনা করেন।
এরপর তিনি লেখালেখিকেই জীবিকার একমাত্র অবলম্বন হিসেবে গ্রহণ করেন।
পদ্মা নদীর মাঝি ও পুতুল নাচের ইতিকথা লিখে তিনি বাংলা কথাসাহিত্যের
সিংহাসনে আরোহণ করেন। জননী, চিহ্ন, সহরতলী, অহিংস, চতুষ্কোণ প্রভৃতি
তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাস। ১৯৫৬ সালের ৩রা ডিসেম্বর এই মহান লেখক মৃত্যুবরণ করেন। |
বহুনির্বাচনি প্রশ্ন : |
---|
প্রশ্ন থেকে
অভিনন্দন!
|
জ্ঞানমূলক প্রশ্ন : |
---|
১. মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বন্ধুদের সাথে বাজি ধরে কোন গল্প রচনা করেন? উত্তর : মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বন্ধুদের সাথে বাজি ধরে ‘অতসীমামী’ নামক গল্প রচনা করেন। ২. মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় কতটি উপন্যাস রচনা করেন? উত্তর : মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় পঞ্চাশটিরও অধিক উপন্যাস রচনা করেন। ৩. মমতাদি কোথায় থাকেন? উত্তর : মমতাদি জীবনময়ের গলিতে থাকেন। ৪. মমতাদির স্বামীর কয় মাস ধরে চাকরি নেই? উত্তর : মমতাদির স্বামীর চাকরি নেই চারমাস। ৫. মমতাদির কত টাকা মাইনে ঠিক হলো? উত্তর : মমতাদির পনেরো টাকা মাইনে ঠিক হলো। ৬. মমতাদির কী দেখে সকলে খুশি হলো? উত্তর : মমতাদির কাজের শৃঙ্খলা ও ক্ষিপ্রতা দেখে সকলে খুশি হলো। ৭. ‘মমতাদি’ গল্পে বাড়িতে কী নিয়ে কুটুম এসেছিল? উত্তর : ‘মমতাদি’ গল্পে বাড়িতে রসগোল্লা ও সন্দেশ নিয়ে কুটুম এসেছিল। ৮. ‘মমতাদি’ গল্পে কার গালে তিনটি আঙুলের দাগ দেখা যায়? উত্তর : ‘মমতাদি’ গল্পে মমতাদির গালে তিনটি আঙুলের দাগ দেখা যায়। ৯. ‘মমতাদি’ গল্পে ছোট ছেলেটি কার চুলে বেণী পাকাবার চেষ্টা করে? উত্তর : ‘মমতাদি’ গল্পে ছোট ছেলেটি মমতাদির চুলে বেণী পাকাবার চেষ্টা করে। ১০. কবে থেকে মমতাদির বরের চাকরি হয়েছে? উত্তর : ইংরেজি মাসের পয়লা থেকে মমতাদির বরের চাকরি হয়েছে। ১১. মিথ্যে বললে কী হয়? উত্তর : মিথ্যে বললে পাপ হয়। ১২. মমতাদি জীবনময়ের গলির কয় নম্বর বাড়িতে থাকেন? উত্তর : মমতাদি জীবনময়ের গলির সাতাশ নম্বর বাড়িতে থাকেন। ১৩. সাতাশ নম্বর বাড়িটি কয় তলা? উত্তর : সাতাশ নম্বর বাড়িটি দোতলা। ১৪. জীবনময়ের গলির মোড়ে ফেরিওয়ালার কাছ থেকে কে কমলালেবু কিনেছিলেন? উত্তর : জীবনময়ের গলির মোড়ে ফেরিওয়ালার কাছ থেকে মমতাদি কমলালেবু কিনেছিলেন। ১৫. মমতাদির বাড়িতে চটের বেড়া দিয়ে কী তৈরি করা হয়েছে? উত্তর : মমতাদির বাড়িতে চটের বেড়া দিয়ে অস্থায়ী রান্নাঘর তৈরি করা হয়েছে। ১৬. মমতাদি ছোট ছেলেটিকে কোন ঘরে নিয়ে গিয়ে টুলে বসাল? উত্তর : মমতাদি ছোট ছেলেটিকে শোবার ঘরে নিয়ে গিয়ে টুলে বসাল। ১৭. মমতাদির শোবার ঘরে কয়টি জানালা আছে? উত্তর : মমতাদির শোবার ঘরে দুটি জানালা আছে। ১৮. মমতাদির সংসারের প্রায় সমস্ত জিনিস কোন ঘরে ঠাঁই পেয়েছে? উত্তর : মমতাদির সংসারের প্রায় সমস্ত জিনিস শোবার ঘরে ঠাঁই পেয়েছে। ১৯. মমতাদির কয় বছর বয়সী একটি ছেলে রয়েছে? উত্তর : মমতাদির পাঁচ বছর বয়সী একটি ছেলে রয়েছে। ২০. মমতাদির ঘরে টেবিলের ঊর্ধ্বে দেয়ালের গর্তের তাকে কী রয়েছে? উত্তর : মমতাদির ঘরে টেবিলের ঊর্ধ্বে দেয়ালের গর্তের তাকে কতকগুলো বই রয়েছে। ২১. মমতাদির বাড়িতে কে সারারাত পেটের ব্যথায় ঘুমায়নি? উত্তর : মমতাদির বাড়িতে মমতাদির ছেলে সারারাত পেটের ব্যথায় ঘুমায়নি। ২২. মমতাদির বাড়িতে ছোট ছেলেটি কয়টি কমলালেবু খেল? উত্তর : মমতাদির বাড়িতে ছোট ছেলেটি দুটি কমলালেবু খেল। ২৩. ‘মমতাদি’ গল্পে কার ঘরে মুড়ি ছাড়া খাওয়ার জিনিস কিছু নেই? উত্তর : ‘মমতাদি’ গল্পে মমতাদির ঘরে মুড়ি ছাড়া খাওয়ার জিনিস কিছু নেই। ২৪. মমতাদি ছোট ছেলেটিকে কোথায় মাদুর পেতে বসতে দিল? উত্তর : মমতাদি ছোট ছেলেটিকে বাইরে রোয়াকে মাদুর পেতে বসতে দিল। ২৫. ‘মমতাদি’ গল্পটি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কোন গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত? উত্তর : ‘মমতাদি’ গল্পটি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘সরীসৃপ’ নামক গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। ২৬. ‘মমতাদি’ গল্পে স্কুলপড়ুয়া ছেলেটি মমতাদির কাছে ছোট ভাইয়ের মর্যাদা লাভ করে। উত্তর : ‘মমতাদি’ গল্পে স্কুলপড়ুয়া ছেলেটি মমতাদির কাছে ছোট ভাইয়ের মর্যাদা লাভ করে। ২৭. মমতাদি কাকে নিজ বাসায় নিয়ে গিয়ে যথাসামর্থ্য আপ্যায়ন করেন? উত্তর : মমতাদি স্কুলপড়ুয়া ছেলেটিকে নিজ বাসায় নিয়ে গিয়ে যথাসামর্থ্য আপ্যায়ন করেন। ২৮. সম্মান ও সহমর্মিতা নিয়ে স্কুল পড়ুয়া ছেলে ও তার পরিবার কার পাশে দাঁড়ায়? উত্তর : সম্মান ও সহমর্মিতা নিয়ে স্কুলপড়ুয়া ছেলে ও তার পরিবার মমতাদির পাশে দাঁড়ায়। |
অনুধাবনমূলক প্রশ্ন : |
---|
১. কাজ চাইতে গিয়ে মমতাদির যেটুকু সংকোচ থাকা দরকার ছিল তাও একেবারে নেই-
কেন?
২. মমতাদির ওপর বাড়ির সকলে খুশি হলেন কেন?
৩. মমতাদির ওপর ছোট ছেলেটি ক্ষুব্ধ হলো কেন?
৪. মমতাদি ছোট ছেলেটিকে বামুনদি বলতে নিষেধ করেন কেন?
৫. মমতাদি তাঁর চড় খাওয়ার বিষয়টি গোপন করেছিলেন কেন?
৬. মমতাদির বরের চাকরির জন্য ছোট ছেলেটি দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল
কেন?
৭. ‘পরদিন থেকে সে আর আসত না’- কেন? |
সৃজনশীল প্রশ্ন- ১ |
---|
রাসেল ড্রাইভার হিসেবে যেমন দক্ষ তেমনি সৎ। প্রকৌশলী এমারত সাহেব তাকে ব্যক্তিগত ড্রাইভার হিসেবে নিয়োগ দেন। ইফতি, সনাম ও শিলাকে স্কুলে নিয়ে যাওয়া-আসাই তার প্রধান কাজ। ঘরের সবাই ওকে ভীষণ ভালোবাসে। ইফতিরা ওকে ভাইয়া বলে ডাকে, একসাথে খায়, গল্প করে, বেড়াতে যায়। রাসেলের প্রতি সন্তানদের এই আচরণে এমারত সাহেব ভীষণ খুশি।
ক. মমতাদির বয়স কত ছিল? |
ক. মমতাদির বয়স ছিল ২৩ বছর।
গ. উদ্দীকের রাসেলের মধ্যে বিদ্যমান মমতাদির বিশেষ গুণটি হচ্ছে দক্ষতা ও
সততা।
ঘ. রাসেল ও মমতাদির প্রতি দুই পরিবারের সৌহার্দ্যপূর্ণ আচরণ সামাজিক
সংহতি সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। |
সৃজনশীল প্রশ্ন- ২ |
---|
দারিদ্র্যের কারণে নিলুফা বেশি পড়াশোনা করতে পারেনি। এসএসসি পাস করে সে একটি হাসপাতালে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী হিসেবে কাজ করছে। কাজের প্রতি তার দায়িত্বশীলতা দেখে প্রতিষ্ঠানের প্রায় সবাই তার প্রশংসা করে। তবে মাঝেমধ্যে কারও কটু কথা শুনলে তার মনে খুব দুঃখ লাগে। সে মর্মাহত হয়।
ক. মমতাদির বয়স কত? |
ক. মমতাদির বয়স তেইশ বছর।
গ. কাজের প্রতি আন্তরিকতা ও দায়িত্বশীলতার দিক থেকে উদ্দীপকের নিলুফা ও
‘মমতাদি’ গল্পের মমতাদি চরিত্রটি সাদৃশ্যপূর্ণ।
ঘ. ‘মমতাদি’ গল্পে গৃহকর্মীদের সাথে মানবিক আচরণের বিষয়টি প্রাধান্য লাভ
করলেও উদ্দীপকে তা অনুপস্থিত থাকায় উদ্দীপকটি ‘মমতাদি’ গল্পের সামগ্রিক
ভাবকে ধারণ করে না। |
সৃজনশীল প্রশ্ন- ৩ |
---|
বিয়ের ছয় মাস পর নাজমার স্বামী মারা যায়। সন্তানহীনা নাজমা সংসারে অভাব আছে বলেই মর্যাদাসম্পন্ন নারী হয়েও কবির সাহেবের বাড়িতে কাজ নেয়। কবির সাহেবের মাতৃহারা শিশুসন্তান রনি ও রানাকে নাজমা সন্তানের স্নেহে লালন-পালন করে। উচ্চ শিক্ষিত রনি ও রানা এখন নাজমাকে মায়ের মতো সম্মান করে। কবির সাহেবের সংসারে স্বর্গসুখ এনে দিয়েছে নাজমা।
ক. গৃহকর্মে মমতাদির মাইনে কত টাকা ঠিক হয়েছিল? |
ক. গৃহকর্মে মমতাদির মাইনে পনেরো টাকা ঠিক করা হয়েছিল।
গ. নিয়োগকারীর পরিবারের সদস্যদের আপন করে নেওয়া, মানবিক আচরণপ্রাপ্তি এবং
আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন হওয়ার দিক থেকে ‘মমতাদি’ গল্পের মমতাদির সাথে
উদ্দীপকের নাজমার সাদৃশ্য আছে।
ঘ. উদ্দীপকের কবির সাহেবের পরিবারে স্বর্গসুখ এনে দিতে নাজমা যে মাতৃময়ী
ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় তা ‘মমতাদি’ গল্পের আংশিক ভাব ধারণ করে। |
সৃজনশীল প্রশ্ন- ৪ |
---|
দরিদ্র কিশোরী শিল্পী গৃহকর্মী হিসেবে কাজ নেয় নরসিংদী শহরের এক ব্যবসায়ীর বাসায়। গৃহকর্ত্রী ওইটুকুন মেয়ের ওপর বাসার সমস্ত কাজের বোঝা চাপিয়ে দেন। রুটি বানানো, কাপড় ধোয়া, থালা-বাসন মাজা, ঘর ঝাড়-মোছা আরো কত কী! মেয়েটি শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়লে গৃহকর্ত্রী তার শরীরের বিভিন্ন স্থানে গরম খুন্তির ছ্যাঁকা দিয়ে দিয়ে পৈশাচিক নির্যাতন চালান।
ক. ‘মমতাদি’ গল্পের রচয়িতা কে? |
ক. ‘মমতাদি’ গল্পের রচয়িতা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়।
গ. ‘মমতাদি’ গল্পের মমতাদি গৃহকর্ত্রীর কাছ থেকে মানবিক আচরণ পেলেও
উদ্দীপকে কিশোরী শিল্পী গৃহকর্ত্রীর কাছ থেকে পেয়েছে অমানবিক আচরণ।
ঘ. শিল্পীর প্রতি তার গৃহকর্ত্রীর আচরণ হওয়া উচিত মমতাদির গৃহকর্ত্রীর
মতোই মানবিক ও আন্তরিকতাপূর্ণ। |
সৃজনশীল প্রশ্ন- ৫ |
---|
সুবল কয়েক মাস ধরে একটি বাড়িতে নিষ্ঠার সাথে কাজ করছে। বাড়ির লোকজন কারণে-অকারণে প্রায়ই তাকে বকাবকি করে। বাড়ির কর্তা দু-একবার তার গায়ে হাতও তুলেছে। সুবল মনের দুঃখে গোপনে চোখের জল ফেলে।
ক. মমতাদি বাড়িতে আসার কতদিন পর তার সাথে লেখকের ভাব হলো? |
ক. মমতাদি বাড়িতে আসার সপ্তাহখানেক পর তার সাথে লেখকের ভাব হলো।
গ. উদ্দীপকের সুবলের গৃহকর্মের পরিবেশে অমানবিকতার দিকটি প্রকাশ পেলেও
‘মমতাদি’ গল্পে গৃহকর্মীর সাথে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের দিকটি প্রকাশ
পেয়েছে।
ঘ. দুটি ভিন্ন প্রেক্ষাপটে উদ্দীপক এবং ‘মমতাদি’ গল্পে গৃহকর্মীদের সাথে
মানবিক আচরণের দিকটি ফুটে উঠেছে। |
সৃজনশীল প্রশ্ন- ৬ |
---|
জয়গুণ কাশিয়াডাঙা গ্রামের তালুকদার বাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ করে। প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বাড়ির সকল কাজই তাকে করতে হয়। সারাদিন একটু দম ফেলার ফুরসতও তার হয় না। এত কাজ করেও জয়গুণ তালুকদার বাড়ির কারো মন পায় না। বাড়ির গৃহকর্ত্রী সাহানা বেগম প্রায়ই তার সাথে দুর্ব্যবহার করেন। একটু পান থেকে চুন খসলেই জয়গুণের বিপদ। অমনি সাহানা বেগম তাকে পাঁচকথা শুনিয়ে দেন।
ক. মমতাদির জন্য মাইনে ঠিক হলো কত টাকা? |
ক. মমতাদির জন্য মাইনে ঠিক হলো পনেরো টাকা?
গ. কর্মদক্ষতার দিক থেকে উদ্দীপকের জয়গুণের সাথে ‘মমতাদি’ গল্পের
কেন্দ্রীয় চরিত্র মমতার সাদৃশ্য ফুটে ওঠে।
ঘ. ‘মমতাদি’ গল্পে গৃহকর্মীদের সাথে সদ্ব্যবহারের দিকটি প্রধান হয়ে উঠলেও
উদ্দীপকে তা অনুপস্থিত। |
সৃজনশীল প্রশ্ন- ৭ |
---|
রানু এক ধনী পরিবারে গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করে। বাড়ির লোকজন রানুকে বাইরের একজন লোক হিসেবেই দেখে। একদিন বাড়ি থেকে কিছু টাকা চুরি হয়। কেউ কিছু না বললেও রানু বুঝতে পারে যে কেউ কেউ ওকে সন্দেহ করছে। রানুর সাথে তারা আগের মতো স্বাভাবিক আচরণ করছে না। তাই গৃহকর্ত্রীকে সে কাজ ছেড়ে দেওয়ার কথা জানায়। গৃহকর্ত্রী রানুকে ছাড়তে না চাইলেও সে তার সিদ্ধান্তে অটল থাকে। এমনকি গৃহকর্ত্রী তাকে ঈদের বোনাসসহ সেই মাসের বেতন বুঝিয়ে দিতে গেলে রানু তা নিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে চলে আসে।
ক. ‘বাছা’ শব্দের অর্থ কী? |
ক. বাছা শব্দের অর্থ হলো বৎস বা অল্পবয়সী সন্তান।
গ. মমতাদি গল্পের মমতাদি গৃহকর্মে নিয়োজিত থাকাকালীন যথাযোগ্য সম্মান ও
সহায়তা পেলেও উদ্দীপকের রানু পায় অবহেলা ও অমর্যাদা।
ঘ. উদ্দীপকের রানু ও মমতাদি গল্পের মমতাদি উভয়েই দারিদ্র্যের কাছে মাথানত
না করে নিজেদের সততা ও আত্মসম্মানবোধের দৃষ্টান্ত তুলে ধরেছে। |
তথ্যসূত্র : |
---|
১. বাংলা সাহিত্য: নবম-দশম শ্রেণি, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক
বোর্ড, ঢাকা, ২০২৫। ২. আধুনিক বাংলা অভিধান: বাংলা একাডেমি, এপ্রিল, ২০১৮। ৩. ব্যবহারিক বাংলা অভিধান: বাংলা একাডেমি, ১৮তম, ২০১৫। |