৫. অনুচ্ছেদ রচনা

৫. অনুচ্ছেদ রচনা
বাক্য মনের ভাব প্রকাশের মাধ্যম। কিন্তু সব সময় একটি বাক্যের মাধ্যমে মনের সম্পূর্ণ ভাব প্রকাশ করা সম্ভব হয় না। প্রয়োজন হয় একাধিক বাক্যের। মনের ভাব সম্পূর্ণরূপে প্রকাশ করার জন্য পরস্পর সম্বন্ধযুক্ত বাক্যের সমষ্টিই অনুচ্ছেদ।
অনুচ্ছেদ এবং প্রবন্ধ এক বিষয় নয়। কোনো বিষয়ের সকল দিক আলোচনা করতে হয় প্রবন্ধে। কোনো বিষয়ের একটি দিকের আলোচনা করা হয় এবং একটিমাত্র ভাব প্রকাশ পায় অনুচ্ছেদে। অনুচ্ছেদ রচনার কয়েকটি নিয়ম রয়েছে। যেমন-
ক) একটি অনুচ্ছেদের মধ্যে একটিমাত্র ভাব প্রকাশ করতে হবে। অতিরিক্ত কোনো কথা লেখা যাবে না।
খ) সুশৃঙ্খলভাবে সাজানো বাক্যের মাধ্যমে বিষয় ও ভাব প্রকাশ করতে হবে।
গ) অনুচ্ছেদটি খুব বেশি বড় করা যাবে না।
ঘ) একই কথার পুনরাবৃত্তি যাতে না ঘটে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
ঙ) যে বিষয়ে অনুচ্ছেদটি রচনা করা হবে, তার গুরুত্বপূর্ণ দিকটি সহজ-সরল ভাষায় সুন্দরভাবে তুলে ধরতে হবে।

৫.১ ছবি আঁকা

মানুষ ভাবতে ভালোবাসে। মানুষের মনে যেসব ভাবনা খেলা করে সেসবের শিল্পময় প্রকাশই ছবি। কে কখন ছবি আঁকা শুরু করেছিল তা বলা মুশকিল। তবে মানুষের আঁকা সবচেয়ে পুরোনো ছবির কথা জানা যায়। ১৮৭৯ খ্রিষ্টাব্দে স্পেনে আলতামিরা নামক এক গুহায় প্রথম মানুষের আঁকা ছবির সন্ধান মেলে। যেকোনো মানুষই ছবি আঁকে। এমন কোনো মানুষ নেই যে জীবনে কোনোদিন ছবি আঁকেনি। যে-কোনো ছবি, হতে পারে তা কোনো পশু, পাখি, মাছ, আম, জাম, কাঁঠাল, পেঁপে- এর কোনো-না-কোনোটি মানুষ জীবনে একবার হলেও এঁকেছে। আঁকতে আঁকতে অনেকের ছবি আঁকাটাই নেশা হয়ে যায় এবং জীবনে ছবি আঁকা ছাড়া তারা আর কিছু ভাবতে পারে না। ছবি আঁকা নিয়েই তাদের স্বপ্ন, ছবি-আঁকাই তাদের পেশা হয়ে যায়। তারা নিজেদের প্রতিভার প্রকাশ ঘটায় ছবি আঁকার মধ্য দিয়ে। পৃথিবীতে অনেকে বিখ্যাত হয়েছেন শুধু ছবি এঁকে।

৫.২ ফেরিওয়ালা

রাস্তায় রাস্তায় হেঁটে নানা ধরনের সামগ্রী বিক্রি করে বা ফেরি করে যে জীবিকা নির্বাহ করে, সে-ই ফেরিওয়ালা। ফেরিওয়ালা আমাদের নিত্যদিনের পরিচিত ব্যক্তি। প্রতিদিনই আমরা দেখি তারা মহল্লায় মহল্লায়, রাস্তায় রাস্তায় বিভিন্ন ধরনের জিনিস, মাছ, তরকারি, ফল, খাবার, কাপড়চোপড় বিক্রি করে। তারা নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে আমাদের বাসার সামনে হাজির হয়। বাজারের চেয়ে কম দামে তাদের কাছ থেকে এসব কেনা যায়। অনেক সময় নানা ধরনের গান গেয়ে তারা ক্রেতার মন জয় করার চেষ্টা করে। অনেক ফেরিওয়ালা আবার চুড়ি, ফিতাসহ নানা ধরনের খেলনা বিক্রি করে। যাওয়া-আসার মধ্য দিয়ে অনেক ফেরিওয়ালা অনেক পরিবারের সঙ্গে আন্তরিকতার সম্পর্ক গড়ে তোলে। তারা আমাদের চাহিদা মতো অনেক জিনিস দূরের শহর থেকেও এনে দেয়। এভাবে তারা আমাদের সময় ও শ্রম বাঁচায়। সমাজে যে যে-কাজই করুক না কেন, কোনো কাজকে ছোট করে দেখার কোনো কারণ নেই। সকল কাজই গুরুত্বপূর্ণ। তাই ফেরিওয়ালাদের সম্মান দেখানো আমাদের মানবিক ও নৈতিক দায়িত্ব।

৫.৩ শীতের পিঠা

ষড়ঋতুর দেশ বাংলাদেশ। শীতকাল তার মধ্যে অন্যতম। শীতকালে নতুন ধান ওঠে। সেই ধানে ঘরে ঘরে পিঠা বানানোর উৎসব শুরু হয়। নতুন চালের গুড়ো আর খেজুর রসের গুড় দিয়ে বানানো হয় নানা রকম পিঠা। নানান তাদের নাম, নানান তাদের রূপের বাহার। ভাপা পিঠা, চিতই পিঠা, পুলি পিঠা, পাটিসাপটা পিঠা, আরও হরেক রকম পিঠা তৈরি হয় বাংলার ঘরে-ঘরে। পায়েস, ক্ষীর ইত্যাদি মুখরোচক খাবার আমাদের রসনাকে তৃপ্ত করে শীতকালে। এ-সময় শহর থেকে অনেকে গ্রামে যায় পিঠা খেতে। তখন গ্রামাঞ্চলের বাড়িগুলো নতুন অতিথিদের আগমনে মুখরিত হয়ে ওঠে। শীতের সকালে চুলোর পাশে বসে গরম গরম ভাপা পিঠা খাওয়ার মজাই আলাদা। গ্রামের মতো শহরে শীতের পিঠা সেরকম তৈরি হয় না। তবে শহরের রাস্তাঘাটে শীতকালে ভাপা ও চিতই পিঠা বানিয়ে বিক্রি করা হয়। এ ছাড়া অনেক বড় বড় হোটেলে পিঠা উৎসব হয়। শীতের পিঠা বাঙালি সংস্কৃতির অন্যতম উপাদান।

সকালবেলা

৫.৪ সকালবেলা

সকালবেলা আমার খুবই প্রিয় একটা সময়। আমি খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে হাতমুখ ধুয়ে আমার বাড়ির পাশে নদীর তীরে হাঁটতে যাই। সেখান থেকে সকালের সূর্যোদয় খুবই সুন্দর লাগে। সকালের শীতল বাতাস আমার দেহমন জুড়িয়ে দেয়। নানারকম পাখির কলকাকলিতে পরিবেশটা মুখরিত হয়ে ওঠে। এ-সময় কৃষকেরা গরু নিয়ে হাল চাষ করতে বের হয়। গ্রামের মসজিদে ছোট ছোট ছেলেমেয়ে সমস্বরে কোরান তেলাওয়াত করে। কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে আমি বাড়ি ফিরে নাস্তা করে পড়তে বসি। তারপর বন্ধুদের সাথে মিলে স্কুলে যাই। ছুটির দিনে সকালবেলা আমি বাবাকে নানা কাজে সাহায্য করি। সকাল-বেলা তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠলে আমার সারাটা দিন খুব ভালো কাটে।

৫.৫ ঘরের সামনের রাস্তা

আমার ঘরের সামনে একটি পায়ে-হাঁটা রাস্তা আছে। ঘর থেকেই রাস্তাটি দেখা যায়। রাস্তাটি শুরু হয়েছে পাশের গ্রাম থেকে। একটি বড় রাস্তার সঙ্গে গিয়ে এটি মিশেছে। সারাদিনই এ-রাস্তা দিয়ে মানুষ যাওয়া-আসা করে। কত রকমের মানুষ যে এ-রাস্তা দিয়ে চলাচল করে তার হিসেব নেই। অফিসের কর্মচারী, কৃষক, ছাত্রছাত্রী, দিনমজুর, ফেরিওয়ালা প্রভৃতি পেশার মানুষ সকালবেলা তাদের কর্মক্ষেত্রে যায় এ-রাস্তা দিয়ে। কাজশেষে বিকেলে আবার ফিরে আসে তাদের বাড়িতে। আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখি সবার আনাগোনা। শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা- একেক ঋতুতে রাস্তাটি একেক রূপ ধারণ করে। পূর্ণিমার রাতে চাঁদের আলোয় রাস্তাটি অপরূপ লাগে। তখন মনে হয় রাস্তাটি যেন চলে গেছে কোন অজানা দেশে। আমার জীবনের একটি বড় অংশ জুড়ে রয়েছে এ-রাস্তা।

বটগাছ

ক. একটি পুরোনো বটগাছ

একটি পুরনো বটগাছ শুধু একটি গাছ নয়, বরং একটি জীবন্ত ইতিহাস ও স্মৃতির প্রতীক। গ্রাম বা শহরের প্রান্তে শত বছর ধরে দাঁড়িয়ে থাকা বটগাছ যেন অনেক গল্পের সাক্ষী। এর বিস্তৃত শিকড় ও ছায়াময় ডালপালা পথচারীদের আশ্রয় দেয়, ক্লান্ত কৃষকের বিশ্রামের স্থান হয়। গ্রামের শিশুরা এর নিচে খেলে, বয়স্করা বসে আড্ডা দেয় বা গল্প শোনায়। বহু বছর ধরে এটি মানুষ, পশু-পাখি ও প্রকৃতির সঙ্গে এক গভীর সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। বটগাছের ডালে বাসা বাঁধে পাখিরা, আর এর ছায়ায় গড়ে ওঠে মানুষের ছোটো ছোটো সামাজিক মিলনমেলা। এই গাছ যেন প্রকৃতির এক অনন্য দান, যা নীরবে আমাদের জীবনকে ছায়া ও শান্তি দিয়ে চলেছে। বটগাছ প্রচুর পরিমাণে অক্সিজেন উৎপন্ন করে, যা বায়ু বিশুদ্ধ রাখতে সাহায্য করে। বাতাসের ক্ষতিকর ধূলিকণা ও গ্যাস শোষণ করে পরিবেশকে পরিষ্কার রাখে। বাতাসে জলীয় বাষ্প রক্ষা করে বৃষ্টিপাত ও আর্দ্রতা বজায় রাখতে ভূমিকা রাখে। এর শক্ত ও বিস্তৃত শিকড় মাটিকে আঁকড়ে ধরে। ফলে বৃষ্টির পানিতে মাটি ক্ষয় হয় না। বটগাছ আমাদের প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় নীরবে বড়ো ভূমিকা রাখে। তাই একে রক্ষা করা আমাদের সকলের দায়িত্ব।

স্কুল লাইব্রেরি

খ. স্কুল লাইব্রেরি

স্কুল লাইব্রেরি শিক্ষার্থীদের জ্ঞানচর্চার একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান। এটি পাঠ্যবইয়ের বাইরেও নানা ধরনের গল্প, কবিতা, নাটক, উপন্যাস, বিজ্ঞান, ইতিহাস, দর্শন, জীবনী, সাধারণ জ্ঞান, বিভিন্ন বিষয়ের রেফারেন্স বই ইত্যাদি বই পড়ে জ্ঞান বৃদ্ধির সুযোগ করে দেয়। এছাড়াও পত্রিকা, সাময়িকী, অভিধান ও বিশ্বকোষ শিক্ষার্থীদের জ্ঞানচর্চায় সহায়তা করে। লাইব্রেরি শিক্ষার্থীদের পাঠাভ্যাস গড়ে তোলে এবং মননশীলতা বাড়ায়। নীরব পরিবেশে বই পড়া মনোযোগ বাড়ায় ও চিন্তাশক্তিকে শানিত করে। অনেক স্কুল লাইব্রেরিতে পত্রিকা ও সাময়িকীও রাখা হয়, যা শিক্ষার্থীদের সমসাময়িক বিষয় জানায়। নিয়মিত লাইব্রেরিতে যাওয়া একদিকে যেমন শিক্ষায় সহায়তা করে, অন্যদিকে মূল্যবোধ ও সংস্কৃতির প্রতিও আগ্রহ তৈরি করে। লাইব্রেরিতে সাধারণত বুকশেলফ, টেবিল-চেয়ার, ক্যাটালগ সিস্টেম ও রেজিস্টার বই থাকে যাতে বই সংগ্রহ ও ব্যবহার সহজ হয়। কিছু লাইব্রেরিতে কম্পিউটার ও ই-লাইব্রেরির ব্যবস্থাও থাকে, যা ডিজিটাল যুগে পড়াশোনাকে আরও সহজ করে তোলে। এসব উপকরণ শিক্ষার্থীদের মনোযোগ, পাঠাভ্যাস ও জ্ঞান বৃদ্ধিতে বড় ভূমিকা রাখে। তাই প্রতিটি স্কুল লাইব্রেরি যেন প্রয়োজনীয় উপকরণে পরিপূর্ণ থাকে, তা নিশ্চিত করা জরুরি।

তথ্যসূত্র :
১. বাংলা ব্যাকরণ ও নির্মিতি: ষষ্ঠ শ্রেণি, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড, ঢাকা, ২০২৫।
২. আধুনিক বাংলা অভিধান: বাংলা একাডেমি, এপ্রিল, ২০১৮।
৩. ব্যবহারিক বাংলা অভিধান: বাংলা একাডেমি, ১৮তম, ২০১৫।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url