৫. বাগর্থ

বাগর্থ
বাগর্থ

৫. বাগর্থ

শব্দ ও বাক্যের অর্থের আলোচনা হলো বাগর্থ। অভিধানে প্রতিটি শব্দের অর্থ থাকে। কিন্তু সেই অর্থের বাইরে নানা অর্থে শব্দ ব্যবহৃত হয়। বাগর্থতত্ত্বে এসব দিক বিস্তৃতভাবে আলোচনা করা হয়। দৃষ্টান্ত দিয়ে আরও সহজে বিষয়টি বোঝানো যেতে পারে। যেমন- ‘বাবা’ একটি শব্দ। এর অর্থ হলো আব্বা বা পিতা। বাবার সঙ্গে আরও দুটি অর্থ জড়িয়ে আছে: ‘পূর্ণবয়স্ক’ ও ‘পুরুষ’। যদি বলি ‘সাঁইবাবা’, ‘সাধুবাবা’ তখন আর এ-বাবা পিতা নয়, অন্যকিছু, হয়তো গুরু, নাহয় কোনো সজ্জন, শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি। এ থেকে বোঝা যায়, শব্দের অর্থের নির্দিষ্ট প্রতিবেশ বা ব্যবহারের ক্ষেত্র আছে। এর বাইরে শব্দের কোনো অর্থ নেই। এ-অধ্যায়ে শব্দের অর্থ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।

৫.১. সমশব্দ

দুটি শব্দ যখন ধ্বনিগত দিক থেকে একই রকম শোনায় কিন্তু অর্থের দিকে থেকে ভিন্ন হয় তখন এসব শব্দকে সমশব্দ বলে। এগুলোকে সমোচ্চারিত শব্দও বলা হয়। যেমন-
কুল
কূল
ফলবিশেষ
নদীর পাড় বা কিনার
কৃতি
কৃতী
কাজ
সফল

৫.২ সমার্থশব্দ

যে-সকল শব্দ সমান বা একই অর্থ প্রকাশ করে তাকে সমার্থশব্দ বলে। যেমন- জননী, মাতা, প্রসূতি, গর্ভধারিণী- এই শব্দগুলোর অর্থ একই। অর্থাৎ এমন অনেক শব্দ আছে যেগুলোর বানান ও উচ্চারণ আলাদা, কিন্তু অর্থ এক। এজাতীয় শব্দগুলোকে বলে সমার্থশব্দ। সমার্থশব্দকে প্রতিশব্দও বলা হয়।
নিচে কিছু শব্দ এবং সেগুলোর সমার্থশব্দ উল্লেখ করা হলো।
শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ-বিষয়ক সমার্থশব্দ:
শব্দ প্রতিশব্দ
১. কপাল : ভাল, ললাট।
২. কান : কর্ণ, শ্রুতিপথ, শ্রবণেন্দ্রিয়।
৩. গলা : কণ্ঠ, গলদেশ, গ্রীবা।
৪. গাল : কপোল, গণ্ডদেশ।
৫. চুল : অলক, কুন্তল, কেশ।
৬. চোখ : অক্ষি, আঁখি, নয়ন, নেত্র, লোচন।
৭. নাক : ঘ্রাণেন্দ্রিয়, নাসা, নাসিকা।
৮. পা : চরণ, পদ, পাদ।
৯. পেট : উদর, জঠর।
১০. মাথা : উত্তমাঙ্গ, মস্তক, মুণ্ড, শির।
১১. বুক : উদর, বক্ষ, সিনা।
১২. মুখ : আনন, বদন।
১৩. হাত : কর, পাণি, বাহু, ভুজ, হস্ত।

প্রাকৃতিক বস্তু-বিষয়ক সমার্থশব্দ:
শব্দ প্রতিশব্দ
১. আকাশ : অম্বর, গগন, নভঃ, ব্যোম, শূন্য।
২. গাছ : তরু, দ্রুম, পাদপ, বিটপী, বৃক্ষ।
৩. জল : নীর, পানীয়, বারি, সলিল।
৪. পাহাড় : অচল, অদ্রি, গিরি, পর্বত, ভূধর।
৫. মেঘ : অম্বুদ, জলদ, জলধর, বারিদ।

৫.৩ বিপরীতার্থক শব্দ

যখন কোনো শব্দ আরেকটি শব্দের বিপরীত অর্থ প্রকাশ করে, তখন শব্দ দুটিকে একে অন্যের বিপরীতার্থক শব্দ বলে। ভাষায় অনেক শব্দ আছে, যেমন- কম-বেশি, অল্প-অধিক।
কিছু শব্দ বিভিন্ন ভাষিক উপাদান দিয়ে তৈরি হয়েছে। এগুলোর বিপরীতার্থক শব্দ সেভাবেই গঠিত হয়েছে। যেমন- আস্তিক-নাস্তিক, পাপিনী-নিষ্পাপা, আমদানি-রপ্তানি ইত্যাদি।
নিচে আরও উদাহরণ দেওয়া হলো:
মূলশব্দ বিপরীতার্থক শব্দ মূলশব্দ বিপরীতার্থক শব্দ
অতীত বর্তমান বড়ো ছোটো
আকাশ পাতাল ভালো মন্দ
আনন্দ নিরানন্দ রাত দিন
আলো আঁধার শত্রু মিত্র
আসল নকল সকাল বিকাল
উন্নতি অবনতি সৎ অসৎ
উপকার অপকার সুখ দুঃখ
কাঁচা পাকা কুৎসিত সুন্দর
গ্রহণ বর্জন ধ্বংস সৃষ্টি
জয় পরাজয় স্বাধীন পরাধীন
নরম কঠিন জিৎ হার
পাপ পুণ্য হাসি কান্না

৫.৪ রূপক

অভিধানে শব্দের একটি অর্থ থাকে কিন্তু ব্যবহারের সময় দেখা যায়, তা সে অর্থে ব্যবহার করা হচ্ছে না। যেমন- ‘পতন’ একটি শব্দ। আভিধানে এর অর্থ দেওয়া আছে ‘পড়া, উপর থেকে নিচে চ্যুতি।’ কিন্তু আমরা যখন বলি উনসত্তরের গণআন্দোলনে পাকিস্তানি একনায়ক আইয়ুব খানেপতন হয়।- তখন এ ‘পতন’ উপর থেকে নিচে পড়া নয়। এর অর্থ ‘শেষ হওয়া’, ‘সমাপ্ত হওয়া’। এভাবে শব্দ যখন অভিধান-অতিরিক্ত অর্থ প্রকাশ করে তখন তা রূপক হয়। যেমন- ‘আমি কান পেতে রই।’ বাক্যটিতে ‘কান’ কর্ণ অর্থে ব্যবহার করা হয়নি, এখানে এটি মনোযোগ, অভিনিবেশ অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি গান দেখো:
“আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজারাজত্বে
নইলে মোদের রাজাসনে মিলব কী স্বত্বে।-
আমরা সবাই রাজা
আমরা যা খুশি তাই করি,
তবু তাঁর খুশিতেই চরি,
আমরা নই বাঁধা নই দাসের রাজাত্রাসেদাসত্বে,
নইলে মোদের রাজার সনে মিলব কী স্বত্বে-
আমরা সবাই রাজা।”
গানটিতে ‘রাজা’ শব্দটি সাতবার ব্যবহার করা হয়েছে। এ-রাজা সম্রাট, বাদশাহ বা নৃপতি নয়। যারা গানটি গাইছে, এখানে তাদের মনের ইচ্ছাকে বড় করে দেখা হয়েছে। রাজাকে কারো কাছে কৈফিয়ত দিতে হয় না। গায়কেরাও স্বাধীন, তারা মনের খুশিতেই চলতে চায়। এভাবে কবিতা, গান কিংবা অন্য কোনো রচনায় একই শব্দ বারবার ব্যবহার করা হলে তা রূপক হয়।

৫.৫ দ্বিরুক্ত শব্দ

একটি শব্দ একবার উচ্চারিত হলে শব্দটি যে-অর্থ প্রকাশ করে তা দুবার উচ্চারণ করলে সে-অর্থ পরিবর্তিত হয়। যেমন- আমার জ্বর হয়েছে। এখানে ‘জ্বর’-এর যে-অর্থ প্রকাশ পায়, ‘আমার জ্বর জ্বর লাগছে।’ বললে অন্য অর্থ বোঝায়। ‘জ্বর জ্বর’ অর্থ ঠিক জ্বর নয়, জ্বরের মতো খারাপ লাগা।
নিচে উদাহরণের সাহায্যে অর্থসহ কিছু দ্বিরুক্ত শব্দ দেওয়া হলো:
বহুত্ববাচক : গাড়ি গাড়ি, হাঁড়ি হাঁড়ি, সাদা সাদা।
সাদৃশ্যবাচক : নিবুনিবু, পড়োপড়ো, কাঠ কাঠ।
সংযোগ : চোখে-চোখে, পিঠে-পিঠে, হাতে-হাতে।
ক্রিয়ার অসম্পূর্ণতা : যেতে যেতে, বলতে বলতে।
প্রকার বোঝাতে : হাসিহাসি, ভালোয় ভালোয়।
পরস্পর সম্পর্ক বোঝাতে : গলাগলি, মুখোমুখি, খোলাখুলি।
প্রকর্ষ অর্থে : চ্যাঁচামেচি, ধরাধরি, হাঁকাহাঁকি।
ইত্যাদি অর্থে : কাপড়চোপড়, জলটল।
আবেগ বোঝাতে : ধিক্ ধিক্, ছি ছি, হাঁ হাঁ।
অনুকরণ অর্থে : চোর চোর, ঘোড়া ঘোড়া।
হনহন পনপন  কবিতা
হনহন পনপন কবিতা 

৫.৬ পারিভাষিক শব্দ

বিশেষ অর্থ বহন করে এমন শব্দগুলো হলো পারিভাষিক শব্দ। জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চায় এমন কিছু শব্দ পাই যেগুলোর সঙ্গে আমরা পরিচিত নই। এগুলোর বাংলা সমার্থশব্দ অনেক সময় পাওয়া যায় না। এ অবস্থায় তৈরি করতে হয় পারিভাষিক শব্দ। পরিভাষা তৈরির একটি নীতি হচ্ছে উৎস ও লক্ষ্য-এর মধ্যে এক-এক সম্পর্ক রক্ষা। যেমন- ইংরেজি ভাষায় বলে Aeroplane. আমরা এর বাংলা পরিভাষা করেছি ‘বিমান’। এখানে অ্যারোপ্লেন হলো উৎস আর বিমান হলো লক্ষ্য। অ্যারোপ্লেনের সঙ্গে বাতাস ও ওড়ার সম্পর্ক আছে। কিন্তু বিমান-এর সঙ্গে এসবের তেমন যোগ নেই। পরিভাষা তৈরিতে উৎস ও লক্ষ্যের মধ্যে অর্থগত ঐক্য থাকতেই হবে এমন কোনো কথা নেই। অ্যারোপ্লেন বললে সব সময় ‘বিমান’ বুঝতে হবে। এটিই হলো এক-এক সম্পর্ক। সবচেয়ে বড়ো কথা, পরিভাষা নির্বাচন করতে হবে লোকজজীবনের গভীর থেকে। উদাহরণ দেওয়া যাক। ইংরেজি ভাষায় আছে Fish Landing Centre. কিন্তু আমাদের মাছেরা অবতরণ করে না। জেলেরা মাছ ধরে আড়তে আনে। সেখান থেকেই মাছ কেনা-বেচা হয়। আমাদের সবাই আড়ত বোঝে। তাই ফিশ ল্যান্ডিং সেন্টার-এর বাংলা পরিভাষা হলো ‘মাছের আড়ত’।
নিচে উৎসসহ কিছু পারিভাষিক শব্দের উল্লেখ করা হলো:
ইংরেজি শব্দ পারিভাষিক শব্দ ইংরেজি শব্দ পারিভাষিক শব্দ
Adviser উপদেষ্টা Debate বিতর্ক
Affidavit হলফনামা Democracy গণতন্ত্র
Agent প্রতিনিধি Design নকশা
Agenda কৃত্যসূচি Designation পদমর্যাদা
Air বাতাস Diplomat কূটনীতিক
Airport বিমানবন্দর Director পরিচালক
Allowance ভাতা Donor দাতা
Analysis বিশ্লেষণ Duplicate অনুলিপি

৫.৭ বাগধারা

বাগধারাগুলো এক দিনে সৃষ্টি হয়নি। বহু মানুষের বহু যুগের অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান এগুলোর মধ্যে সঞ্চিত হয়ে আছে। শব্দের অতিপরিচিত যে-অর্থ, বাগধারার অর্থ তা থেকে স্বতন্ত্র। অভিধানে বাগধারাগুলোকে পৃথকভাবে ভুক্তি দিয়ে এগুলোর অর্থ উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন- ‘কাঁঠাল’ বললে আমরা সবাই জানি তা এক ধরনের ফল, বাংলাদেশের জাতীয় ফল। কিন্তু বাগধারায় যখন বলা হয় ‘কাঁঠালের আমসত্ত্ব’, তখন কাঁঠাল কিংবা আমসত্ত্বের অর্থ খুঁজতে গেলে হতাশ হতে হবে। পুরো বাগধারাটি একটি শব্দ বা ভাষিক উপাদান এবং এর অর্থও স্বতন্ত্র, তা হলো ‘অসম্ভব বস্তু’।
অনুরূপ:
বাগধারা অর্থ
আঠারো মাসে বছর দীর্ঘসূত্রিতা
কাঁঠালের আমসত্ত্ব অসম্ভব বস্তু
মুখ করা
মাথা খাওয়া সর্বনাশ করা; নষ্ট করা।
ভুঁইফোড় হঠাৎ ধনী; নতুন আগমন।
হাড়জুড়ানো স্বস্তি লাভ করা; শান্তি পাওয়া।

বহুনির্বাচনি প্রশ্ন :

প্রশ্ন থেকে

অভিনন্দন!
You Got out of answers correct!
That's


তথ্যসূত্র :
১. বাংলা ব্যাকরণ ও নির্মিতি: ষষ্ঠ শ্রেণি, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড, ঢাকা, ২০২৫।
২. আধুনিক বাংলা অভিধান: বাংলা একাডেমি, এপ্রিল, ২০১৮।
৩. ব্যবহারিক বাংলা অভিধান: বাংলা একাডেমি, ১৮তম, ২০১৫।

Next Post Previous Post