ভাব-সম্প্রসারণ : ষষ্ঠ শ্রেণির নির্মিতি অংশ
![]() |
ভাব-সম্প্রসারণ |
৩. ভাব-সম্প্রসারণ : |
---|
প্রতিটি ভাষায়ই এমন কিছু বাক্য রয়েছে, যেগুলোতে লুকিয়ে আছে গভীর ভাব। কবি,
সাহিত্যিক, মনীষীদের রচনা কিংবা হাজার বছর ধরে প্রচলিত প্রবাদ প্রবচনে
নিহিত থাকে জীবনসত্য। এ-ধরনের গভীর ভাব বিশ্লেষণ করে তা সহজভাবে বুঝিয়ে
দেওয়াকে বলে ভাবসম্প্রসারণ। ভাবসম্প্রসারণে যুক্তি, দৃষ্টান্ত ও প্রাসঙ্গিক
উদ্ধৃতি দিয়ে মূলভাব পরিষ্কারভাবে উপস্থাপন করতে হবে। ভাবসম্প্রসারণ লেখার
সময় নিচের বিষয়গুলো লক্ষ রাখতে হবে : ১. উদ্ধৃত অংশটি মনোযোগ দিয়ে বারবার পড়ে এর মূলভাব উদ্ধার করতে হবে। লেখার উদ্ধৃত অংশটির মধ্যে এমন কিছু শব্দ থাকে যার অর্থ বুঝতে পারলে মূলভাব বোঝা সহজ হয়। তাই প্রতিটি শব্দের অর্থ খুঁজে বুঝতে হবে। ২. মূলভাব সহজ ও সরল ভাষায় বর্ণনা করতে হবে। একই বিষয় বারবার লেখা যাবে না। অবান্তর কথা লেখা যাবে না। উদ্ধৃত অংশে কোনো উপমা বা রূপক থাকলে তার অর্থ বিশ্লেষণ করে বুঝিয়ে দিতে হবে। ৩. মূলভাব স্পষ্ট করার জন্য উদাহরণ, উদ্ধৃতি ইত্যাদি দেওয়া যাবে। উদ্ধৃতির ক্ষেত্রে লেখকের নাম দেওয়ার প্রয়োজন নেই। ৪. ভাব-সম্প্রসারণের আয়তন প্রবন্ধের মতো বড় বা সারাংশের মতো ছোট হবে না। |
৩.১ গদ্য : |
---|
১. চরিত্র মানবজীবনের অমূল্য সম্পদ।
মূলভাব : চরিত্র মানবজীবনের মুকুটস্বরূপ। চরিত্রবান ব্যক্তিকে সবাই
শ্রদ্ধা করে; চরিত্রহীনকে সকলে ঘৃণা করে। |
২. পরিশ্রম সৌভাগ্যের প্রসূতি।মূলভাব : সৌভাগ্য নিয়ে পৃথিবীতে কোনো মানুষের জন্ম হয় না। কর্মের মাধ্যমে মানুষ তার ভাগ্য গড়ে তোলে। পরিশ্রমই সৌভাগ্য বয়ে আনে।সম্প্রসারিত ভাব : যিনি জন্ম দান করেন তিনি প্রসূতি। মা যেমন সন্তানের প্রসূতি, তেমনি পরিশ্রম হলো সৌভাগ্যের প্রসূতি বা উৎস। মানুষকে তার কর্মফল ভোগ করতে হয়। ভালো কাজের ফল ভালো, মন্দ কাজের ফল মন্দ। কোনো কাজই সহজ নয়। আবার কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে কঠিন কাজও সহজ হয়। জীবনে উন্নতি করতে হলে পরিশ্রমের কোনো বিকল্প নেই। পরিশ্রম ছাড়া কেউ কখনো তার ভাগ্যকে গড়ে তুলতে পারেনি। জীবনে অর্থ, বিদ্যা, যশ, প্রতিপত্তি লাভ করতে হলে অবশ্যই পরিশ্রম করতে হবে। ছাত্রজীবনে কঠোর পরিশ্রম করে শিক্ষালাভ না করলে ভবিষ্যত জীবনে সাফল্য লাভ সম্ভব নয়। পরিশ্রম ছাড়া জাতীয় উন্নতিও লাভ করা যায় না। মন্তব্য : শ্রমই হলো উন্নতির চাবিকাঠি। যে জাতি পৃথিবীতে যত বেশি পরিশ্রমী, সে জাতি তত উন্নত। ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত পরিশ্রমের মধ্য দিয়েই জাতির অগ্রগতি অর্জন করা যায়। |
৩. শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড।মূলভাব : শিক্ষাই আলো, নিক্ষরতা অন্ধকার। শিক্ষা মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটায়, মানুষের অন্তরের প্রতিভাকে জাগিয়ে তোলে।সম্প্রসারিত ভাব : জীবন ছাড়া শরীর মূল্যহীন, শিক্ষা ছাড়া জীবনের কোনো মূল্য নেই। শিক্ষাহীন মানুষ আর অন্ধের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। যে জাতি শিক্ষা থেকে বঞ্চিত সে জাতি পঙ্গুত্ব নিয়ে বেঁচে থাকে। তাই নিরক্ষর জনগোষ্ঠী জাতির জন্য বোঝাস্বরূপ।মেরুদণ্ডহীন মানুষ যেমন সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে না, তেমনি শিক্ষা ছাড়া কোনো জাতি সফল হয় না। যে দেশের লোক যত বেশি শিক্ষিত, সে দেশ তত বেশি উন্নত। জাতীয় জীবনে উন্নতি ও প্রতিষ্ঠা নির্ভর করে শিক্ষার ওপর। মানুষের পূর্ণ বিকাশের জন্যই শিক্ষা প্রয়োজন। শিক্ষা শুধু ব্যক্তিজীবনে উন্নতি বয়ে আনে না সমাজ জাতি ও রাষ্ট্রীয় জীবনের সব রকম উন্নতিও সাধন করে। পৃথিবীর প্রতিটি দেশ আজ তাই নিরক্ষরতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। মন্তব্য : উন্নতির একমাত্র চাবিকাঠি শিক্ষা। শিক্ষা ব্যক্তিজীবন ও জাতির ভবিষ্যৎ কল্যাণ বয়ে আনে। জাতিকে প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তোলা একান্ত জরুরি। |
৪. ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়।মূলভাব : জীবন কর্মময়। কর্মশক্তির মূলে রয়েছে উৎসাহ-উদ্দীপনা আর প্রবল আগ্রহ। আগ্রহের সঙ্গে নিষ্ঠা যুক্ত থাকলে অসাধ্যকেও সাধ্য করা যায়।সম্প্রসারিত ভাব : মানুষকে সব বাধা অতিক্রম করতে সাহায্য করে তার ইচ্ছাশক্তি। প্রতিদিনই আমাদের কোনো না কোনো কাজ করতে হয়। পৃথিবীতে কোনো কাজই বিনা বাধায় করা যায় না। সব কাজেই কিছু না কিছু সুবিধা-অসুবিধা ও বাধা-বিপত্তি থাকে। সেই অসুবিধা ও বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করতে পারলেই সাফল্য আসে। এজন্য প্রয়োজন প্রবল ইচ্ছা। ইচ্ছা থাকলে কোনো কাজ আটকে থাকে না। ইচ্ছাই সকল কর্মের প্রেরণা। ইচ্ছাই মানুষকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। দৃঢ় ইচ্ছার কাছে সকল বাধা হার মানে। প্রবল ইচ্ছা নিয়ে কোনো কাজ করলে অতি কঠিন কাজও শেষ করা যায়। পৃথিবীর মহান ব্যক্তিরা এভাবেই সব ধরনের বিপত্তি অতিক্রম করে লক্ষ্যে পৌঁছেছেন। সম্রাট নেপোলিয়ান তাঁর সেনাবাহিনীসহ আল্পস পর্বতের কাছে গিয়ে অসীম উৎসাহে বলে ওঠেন : ‘আমার বিজয় অভিযানের মুখে আল্পস পর্বত থাকবে না।’ আত্মশক্তি ও ইচ্ছাশক্তির বলে তিনি আল্পস পার হতে পেরেছিলেন। মন্তব্য : মানুষের সকল কাজের মূল হলো ইচ্ছাশক্তি। ইচ্ছাই মানুষকে সাফল্যের দ্বারে পৌঁছে দেয়। |
৩.২ কবিতা : |
---|
১. আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে
মূলভাব : মানুষ সামাজিক জীব। সমাজে পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে তাকে বেঁচে
থাকতে হয়। |
২. স্বদেশের উপকারে নাই যার মন
মূলভাব : নিজের দেশকে ভালোবাসার মতো মহান আর কিছু নেই। দেশ মানুষকে আশ্রয়
দেয়, অন্ন দেয়, স্বাধীনতা দেয়। |
৩. বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চিরকল্যাণকর
মূলভাব : আজকের এই সভ্যতা বিকাশে নারী ও পুরুষের সমান অবদান রয়েছে। নারী ও
পুরুষ তাই সমান মর্যাদার অধিকারী। |
৪. নানান দেশের নানান ভাষা
মূলভাব : মাতৃভাষার চেয়ে মধুর ভাষা পৃথিবীতে আর নেই। মায়ের ভাষায় যত সহজে ও
সাবলীলভাবে মনের ভাব প্রকাশ করা যায়, অন্য ভাষায় তা সম্ভব নয়। |
অনুশীলনী: |
---|
ক. কর্ম মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে।মূলভাব : মানুষের জীবনের মূল ভিত্তি হলো কর্ম। কর্মহীন মানুষ যেমন জীবনের লক্ষ্য হারায়, তেমনি সমাজেও তার মূল্য কমে যায়। একজন মানুষের প্রকৃত পরিচয় পাওয়া যায় তার কর্মের মধ্য দিয়ে। কর্ম শুধু জীবিকা অর্জনের মাধ্যম নয়, এটি মানুষের মর্যাদা, সৃষ্টিশীলতা এবং অস্তিত্বের প্রকাশ ঘটায়।সম্প্রসারিত ভাব : যে মানুষ সৎভাবে পরিশ্রম করে, দেশ ও সমাজের কল্যাণে কাজ করে, সে কখনও মরে না। এমনকি মৃত্যুর পরেও তার কর্মই তাকে মানুষের স্মৃতিতে বাঁচিয়ে রাখে। যেমন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান– এঁরা আজ আর জীবিত না থাকলেও, তাদের কর্ম তাদেরকে চিরঞ্জীব করে রেখেছে। কাজেই মানুষের প্রকৃত জীবন বেঁচে থাকার মাঝে নয়, বরং তার কর্মে। যারা নিষ্ক্রিয়, অলস, কর্মবিমুখ, তারা জীবিত থেকেও মৃতের মতো। অন্যদিকে, যারা কাজের মাধ্যমে নিজেকে ও সমাজকে উন্নত করে, তারা যুগ যুগ ধরে বেঁচে থাকে মানুষের মনে। মন্তব্য : সৎ ও নিষ্ঠার সঙ্গে করা কর্মই মানুষকে প্রকৃত অর্থে অমর করে তোলে। তাই কর্মই মানুষের জীবনের শ্রেষ্ঠ সাধনা। |
খ. চকচক করলেই সোনা হয় না।মূলভাব : চকচক করলেই যে জিনিসটি সোনা, তা ভাবা ঠিক নয়—এই প্রবাদটি দ্বারা বোঝানো হয়, বাহ্যিক চাকচিক্য দিয়ে কোনও কিছু বা কাউকে বিচার করা উচিত নয়। কারণ অনেক সময় যা বাইরে থেকে আকর্ষণীয়, ভেতরে তা তেমন মূল্যবান নাও হতে পারে। আবার যা দেখতে সাধারণ বা নির্জন, ভিতরে তার গুণাগুণ অগাধ হতে পারে।সম্প্রসারিত ভাব : আমরা অনেক সময় লোক দেখানো ব্যক্তিত্ব, বাহ্যিক সৌন্দর্য বা ধনী বেশভূষা দেখে মুগ্ধ হই এবং তাদের প্রকৃত চরিত্র না জেনে বিশ্বাস করি। অথচ, অনেক সময় এই বাহ্যিক চাকচিক্যের আড়ালে লুকিয়ে থাকে প্রতারণা, অসততা বা দম্ভ। অন্যদিকে, অনেক নিরীহ, সাধারণ মানুষের মধ্যেই থাকে সততা, জ্ঞান, গুণ এবং মহত্ব—যা প্রথম দেখায় বোঝা যায় না। এই প্রবাদটি আমাদের শেখায় মানুষ বা বস্তু বিচার করতে হলে শুধু বাহ্যিক দিক নয়, তার অন্তর্নিহিত গুণাবলিও বিবেচনা করতে হবে। সত্যিকারের মূল্য সবসময় ভিতরের গুণেই নির্ধারিত হয়, বাহ্যিক চাকচিক্যে নয়। মন্তব্য : তাই, চকচক করলেই যে তা সোনা হবে—এমন ধারণা ভুল। সবসময় গভীর দৃষ্টিতে দেখার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। |
তথ্যসূত্র : |
---|
১. বাংলা ব্যাকরণ ও নির্মিতি: ষষ্ঠ শ্রেণি, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড,
বাংলাদেশ, ২০২৫। ২. আধুনিক বাংলা অভিধান: বাংলা একাডেমি, এপ্রিল, ২০১৮। ৩. ব্যবহারিক বাংলা অভিধান: বাংলা একাডেমি, ১৮তম , ২০১৫। |