বিলাসী : শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

বিলাসী
বিলাসী

বিলাসী
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

পাকা দুই ক্রোশ পথ হাঁটিয়া স্কুলে বিদ্যা অর্জন করিতে যাই। আমি একা নই-দশ-বারোজন। যাহাদেরই বাটী পল্লিগ্রামে, তাহাদেরই ছেলেদের শতকরা আশিজনকে এমনি করিয়া বিদ্যালাভ করিতে হয়। ইহাতে লাভের অঙ্কে শেষ পর্যন্ত একেবারে শূন্য না পড়িলেও, যাহা পড়ে, তাহাতে হিসাব করিবার পক্ষে এই কয়টা কথা চিন্তা করিয়া দেখিলেই যথেষ্ট হইবে যে, যে ছেলেদের সকাল আটটার মধ্যে বাহির হইয়া যাতায়াতে চার ক্রোশ পথ ভাঙিতে হয়-চার ক্রোশ মানে আট মাইল নয়, ঢের বেশি-বর্ষার দিনে মাথার ওপর মেঘের জল পায়ের নিচে এক হাঁটু কাদা এবং গ্রীষ্মের দিনে জলের বদলে কড়া সূর্য এবং কাদার বদলে ধুলার সাগর সাঁতার দিয়া স্কুল-ঘর করিতে হয়, সেই দুর্ভাগা বালকদের মা-সরস্বতী খুশি হইয়া অলৌকিক উৎস থেকে ক্ষমতা বা অভীষ্ট বস্তু লাভ। দিবেন কি, তাহাদের যন্ত্রণা দেখিয়া কোথায় যে তিনি লুকাইবেন, ভাবিয়া পান না।

তারপরে এই কৃতবিদ্য শিশুর দল বড় হইয়া একদিন গ্রামেই বসুন, আর ক্ষুধার জ্বালায় অন্যত্রই যান-তাঁদের চার ক্রোশ হাঁটা বিদ্যার তেজ আত্মপ্রকাশ করিবেই করিবে। কেহ কেহ বলেন শুনিয়াছি, আচ্ছা, যাঁদের ক্ষুধার জ্বালা, তাঁদের কথা না হয় নাই ধরিলাম কিন্তু যাঁদের সে জ্বালা নাই, তেমন সব ভদ্রলোকই বা কী সুখে গ্রাম ছাড়িয়া পলায়ন করেন? তাঁরা বাস করিতে থাকিলে তো পল্লির এত দুর্দশা হয় না।

ম্যালেরিয়া (মানবদেহে অ্যানোফিলিস মশাবাহিত জীবাণু সংক্রমণের ফলে পালা করে আসে এমন জ্বর।) কথাটা না হয় নাই পাড়িলাম। সে থাক, কিন্তু ওই চার ক্রোশ হাঁটার জ্বালায় কত ভদ্রলোকেই যে ছেলে-পুলে লইয়া গ্রাম ছাড়িয়া শহরে পালান তাহার আর সংখ্যা নাই। তারপরে একদিন ছেলে-পুলের পড়াও শেষ হয় বটে, তখন কিন্তু শহরের সুখ-সুবিধা রুচি লইয়া আর তাদের গ্রামে ফিরিয়া আসা চলে না। কিন্তু থাক এ-সকল বাজে কথা। স্কুলে যাই-দুক্রোশের মধ্যে এমন আরও তো দুই তিনখানা গ্রাম পার হইতে হয়। কার বাগানে আম পাকিতে শুরু করিয়াছে, কোন বনে বঁইচি ফল অপর্যাপ্ত ফলিয়াছে, কার গাছে কাঁঠাল এই পাকিল বলিয়া, কার মর্তমান রম্ভার কাঁদি (মায়ানমারের মার্তাবান দ্বীপে উৎপন্ন কলার ছড়া।)কাটিয়া লইবার অপেক্ষা মাত্র, কার কানাচে ঝোপের মধ্যে আনারসের গায়ে রং ধরিয়াছে, কার পুকুরপাড়ের খেজুরমেতি কাটিয়া খাইলে ধরা পড়িবার সম্ভাবনা অল্প, এই সব খবর লইতেই সময় যায়, কিন্তু আসলে যা বিদ্যা-কামস্কাটকার রাজধানীর নাম কী এবং সাইবেরিয়ার খনির মধ্যে রূপা মেলে, না সোনা মেলে- এ সকল দরকারি তথ্য অবগত হইবার ফুরসতই মেলে না।

কাজেই এজামিনের সময় এডেন কী জিজ্ঞাসা করিলে বলি পারশিয়ার বন্দর, আর হুমায়ুনের বাপের নাম জানিতে চাহিলে লিখিয়া দিয়া আসি তোগলক খাঁ এবং আজ চল্লিশের কোঠা পার হইয়াও দেখি, ও-সকল বিষয়ের ধারণা প্রায় একরকমই আছে-তারপরে প্রমোশনের দিন মুখ ভার করিয়া বাড়ি ফিরিয়া আসিয়া কখনো বা দল বাঁধিয়া মতলব করি মাস্টারকে ঠ্যাঙানো উচিত, কখনো বা ঠিক করি, অমন বিশ্রী স্কুল ছাড়িয়া দেওয়াই কর্তব্য।

আমাদের গ্রামের একটি ছেলের সঙ্গে মাঝে মাঝেই স্কুলের পথে দেখা হইত। তাহার নাম ছিল মৃত্যুঞ্জয়। আমাদের চেয়ে সে বয়সে অনেক বড়। থার্ড ক্লাসে পড়িত। কবে সে যে প্রথম থার্ড ক্লাসে উঠিয়াছিল, এ খবর আমরা কেহই জানিতাম না- সম্ভবত তাহা প্রত্নতাত্ত্বিকের গবেষণার বিষয়-আমরা কিন্তু তাহার ওই থার্ড ক্লাসটাই চিরদিন দেখিয়া আসিয়াছি।

তাহার ফোর্থ ক্লাসে পড়ার ইতিহাসও কখনো শুনি নাই, সেকেন্ড ক্লাসে উঠিবার খবরও কখনো পাই নাই। মৃত্যুঞ্জয়ের বাপ-মা, ভাই-বোন কেহই ছিল না, ছিল শুধু গ্রামের এক প্রান্তে একটা প্রকাণ্ড আম-কাঁঠালের বাগান, আর তার মধ্যে একটা প্রকাণ্ড পোড়োবাড়ি, আর ছিল এক জ্ঞাতি খুড়া। খুড়ার কাজ ছিল ভাইপোর নানাবিধ দুর্নাম রটনা করা-সে গাঁজা খায়, সে গুলি খায়, এমনি আরও কত কি! তাঁর আর একটা কাজ ছিল বলিয়া বেড়ানো, ওই বাগানের অর্ধেকটা তাঁর নিজের অংশ, নালিশ করিয়া দখল করার অপেক্ষা মাত্র। অবশ্য দখল একদিন তিনি পাইয়াছিলেন বটে, কিন্তু সে জেলা-আদালতে নালিশ করিয়া নয়-ওপরের আদালতের হুকুমে। কিন্তু সে কথা পরে হইবে।

মৃত্যুঞ্জয় নিজে রাঁধিয়া খাইত এবং আমের দিনে ওই আম-বাগানটা জমা দিয়াই তাহার সারা বৎসরের খাওয়া-পরা চলিত এবং ভালো করিয়াই চলিত। যেদিন দেখা হইয়াছে, সেইদিনই দেখিয়াছি ছেঁড়া-খোঁড়া মলিন বইগুলি বগলে করিয়া পথের এক ধার দিয়া নীরবে চলিয়াছে। তাহাকে কখনো কারও সহিত যাচিয়া আলাপ করিতে দেখি নাই-বরঞ্চ উপযাচক হইয়া কথা কহিতাম আমরাই। তাহার প্রধান কারণ ছিল এই যে, দোকানের খাবার কিনিয়া খাওয়াইতে গ্রামের মধ্যে তাহার জোড়া ছিল না। আর শুধু ছেলেরাই নয়। কত ছেলের বাপ কতবার যে গোপনে ছেলেকে দিয়া তাহার কাছে স্কুলের মাহিনা হারাইয়া গেছে, বই চুরি গেছে ইত্যাদি বলিয়া টাকা আদায় করিয়া লইত, তাহা বলিতে পারি না। কিন্তু ঋণ স্বীকার করা তো দূরের কথা, ছেলে তাহার সহিত একটা কথা কহিয়াছে, এ কথাও কোনো বাপ ভদ্র সমাজে কবুল করিতে চাহিত না-গ্রামের মধ্যে মৃত্যুঞ্জয়ের ছিল এমনি সুনাম।

অনেক দিন মৃত্যুঞ্জয়ের দেখা নাই। একদিন শোনা গেল সে মর-মর। আর একদিন শোনা গেল, মালোপাড়ার এক বুড়া মালো তাহার চিকিৎসা করিয়া এবং তাহার মেয়ে বিলাসী সেবা করিয়া মৃত্যুঞ্জয়কে যমের মুখ হইতে এ যাত্রা ফিরাইয়া আনিয়াছে।

অনেক দিন তাহার মিষ্টান্নের সদ্ব্যয় করিয়াছি- মনটা কেমন করিতে লাগিল, একদিন সন্ধ্যার অন্ধকারে লুকাইয়া তাহাকে দেখিতে গেলাম। তাহার পোড়োবাড়িতে প্রাচীরের বালাই নাই। স্বচ্ছন্দে ভিতরে ঢুকিয়া দেখি, ঘরের দরজা খোলা, বেশ উজ্জ্বল একটি প্রদীপ জ্বলিতেছে, আর ঠিক সমুখেই তক্তপোষের ওপর পরিষ্কার ধবধবে বিছানায় মৃত্যুঞ্জয় শুইয়া আছে, তাহার কঙ্কালসার দেহের প্রতি চাহিলেই বুঝা যায়, বাস্তবিক যমরাজ চেষ্টার ত্রুটি কিছু করেন নাই, তবে যে শেষ পর্যন্ত সুবিধা করিয়া উঠিতে পারেন নাই, সে কেবল ওই মেয়েটির জোরে। সে শিয়রে বসিয়া পাখার বাতাস করিতেছিল, অকস্মাৎ মানুষ দেখিয়া চমকিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল। এই সেই বুড়া সাপুড়ের মেয়ে বিলাসী। তাহার বয়স আঠারো কি আটাশ ঠাহর করিতে পারিলাম না। কিন্তু মুখের প্রতি চাহিবামাত্রই টের পাইলাম, বয়স যাই হোক, খাটিয়া খাটিয়া আর রাত জাগিয়া জাগিয়া ইহার শরীরে আর কিছু নাই। ঠিক যেন ফুলদানিতে জল দিয়া ভিজাইয়া রাখা বাসি ফুলের মতো। হাত দিয়া এতটুকু স্পর্শ করিলে, এতটুকু নাড়াচাড়া করিতে গেলেই ঝরিয়া পড়িবে।

মৃত্যুঞ্জয় আমাকে চিনিতে পারিয়া বলিল, "কে, ন্যাড়া?"

বলিলাম, "হুঁ।”

মেয়েটা ঘাড় হেঁট করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল। মৃত্যুঞ্জয় দুই-চারিটি কথায় যাহা কহিল, তাহার মর্ম এই যে, প্রায় দেড় মাস হইতে চলিল সে শয্যাগত। মধ্যে দশ-পনের দিন সে অজ্ঞান অচৈতন্য অবস্থায় পড়িয়াছিল, এই কয়েক দিন হইল সে লোক চিনিতে পারিতেছে এবং যদিচ এখনো সে বিছানা ছাড়িয়া উঠিতে পারে না, কিন্তু আর ভয় নাই।

ভয় নাই থাকুক। কিন্তু ছেলেমানুষ হইলেও এটা বুঝিলাম, আজও যাহার শয্যাত্যাগ করিয়া উঠিবার ক্ষমতা হয় নাই, সেই রোগীকে এই বনের মধ্যে একাকী যে মেয়েটি বাঁচাইয়া তুলিবার ভার লইয়াছেন, সে কত বড় গুরুভার। দিনের পর দিন, রাত্রির পর রাত্রি তাহার কত সেবা, কত শুশ্রূষা, কত ধৈর্য, কত রাতজাগা। সে কত বড় সাহসের কাজ! কিন্তু যে বস্তুটি এই অসাধ্য-সাধন করিয়া তুলিয়াছিল তাহার পরিচয় যদিচ সেদিন পাই নাই, কিন্তু আর একদিন পাইয়াছিলাম।

ফিরিবার সময় মেয়েটি আর একটি প্রদীপ লইয়া আমার আগে আগে ভাঙা প্রাচীরের শেষ পর্যন্ত আসিল। এতক্ষণ পর্যন্ত সে একটি কথাও কহে নাই, এইবার আস্তে আস্তে বলিল, রাস্তা পর্যন্ত তোমায় রেখে আসব কি?

বড় বড় আমগাছে সমস্ত বাগানটা যেন একটা জমাট অন্ধকারের মতো বোধ হইতেছিল, পথ দেখা তো দূরের কথা, নিজের হাতটা পর্যন্ত দেখা যায় না। বলিলাম, "পৌঁছে দিতে হবে না, শুধু আলোটা দাও।" সে প্রদীপটা আমার হাতে দিতেই তাহার উৎকণ্ঠিত মুখের চেহারাটা আমার চোখে পড়িল। আস্তে আস্তে সে বলিল, "একলা যেতে ভয় করবে না তো? একটু এগিয়ে দিয়ে আসব?"

মেয়ে মানুষ জিজ্ঞাসা করে, ভয় করবে না তো। সুতরাং মনে যাই থাক, প্রত্যুত্তরে শুধু একটা "না" বলিয়াই অগ্রসর হইয়া গেলাম। সে পুনরায় কহিল, ঘন জঙ্গলের পথ, একটু দেখে পা ফেলে যেয়ো।"

সর্বাঙ্গে কাঁটা দিয়া উঠিল, কিন্তু এতক্ষণে বুঝিলাম, উদ্বেগটা তাহার কিসের জন্য এবং কেন সে আলো দেখাইয়া এই বনের পথ পার করিয়া দিতে চাহিতেছিল। হয়ত সে নিষেধ শুনিত না, সঙ্গেই যাইত, কিন্তু পীড়িত মৃত্যুঞ্জয়কে একাকী ফেলিয়া যাইতেই বোধ করি তাহার শেষ পর্যন্ত মন সরিল না।

মেয়ে মানুষ জিজ্ঞাসা করে, ভয় করবে না তো। সুতরাং মনে যাই থাক, প্রত্যুত্তরে শুধু একটা "না" বলিয়াই অগ্রসর হইয়া গেলাম।

সে পুনরায় কহিল, “ঘন জঙ্গলের পথ, একটু দেখে পা ফেলে যেয়ো।”

কুড়ি-পঁচিশ বিঘার বাগান। সুতরাং পথটা কম নয়। এই দারুণ অন্ধকারের মধ্যে প্রত্যেক পদক্ষেপই বোধ করি ভয়ে ভয়ে করিতে হইত, কিন্তু পরক্ষণই মেয়েটির কথাতেই সমস্ত মন এমনি আচ্ছন্ন হইয়া রহিল যে, ভয় পাইবার আর সময় পাইলাম না। কেবল মনে হইতে লাগিল, একটা মৃতকল্প রোগী লইয়া থাকা কত কঠিন। মৃত্যুঞ্জয় তো যে-কোনো মুহূর্তেই মরিতে পারিত, তখন সমস্ত রাত্রি এই বনের মধ্যে মেয়েটি একাকী কী করিত। কেমন করিয়া তাহার সে রাতটা কাটিত।

এই প্রসঙ্গে অনেকদিন পরের একটা কথা আমার মনে পড়ে। এক আত্মীয়ের মৃত্যুকালে আমি উপস্থিত ছিলাম। অন্ধকার রাত্রি-বাটীতে ছেলে-পুলে, চাকর-বাকর নাই, ঘরের মধ্যে শুধু তার সদ্যবিধবা স্ত্রী আর আমি। তার স্ত্রী তো শোকের আবেগে দাপাদাপি করিয়া এমন কাণ্ড করিয়া তুলিলেন যে, ভয় হইল তাহারও প্রাণটা বুঝি বাহির হইয়া যায় বা! কাঁদিয়া কাঁদিয়া বারবার আমাকে প্রশ্ন করিতে লাগিলেন, তিনি স্বেচ্ছায় যখন সহমরণে যাইতে চাহিতেছেন, তখন সরকারের কী? তাঁর যে আর তিলার্ধ বাঁচিতে সাধ নাই, এ কি তাহারা বুঝিবে না? তাহাদের ঘরে কি স্ত্রী নাই? তাহারা কি পাষাণ? আর এই রাত্রেই গ্রামের পাঁচজন যদি নদীর তীরের কোনো একটা জঙ্গলের মধ্যে তাঁর সহমরণের যোগাড় করিয়া দেয় তো পুলিশের লোক জানিবে কী করিয়া? এমনি কত কি। কিন্তু আমার তো আর বসিয়া বসিয়া তাঁর কান্না শুনিলেই চলে না। পাড়ায় খবর দেওয়া চাই-অনেক জিনিস যোগাড় করা চাই। কিন্তু আমার বাহিরে যাইবার প্রস্তাব শুনিয়াই তিনি প্রকৃতিস্থ হইয়া উঠিলেন। চোখ মুছিয়া বলিলেন, "ভাই, যা হবার সে তো হইয়াছে, আর বাইরে গিয়া কী হইবে? রাতটা কাটুক না।"

বলিলাম, "অনেক কাজ, না গেলেই যে নয়।"

তিনি বলিলেন, "হোক কাজ, তুমি বসো।"

বলিলাম, "বসলে চলবে না, একবার খবর দিতেই হইবে", বলিয়া পা বাড়াইবামাত্রেই তিনি চিৎকার করিয়া উঠিলেন, "ওরে বাপরে! আমি একলা থাকতে পারব না।"

কাজেই আবার বসিয়া পড়িতে হইল। কারণ, তখন বুঝিলাম, যে স্বামী জ্যান্ত থাকতে তিনি নির্ভয়ে পঁচিশ বৎসর একাকী ঘর করিয়াছেন, তাঁর মৃত্যুটা যদি-বা সহে তাঁর মৃতদেহটা এই অন্ধকার রাত্রে পাঁচ মিনিটের জন্যও সহিবে না। বুক যদি কিছুতে ফাটে তো সে এই মৃত স্বামীর কাছে একলা থাকিলে।

কিন্তু দুঃখটা তাহার তুচ্ছ করিয়া দেখানও আমার উদ্দেশ্য নহে। কিংবা তাহা খাঁটি নয় এ কথা বলাও আমার অভিপ্রায় নহে। কিংবা একজনের ব্যবহারেই তাহার চূড়ান্ত মীমাংসা হইয়া গেল তাহাও নহে। কিন্তু এমন আরও অনেক ঘটনা জানি, যাহার উল্লেখ না করিয়াও আমি এই কথা বলিতে চাই যে, শুধু কর্তব্যজ্ঞানের জোরে অথবা বহুকাল ধরিয়া একসঙ্গে ঘর করার অধিকারেই এই ভয়টাকে কোনো মেয়েমানুষই অতিক্রম করিতে পারে না। ইহা আর একটি শক্তি, যাহা বহু স্বামী-স্ত্রী একশ বৎসর একত্রে ঘর করার পরেও হয়ত তাহার কোনো সন্ধান পায় না।

কিন্তু সহসা সে শক্তির পরিচয় যখন কোনো নরনারীর কাছে পাওয়া যায়, তখন সমাজের আদালতে আসামি করিয়া তাহাদের দণ্ড দেওয়ার আবশ্যক যদি হয় তো হোক, কিন্তু মানুষের যে বস্তুটি সামাজিক নয়, সে নিজে যে ইহাদের দুঃখে গোপন অশ্রু বিসর্জন না করিয়া কোনো মতেই থাকিতে পারে না।

প্রায় মাস দুই মৃত্যুঞ্জয়ের খবর লই নাই। যাঁহারা পল্লিগ্রাম দেখেন নাই, কিংবা ওই রেলগাড়ির জানালায় মুখ বাড়াইয়া দেখিয়াছেন, তাঁহারা হয়ত সবিস্ময়ে বলিয়া উঠিবেন, এ কেমন কথা? এ কি কখনো সম্ভব হইতে পারে যে, অত বড় অসুখটা চোখে দেখিয়া আসিয়াও মাস-দুই আর তার খবরই নাই। তাহাদের অবগতির জন্য বলা আবশ্যক যে, এ শুধু সম্ভব নয়, এ-ই হইয়া থাকে। একজনের বিপদে পাড়াসুদ্ধ ঝাঁক বাঁধিয়া উপুড় হইয়া পড়ে, এই যে, একটা জনশ্রুতি আছে, জানি না তাহা সত্যযুগের পল্লিগ্রামে ছিল কি না, কিন্তু একালে তো কোথাও দেখিয়াছি বলিয়া মনে করিতে পারি না। তবে তাহার মরার খবর যখন পাওয়া যায় নাই, তখন সে যে বাঁচিয়া আছে এ ঠিক।

এমনি সময়ে হঠাৎ একদিন কানে গেল, মৃত্যুঞ্জয়ের সেই বাগানের অংশীদার খুড়া তোলপাড় করিয়া বেড়াইতেছেন যে, গেল গেল, গ্রামটা এবার রসাতলে গেল। নালতের মিত্তির বলিয়া সমাজে আর তাঁর মুখ বাহির করিবার যো রহিল না-অকালকুষ্মাণ্ডটা একটা সাপুড়ের মেয়ে নিকা করিয়া ঘরে আনিয়াছে। আর শুধু নিকা নয়, তাও না হয় চুলায় যাক, তাহার হাতে ভাত পর্যন্ত খাইতেছে। গ্রামে যদি ইহার শাসন না থাকে তো বনে গিয়া বাস করিলেই তো হয়। কোড়োলা, হরিপুরের সমাজ একথা শুনিলে যে- ইত্যাদি ইত্যাদি।

তখন ছেলে বুড়ো সকলের মুখেই ওই এক কথা-অ্যাঁ এ হইল কী? কলি কি সত্যই উল্টাইতে বসিল।

খুড়া বলিয়া বেড়াইতে লাগিলেন, এ যে ঘটিবে তিনি অনেক আগেই জানিতেন। তিনি শুধু তামাশা দেখিতেছিলেন, কোথাকার জল কোথায় গিয়া পড়ে। নইলে পর নয়, প্রতিবেশী নয়, আপনার ভাইপো। তিনি কি বাড়ি লইয়া যাইতে পারিতেন না? তাঁহার কি ডাক্তার-বৈদ্য দেখাইবার ক্ষমতা ছিল না? তবে কেন যে করেন নাই, এখন দেখুন সবাই। কিন্তু আর তো চুপ করিয়া থাকা যায় না। এ যে মিত্তির বংশের নাম ডুবিয়া যায়। গ্রামের যে মুখ পোড়ে।

তখন আমরা গ্রামের লোক মিলিয়া যে কাজটা করিলাম, তাহা মনে করিলে আমি আজও লজ্জায় মরিয়া যাই। খুড়া চলিলেন নালতের মিত্তির বংশের অভিভাবক হইয়া, আর আমরা দশ-বারোজন সঙ্গে চলিলাম গ্রামের বদন দগ্ধ না হয় এইজন্য।

মৃত্যুঞ্জয়ের পোড়োবাড়িতে গিয়া যখন উপস্থিত হইলাম তখন সবেমাত্র সন্ধ্যা হইয়াছে। মেয়েটি ভাঙা বারান্দায় একধারে রুটি গড়িতেছে। অকস্মাৎ লাঠিসোটা হাতে এতগুলি লোককে উঠানের ওপর দেখিয়া ভয়ে নীলবর্ণ হইয়া গেল। খুড়া ঘরের মধ্যে উঁকি মারিয়া দেখলেন, মৃত্যুঞ্জয় শুইয়া আছে। চট করিয়া শিকলটা টানিয়া দিয়া সেই ভয়ে মৃতপ্রায় মেয়েটিকে সম্ভাষণ শুরু করিলেন। বলা বাহুল্য, জগতের কোনো খুড়া কোনো কালে বোধ করি ভাইপোর-স্ত্রীকে ওরূপ সম্ভাষণ করে নাই। সে এমনি যে, মেয়েটি হীন সাপুড়ের মেয়ে হইয়াও তাহা সহিতে পারিল না, চোখ তুলিয়া বলিল, বাবা আমারে বাবুর সাথে নিকা দিয়েছে জানো?

খুড়া বলিলেন তবে রে! ইত্যাদি ইত্যাদি এবং সঙ্গে সঙ্গেই দশ-বারোজন বীরদর্পে হুংকার দিয়া তাহার ঘাড়ে পড়িল। কেহ ধরিল চুলের মুঠি, কেহ ধরিল কান, কেহ ধরিল হাত-দুটো এবং যাহাদের সে সুযোগ ঘটিল না তাহারাও নিশ্চেষ্ট হইয়া রহিল না।

কারণ, সংগ্রামস্থলে আমরা কাপুরুষের ন্যায় চুপ করিয়া থাকিতে পারি, আমাদের বিরুদ্ধে এত বড় দুর্নাম রটনা করিতে বোধ করি নারায়ণের কর্তৃপক্ষেরও চক্ষুলজ্জা হইবে।

এইখানে একটা অবান্তর কথা বলিয়া রাখি। শুনিয়াছি নাকি বিলাত প্রভৃতি স্লেচ্ছদেশে পুরুষদের মধ্যে একটা কুসংস্কার আছে, স্ত্রীলোক দুর্বল এবং নিরুপায় বলিয়া তাহার গায়ে হাত তুলিতে নাই। এ আবার একটা কী কথা। সনাতন হিন্দু এ কুসংস্কার মানে না। আমরা বলি যাহারই গায়ে জোর নাই, তাহারই গায়ে হাত তুলিতে পারা যায়। তা সে নরনারী যাই হোক না কেন।

মেয়েটি প্রথমেই সেই যা একবার আর্তনাদ করিয়া উঠিয়াছিল, তারপর একেবারে চুপ করিয়া গেল। কিন্তু আমরা যখন তাহাকে গ্রামের বাহিরে রাখিয়া আসিবার জন্য হিঁচড়াইয়া লইয়া চলিলাম, তখন মিনতি করিয়া বলিতে লাগিল, "বাবুরা, আমাকে একটিবার ছেড়ে দাও আমি রুটিগুলো ঘরে দিয়ে আসি। বাইরে শিয়াল কুকুরে খেয়ে যাবে-রোগা মানুষ সমস্ত রাত খেতে পাবে না।"

মৃত্যুঞ্জয় রুদ্ধ ঘরের মধ্যে পাগলের মতো মাথা কুটিতে লাগিল, দ্বারে পদাঘাত করিতে লাগিল এবং শ্রাব্য-অশ্রাব্য বহুবিধ ভাষা প্রয়োগ করিতে লাগিল। কিন্তু আমরা তাহাতে তিলার্ধ বিচলিত হইলাম না। স্বদেশের মঙ্গলের জন্য সমস্ত অকাতরে সহ্য করিয়া টানিয়া লইয়া চলিলাম।

চলিলাম বলিতেছি, কেননা, আমিও বরাবর সঙ্গে ছিলাম, কিন্তু কোথায় আমার মধ্যে একটুখানি দুর্বলতা ছিল, আমি তার গায়ে হাত দিতে পারি নাই। বরঞ্চ কেমন যেন কান্না পাইতে লাগিল। সে যে অত্যন্ত অন্যায় করিয়াছে এবং তাহাকে গ্রামের বাহির করাই উচিত বটে, কিন্তু এটাই যে আমরা ভালো কাজ করিতেছি সেও কিছুতেই মনে করিতে পারিলাম না। কিন্তু আমার কথা থাক।

আপনারা মনে করিবেন না, পল্লিগ্রামে উদারতার একান্ত অভাব। মোটেই না। বরঞ্চ বড়লোক হইলে আমরা এমন সব ঔদার্য প্রকাশ করি যে, শুনিলে আপনারা অবাক হইয়া যাইবেন।

এই মৃত্যুঞ্জয়টাই যদি না তাহার হাতে ভাত খাইয়া অমার্জনীয় অপরাধ করিত তাহা হইলে তো আমাদের এত রাগ হইত না। আর কায়েতের ছেলের সঙ্গে সাপুড়ের মেয়ের নিকা-এ তো একটা হাসিয়া উড়াইবার কথা কিন্তু কাল করিল যে ওই ভাত খাইয়া। হোক না সে আড়াই মাসের রোগী, হোক না সে শয্যাশায়ী কিন্তু তাই বলিয়া ভাত! লুচি নয়, সন্দেশ নয়, পাঁঠার মাংস নয়। ভাত খাওয়া যে অন্ন-পাপ। সে তো আর সত্য সত্যই মাপ করা যায় না। তা নইলে পল্লিগাঁয়ের লোক সংকীর্ণচিত্ত নয়। চার ক্রোশ হাঁটা বিদ্যা যেসব ছেলের পেটে তারাই তো একদিন বড় হইয়া সমাজের মাথা হয়। দেবী বীণাপাণির বরে সংকীর্ণতা তাহাদের মধ্যে আসিবে কী করিয়া!

এই তো ইহারই কিছুদিন পরে, প্রাতঃস্মরণীয় স্বর্গীয় মুখোপাধ্যায় মহাশয়ের বিধবা পুত্রবধূ মনের বৈরাগ্যে বছর দুই কাশীবাস করিয়া যখন ফিরিয়া আসিলেন, তখন নিন্দুকেরা কানাকানি করিতে লাগিল যে, অর্ধেক সম্পত্তি ওই বিধবার এবং পাছে তাহা বেহাত হয় এই ভয়েই ছোটবাবু অনেক চেষ্টা, অনেক পরিশ্রমের পর বৌঠানকে যেখান হইতে ফিরাইয়া আনিয়াছেন, সেটা কাশীই বটে। যাই হোক, ছোটবাবু তাহার স্বাভাবিক ঔদার্যে গ্রামের বারোয়ারি পূজাবাবদ দুইশত টাকা দান করিয়া, পাঁচখানা গ্রামের ব্রাহ্মণের সদক্ষিণা-উত্তর ফলাহারের পর, প্রত্যেক সদব্রাহ্মণের হাতে যখন একটা করিয়া কাঁসার গেলাস দিয়া বিদায় করিলেন, তখন ধন্য ধন্য পড়িয়া গেল। এমনকি, পথে আসিতে অনেকেই দশের এবং দেশের কল্যাণের নিমিত্ত কামনা করিতে লাগিলেন, এমন সব যারা বড়লোক তাদের বাড়িতে বাড়িতে, মাসে মাসে এমন সদানুষ্ঠানের আয়োজন হয় না কেন?

কিন্তু যাক। মহত্ত্বের কাহিনি আমাদের অনেক আছে। যুগে যুগে সঞ্চিত হইয়া প্রায় প্রত্যেক পল্লিবাসীর দ্বারেই স্তূপাকার হইয়া উঠিয়াছে। এই দক্ষিণ বঙ্গের অনেক পল্লিতে অনেকদিন ঘুরিয়া গৌরব করিবার মত অনেক বড় বড় ব্যাপার প্রত্যক্ষ করিয়াছি। চরিত্রেই বল, ধর্মেই বল, সমাজেই বল, আর বিদ্যাতেই বল, শিক্ষা একেবারেই পুরা হইয়া আছে; এখন শুধু ইংরাজকে কষিয়া গালিগালাজ করিতে পারিলে দেশটা উদ্ধার হইয়া যায়।

বৎসরখানেক গত হইয়াছে। মশার কামড় আর সহ্য করিতে না পারিয়া সবেমাত্র সন্ন্যাসীগিরিতে ইস্তফা দিয়া ঘরে ফিরিয়াছি। একদিন দুপুরবেলা ক্রোশ দুই দূরের মালোপাড়ার ভিতর দিয়া চলিয়াছি, হঠাৎ দেখি, একটা কুটিরের দ্বারে বসিয়া মৃত্যুঞ্জয়। তাহার মাথায় গেরুয়া পাগড়ি, বড় বড় দাড়ি-চুল, গলায় রুদ্রাক্ষ ও পুঁতির মালা-কে বলিবে এ আমাদের সেই মৃত্যুঞ্জয়। কায়স্থের ছেলে একটা বছরের মধ্যেই জাত দিয়া একেবারে পুরাদস্তুর সাপুড়ে হইয়া গিয়াছে। মানুষ কত শীঘ্র যে তাহার চৌদ্দ পুরুষের জাতটা বিসর্জন দিয়া আর একটা জাত হইয়া উঠিতে পারে, সে এক আশ্চর্য ব্যাপার। ব্রাহ্মণের ছেলে মেথরানি বিবাহ করিয়া মেথর হইয়া গেছে এবং তাহাদের ব্যবসা অবলম্বন করিয়াছে, এ বোধ করি আপনারা সবাই শুনিয়াছেন। আমি সদব্রাহ্মণের ছেলেকে এন্ট্রান্স পাস করার পরেও ডোমের মেয়ে বিবাহ করিয়া ডোম হইতে দেখিয়াছি। এখন সে ধুচুনি কুলো বুনিয়া বিক্রয় করে, শুয়ার চরায়। ভালো কায়স্থ-সন্তানকে কসাইয়ের মেয়ে বিবাহ করিয়া কসাই হইয়া যাইতেও দেখিয়াছি। আজ সে স্বহস্তে গরু কাটিয়া বিক্রয় করে-তাহাকে দেখিয়া কাহার সাধ্য বলে, কোনো কালে সে কসাই ভিন্ন আর কিছু ছিল। কিন্তু সকলেরই ওই একই হেতু। আমার তাই তো মনে হয়, এমন করিয়া এত সহজে পুরুষকে যাহারা টানিয়া নামাইতে পারে তাহারা কি এমনিই অবলীলাক্রমে তাহাদের ঠেলিয়া উপরে তুলিতে পারে না? যে পল্লিগ্রামের পুরুষদের সুখ্যাতিতে আজ পঞ্চমুখ হইয়া উঠিয়াছি, গৌরবটা কি একা শুধু তাহাদেরই? শুধু নিজেদের জোরেই এত দ্রুত নিচের দিকে নামিয়া চলিয়াছে। অন্দরের দিক হইতে কি এতটুকু উৎসাহ, এতটুকু সাহায্য আসে না?

কিন্তু যাক। ঝোঁকের মাথায়, হয়ত বা অনধিকারচর্চা করিয়া বসিব। কিন্তু আমার মুশকিল হইয়াছে যে, আমি কোনোমতেই ভুলিতে পারি না, দেশের নব্বই জন নরনারীই ওই পল্লিগ্রামেরই মানুষ এবং সেই জন্য কিছু একটা আমাদের করা চাই-ই। যাক। বলিতেছিলাম যে, দেখিয়া কে বলিবে এ সেই মৃত্যুঞ্জয়। কিন্তু আমাকে সে খাতির করিয়া বসাইল। বিলাসী পুকুরে জল আনিতে গিয়াছিল, আমাকে দেখিয়া সেও ভারি খুশি হইয়া বার বার বলিতে লাগিল, “তুমি না আগলালে সে রাত্তিরে আমাকে তারা মেরেই ফেলত। আমার জন্য না জানি কত মার তুমি খেয়েছিলে।”

কথায় কথায় শুনিলাম, পরদিনই তাহারা এখানে উঠিয়া আসিয়া ক্রমশ ঘর বাঁধিয়া বাস করিতেছে এবং সুখে আছে। সুখে যে আছে একথা আমাকে বলার প্রয়োজন ছিল না, শুধু তাহাদের মুখের পানে চাহিয়াই আমি তাহা বুঝিয়াছিলাম।

তাই শুনিলাম, আজ কোথায় নাকি তাহাদের সাপ ধরার বায়না আছে এবং তাহারা প্রস্তুত হইয়াছে, আমিও অমনি সঙ্গে যাইবার জন্য লাফাইয়া উঠিলাম। ছেলেবেলা হইতেই দুটা জিনিসের ওপর আমার প্রবল শখ ছিল। এক ছিল গোখরা সাপ ধরিয়া পোষা, আর ছিল মন্ত্র-সিদ্ধ হওয়া।

সিদ্ধা হওয়ার উপায় তখনও খুঁজিয়া বাহির করিতে পারি নাই। কিন্তু মৃত্যুঞ্জয়কে ওস্তাদ লাভ করিবার আশায় আনন্দে উৎফুল্ল হইয়া উঠিলাম। সে তাহার নামজাদা শ্বশুরের শিষ্য, সুতরাং মস্ত লোক। আমার ভাগ্য যে অকস্মাৎ এমন প্রসন্ন হইয়া উঠিবে তাহা কে ভাবিতে পারিত?

কিন্তু শক্ত কাজ এবং ভয়ের কারণ আছে বলিয়া প্রথমে তাহারা উভয়েই আপত্তি করিল, কিন্তু আমি এমনি নাছোড়বান্দা হইয়া উঠিলাম যে, মাস খানেকের মধ্যে আমাকে সাগরেদ করিতে মৃত্যুঞ্জয় পথ পাইল না। সাপ ধরার মন্ত্র এবং হিসাব শিখাইয়া দিল এবং কবজিতে ওষুধ সমেত মাদুলি বাঁধিয়া দিয়া দস্তুরমত সাপুড়ে বানাইয়া তুলিল।

মন্ত্রটা কি জানেন? তার শেষটা আমার মনে আছে-

-ওরে কেউটে তুই মনসার বাহন-

মনসা দেবী আমার মা-

ওলটপালট পাতাল-ফোঁড়-

ঢোঁড়ার বিষ তুই নে, তোর বিষ ঢোঁড়ারে দে-

-দুধরাজ, মণিরাজ।

কার আজ্ঞা-বিষহরির আজ্ঞা।

ইহার মানে যে কী তাহা আমি জানি না। কারণ, যিনি এই মন্ত্রেরও দ্রষ্টা ঋষি ছিলেন-নিশ্চয় কেহ না কেহ ছিলেন-তাঁর সাক্ষাৎ কখনও পাই নাই।

অবশেষে একদিন এই মন্ত্রের সত্য মিথ্যার চরম মীমাংসা হইয়া গেল বটে, কিন্তু যতদিন না হইল ততদিন সাপ ধরার জন্য চতুর্দিকে প্রসিদ্ধ হইয়া গেলাম। সবাই বলাবলি করিতে লাগিল, হ্যাঁ, ন্যাড়া একজন গুণী লোক বটে। সন্ন্যাসী অবস্থায় কামাখ্যায় গিয়া সিদ্ধ হইয়া আসিয়াছে। এতটুকু বয়সের মধ্যে এত বড় ওস্তাদ হইয়া অহংকারে আমার মাটিতে পা পড়ে না, এমনি যো হইল।

বিশ্বাস করিল না শুধু দুই জন। আমার গুরু যে, সে তো ভালো মন্দ কোনো কথাই বলিত না। কিন্তু বিলাসী মাঝে মাঝে মুখ টিপিয়া হাসিয়া বলিত, ঠাকুর, এসব ভয়ংকর জানোয়ার, একটু সাবধানে নাড়াচাড়া করো। বস্তুত বিষদাঁত ভাঙা, সাপের মুখ হইতে বিষ বাহির করা প্রভৃতি কাজগুলো এমনি অবহেলার সহিত করিতে শুরু করিয়াছিলাম যে, সেসব মনে পড়িলে আমার আজও গা কাঁপে।

আসলে কথা হইতেছে এই যে, সাপ ধরাও কঠিন নয় এবং ধরা সাপ দুই চারদিন হাঁড়িতে পুরিয়া রাখার পরে তাহার বিষদাঁত ভাঙাই হোক আর নাই হোক, কিছুতেই কামড়াইতে চাহে না। চক্র তুলিয়া কামড়াইবার ভান করে, ভয় দেখায়, কিন্তু কামড়ায় না।

মাঝে মাঝে আমাদের গুরুশিষ্যের সহিত বিলাসী তর্ক করিত। সাপুড়েদের সবচেয়ে লাভের ব্যবসা শিকড় বিক্রি করা, যা দেখাইবামাত্র সাপ পালাইতে পথ পায় না। কিন্তু তার পূর্বে সামান্য একটু কাজ করিতে হইত। যে সাপটা শিকড় দেখিয়া পালাইবে, তাহার মুখে একটা লোহার শিক পুড়াইয়া বার কয়েক ছ্যাঁকা দিতে হয়। তারপর তাহাকে শিকড়ই দেখান হোক বা একটা কাঠিই দেখান হোক, সে কোথায় পালাইবে তা ভাবিয়া পায় না। এই কাজটার বিরুদ্ধে বিলাসী ভয়ানক আপত্তি করিয়া মৃত্যুঞ্জয়কে বলিত, “দেখ, এমন করে মানুষ ঠকায়ো না।”

মৃত্যুঞ্জয় কহিত, “সবাই করে-এতে দোষ কী?”

বিলাসী বলিত, "করুক গে সবাই। আমাদের তো খাবার ভাবনা নেই, আমরা কেন মিছামিছি লোক ঠকাতে যাই।"

আর একটা জিনিস আমি বারবার লক্ষ করিয়াছি। সাপ ধরার বায়না আসিলেই বিলাসী নানাপ্রকারে বাধা দিবার চেষ্টা করিত-আজ শনিবার, আজ মঙ্গলবার, এমনি কত কি। মৃত্যুঞ্জয় উপস্থিত না থাকিলে সে তো একবারেই ভাগাইয়া দিত, কিন্তু উপস্থিত থাকিলে মৃত্যুঞ্জয় নগদ টাকার লোভ সামলাইতে পারিত না। আর আমার তো একরকম নেশার মত হইয়া দাঁড়াইয়াছিল। নানাপ্রকারে তাহাকে উত্তেজিত করিতে চেষ্টার ত্রুটি করিতাম না। বস্তুত ইহার মধ্যে মজা ছাড়া ভয় যে কোথায় ছিল, এ আমাদের মনেই স্থান পাইত না। কিন্তু এই পাপের দণ্ড আমাকে একদিন ভালো করিয়াই দিতে হইল।

সেদিন ক্রোশ-দেড়েক দূরে এক গোয়ালার বাড়িতে সাপ ধরিতে গিয়াছি। বিলাসী বরাবরই সঙ্গে যাইত, আজও সঙ্গে ছিল। মেটে ঘরের মেঝে খানিকটা খুঁড়িতেই একটা গর্তের চিহ্ন পাওয়া গেল। আমরা কেহই লক্ষ করি নাই, কিন্তু বিলাসী সাপুড়ের মেয়ে-সে হেঁট হইয়া কয়েক টুকরা কাগজ তুলিয়া লইয়া আমাকে বলিল, "ঠাকুর, একটু সাবধানে খুঁড়ো। সাপ একটা নয় একজোড়া তো আছে বটেই হয়ত বা বেশি থাকিতে পারে।"

মৃত্যুঞ্জয় বলিল, "এরা যে বলে একটাই এসে ঢুকেছে। একটাই দেখতে পাওয়া গেছে।"

বিলাসী কাগজ দেখাইয়া কহিল, "দেখছ না বাসা করেছিল?"

মৃত্যুঞ্জয় কহিল, "কাগজ তো ইঁদুরেও আনতে পারে।"

বিলাসী কহিল, "দু-ই হতে পারে। কিন্তু দুটো আছে আমি বলছি।"

বাস্তবিক বিলাসীর কথাই ফলিল এবং মর্মান্তিকভাবেই সেদিন ফলিল। মিনিট-দশেকের মধ্যে একটা প্রকাণ্ড খরিশ গোখরো ধরিয়া ফেলিয়া মৃত্যুঞ্জয় আমার হাতে দিল। কিন্তু সেটাকে ঝাঁপির মধ্যে পুরিয়া ফিরিতে না ফিরিতেই মৃত্যুঞ্জয় 'উঃ' করিয়া নিঃশ্বাস ফেলিয়া বাহিরে আসিয়া দাঁড়াইল। তাহার হাতের উলটা পিঠ দিয়ে ঝরঝর করিয়া রক্ত পড়িতেছিল।

প্রথমটা যেন সবাই হতবুদ্ধি হইয়া গেলাম। কারণ সাপ ধরিতে গেলে সে পালাইবার জন্য ব্যাকুল না হইয়া বরঞ্চ গর্ত হইতে একহাত মুখ বাহির করিয়া দংশন করে, এমন অভাবনীয় ব্যাপার জীবনে এই একটিবার দেখিয়াছি। পরক্ষণেই বিলাসী চিৎকার করিয়া ছুটিয়া গিয়া আঁচল দিয়া তাহার হাতটা বাঁধিয়া ফেলিল এবং যত রকমের শিকড়-বাকড় সে সঙ্গে আনিয়াছিল সমস্তই তাহাকে চিবাইতে দিল। মৃত্যুঞ্জয়ের নিজের মাদুলি তো ছিলই, তাহার উপরে আমার মাদুলিটাও খুলিয়া তাহার হাতে বাঁধিয়া দিলাম। আশা, বিষ ইহার ঊর্ধ্বে আর উঠিবে না, বরং সেই 'বিষহরির আজ্ঞা' মন্ত্রটা সতেজে বারংবার আবৃত্তি করিতে লাগিলাম। চতুর্দিকে ভিড় জমিয়া গেল এবং এ অঞ্চলের মধ্যে যেখানে যত গুণী ব্যক্তি আছেন সকলকে খবর দিবার জন্য দিকে দিকে লোক ছুটিল। বিলাসীর বাপকে সংবাদ দিবার জন্য লোক গেল।

আমার মন্ত্র পড়ার আর বিরাম নাই, কিন্তু ঠিক সুবিধা হইতেছে বলিয়া মনে হইল না। তথাপি আবৃত্তি সমভাবেই চলিতে লাগিল। কিন্তু মিনিট পনের কুড়ি পরেই যখন মৃত্যুঞ্জয় একবার বমি করিয়া দিল, তখন বিলাসী মাটির ওপর একবারে আছাড় খাইয়া পড়িল। আমিও বুঝিলাম, বিষহরির দোহাই বুঝি-বা আর খাটে না।

নিকটবর্তী আরও দুই-চারিজন ওস্তাদ আসিয়া পড়িলেন এবং আমরা কখনও-বা একসঙ্গে কখনও আলাদা তেত্রিশ কোটি দেবদেবীর দোহাই পাড়িতে লাগিলাম। কিন্তু বিষ দোহাই মানিল না, রোগীর অবস্থা ক্রমেই মন্দ হইতে লাগিল। যখন দেখা গেল ভালো কথায় হইবে না, তখন তিন-চারজন ওঝা মিলিয়া বিষকে এমনি অকথ্য অশ্রাব্য গালিগালাজ করিতে লাগিল যে, বিষের কান থাকিলে সে মৃত্যুঞ্জয় তো মৃত্যুঞ্জয়, সেদিন দেশ ছাড়িয়া পলাইত। কিন্তু কিছুতেই কিছু হইল না। আরও আধ ঘণ্টা ধ্বস্তাধ্বস্তির পরে রোগী তাহার বাপ মায়ের দেওয়া মৃত্যুঞ্জয় নাম, তাহার শ্বশুরের দেওয়া মন্ত্রৌষধি সমস্ত মিথ্যা প্রতিপন্ন করিয়া ইহলোকের লীলা সাঙ্গ করিল। বিলাসী তাহার স্বামীর মাথাটা কোলে করিয়া বসিয়াছিল সে যেন একেবারে পাথর হইয়া গেল।

যাক, তাহার দুঃখের কাহিনিটি আর বাড়াইব না। কেবল এইটুকু বলিয়া শেষ করিব যে, সে সাত দিনের বেশি বাঁচিয়া থাকাটা সহিতে পারিল না। আমাকে শুধু একদিন বলিয়াছিল, ঠাকুর আমার মাথার দিব্যি রইল, এসব তুমি আর কখনও করো না।

আমার মাদুলি-কবচ তো মৃত্যুঞ্জয়ের সঙ্গে কবরে গিয়াছিল, ছিল শুধু বিষহরির আজ্ঞা। কিন্তু সে আজ্ঞা যে ম্যাজিস্ট্রেটের আজ্ঞা নহে এবং সাপের বিষ যে বাঙালির বিষ নয়, তাহা আমিও বুঝিয়াছিলাম।

একদিন গিয়া শুনিলাম, ঘরে তো আর বিষের অভাব ছিল না, বিলাসী আত্মহত্যা করিয়া মরিয়াছে এবং শাস্ত্রমতে সে নিশ্চয় নরকে গিয়াছে। কিন্তু যেখানেই যাক, আমার নিজের যখন যাইবার সময় আসিবে, তখন ওইরূপ কোনো একটা নরকে যাওয়ার প্রস্তাবে পিছাইয়া দাঁড়াইব না, এইমাত্র বলিতে পারি।

খুড়া মশাই ষোল আনা বাগান দখল করিয়া অত্যন্ত বিজ্ঞের মতো চারিদিকে বলিয়া বেড়াইতে লাগিলেন, ওর যদি না অপঘাত-মৃত্যু হবে, তো হবে কার? পুরুষমানুষ অমন একটা ছেড়ে দশটা করুক না, তাতে তো তেমন আসে যায় না-না হয় একটু নিন্দাই হতো। কিন্তু হাতে ভাত খেয়ে মরতে গেলি কেন? নিজে মরলো, আমার পর্যন্ত মাথা হেঁট করে গেল। না পেলে এক ফোঁটা আগুন, না পেলে একটা পিন্ডি, না হলো একটা ভুজ্যি উচ্ছুণ্ড্য। গ্রামের লোক একবাক্যে বলিতে লাগিল, তাহাতে আর সন্দেহ কী! অন্নপাপ। বাপ রে! এর কি আর প্রায়শ্চিত্ত আছে।

বিলাসীর আত্মহত্যার ব্যাপারটা অনেকের কাছে পরিহাসের বিষয় হইল। আমি প্রায় ভাবি, এ অপরাধ হয়ত ইহারা উভয়েই করিয়াছিল, কিন্তু মৃত্যুঞ্জয় তো পল্লিগ্রামেরই ছেলে, পাড়াগাঁয়ের তেলে-জলেই তো মানুষ। তবু অত বড় দুঃসাহসের কাজে প্রবৃত্ত করিয়াছিল তাহাকে যে বস্তুটা সেটা কেহ একবার চোখ মেলিয়া দেখিতে পাইল না?

আমার মনে হয়, যে দেশের নরনারীর মধ্যে পরস্পরের হৃদয় জয় করিয়া বিবাহ করিবার রীতি নাই, বরঞ্চ তাহা নিন্দার সামগ্রী, যে দেশে নরনারী আশা করিবার সৌভাগ্য, আকাঙ্ক্ষা করিবার ভয়ংকর আনন্দ হইতে চিরদিনের জন্য বঞ্চিত, যাহাদের জয়ের গর্ব, পরাজয়ের ব্যথা কোনোটাই জীবনে একটিবারও বহন করিতে হয় না, যাহাদের ভুল করিবার দুঃখ, আর ভুল না করিবার আত্মপ্রসাদ, কিছুরই বালাই নাই, যাহাদের প্রাচীন এবং বহুদর্শী বিজ্ঞ সমাজ সর্ব প্রকারের হাঙ্গামা হইতে অত্যন্ত সাবধানে দেশের লোককে তফাৎ করিয়া, আজীবন কেবল ভালোটি হইয়া থাকিবারই ব্যবস্থা করিয়া দিয়াছেন, তাই বিবাহ ব্যাপারটা যাহাদের শুধু নিছক Contract তা সে যতই কেননা বৈদিক মন্ত্র দিয়া Document পাকা করা হোক, সে দেশের লোকের সাধ্যই নাই মৃত্যুঞ্জয়ের অন্নপাপের কারণ বোঝে। বিলাসীকে যাঁহারা পরিহাস করিয়াছিলেন, তাঁহারা সাধু গৃহস্থ এবং সাধ্বী গৃহিণী- অক্ষয় সতীলোক তাঁহারা সবাই পাইবেন, তাও আমি জানি কিন্তু সেই সাপুড়ের মেয়েটি যখন একটি পীড়িত শয্যাগত লোককে তিল তিল করিয়া জয় করিতেছিল, তাহার তখনকার সেই গৌরবের কণামাত্র হয়ত আজিও ইহাদের কেহ চোখে দেখেন নাই। মৃত্যুঞ্জয় হয়ত নিতান্তই একটা তুচ্ছ মানুষ ছিল, কিন্তু তাহার হৃদয় জয় করিয়া দখল করার আনন্দটাও তুচ্ছ নয়, সে সম্পদও অকিঞ্চিৎকর নহে।

এই বস্তুটাই এ দেশের লোকের পক্ষে বুঝিয়া উঠা কঠিন। আমি ভূদেববাবুর পারিবারিক প্রবন্ধেরও দোষ দিব না এবং শাস্ত্রীয় তথা সামাজিক বিধি-ব্যবস্থারও নিন্দা করিব না। করিলেও মুখের ওপর কড়া জবাব দিয়া যাঁহারা বলিবেন, এই হিন্দু সমাজ তাহার নির্ভুল বিধিব্যবস্থার জোরেই অত শতাব্দীর অতগুলো বিপ্লবের মধ্যে বাঁচিয়া আছে, আমি তাঁহাদেরও অতিশয় ভক্তি করি, প্রত্যুত্তরে আমি কখনই বলিব না, টিকিয়া থাকাই চরম সার্থকতা নয়, এবং অতিকায় হস্তী লোপ পাইয়াছে কিন্তু তেলাপোকা টিকিয়া আছে। আমি শুধু এই বলিব যে, বড়লোকের নন্দগোপালটির মতো দিবারাত্রি চোখে চোখে এবং কোলে কোলে রাখিলে যে সে বেশটি থাকিবে, তাহাতে কোনোই সন্দেহ নাই, কিন্তু একেবারে তেলাপোকাটির মত বাঁচাইয়া রাখার চেয়ে এক আধবার কোল হইতে নামাইয়া আরও পাঁচজন মানুষের মতো দু-এক পা হাঁটিতে দিলেই প্রায়শ্চিত্ত করার মত পাপ হয় না।

উৎস নির্দেশ :
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের “বিলাসী” গল্পটি প্রথমে প্রকাশিত হয় ‘ভারতী’ পত্রিকায় ১৩২৫ বঙ্গাব্দের (১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দ) বৈশাখ সংখ্যায়।

শব্দার্থ ও টীকা :
➠ ক্রোশ- আনুমানিক ৩.৬৫৬ কিলেোমিটার।
➠ বাটী- বাড়ি।
➠ মাইল- ১.৬০৯ কিলোমিটার।
➠ ঢের- অনেক।
মা-সরস্বতী- হিন্দু পুরাণ অনুসারে বিদ্যা ও কলার অধিষ্ঠাত্রী দেবী। বীণাপাণি। বাগ্দেবী।
➠ বর- অলৌকিক উৎস থেকে ক্ষমতা বা অভীষ্ট বস্তু লাভ।
➠ কৃতবিদ্য- বিদ্যা অর্জন করেছেন এমন পণ্ডিত। বিদ্বান।
➠ ম্যালেরিয়া- মানবদেহে অ্যানোফিলিস মশাবাহিত জীবাণু সংক্রমণের ফলে পালা করে আসে এমন জ্বর।
➠ ছেলে-পুলে- ছোটো ছোটো ছেলেমেয়ে; সন্তান-সন্তুতি; পুত্র-কন্যা।
➠ বঁইচি- কাঁটাযুক্ত একরকম ছোট গাছ ও তার ফল।
➠ রম্ভার কাঁদি- কলার ছড়া।
➠ কানাচ- ঘরের পেছন দিককার লাগোয়া জায়গা।
➠ খেজুরমেতি- খেজুর গাছের মাথার কাছের নরম মিষ্টি অংশ।
➠ কামস্কাকা- প্রকৃত উচ্চারণ কামচাকা (Kamchatka) রাশিয়ার অন্তর্গত সাইবেরিয়ার উত্তর পূর্বে অবস্থিত একটি উপদ্বীপ। এর দক্ষিণ-পশ্চিমে ওখটক সাগর ও উত্তর-পূর্বে বেরিং সাগর। উপদ্বীপটি পার্বত্য, তুন্দ্রা ও বনময়। বহু উষ্ণ প্রস্রবণ ও সতেরোটি জীবন্ত আগ্নেয়গিরি আছে এখানে। প্রচুর স্যামন মাছ পাওয়া যায় বলে দ্বীপটি স্যামন মাছের দেশ নামে পরিচিত। রাজধানী শহরের নাম- পেত্রোপালাভস্ক।
➠ সাইবেরিয়া- এশিয়ার উত্তরে রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত এশিয়ার উত্তরাঞ্চলের বিস্তীর্ণ ভূভাগ। এশিয়া মহাদেশের এক তৃতীয়াংশ অঞ্চল এর মধ্যে পড়েছে। তুন্দ্রা, সরলবর্গীয় বৃক্ষের অরণ্য, স্তেপ তৃণভূমি ও পৃথিবীর গভীরতম হ্রদ ‘বৈকাল’ এখানে অবস্থিত। পৃথিবীর দীর্ঘতম রেলপথ ট্রান্স-সাইবেরিয়ান চালু হওয়ার পর এখানে বহু শহর গড়ে উঠেছে।
➠ ফুরসতই- অবসর।
➠ এডেন- লোহিতসাগর ও আরব সাগরের প্রবেশপথে আরব দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত বিখ্যাত বন্দর। সামুদ্রিক লবণ তৈরির জন্য বিখ্যাত।
➠ পারশিয়া- পারস্য বা ইরান দেশ।
➠ হুমায়ূন- মোগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বাবরের পুত্র এবং দ্বিতীয় মোগল সম্রাট। তিনি মোগল সম্রাট আকবরের পিতা।
➠ তোগলক খাঁ- ভারতবর্ষের ইতিহাসে তোগলক খাঁ নামে কোনো সম্রাট ছিলেন না। ইতিহাসে যে তিনজন বিখ্যাত তোগলক সম্রাটের নাম পাওয়া যায় তাঁরা হলেন: গিয়াসউদ্দিন তোগলক, মুহাম্মদ তোগলক ও ফিরোজ তোগলক।
➠ চল্লিশের কোঠা- এখানে চল্লিশ থেকে ঊনপঞ্চাশ পর্যন্ত বয়সসীমা।
➠ প্রমোশন- promotion অর্থ পদের উন্নতি।
➠ মতলব করি- ফন্দি কররা; কূট-কৌশল করি।
➠ ঠ্যাঙানো- মারা; প্রহার।
➠ ফোর্থ ক্লাস- এখনকার সপ্তম শ্রেণি।
➠ থার্ড ক্লাস- বর্তমান অষ্টম শ্রেণি। সেকালে মাধ্যমিক শিক্ষার শ্রেণি হিসাব করা হতো ওপর থেকে নিচের দিকে। দশম শ্রেণি তখন ছিল ফার্স্ট ক্লাস, নবম শ্রেণি ছিল সেকেন্ড ক্লাস।
➠ সেকেন্ড ক্লাস- এখনকার নবম শ্রেণি।
➠ প্রত্নতাত্ত্বিক- পুরাতত্ত্ববিদ। প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ, মুদ্রা, লিপি ইত্যাদি থেকে ঐতিহাসিক তথ্য নির্ণয়ের বিদ্যায় পণ্ডিত ব্যক্তি।
প্রকাণ্ড পোড়োবাড়ি- বড়ো জীর্ণ ও পরিত্যক্ত বাড়ি; বড়ো ভূতুড়ে বাড়ি।
➠ জ্ঞাতি- একই বংশে জাত ব্যক্তি; পিতৃবংশের লোক।
➠ খুড়া- চাচা।
➠ গুলি- আফিমের তৈরি একরকম মাদক যা বড়ির মতো গুলি পাকিয়ে ব্যবহার করা হয়।
➠ দুর্নাম- বদনাম।
➠ রটনা- প্রচার।
➠ ওপরের আদালতের হুকুমে- স্রষ্টার নির্দেশে।
এমনি সুনাম- দুর্নাম বোঝাতে বিদ্রুপ করা হয়েছে।
মালো- এ গল্পে সাপের ওঝা অর্থে ব্যবহৃত। সাধারণত এরা সাপ ধরে, সাপের কামড়ের চিকিৎসা ও সাপের খেলা দেখিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে। তবে মালো বলতে এমন একটি সম্প্রদায়কেও বোঝায় যাদের পেশা মাছ ধরা।
সদ্ব্যয় করিয়াছি- অপব্যয় করেছি বোঝাতে ব্যঙ্গ ভরে বলা হয়েছে।
কঙ্কালসার- অস্থিচর্মসার অবস্থা যেন প্রায় কঙ্কাল।
➠ যমরাজ- ধর্মরাজ। এখানে মৃত্যু অর্থে।
➠ তিলার্ধ- তিল পরিমাণ সময়ের অর্ধ, মুহূর্তমাত্র।
➠ জনশ্রুতি- লোকপরম্পরায় শোনা কথা, জনরব, লোকশ্রুতি।
➠ সত্যযুগ- হিন্দু পুরাণে বর্ণিত চার যুগের প্রথম যুগ যখন সমাজে অসত্য অন্যায় একেবারেই ছিল না বলে ধারণা করা হয়।
➠ রসাতলে গেল- অধঃপাতে বা উচ্ছন্নে গেল।
➠ অকালকুষ্মাণ্ড- অসময়ে ফলেছে এমন কুমড়ো। এখানে অকর্মণ্য ব্যক্তি।
➠ নিকা- আরবি শব্দ নিকাহ্; বিয়ে। বিধবাবিবাহ বা পুনর্বার বিবাহ।
➠ কলি- হিন্দু পুরাণে বর্ণিত চার যুগের শেষ যুগ। পুরাণ মতে, এ যুগে অন্যায়, অসত্য ও অধর্মের বাড়াবাড়ি ঘটবে।
➠ বদন দগ্ধ না হয়- মুখ যেন না পোড়ে। সুনাম যেন নষ্ট না হয়।
নারায়ণের কর্তৃপক্ষেরও চক্ষুলজ্জা হইবে- কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে একদিকে সর্বভারতীয় রাজারা একপক্ষ নিয়ে যুদ্ধ করেছিলেন। শ্রীকৃষ্ণ ছিলেন নিরস্ত্র রথ-সারথি। সেখানে নারায়ণের নিরপেক্ষ আচরণ ছিল কাপুরুষ-সুলভ। সেই নারায়ণের পথাবলম্বীরাও এরূপ আচরণকে ভীরুতা বলতে লজ্জিত হবে। বাক্যাংশটিতে প্রকৃতপক্ষে ব্যঙ্গ করে বলা হয়েছে যে- ওদের আচরণ এতই বর্বর ছিল যে তা কাপুরুষতার চেয়েও লজ্জাজনক ছিল।
বিলাত প্রভৃতি স্লেচ্ছদেশে- ইংল্যান্ডসহ ইউরোপীয় দেশসমূহে যেখানে হিন্দু সমাজের আচারধর্মের কোনো বালাই নেই।
সনাতন হিন্দু এ কুসংস্কার মানে না- এখানে হিন্দু ধর্মের সংস্কারাচ্ছন্নতাকে তীব্রভাবে ব্যঙ্গ করা হয়েছে।
শ্রাব্য-অশ্রাব্য- শোনার যোগ্য ও অযোগ্য। শ্লীল-অশ্লীল অর্থে ব্যবহৃত।
দেবী বীণাপাণির বরে সংকীর্ণতা তাহাদের মধ্যে আসিবে কী করিয়া- এখানে ব্যঙ্গ করে বলা হয়েছে- দেবী সরস্বতীর প্রকৃত মান্যতার অভাবে এরা সংকীর্ণতাসর্বস্ব হয়ে পড়েছে।
প্রাতঃস্মরণীয়- প্রাতঃকালে স্মরণ করার যোগ্য। অতি শ্রদ্ধেয়।
সেটা কাশীই বটে- কাশী ভারতের উত্তর প্রদেশে অবস্থিত বিখ্যাত ও সুপ্রাচীন তীর্থক্ষেত্র।সেখানে সাধু-সন্ত-পুণ্যার্থীর সমাবেশ যেমন হয় তেমনি দুশ্চরিত্র লোকজনের আখড়াও সেখানে জমে। মুখোপাধ্যায় মহাশয়ের বিধবা পুত্রবধূকে যেখান থেকে উদ্ধার করে আনা হয়েছিল তা কাশী হলেও তীর্থস্থান ছিল না বরং পতিতালয় বা অনুরূপ কোনো স্থান ছিল এখানে সেই ইঙ্গিতই করা হয়েছে।
➠ বারওয়ারি- অনেকের সমবেত চেষ্টায় যা করা হয়। সর্বজনীন। বারোয়ারি।
➠ সুদক্ষিণা- পুরোহিতের সম্মানী বা সেলামি।
➠ ফলাহার- জলযোগ। ফলার।
➠ ধন্য ধন্য পড়িয়া গেল- সকলে প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠলেন।
মহত্ত্বের কাহিনি- মহানুভবতার কথা। ব্যঙ্গার্থে নীচতার কাহিনি।
➠ এন্ট্রান্স- প্রবেশিকা পরীক্ষা। বর্তমান মাধ্যমিক পরীক্ষার সমতুল্য।
➠ ধুচুনি- চাল ইত্যাদি ধোয়ার জন্য বহু ছিদ্রবিশিষ্ট বাঁশের ঝুড়ি।
➠ পঞ্চমুখ- পাঁচ মুখে যে কথা বলে। মুখর।
পল্লিগ্রামের পুরুষদের সুখ্যাতিতে- ব্যঙ্গ করে সুখ্যাতি বলা হয়েছে। বস্তুত লেখক গ্রামের পুরুষদের সমালোচনা ও নিন্দা করেছেন।
➠ মন্ত্রসিদ্ধ- মন্ত্রে সাধনায় সিদ্ধি অর্জন করেছেন এমন যার উচ্চারিত মন্ত্র অব্যর্থভাবে কার্যকর।
➠ মনসা- হিন্দু ধর্মানুসারে সাপের দেবী।
➠ মন্ত্রের দ্রষ্টা- যিনি প্রথম মন্ত্র লাভ করেন। মন্ত্র সম্পর্কে সাধারণ লোকবিশ্বাস এই যে, মন্ত্র কেউ তৈরি করেন না। তা কোনো ভাগ্যবান দৈববলে পেয়ে থাকেন। যাঁর কাছে প্রথম মন্ত্র আবির্ভূত হয় তিনিই মন্ত্রদ্রষ্টা।
➠ কামাখ্যা- ভারতের আসাম রাজ্যে অবস্থিত প্রাচীন তীর্থস্থান। তান্ত্রিক সাধক ও উপাসকদের তন্ত্রমন্ত্র সাধনার জন্য বিখ্যাত।
চক্র তুলিয়া- ফণা তুলে।
খরিশ গোখরা- খুব বিষাক্ত এক প্রজাতির গোখরা সাপ।
➠ বিষহরির দোহাই- মনসার মন্ত্রশক্তি।
মৃত্যুঞ্জয় নাম- মৃত্যুঞ্জয় নামের অর্থ- যিনি মৃত্যুকে জয় করেন। বিষকণ্ঠ শিব বা মহেশ্বরের অন্য নাম মৃত্যুঞ্জয়। মৃত্যুঞ্জয়ের বাবা-মা তাদের পুত্রের নাম মৃত্যুঞ্জয় রাখলেও সে মৃত্যুকে জয় করতে পারল না। তার নাম মিথ্যা প্রতিপন্ন হলো।
শ্বশুরের দেওয়া মন্ত্রৌষধি- মৃত্যুঞ্জয় তার শ্বশুরের কাছ থেকে অমোঘ মন্ত্রৌষধি পেয়েছিল বলে জনশ্রুতি ছিল।
ম্যাজিস্ট্রেটের আজ্ঞা- জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশ বা হুকুম যা পালন করা বাধ্যতামূলক। ম্যাজিস্ট্রেট চলে গেলেও হুকুম বহাল থাকে।
বাঙালির বিষ- লেখক ব্যঙ্গার্থে বলতে চান, বাঙালির ক্রোধ, বিদ্বেষ ইত্যাদি মুখের বাক্যেই সীমাবদ্ধ এবং ক্ষণস্থায়ী। তা সাপের বিষের মতো অব্যর্থভাবে কার্যকর নয়।
➠ পিণ্ডি- শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানে মৃতের উদ্দেশে দেওয়া চালের গোলাকার ডেলা।
➠ ভুজ্যি উচ্ছ্বগ্য- মৃতের আত্মার সদগতি কামনা করে ব্রাহ্মণকে যে ভোজ্য উৎসর্গ করা হয় তা।
➠ বহুদর্শী- জ্ঞানী। অনেক দেখেছেন এমন। বহু অভিজ্ঞতাসম্পন্ন।
➠ ভূদেববাবু- ভূদেবচন্দ্র মুখোপাধ্যায় (১৮২৫-১৮৯৪ খ্রিষ্টাব্দ) উনিশ শতকের বাংলার নবজাগরণের অন্যতম পথিকৃৎ। হিন্দু সমাজের নানা কুসংস্কারের বিরুদ্ধে মত ব্যক্ত করে আধুনিক মানস গঠনের লক্ষ্যে তিনি অনেক গ্রন্থ রচনা করেন। ‘পারিবারিক প্রবন্ধ’, ‘সামাজিক প্রবন্ধ’, ‘আচার প্রবন্ধ’ ইত্যাদি এ বিষয়ে তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ।
অতিকায় হস্তী- মহাগজ। Mammoth। হাতির এই প্রজাতি বর্তমান কালের হাতির চেয়ে অনেক বড় ছিল। এই প্রজাতির হাতি প্রাণিজগৎ থেকে লুপ্ত হয়েছে প্রাগৈতিহাসিক যুগে। তাদের অস্তিত্বের চিহ্ন রয়ে গেছে তাদের কঙ্কালে।

পাঠ-পরিচিতি :

‘ন্যাড়া’ নামের এক যুবকের নিজের জবানিতে বিবৃত হয়েছে “বিলাসী” গল্প। “বিলাসী” গল্পের কাহিনিতে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রথম জীবনের ছায়াপাত ঘটেছে।

“বিলাসী” গল্পে বর্ণিত হয়েছে ব্যতিক্রমধর্মী দুই মানব-মানবীর চরিত্রের অসাধারণ প্রেমের মহিমা, যা ছাপিয়ে উঠেছে জাতিগত বিভেদের সংকীর্ণ সীমা। গল্পে সংঘটিত একের পর এক ঘটনা এবং বিভিন্ন চরিত্রের মধ্যে সংঘাতের মাধ্যমেই কাহিনি অগ্রসর হয়। ঘটনার দ্বন্দ্ব-সংঘাতের মধ্য দিয়ে কাহিনিতে গতি সঞ্চারিত হয়েছে। লেখক কোন অবস্থান থেকে কাহিনি বলছেন, সেটা অনেক সময় কাহিনি বর্ণনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। লেখক সর্বদর্শী অবস্থান থেকেও কাহিনি বর্ণনা করতে পারেন। সেক্ষেত্রে তিনি সবগুলো চরিত্র ও ঘটনা- নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে বর্ণনা করেন। যেমনটি দেখা যায় সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর 'লালসালু' উপন্যাস এবং মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের "মাসি-পিসি" গল্পে। পক্ষান্তরে গল্পটি উত্তম পুরুষের ভাষ্যেও বর্ণিত হতে পারে। এক্ষেত্রে গল্পে আমি, আমাকে ইত্যাদি সর্বনাম এসে যায়। এরকম ক্ষেত্রে কখনো-কখনো লেখক নিজেই কাহিনির একটা চরিত্রের ভূমিকা নেন, হয়ে ওঠেন কথক। “বিলাসী” গল্পে লেখক সেই ভূমিকা গ্রহণ করেছেন। বর্তমান সংকলনের “অপরিচিতা”, “আহ্বান” ও “তাজমহল” গল্পে উত্তমপুরুষের ভাষ্য গৃহীত হয়েছে।

“বিলাসী” গল্পের নাম চরিত্র কর্মনিপুণ, বুদ্ধিমতী ও সেবাব্রতী বিলাসী; শরৎসাহিত্যের অন্যান্য উজ্জ্বল নায়িকাদের মতোই একজন। যে প্রেমের জন্যে নির্দ্বিধায় বেছে নিয়েছে স্বেচ্ছামৃত্যুর পথ আর তার প্রেমের মহিমাময় আলোয় ধরা পড়েছে সমাজের অনুদারতা ও রক্ষণশীলতা, জীবনের নিষ্ঠুর ও অশুভ চেহারা।


লেখক পরিচিতি :

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ১৮৭৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ই সেপ্টেম্বর পশ্চিম বাংলার হুগলি জেলার দেবানন্দপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মতিলাল চট্টোপাধ্যায়, জননী ভুবনমোহিনী দেবী। বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে জনপ্রিয় এই ঔপন্যাসিকের ছেলেবেলা কাটে দারিদ্র্যের মধ্যে। চব্বিশ বছর বয়সে মনের ঝোঁকে সন্ন্যাসী হয়ে গৃহত্যাগ করেছিলেন শরৎচন্দ্র। সংগীতজ্ঞ হিসেবে খ্যাতির সূত্রে ঘটনাচক্রে এক জমিদারের বন্ধু হয়েছিলেন তিনি; জীবিকার তাগিদে দেশ ছেড়ে গিয়েছিলেন বর্মা মুল্লুকে অর্থাৎ বর্তমান মিয়ানমারে।

শরৎচন্দ্র তাঁর জীবনের নানা অভিজ্ঞতা ও বিচিত্র সব মানুষের চরিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন তাঁর বিভিন্ন উপন্যাসে। বিশেষ করে সমাজের নিচু তলার মানুষ তাঁর সৃষ্ট চরিত্রে অপূর্ব মহিমা নিয়ে চিত্রিত হয়েছে। কথাশিল্পী শরৎচন্দ্রের শিল্পীমানসের মৌলবৈশিষ্ট্য মানবতা ও মানুষের প্রতি ভালোবাসা।

শরৎচন্দ্রের প্রথম মুদ্রিত রচনা কুন্তলীন পুরস্কারপ্রাপ্ত ‘মন্দির’ নামে একটি গল্প। তাঁর বিখ্যাত উপন্যাসগুলোর মধ্যে রয়েছে:‘দেবদাস’, ‘পল্লি-সমাজ’, ‘চরিত্রহীন’, ‘শ্রীকান্ত’, ‘গৃহদাহ’, ‘দেনাপাওনা’ ইত্যাদি। এসব উপন্যাসে বাঙালি নারীর প্রতিকৃতি অঙ্কনে তিনি অসামান্য দক্ষতা দেখিয়েছেন। তাঁর বহু উপন্যাস ভারতবর্ষের বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত ও চলচ্চিত্রায়িত হয়েছে। তাঁর কয়েকটি উপন্যাস বিদেশি ভাষায়ও অনূদিত হয়েছে। সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতি হিসেবে ১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে জগত্তারিণী স্বর্ণপদক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৩৬ সালে তাঁকে সম্মানসূচক ডিলিট ডিগ্রি প্রদান করে।
শরৎচন্দ্র ১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ই জানুয়ারি কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।


বহুনির্বাচনি প্রশ্ন :

প্রশ্ন থেকে

অভিনন্দন!
আপনি পেয়েছেন -এর মধ্যে!
যা


জ্ঞানমূলক প্রশ্ন :
১. খুড়া কোন বংশের?
উত্তর: খুড়া মিত্তির বংশের।
২. মৃত্যুঞ্জয়ের বাগানটা কত বিঘার ছিল?
উত্তর: মৃত্যুঞ্জয়ের বাগানটা কুড়ি-পঁচিশ ছিল।
৩. কোন যুক্তিকে কলি যুগ বলা হয়?
উত্তর: হিন্দুপুরাণে বর্ণিত চারযুগের শেষ যুগকে কলিযুগ বলা হয়।
৪. ‘বিলাসী’ গল্পের বর্ণনাকারী কে?
উত্তর: ‘বিলাসী’ গল্পের বর্ণনাকারী ন্যাড়া।
৫. বিলাসীর পারিবারিক পদাবি কী?
উত্তর: বিলাসীর পারিবারিক পদবি হল মালো।
৬. কামাখ্যা কী?
উত্তর: কামাখ্যা হলো ভারতের আসাম রাজ্যে অবস্থিত প্রাচীন তীর্থস্থান। স্থানটি তান্ত্রিক সাধক ও উপাসকদের তন্ত্র মন্ত্র সাধনা জন্য বিখ্যাত।
৭. অন্নপাপ কী?
উত্তর: বর্ণবাদী হিন্দু সমাজের অনুশাসনে উচ্চবংশীয় লোক নিম্নবংশের লোকের হাতের ভাত খেলে তাকে অন্নপাপ হিসেবে ধরা হয়।
৮. ‘কানাচ’ শব্দটির অর্থ কী?
উত্তর: ‘কানাচ’ শব্দটির অর্থ ঘরের পেছনে দিককার লাগানো জায়গা।
৯. ‘বুকফাটা শব্দের অর্থ কী?
উত্তর: ‘বুকফাটা’ শব্দটির অর্থ হৃদয়বিদারক।
১০. খুড়োর সঙ্গে কতজন মৃত্যুঞ্জয়ের বাড়িতে যায়?
উত্তর: খুড়োর সঙ্গে দশ-বারোজন মৃত্যুঞ্জয়ের বাড়িতে যায়।
১১. ‘বিলাসী’ গল্পে স্কুল-বালকদের যাতায়াতে কত ক্রোশ পথ ব্যয় করতে হতো?
উত্তর: ‘বিলাসী’ গল্পে স্কুল-বালকদের যাতায়াতে চার ক্রোশ পথ ব্যয় করতে হতো।
১২. সনাতন সংস্কারে কার গায়ে হাত তুলতে পারা যায়?
উত্তর: সনাতন সংস্কারে যার গায়ে জোর নাই তার গায়ে হাত তুলতে পারা যায়।
১৩. এন্ট্রান্স পাস করা ব্রাহ্মণের ছেলে কাকে বিয়ে করেছে?
উত্তর: এন্ট্রান্স পাস করা ব্রাহ্মণের ছেলে ডোমের মেয়েকে বিয়ে করেছে।
১৪. ন্যাড়ার বয়স কত ছিল?
উত্তর: ন্যাড়ার বয়স চল্লিশের কোঠা পেরিয়েছিল।
১৫. লোকের কথায় সন্ন্যাসী অবস্থায় ন্যাড়া কোথায় গিয়ে সিদ্ধ হয়েছিল?
উত্তর: লোকের কথায় সন্ন্যাসী অবস্থায় ন্যাড়া কামাখ্যায় গিয়ে সিদ্ধ হয়েছিল।
১৬. ‘মালো’ শব্দটি কোন অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে?
উত্তর: ‘মালো’ শব্দটি সাপের ওঝা অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।
১৭. ‘বিলাসী’ গল্পটি কোন পুরুষে বর্ণিত?
উত্তর: ‘বিলাসী’ গল্পটি উত্তম পুরুষে বর্ণিত।
১৮. ‘সেকেন্ড ক্লাস’ কোন শ্রেণি?
উত্তর: ‘সেকেন্ড ক্লাস’ বর্তমান নবম শ্রেণি।
১৯. বিলাসী চরিত্রের প্রধান তিনটি গুণ কী?
উত্তর: বিলাসী চরিত্রের প্রধান তিনটি গুণ হলো কর্মনিপুণা, বুদ্ধিমতী, সেবাব্রতী।
২০. ‘বিলাসী’ গল্পটি প্রথম কত সালে কোন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়?
উত্তর: ‘বিলাসী’ গল্পটি প্রথম ১৩২৫ বঙ্গাব্দে (১৯১৮ খ্রিস্টাব্দ) ‘ভারতী’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
২১. শরৎচন্দ্রের প্রথম গল্প কোনটি?
উত্তর: শরৎচন্দ্রের প্রথম গল্প ‘মন্দির’।
২২. ‘বিলাসী’ গল্পে শরৎচন্দ্রের কোন জীবনের ছায়া রয়েছে?
উত্তর: ‘বিলাসী’ গল্পে শরৎচন্দ্রের প্রথম জীবনের ছায়া রয়েছে।
২৩. শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কত বছর বয়সে, কেন সন্ন্যাসী হয়েছিলেন?
উত্তর: শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ২৪ বছর বয়সে, ঝোঁকের মাথায় সন্ন্যাসী হয়েছিলেন।
২৪. ‘বিলাসী’ গল্পে সমাজের প্রধানত কোন চেহারাটি প্রকাশিত হয়েছে?
উত্তর: ‘বিলাসী’ গল্পে সমাজের প্রধানত অনুদারতা ও রক্ষণশীলতার চেহারা প্রকাশিত হয়েছে।
২৫. মৃত্যুঞ্জয়ের পোড়োবাড়িতে কিসের বালাই নাই?
উত্তর: মৃত্যুঞ্জয়ের পোড়োবাড়িতে প্রাচীরের বালাই নাই।
২৬. ‘কলিযুগ’ কী?
উত্তর: ‘কলিযুগ’হলো ভারতীয় পুরাণে বর্ণিত পৃথিবীর শেষযুগ।
২৭. ভূদেব বাবু কে?
উত্তর: ভূদেব বাবু হলেন উনিশ শতকের বাংলার নবজাগরণের অন্যতম পথিকৃৎ।
২৮. ‘সত্যযুগ’ কোন সময়?
উত্তর: ‘সত্যযুগ’ হলো ভারতীয় পুরাণে বর্ণিত পৃথিবীর প্রথম যুগ।
২৯. ‘এডেন বন্দর’ কিসের জন্য বিখ্যাত ছিল?
উত্তর: ‘এডেন বন্দর’ হলো সামুদ্রিক লবণ তৈরির জন্য বিখ্যাত ছিলো।
৩০. ‘কামাখ্যা’ কোথায় অবস্থিত?
উত্তর: ‘কামাখ্যা’ ভারতের আসামে অবস্থিত।
৩১. লেখকের কাছে কেবল সার্থকতা নয় কোনটি?
উত্তর: লেখকের কাছে কেবল টিকিয়া থাকা সার্থকতা নয়।
৩২. কোন কাজটির বিরুদ্ধে বিলাসী ভয়ানক আপত্তি করত?
উত্তর: ‘শিকড় বিক্রির লোক ঠকানোর ব্যবসা’- কাজটির বিরুদ্ধে বিলাসী ভয়ানক আপত্তি করত।
৩৩. ছেলেবেলা থেকে ন্যাড়ার কোন দুটি শখ প্রবল ছিল?
উত্তর: ছেলেবেলা থেকে ন্যাড়ার গোখরা সাপ ধরে পোষা ও মন্ত্রসিদ্ধ হওয়া দুটি শখ প্রবল ছিল।
৩৪. ধরা সাপ কয় দিন হাঁড়িতে রাখলে আর কামড়াতে চায় না?
উত্তর: ধরা সাপ দুই-চার দিন হাঁড়িতে রাখলে আর কামড়াতে চায় না।
৩৫. বালকদের দুরবস্থা দেখে মা সরস্বতী মুখ লুকান কেন?
উত্তর: বালকদের দুরবস্থা দেখে মা সরস্বতী লজ্জায় মুখ লুকান।
৩৬. মৃত্যুঞ্জয় কোন বংশের সুনাম ডুবিয়েছে?
উত্তর: মৃত্যুঞ্জয় মিত্তির বংশের সুনাম ডুবিয়েছে।
৩৭. প্রত্যেক ব্রাহ্মণকে ছোটবাবু একটি করে কী দিয়ে বিদায় করেন?
উত্তর: প্রত্যেক ব্রাহ্মণকে ছোটবাবু একটি করে কাঁসার গেলাস দিয়ে বিদায় করেন।

অনুধাবনমূলক প্রশ্ন :

১. ‘ইহা আর একটি শক্তি।’— বলতে কী বোঝানো হয়েছে?
উত্তর: ‘ইহা আর একটি শক্তি।’— কথাটি দ্বারা স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার প্রকৃত ভালোবাসার প্রসঙ্গকে ইঙ্গিত করা হয়েছে।
➠ স্বামী-স্ত্রী বহুবছর একত্রে বসবাস করলেও সত্যিকারের ভালোবাসার সন্ধান খুব কম যুগলই পায়। আলোচ্য গল্পে প্রসঙ্গক্রমে গল্পকথক তাঁর এক আত্মীয়ার উদাহরণ টেনেছেন।সেই নারী স্বামীর সাথে পঁচিশ বছর ঘর করেছে। অথচ স্বামীর মৃতদেহ আগলে পাঁচ মিনিটও একাকী থাকার সাহস তার নেই। এর কারণ প্রকৃত ভালোবাসার সম্পর্কের অনুপস্থিতি। স্বামীর মৃতদেহের কাছে থাকার জন্য প্রয়োজন ছিল ‘আর একটি শক্তি’ অর্থাৎ খাঁটি ভালোবাসা। প্রশ্নোক্ত উদ্ভিটির মধ্য দিয়ে এ বিষয়টিই ইঙ্গিতময় হয়ে উঠেছে।

২. “ভয় পাই বাড়ার সময় পাইলাম না।”- উক্তিটির প্রেক্ষাপট বর্ণনা করো।
উত্তর: বাল্যবন্ধু মৃত্যুঞ্জয়কে দেখা শেষে বাড়ি ফেরার পথেই ‘বিলাসী’ গল্পের কথক ন্যাড়া উদ্ধৃত উক্তিটি করেছেন।
➠ সাপুড়ে কন্যা বিলাসী একদিন সন্ধ্যার অন্ধকারে ন্যাড়া মৃত্যুঞ্জয়কে দেখতে পোরোবাড়িতে গেল। গভীর বনের মধ্যে দিয়ে অন্ধকার রাতে ফেরার পথে কিছুটা হলেও ভয় পাচ্ছিল। কিন্তু বিলাসীর সাহসের কথা মনে পড়তেই তার ভয় দূর হয়ে গেল। কেবল ভারতে থাকল, একটা মৃত্যু কল্প রোগী নিয়ে এমন স্থানে একা একটা মেয়ের রাত্রি পাড়ি দেওয়া কত কঠিন কাজ। মৃত্যুঞ্জয় তো যে কোন মুহূর্তে মারা যেতে পারত। তখন নিশ্চয় মেয়েটিকে স্বামীর মৃতদেহের পাশে বসে একাকী রাত কাটাতে হতো। এ পরিপ্রেক্ষিতে ন্যাড়া বিলাসীর সাহসের উৎস হিসেবে আবিষ্কার করল স্বামী মৃত্যুঞ্জয়ের প্রতি তার সীমাহীন ভালোবাসা। এ সত্য আবিষ্কারের ন্যাড়ার মন এমনই আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল যে শ্বাপদসংকুল পথ পাড়ি দিতে গিয়ে সে ভয় পাওয়ার সময়ই পায় নি।

৩. তাহার বয়স আঠারো কি আঠাশ ঠাহর করিতে পারিলাম না।’- বুঝিয়ে বলো।
উত্তর: অসুস্থ মৃত্যুঞ্জয়ের সেবায় বিলাসী নিজেকে বিসর্জন দিয়েছে।
➠ রাতদিন সেবা করে করে বিলাসীর শরীর একেবারে নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল। এ কারণেই ন্যাড়া তার বয়স ঠাহর করতে পারে নি।মৃত্যুঞ্জয় একবার কঠিন রোগে আক্রান্ত হলে আত্মীয়স্বজন কিংবা পাড়া-প্রতিবেশীদের কেউ তার সেবায় এগিয়ে আসেনি। সাপুড়ে কন্যা বিদেশি মৃত্যুর কবল থেকে সে যাত্রায় মৃত্যুঞ্জয়কে রক্ষা করেছে। একদিন সন্ধ্যার অন্ধকারে ন্যাড়া মৃত্যুঞ্জয়কে দেখতেই পোরোবাড়িতে গেল। কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখতে পায় বিদেশি মৃত্যুঞ্জয়ের সেবা করতে করতে ফুলদানির ফুলের মধু শুকিয়ে গেছে। তার প্রকৃত বয়স আঠারো কিংবা আঠাশ কোনটাই বুঝার উপায় ছিল না। তাই মেয়েরা আলোচ্য মন্তব্যটি করেছিল।

৪. বাঙালির মন্ত্রতন্ত্রের সাথে সাপের বিষের তুলনা প্রসঙ্গে ন্যাড়ার উক্তিটি ব্যাখ্যা করো।
উত্তর: ‘বিলাসী’ গল্পে ন্যাড়া বাঙালির মন্ত্র তন্ত্রের সাথে সাপের বিষের তুলনা করে প্রকৃত সত্যটি উপস্থাপন করেছেন এবং দেখিয়েছেন যে বাঙালির মন্ত্র সিদ্ধ মিথ্যা হতে পারে কিন্তু সাপের বিষ কখনোই অকার্যকর হয় না।
➠ মৃত্যুঞ্জয় বিলাসীকে বিয়ে করে সমাজ থেকে বিতাড়িত হয় প্রচলিত প্রকারভেদ প্রথা সমাজে তার স্থান হয় না, কিন্তু মেসির প্রতি সে ছিল এক নিষ্ঠ। মৃত্যুঞ্জয় সাপুড়েবৃত্তিকে গ্রহণ করেছিল। মৃত্যুঞ্জয় সাপুড়ে হোক বিলাসিতা চাননি। সমাজ থেকে বিতাড়িত হয়ে এসে বিলাসীকে বিয়ে করে সাপুড়ে হয়। সাপ ধরা এবং প্রসার তার পেশা তে পরিণত হয়। অবশেষে এনে শায়িত তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। গোয়ালার বাড়িতে সাপ ধরতে গিয়ে দংশিত হয় সে। ন্যাড়া এবং বিলাসী সহ সব সাপুড়ে তাদের সমস্ত বিদ্যার প্রয়োগ করেছে তাকে বাঁচানোর জন্য, কিন্তু তা কোনো কাজে আসেনি। তাই ন্যাড়া উল্লিখিত উক্তিটি করেছে।

৫. মৃত্যুঞ্জয়ের ‘জাতবিসর্জনের’ কারণ বর্ণনা করো।
উত্তর: মৃত্যুঞ্জয়ের বিসর্জন এর কারণ হল বিলাসিতার অকৃত্রিম ভালোবাসা।
➠ মৃত্যুঞ্জয় কায়স্থের ছেলে। তার বাপ মা বেঁচে নেই। গ্রামের আর দশটা ছেলের মত সেও লেখাপড়া করে। কিন্তু ছাত্র হিসেবে ভাল নয় বিধায় সে কখনো থার্ডক্লাস অতিক্রম করতে পারেনি। এদিকে মৃত্যুঞ্জয় অসুস্থ হয়ে পড়লে পাড়ার এক সাপুড়ের মেয়ে বিলাসী সেবা যত্ন দিয়ে তাকে সারিয়ে তোলে, ফলে বিলাসী সঙ্গে তার ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। কিন্তু গ্রামের রক্ষণশীল হিন্দুসমাজ কিছুতেই সে সম্পর্ক মেনে নেয়নি। কিন্তু মৃত্যুঞ্জয় তার ভালোবাসার টানে সাপুড়ে কন্যা বিলাসীকে বিয়ে করার ভেতর দিয়ে যার ধর্ম বিসর্জন দেয়। মৃত্যুঞ্জয় বিলাসীর ভালোবাসা যেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের অপূর্ব সৃষ্টি।

৬. কোন উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে খুঢ়া মৃত্যুঞ্জয়ের বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা করে? ব্যাখ্যা করো।
উত্তর: ‘বিলাসী’ গল্পের নায়ক মৃত্যুঞ্জয় কায়স্থের ছেলে। তার মা-বাবা কিংবা ভাই-বোন কেউ বেঁচে নেই। এ পৃথিবীর বুকে বলতে গেলে সে একা। তাই মৃত্যুঞ্জয়ের সম্পত্তি দখল করার উদ্দেশ্যে তার নামে কুৎসা রটনা করে বেড়াত।
➠ মৃত্যুঞ্জয়ের ছিল গ্রামের এক প্রান্তে একটা প্রকাণ্ড আম-কাঁঠালের বাগান। আর তার মধ্যে একটা প্রকাণ্ড পোরোবাড়ি। তাছাড়া তার ছিল এক জাতি খুড়া। খোঁড়ার কাজ ছিল ভাইপোর বিরুদ্ধে বলে দাঁড়ানো- দাঁড়ানো ‘সে গাঁজা খায়; সে গুলি খায়, এমনকি আর কত কি!’ সে বাগানের অর্ধেক অংশের দাবিদার বলেও সমাজে প্রচার করে বেড়াত। বস্তুত সম্পত্তির লোভেই সে মৃত্যুঞ্জয়ের বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা করে বেড়াত।

৭. মৃত্যুঞ্জয়ের প্রতি খুড়োর বৈরী মনোভাবের কারণ কী?
উত্তর: ‘বিলাসী’ গল্পে মৃত্যুঞ্জয় এর প্রতি বৈরী মনোভাব এর মূল কারণ মৃত্যুঞ্জয়ের বিশাল বাগানটি নিজের করে নেওয়ার লোভ।
➠ মৃত্যুঞ্জয়ের জ্ঞাতি খুড়ো সবসময় ভাইপো মৃত্যুঞ্জয়ের অনিষ্ট করার কাজে লেগে থাকত। তাকে কিভাবে সমাজের কাছে হেয় করা যায়, নিন্দিত করা যায়, সে চেষ্টায় তার কোনো ত্রুটি ছিল না। ভাইপোকে গ্রামবাসীর কাছে কোণঠাসা করার জন্য মৃত্যুঞ্জয়ের অন্য পাপের কথা প্রচার করেছে। খুড়ো মৃত্যুঞ্জয়ের কুড়ি পঁচিশ বিঘা গান নিজের নামে প্রতিষ্ঠার জন্য নানা ষড়যন্ত্র করত।

৮. ‘গ্রামের মধ্যে মৃত্যুঞ্জয়ের ছিল এমনি সুনাম।’ বিষয়টি ব্যাখ্যা করো।
উত্তর: ‘গ্রামের মধ্যে মৃত্যুঞ্জয়ের এমনি সুনাম।’–এটি ‘বিলাসী’গল্পের লেখক এর ব্যাঙ্গাত্মক উক্তি।
➠ আমরা জানি যে, সুনাম শব্দটি একটি আদর্শ অর্থ বহন করে, যা দিয়ে কারো প্রশংসা কে বোঝানো হয়। কিন্তু বিলাসী গল্পে উক্তিটি লেখক ব্যাঙ্গার্থে করেছেন। গল্পে পরোপকারী মৃত্যুঞ্জয়ের উপকার স্বীকার না করে রফি নিচু মনের মানুষ যখন তাকে অবহেলা অবজ্ঞা করেছে, লেখক তখনই সার্থক হবে উক্তিটি করেছেন। মৃত্যুঞ্জয় শিক্ষার্থীদের কে খাওয়ানো, বই কিনে দেওয়া, বাচ্চাদের স্কুলের পাওনা মিটানো ইত্যাদি কাজের মধ্য দিয়ে যে মানবীয় গুণাবলীর পরিচয় দিয়েছিল, তৎকালীন সংকীর্ণমনা রাস্তা মনে রাখেনি; বরং তার অসুস্থতার সময় তাকে সেবা দিয়ে সুস্থ করে তোলার বিষয়কে পাপ হিসেবে দেখেছে, তাকে সমাজচ্যু করে মৃত্যুর দিকেই ঠেলে দিয়েছে।

৯. ‘বদন দগ্ধ না হয়’- বলতে কী বোঝানো হয়েছে?
উত্তর: ‘বদন দন্ধ না হয়’-এর আভিধানিক অর্থ মুখ যেন না পোড়ে। কিন্তু এ কথাটি সুনাম যেন নষ্ট না হয় এই অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।
➠ ‘বিলাসী’ গল্পের নায়ক বিজয়ের দেড় মাস প্রায় অচেতন অবস্থায় পড়েছিল জ্বরে। গ্রামের কেউ খবর নিতে আসেনি। সাপুড়ের মেয়ে বিলাসিতাকে সেবা-শুশ্রূষা দিয়ে সুস্থ করে তুলেছে। কৃতজ্ঞ মৃত্যুঞ্জয় তাকে বিয়ে করেছে। এতে গ্রামের বদন দন্ধ হয়েছে অর্থাৎ সুনাম ক্ষুন্ন হয়েছে। বিষয়টি যেন বাইরের কেউ জানতে না পারে এবং একই সাথে ঘুরার স্বার্থোদ্ধার হয়, সেজন্য খুরা অভিভাবক হয়ে বলেছেন ব্যবস্থা নিতে। আর সংঘের যুবক ছেলেরা চলেছে গ্রামের বদন যেন দগ্ধ না হয় তারই একটা মীমাংসা করতে।

১০. ‘বাঙালির বিষ’ বলতে কী বুঝানো হয়েছে?
উত্তর: ‘বাঙালির বিষ’ বলতে বাঙালির ক্ষণস্থায়ী ক্রোধ বা বিদ্বেষকে বুঝানো হয়েছে।
➠ বাঙালির রাগ আছে, হিংসা-বিদ্বেষ আছে। কিন্তু তা কখনো দিনের পর দিন বা দীর্ঘ সময় ধরে চলতে থাকে না। মনের মধ্যে প্রতিশোধ না নেওয়া পর্যন্ত পুষে রাখে না।

১১. "চার ক্রোশ মানে আট মাইল নয়, ঢের বেশি- উক্তিটি ব্যাখ্যা করো।
উত্তর: গাণিতিকভাবে চার ক্রোশ মানে আট মাইল হলেও পারিপার্শ্বিক অবস্থার কারণে গল্পকথকদের যাতায়াতের পথ দীর্ঘতর হয়ে উঠত বোঝাতেই প্রশ্নোক্ত উক্তিটির অবতারণা করা হয়েছে।
➠ লেখক ও তার সহপাঠীদের প্রতিদিন স্কুলে যাতায়াতের জন্য দীর্ঘ চার ক্রোশ পথ অতিক্রম করতে হতো। কিন্তু বর্ষার দিনে মেঘের জল, এক হাঁটু কাদা এবং গ্রীষ্মের দিনের খরতাপ ও ধুলার কারণে সেই চার ক্রোশ পথ আরও বেশি দীর্ঘ বলে মনে হতো। এ ব্যাপারটি স্পষ্ট করে তুলতেই লেখক উপরিউক্ত ব্যঙ্গাত্মক উক্তিটির আশ্রয় গ্রহণ করেছেন।

১২. মা সরস্বতী খুশি হইয়া বর দিবেন কি, তাহাদের যন্ত্রণা দেখিয়া কোথায় যে তিনি লুকাইবেন, ভাবিয়া পান না' উক্তিটি ব্যাখ্যা করো।
উত্তর: তৎকালীন বাস্তবতায় শিক্ষার্থীদের বিদ্যার্জনের ক্লেশ প্রসঙ্গে প্রশ্নোক্ত উক্তিটির অবতারণা করা হয়েছে।
➠ ন্যাড়া, মৃত্যুঞ্জয়সহ শিক্ষার্থীদের তখন বহু কষ্টে দুই ক্রোশ পথ অতিক্রম করে বিদ্যালয়ে আসা-যাওয়া করতে হতো। প্রকৃতির বিরূপ প্রভাবে এ পথ যেন আরও দুর্গম হয়ে উঠত। এত প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে শিক্ষা গ্রহণ করে শেষ পর্যন্ত গ্রামের ছেলেদের পরীক্ষার ফল আশানুরূপ হতো না। তৎকালীন বাস্তবতায় শিক্ষার্থীদের বিদ্যালাভের এই বিড়ম্বনাকে বোঝাতেই লেখক প্রশ্নোক্ত উক্তিটি করেছেন।

১৩. "তারা বাস করিতে থাকিলে তো পল্লির এত দুর্দশা হয় না।" ব্যাখ্যা করো।
উত্তর: প্রশ্নোক্ত উক্তিটির মধ্য দিয়ে আর্থিকভাবে সংগতিপূর্ণ ব্যক্তিরা পল্লির প্রতি মনোযোগী হলে সেখানকার দুর্দশা লাঘব হতো বলে মত প্রকাশ করা হয়েছে।
➠ পল্লি অঞ্চলে ঋতুভেদে জল, কাদা এবং প্রখর সূর্যতাপ ও ধুলোর পথ পার হয়ে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা দূর-দূরান্তের স্কুলে যেত। লেখক মনে করেন, আর্থিকভাবে সচ্ছল ব্যক্তিরা যদি ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার জন্য শহরে পাড়ি না জমিয়ে পল্লি অঞ্চলের শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতির চেষ্টা করতেন এবং শহরে বসবাসকারী শিক্ষিত উঁচুতলার মানুষেরা যদি পল্লির দিকে সামান্য সুনজর দিতেন, তবে পল্লির এ দুর্দশা আর থাকত না। প্রশ্নোক্ত উক্তিটির মধ্য দিয়ে লেখকের এমন মনোভাবই প্রকাশিত হয়েছে।

১৪. কোন উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে খুড়া মৃত্যুঞ্জয়ের বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা করে? ব্যাখ্যা করো।
উত্তর: মৃত্যুঞ্জয়ের সম্পত্তি দখল করার উদ্দেশ্যেই খুড়া তার বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা করে।
➠ এক জ্ঞাতি খুড়া ছাড়া মৃত্যুঞ্জয়ের মা-বাবা, ভাই-বোন কেউ ছিল না। তবে গ্রামের এক প্রান্তে একটি প্রকাণ্ড আম-কাঁঠালের কুড়ি- পঁচিশ বিঘার বাগান ছিল তার। খুড়া দাবি করত ঐ বাগানের অর্ধেক অংশ তার প্রাপ্য। মৃত্যুঞ্জয়কে তাড়িয়ে সেই বাগানটি হাতিয়ে নেওয়ার উদ্দেশ্যেই সে তার বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা করত।

১৫. মৃত্যুঞ্জয় নিজে রেধে খেত কেন? ব্যাখ্যা করো।
উত্তর: মা-বাবা বা পরিজন না থাকায় মৃত্যুঞ্জয় নিজের খাবার নিজেই রান্না করে খেতো।
➠ মৃত্যুঞ্জয় একটি বিশাল পুরনো বাড়িতে একা থাকতো। এক জ্ঞাতি খুড়া ছাড়া তার মা-বাবা বা পরিজন কেউ ছিল না। সেই খুড়াও আবার তার কুৎসা রটাত। ফলে তার দেখভালের মতো মানুষের অভাব ছিল। এ কারণে নিজের রান্নার দায়িত্ব মৃত্যুঞ্জয় নিজের কাঁধে তুলে নেয়। উত্তরের সারবস্তু: মা-বাবা বা পরিজন না থাকায় মৃত্যুঞ্জয় নিজের খাবার নিজেই রান্না করে খেতো।

১৬. ‘গ্রামের মধ্যে মৃত্যুঞ্জয়ের ছিল এমনি সুনাম।’ - ব্যাখ্যা করো।
উত্তর: প্রশ্নোক্ত উক্তিটিতে গ্রামের মধ্যে মৃত্যুঞ্জয়ের নেতিবাচক ভাবমূর্তিকে ব্যঙ্গার্থে 'সুনাম' বলা হয়েছে।
➠ মৃত্যুঞ্জয় সম্পর্কে উদ্ধৃত উক্তিতে ‘সুনাম’ শব্দটি গল্পকথক ন্যাড়া 'দুর্নাম' অর্থে ব্যবহার করেছে। আত্মীয়-পরিজনহীন মৃত্যুঞ্জয়ের এক জ্ঞাতি খুড়া ছিল। সে তার নামে দুর্নাম রটনা করে বেড়াত। দুর্নাম প্রচারের কল্যাণে গ্রামের মধ্যে মৃত্যুঞ্জয়ের এমন একটা নেতিবাচক ভাবমূর্তি গড়ে উঠেছিল যে, গ্রামবাসী তার সঙ্গে প্রকাশ্যে মেলামেশা দূরে থাক, তার সঙ্গে সংশ্রব থাকার কথাটা পর্যন্ত স্বীকার করত না। নিজ গ্রামে মৃত্যুঞ্জয়ের এমন নেতিবাচক ভাবমূর্তি প্রসঙ্গেই গল্পটিতে উদ্‌ধৃত উক্তিটির অবতারণা করা হয়েছে।

১৭. 'অনেকদিন মৃত্যুঞ্জয়ের দেখা নাই'- ব্যাখ্যা করো।
উত্তর: মৃত্যুঞ্জয় দীর্ঘদিন অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী থাকার কারণে তার সঙ্গে গল্পকথক ন্যাড়ার দেখা নেই।
➠ মৃত্যুঞ্জয় একটি বিশাল পুরনো বাড়িতে একা থাকতো। এক জ্ঞাতি খুড়া ছাড়া তার মা-বাবা বা পরিজন কেউ ছিল না। সেই খুড়াও আবার তার নামে কুৎসা রটাত। একবার তার অসুখ হলে দেখাশোনার মতো কেউ না থাকায় দীর্ঘদিন সে শয্যাশায়ী ছিল। দীর্ঘ এই অসুস্থতার কারণেই অনেকদিন মৃত্যুঞ্জয়ের সাথে গল্পকথক ন্যাড়ার দেখা হয়নি।

১৮. 'অনেক দিন তাহার মিষ্টান্নের সদ্ব্যয় করিয়াছি- মনটা কেমন করিতে লাগিল'- কথাটি ব্যাখ্যা করো।
উত্তর: গল্পকথকসহ মৃত্যুঞ্জয়ের অন্য বন্ধুরা মাঝেমধ্যেই তার কিনে দেওয়া মিষ্টান্ন খেয়েছেন আর তাই অসুস্থ মৃত্যুঞ্জয়ের কথা ভেবে তার মন খারাপ হলো।
➠ মৃত্যুঞ্জয় ছিল উদার প্রকৃতির। গ্রামের ছেলেমেয়েদের মাঝেমধ্যেই বই কেনার টাকাসহ এটা সেটা দিয়ে সাহায্য করত সে। শুধু তাই নয়, গল্পকথকসহ অন্য বন্ধুদের মাঝেমধ্যেই দোকানের মিষ্টান্ন কিনে দিত সে। আর তাই মৃত্যুঞ্জয়ের অসুস্থতার কথা ভেবে গল্পকথকের মন কেমন করতে লাগলো। প্রশ্নোক্ত উক্তিটির মধ্য দিয়ে এ বিষয়টিই প্রকাশিত হয়েছে।

১৯. মৃত্যুঞ্জয়ের বাড়ির পারিপার্শ্বিক অবস্থার পরিচয় দাও।
উত্তর: 'বিলাসী' গল্পে গল্পকথক ন্যাড়ার বর্ণনায় মৃত্যুঞ্জয়ের জঙ্গলাকীর্ণ বাড়ির পারিপার্শ্বিক অবস্থার পরিচয় পাওয়া যায়।
➠ মৃত্যুঞ্জয়ের বাস ছিল গ্রামের এক প্রান্তে, বিশ-পঁচিশ বিঘা আয়তনের প্রকাণ্ড এক আম-কাঁঠালের বাগানের মধ্যে বিশাল একটা পোড়োবাড়িতে। এ পোড়োবাড়িতে প্রাচীরের বালাই ছিল না। স্বচ্ছন্দে যে কেউ বাড়ির ভেতরে ঢুকতে বা বের হতে পারত। রাতের অন্ধকারে ঘন জঙ্গল বাড়ির পরিবেশকে ভুতুড়ে ও ভীতিজনক করে তুলত।

২০. ‘তাহার বয়স আঠারো কি আটাশ ঠাহর করিতে পারিলাম না।’- উক্তিটি ব্যাখ্যা করো।
উত্তর: মৃত্যুঞ্জয়ের সেবা করতে গিয়ে স্বাস্থ্যহানির শিকার হওয়া বিলাসীকে দেখে গল্পকথক ন্যাড়া আলোচ্য মন্তব্যটি করেছে।
➠ মৃত্যুঞ্জয়ের রোগাক্রান্ত হলে বিলাসী দিনরাত সেবা-যত্ন করে তাকে সুস্থ করে তুলেছে। তাকে সুস্থ করতে গিয়ে অক্লান্ত পরিশ্রমে বিলাসীর নিজের স্বাস্থ্যহানি হয়েছে। তাই ন্যাড়া যখন তাকে দেখেছে, তখন সে বিভ্রান্তিতে পড়েছে। তার বয়স আসলে কত হবে তা সে বুঝে উঠতে পারেনি। এ অবস্থায় বিলাসীর স্বাস্থ্যহানি প্রসঙ্গেই ন্যাড়া উদ্‌ধৃত উক্তিটির অবতারণা করেছে।

২১. ‘ঠিক যেন ফুলদানিতে জল দিয়া ভিজাইয়া রাখা বাসি ফুলের মতো।’- কথাটি দ্বারা কী বোঝানো হয়েছে?
উত্তর: উদ্‌ধৃত উক্তিটির মাধ্যমে অসুস্থ মৃত্যুঞ্জয়ের সেবারত বিলাসীর অবস্থা বোঝানো হয়েছে।
➠ ‘বিলাসী’ গল্পের নায়ক মৃত্যুঞ্জয় অসুস্থ হয়ে পড়লে বিলাসী রাতের পর রাত জেগে তার সেবা-শুশ্রূষা করে। এই নিরবচ্ছিন্ন পরিশ্রমে বিলাসী শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। তার সারা শরীরে একটা অপরিসীম ক্লান্তি ও নিরবচ্ছিন্ন রাত জাগার ছাপ পড়ে যায়। তার এ সজীবতাহীন ও অবসন্ন শরীরকে গল্পের কথক তুলে ধরেছে উক্তিটির মাধ্যমে।

২২. ন্যাড়া বিলাসীকে ‘ফুলদানিতে ভিজিয়ে রাখা বাসি ফুল’ বলেছিলেন কেন?
উত্তর: অতিরিক্ত পরিশ্রমের ফলে শ্রান্ত, ভগ্নস্বাস্থ্য বিলাসীকে দেখে ন্যাড়া ‘ফুলদানিতে ভিজিয়ে রাখা বাসি ফুল’-এর প্রতীকে তার পরিচয় প্রকাশ করেছিল।
➠ 'বিলাসী' গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র বিলাসীকে গল্পকথক ন্যাড়া প্রথম দেখে মৃত্যুঞ্জয়ের রোগ-সজ্জায়। দিন-রাত অসুস্থ মৃত্যুঞ্জয়ের প্রাণপণ সেবা করে অস্পৃশ্য মালোর মেয়ে। বিলাসীর তখন এমনই করুণ চেহারা যে, দেখে বোঝার উপায় ছিল না তার বয়স আঠারো নাকি আটাশ। ন্যাড়া তার ভগ্ন-শরীর আর ম্লান-সৌন্দর্য দেখে বুঝেছিল, যমরাজকে নিরস্ত করতে সেবাব্রতী বিলাসীকে কত কঠিন পরিশ্রমই না করতে হয়েছে। তাই ন্যাড়া ‘ফুলদানিতে ভিজিয়ে রাখা বাসি ফুল’-এর প্রতীকে বিলাসীর পরিচয় প্রকাশ করেছিল।

২৩. বিলাসী কেন ন্যাড়াকে অন্ধকার রাতে বাগান পার করে দিতে চেয়েছিল?
উত্তর: অন্ধকার রাতে অনভ্যস্ত ন্যাড়ার পক্ষে বাগানের দীর্ঘ পথ পেরিয়ে যাওয়া ঝুঁকিপূর্ণ ছিল বলে বিলাসী তাকে বাগান পার করে দিতে চেয়েছিল।
➠ অসুস্থ মৃত্যুঞ্জয়কে দেখে ফিরতে ন্যাড়ার বেশ রাত হয়ে গিয়েছিল। বাইরে ছিল গভীর অন্ধকার। এমন অন্ধকারে কুড়ি-পঁচিশ বিঘার বাগান পার হওয়া বেশ ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। ফেরার পথে বিলাসী আলো হাতে ভাঙা প্রাচীর পর্যন্ত ন্যাড়ার সঙ্গে আসে। কিন্তু তারপরও বিলাসীর উদ্বেগ কমেনি। রাতে বাগানের পথের কীরূপ অবস্থা হতে পারে তা অনুমান করেই সে ন্যাড়াকে বাগান পার করে দিতে চেয়েছিল।

২৪. ‘মেয়ে মানুষ জিজ্ঞাসা করে, ভয় করবে না তো।’- উক্তিটির ব্যাখ্যা দাও।
উত্তর: রাতের বেলায় গল্পকথক ন্যাড়ার একাকী বাড়ি ফেরার বিষয়ে উদ্বিগ্ন বিলাসীর প্রশ্নের প্রতিক্রিয়ায় তার মনে সংকোচের উদয় হয় 'বিলাসী' গল্পে গল্পকথক ন্যাড়া একদিন রোগগ্রস্ত মৃত্যুঞ্জয়কে দেখতে যায়।
➠ বাড়ি ফিরতে রাত অধিক হয়ে যাওয়ায় বিলাসী তার কথা ভেবে উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে। অন্ধকার রাতে বিশাল আমবাগান পার হয়ে একা বাড়ি ফিরতে ভয় পাবে কি না- বিলাসীর এমন প্রশ্নে ন্যাড়ার পৌরুষে আঘাত লাগে। সংগত কারণেই ন্যাড়া সংকোচবোধ করছিল। প্রশ্নোক্ত উক্তিটিতে এ বিষয়টিই প্রকাশিত হয়েছে।

২৫. ‘ঘন জঙ্গলের পথ, একটু দেখে পা ফেলে যেয়ো।’- ব্যাখ্যা করো।
উত্তর: আলোচ্য উক্তিটিতে ন্যাড়া জঙ্গলের পথ ধরে বাড়ি পৌঁছতে কোনো সমস্যায় পড়তে পারে বলে বিলাসীর আশঙ্কা প্রকাশিত হয়েছে।
➠ এক সন্ধ্যায় গল্পকথক ন্যাড়া লুকিয়ে অসুস্থ মৃত্যুঞ্জয়কে দেখতে যায়। ততদিনে শয্যাশায়ী মৃত্যুঞ্জয়ের শারীরিক অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছে। কথাবার্তা শেষে বাড়ি ফেরার সময় বিলাসী ন্যাড়াকে ভাঙা প্রাচীর পর্যন্ত এগিয়ে দেয়। অসুস্থ মৃত্যুঞ্জয়কে একা রেখে ন্যাড়াকে এর বেশি এগিয়ে দেওয়া তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। তাই দীর্ঘ জঙ্গল পথে সাপ থাকতে পারে এই আশঙ্কায় ন্যাড়াকে সাবধান থাকার জন্য সে অনুরোধ করে।

২৬. ‘ভয় পাইবার আর সময় পাইলাম না।’- উক্তিটি ব্যাখ্যা করো।
উত্তর: গল্পের কথক ন্যাড়ার রাতের অন্ধকারের সহজাত ভয় বা ভীতিকর চিন্তাভাবনার উদ্রেক না ঘটার কারণ বিলাসীকে নিয়ে ভাবনা।
➠ অসুস্থ মৃত্যুঞ্জয়কে দেখে ফেরার পথে বিলাসী গল্পের কথক ন্যাড়াকে এগিয়ে দিতে আসে। বিশাল আম বাগানের ঘন অন্ধকারে সাপের ভয় উপেক্ষা করে বিলাসী ন্যাড়াকে এগিয়ে দেয়। বিলাসীর এরকম সাহসিকতাপূর্ণ পরোপকারী মনোভাব ন্যাড়াকে এমনভাবে মোহাচ্ছন্ন করে রাখে যে, পরবর্তী পথের সাপ বা অন্য কিছুর ভয় ন্যাড়ার চিন্তাতে ক্ষণিকের জন্যও আসে না।

২৭. ‘একটা মৃতকল্প রোগী লইয়া থাকা কত কঠিন।’- ব্যাখ্যা করো।
উত্তর: অসুস্থ মৃত্যুঞ্জয়কে নিয়ে বিলাসীর জঙ্গল ঘেরা বাড়িতে বিনিদ্র রাত কাটানোর দুঃসহ অবস্থাকে বোঝাতেই প্রশ্নোক্ত উক্তিটির অবতারণা করা হয়েছে।
➠ মৃত্যুঞ্জয় একটি বিশাল পোড়োবাড়িতে একা থাকতো। মৃত্যুপথযাত্রী মৃত্যুঞ্জয়কে নিয়ে সেখানে কারও পক্ষে একা থাকাটা সত্যিকার অর্থেই কঠিন ছিল । এমন পরিস্থিতিতে মৃত্যুঞ্জয় মারা গেলে মৃতদেহ নিয়ে বিলাসীকে একা রাত জাগতে হতো। অসুস্থ মৃত্যুঞ্জয়কে নিয়ে বিলাসীর এমন দুঃসহ দিনযাপনের বিষয়টি চিন্তা করেই লেখক প্রশ্নোক্ত উক্তিটি করেছেন।

২৮. “ওরে বাপরে, আমি একলা থাকতে পারব না।” উক্তিটি ব্যাখ্যা করো।
উত্তর: উক্তিটির মাধ্যমে ন্যাড়া তার এক আত্মীয়ার দৃষ্টান্ত তুলে ধরে তার মেকি স্বামীপ্রেমের প্রতি ইঙ্গিত করেছে।
➠ 'বিলাসী' গল্পে ন্যাড়ার এক আত্মীয় মারা গেলে তার বিধবা স্ত্রী শোকাহত হয়ে স্বামীর সঙ্গে সহমরণের জন্য হাহাকার করতে থাকে। কিন্তু লাশের পাশে তাকে একাকী রেখে ন্যাড়া যখন মৃতের সৎকারের জন্য লোক ডাকতে বাইরে পা বাড়ায়, তখনই সে চিৎকার করে উদ্‌ধৃত উক্তিটি করে। এ ঘটনা থেকে বোঝা যায়, বহুদিনের সাহচর্য সত্ত্বেও স্বামীর সঙ্গে তার কোনো আত্মিক সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। এভাবে উক্তিটির মধ্য দিয়ে তার মেকি স্বামীপ্রেমের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।

২৯. ‘বুক যদি কিছুতে ফাটে তো সে এই মৃত স্বামীর কাছে একলা থাকিলে’- কেন?
উত্তর: একসঙ্গে বহুকাল বসবাস করেও শুধু ভালোবাসার অভাবে অনেক নারী মৃত্যুভয়কে জয় করতে পারে না; তাই মৃত একলা থাকতে ভয়ে তাদের বুক ফাটে
➠ স্বামীর কাছে বহুকাল একসঙ্গে সংসার করার পরও অনেক স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সম্পর্কের গভীরতা তৈরি হয় না। এ কারণে তারা স্বামী বা স্ত্রীর মৃত্যুশোক সইতে পারলেও মৃতদেহটাকে মুহূর্তকাল সহ্য করার সাহস পায় না। স্বামীর মৃত্যুশোকে তাদের যতটা না বুক ফাটে, তার চেয়ে বেশি বুক ফাটে মৃত স্বামীর কাছে একলা থাকার ভয়ে। প্রকৃতপক্ষে, ভালোবাসার অভাবেই স্বামীর মৃতদেহ তাদের মধ্যে ভয়ের উদ্রেক করে। এ বিষয়টিকে বোঝাতেই গল্পকার প্রশ্নোক্ত উক্তিটির অবতারণা করেছেন।

৩১. বিলাসী বিষপানে আত্মহত্যা করে কেন?
উত্তর: স্বামীর মৃত্যুর শোক সইতে না পেরে বিলাসী বিষপানে আত্মহত্যা করে। বিলাসী ও মৃত্যুঞ্জয়ের মাঝে ছিল গভীর প্রেম।
➠ সাপুড়ের মেয়ে বিলাসীকে আপন করে পাওয়ার জন্যই মৃত্যুঞ্জয় জাত বিসর্জন দিয়ে পুরোদস্তুর সাপুড়ে জীবন বেছে নিয়েছিল। নিয়তির নির্মম পরিহাসে তার মৃত্যু হয় সাপের কামড়েই। ভালোবাসার মানুষকে হারিয়ে বেঁচে থাকাটা মূল্যহীন বলে মনে হয় বিলাসীর কাছে। এ কারণেই সে বিষপানে আত্মহত্যা করে মৃত্যুঞ্জয়ের অনুগামী হয়।

৩১. ‘আমার মাথার দিব্যি রইল, এসব তুমি আর কখনও করো না’- এ উক্তিটি কারণ ব্যাখ্যা করো।
উত্তর: ন্যাড়া যাতে সাপ ধরার মতো ভয়ংকর পেশায় নিয়োজিত না থাকে সেজন্যই স্বামীর মৃত্যুর পর বিলাসী তাকে এ পেশা ছাড়ার জন্য দিব্যি দেয়।
➠ বিলাসী জাত সাপুড়ের মেয়ে। সে জানত সাপ খুব ভয়ংকর প্রাণী, যেকোনো মুহূর্তে সাপুড়েকেও কামড়াতে পারে। সাপ সম্বন্ধে তার এ ধারণা সত্যিও হয়েছিল। একদিন সাপের কামড়েই তার প্রিয়জন মৃত্যুঞ্জয়কে হারাতে হয়েছে। সে জানে, এ পেশা না ছাড়লে হয়তো ন্যাড়ারও শেষ পরিণতি হবে মৃত্যু। তাই বিলাসী তাকে এ পেশা ছাড়ার জন্য দিব্যি দেয়।

৩২. এ যে মিত্তির বংশের নাম ডুবিয়া যায়- উক্তিটি কেন করা হয়েছিল?
উত্তর: কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজের নিষ্ঠুর জাত-কুল-ভেদের কারণে উক্তিটি করা হয়েছে।
➠ মৃতপ্রায় মৃত্যুঞ্জয়ের সেবা-শুশ্রূষায় এগিয়ে আসে নিচু বংশের সাপুড়েকন্যা বিলাসী। অসুস্থতার এক পর্যায়ে মৃত্যুঞ্জয় বিলাসীর রান্না করা ভাত খায়। কিন্তু আচারসর্বস্ব কুসংস্কারাশ্রয়ী তৎকালীন হিন্দু সমাজে এটি ছিল অনেক বড় ধরনের পাপ, যেটিকে অন্নপাগ বলা হতো। মৃত্যুঞ্জয় অন্নপাপ করায় বংশের মান ডুবেছে- মৃত্যুঞ্জয়ের অমঙ্গলপ্রত্যাশী লোভী খুড়া এই ব্যাপারটিই ফলাও করে বলছিল। মৃত্যুঞ্জয়কে সমাজে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য এবং সে জন্যই আলোচ্য উক্তিটি সে করেছে।

৩৩. খুড়া মৃত্যুঞ্জয়কে অন্নপাপের জন্য কেন দায়ী করেছে?
উত্তর: অন্নপাপের জন্য মৃত্যুঞ্জয়ের খুড়া মৃত্যুঞ্জয়কে দায়ী করেছে নিচু জাতের বিলাসীর হাতে ভাত খাওয়ার কারণে।
➠ তৎকালীন মূঢ় হিন্দু সমাজব্যবস্থায় জাত প্রথার বিষবাষ্প ছিল প্রবল। নিচু জাতের কারো হাতে রান্না করা খাবার বিশেষত ভাত খেলে অন্নপাপ হয় বলে অন্নপাপকে সকল পাপের বড় পাপ বলে মনে করা হতো এবং এর কোনো প্রায়শ্চিত্তও নেই। অসুস্থ মৃত্যুপথযাত্রী মৃত্যুঞ্জয়ের শুশ্রূষা করতে আসা তৎকালীন হিন্দুসমাজের চোখে নিচু বলে আখ্যায়িত সাপুড়েকন্যা বিলাসীর হাতে মৃত্যুঞ্জয়ের ভাত খাওয়ার কারণেই মৃত্যুঞ্জয়ের খুড়া মৃত্যুঞ্জয়কে অন্নপাপের জন্যে দায়ী করেছে।

৩৪. মৃত্যুঞ্জয় গ্রামের মুখ পোড়ায় কীভাবে? ব্যাখ্যা করো।
উত্তর: সাপুড়েকন্যা বিলাসীকে বিয়ে করায় উঁচু বর্ণের মৃত্যুঞ্জয়ের গ্রামের মুখ পোড়ে।
➠ মৃত্যুঞ্জয় যখন দীর্ঘদিন রোগশয্যায় ছিল তখন বিলাসী প্রাণপণ সেবা-শুশ্রূষা করে তাকে রোগমুক্ত করে। বিলাসীর আন্তরিকতায় মুগ্ধ হয়ে মৃত্যুঞ্জয় তাকে ভালোবেসে বিয়ে করে। উঁচু-নিচু নানান সম্প্রদায়ে বিভক্ত তৎকালীন সমাজ এ বিয়েকে মেনে নেয়নি। উপরন্তু ঘটনাটিকে তারা গ্রামের মুখ পোড়ানো বলে অভিহিত করে।

৩৫. ‘বাবা আমারে বাবুর সাথে নিকা দিয়েছে জানো’- কথাটি দ্বারা বিলাসী কী বোঝাতে চেয়েছেন?
উত্তর: উক্তিটির মাধ্যমে বিলাসী তার অধিকার ও নৈতিক ভিত্তিকে মৃত্যুঞ্জয়ের খুড়া ও তার দলবলের সামনে দৃঢ়তার সঙ্গে প্রকাশ করে।
➠ মৃত্যুঞ্জয়ের খুড়া সমাজের দোহাই দিয়ে একদিন সন্ধেবেলা দশ-বারোজন লোক সঙ্গে নিয়ে মৃত্যুঞ্জয়ের পোড়োবাড়িতে গিয়ে বিলাসীকে উদ্দেশ করে কটু মন্তব্য করলে আলোচ্য উক্তির মাধ্যমে বিলাসী প্রতিবাদ করে তার প্রকৃত অবস্থান জানিয়ে দেয়।

৩৬. “এখন শুধু ইংরাজকে কষিয়া গালিগালাজ করিতে পারিলে দেশটা উদ্ধার হইয়া যায়।”- উক্তিটি ব্যাখ্যা করো।
উত্তর: উদ্‌ভূত উক্তিতে সংকীর্ণতার বেড়াজালে বন্দি তৎকালীন সমাজে বিদ্যমান নানা কুসংস্কারের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে।
➠ ‘বিলাসী’ গল্প রচনাকালে এদেশের অধিকাংশ পল্লি ছিল শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত। ফলে ধর্মীয় গোঁড়ামি, সামাজিক অনাচার আর অশিক্ষা-কুশিক্ষায় সমাজ ছিল আকণ্ঠ নিমজ্জিত। সে যুগে ইংরেজ প্রশাসন শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতি ও সমাজসংস্কারমূলক নানা পদক্ষেপ নিলেও রক্ষণশীল হিন্দুরা ভালোভাবে নেয়নি। প্রশ্নোক্ত উক্তিটিতে রক্ষণশীলদের এ মানসিক দৈন্যকে তীব্রভাবে বিদ্রূপ করা হয়েছে।

৩৭. ‘আমরা বলি যাহারই গায়ে জোর নাই, তাহারই গায়ে হাত তুলিতে পারা যায়।’- উক্তিটি ব্যাখ্যা করো।
উত্তর: তৎকালীন নিষ্ঠুর হিন্দু সমাজব্যবস্থায় দুর্বলের উপর যে-অত্যাচার করা হতো, সে প্রসঙ্গেই উক্তিটি উত্থাপিত হয়েছে গল্পকথক ন্যাড়ার মাধ্যমে।
➠ ইংল্যান্ডসহ বিভিন্ন পাশ্চাত্য দেশে শারীরিকভাবে দুর্বল বলে নারীদের গায়ে হাত না তোলার একটি রীতি প্রচলিত ছিল। কিন্তু তৎকালীন আচারসর্বস্ব হিন্দু সমাজ ছিল দুর্বলদের জন্য আরও অনেক নিষ্ঠুর। তাই তারা দুর্বল বলে নারীদের ওপর হাত তুলতে কুণ্ঠিত নয় বরং সিদ্ধহস্ত। 'বিলাসী' গল্পে সমাজের নিষ্ঠুর লোকদের প্রহারের শিকার বিলাসীর ওপর এই শারীরিক নির্যাতনের বর্ণনা দিতে গিয়ে ন্যাড়া উক্তিটি করেছে।

৩৮. বিলাসীকে কেন টেনে-হিঁচড়ে গ্রামের বাইরে নেওয়া হলো? ব্যাখ্যা করো।
উত্তর: নিষ্ঠুর সামাজিক লোকাচারের অন্যতম সৃষ্টি অন্নপাপ সংঘটনের কারণেই বিলাসীকে টেনে-হিঁচড়ে গ্রামের বাইরে নেওয়া হলো।
➠ মৃতপ্রায় মৃত্যুঞ্জয়ের সেবা-শুশ্রূষায় এগিয়ে আসা বিলাসীর রান্না করা ভাত খায় মৃত্যুঞ্জয়। কিন্তু তৎকালীন কুসংস্কারাশ্রয়ী সমাজের চোখে নিচু শ্রেণির কারো হাতে ভাত খাওয়া ছিল ঘোর পাপ, সেটি অন্নপাপ। এই পাপের প্রায়শ্চিত্ত নেই, এটি ছিল সেই সমাজের ভাবনা। পাপের ছোঁয়া যেন তাদের গায়ে না লাগে, সেই জন্যই নিষ্ঠুর সমাজের নিষ্ঠুর মানুষগুলো প্রায়শ্চিত্তের অভিপ্রায়ে দুর্বল বিলাসীকে টেনে-হিঁচড়ে গ্রামের বাইরে নিয়ে যায়।

৩৯. ‘বাবুরা, আমাকে একটি বার ছেড়ে দাও আমি রুটিগুলো ঘরে দিয়ে আসি’- উক্তিটি ব্যাখ্যা করো।
উত্তর: নিজের বিপদ উপেক্ষা করে অসুস্থ মৃত্যুঞ্জয়ের জন্য উদ্বেগ প্রকাশের দিকটিই ফুটে উঠেছে আলোচ্য উক্তিতে মৃত্যুশয্যাশায়ী মৃত্যুঞ্জয় বিলাসীর রাঁধা ভাত খায়, যেটি তৎকালীন সমাজের চোখে অন্নপাপ বলে প্রতীয়মান ছিল।
➠ সেই কুসংস্কারাশ্রয়ী সমাজের চোখে অন্নপাপ ছিল ঘোরতর আপত্তিকর এবং এই পাপের প্রায়শ্চিত্তের জন্য তারা বিলাসীকে শাস্তি দিতে উদ্যত হয়। যখন তারা বিলাসীকে গ্রাম থেকে বের করে দিতে যায় তখন বিলাসী অসুস্থ, একাকী মৃত্যুঞ্জয়ের জন্য রুটি বানাচ্ছিল। অসুস্থ মৃত্যুঞ্জয় খেতে পাবে না, এই উদ্বেগ থেকেই বিলাসী উক্তিটি করেছিল।

৪০. ‘কে বলিবে এ আমাদের সেই মৃত্যুঞ্জয়।’- উক্তিটি বুঝিয়ে দাও।
উত্তর: ‘বিলাসী’ গল্পে কায়স্থ ঘরের সন্তান মৃত্যুঞ্জয়ের সাপুড়ে রূপ দেখে গল্পকথক ন্যাড়া উদ্‌ধৃত উক্তিটি করেছে।
➠ অন্ত্যজ শ্রেণির মেয়ে বিলাসীকে বিয়ে করায় অনুদার ও রক্ষণশীল হিন্দুসমাজ কর্তৃক মৃত্যুঞ্জয়কে গ্রামছাড়া হতে হয়। কিন্তু এতে সে দমে যায়নি। জাত বিসর্জন দিয়ে বছরখানেকের মধ্যেই সে পুরোদস্তুর সাপুড়ে হয়ে ওঠে। মাথায় গেরুয়া পাগড়ি, বড়ো বড়ো দাড়ি-চুল, গলায় রুদ্রাক্ষ ও পুঁতির মালায় সজ্জিত মৃত্যুঞ্জয়কে দেখে বোঝার উপায় থাকে না যে, কোনো একসময় সে কায়স্থ ঘরের সন্তান ছিল। জাত বিসর্জন দেওয়ার পর স্বল্প সময়েই সে নিজেকে এমনভাবে পরিবর্তন করেছিল যে, ন্যাড়া পর্যন্ত অবাক না হয়ে পারেনি। আলোচ্য উক্তিটিতে মৃত্যুঞ্জয়কে নিয়ে গল্পকথক ন্যাড়ার সেই উপলব্ধিই ফুটে উঠেছে।

৪১. মৃত্যুঞ্জয়ের ‘জাত বিসর্জনের’ কারণ বর্ণনা করো।
উত্তর: স্বার্থান্বেষী খুড়ার চক্রান্ত ও তৎকালীন বর্ণবিভক্ত সমাজের অনৈতিক অনুশাসনের জাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে মৃত্যুঞ্জয় জাত বিসর্জন দিতে বাধ্য হয়।
➠ বিলাসীর আন্তরিকতায় মুগ্ধ হয়ে মৃত্যুঞ্জয় তাকে বিয়ে করে। উচ্চবর্ণের হয়ে নিম্নবর্ণের বিলাসীকে বিয়ের বিষয়টি তৎকালীন বর্ণবিভক্ত সমাজ ভালোভাবে নেয়নি। এমতাবস্থায় সম্পদলোভী মৃত্যুঞ্জয়ের খুড়াও বিষয়টিকে সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করে। এরই অংশ হিসেবে বিলাসীর হাতে মৃত্যুঞ্জয়ের অন্নগ্রহণের অজুহাতে গ্রামের মানুষ বিলাসীকে টেনে-হিঁচড়ে গ্রামের বাইরে বের করে দেয়। এ ধরনের অন্যায়, অত্যাচার ও অমানবিক আচরণের শিকার হয়ে শেষাবধি মৃত্যুঞ্জয় জাত বিসর্জন দিয়ে মালো সমাজের অন্তর্ভুক্ত হয়ে সাপুড়ে হয়ে ওঠে।

৪২. মৃত্যুঞ্জয়ের অন্তঃকরণে অসাম্প্রদায়িক চেতনার কারণ কী?
উত্তর: পঙ্কিল সমাজের বাইরে একাকী বেড়ে ওঠার কারণেই মৃত্যুঞ্জয়ের অন্তঃকরণ অসাম্প্রদায়িক চেতনা-সমৃদ্ধ।
➠ তৎকালীন হিন্দু সমাজব্যবস্থা ছিল মূঢ়, মানবিকতাবিরোধী, শুভ বুদ্ধি-শুভচিন্তার প্রতিপক্ষ। এমন সমাজ ব্যবস্থায় সমাজের তথাকথিত আচারসর্বস্ব নিষ্ঠুর মানুষদের সাথে মিশে বেড়ে উঠে অসাম্প্রদায়িক চেতনাসমৃদ্ধ হওয়া অসম্ভব। একাকী জীবন কাটানোর কারণেই সাম্প্রদায়িকতার অন্ধকার মৃত্যুঞ্জয়কে গ্রাস করতে পারেনি বলেই মৃত্যুঞ্জয় অসাম্প্রদায়িক চেতনাসমৃদ্ধ হয়ে উঠেছিল।

৪৩. সাপ ধরার মন্ত্রের সত্য-মিথ্যার মীমাংসা হলো কীভাবে?
উত্তর: সাপের কাপড়ে মৃত্যুঞ্জয়ের মৃত্যুর মাধ্যমেই সাপ ধরার মন্ত্রের সত্য-মিথ্যার মীমাংসা হয়ে গেল।
➠ সাপ ধরার একটি মন্ত্র রয়েছে যেটিকে বিষহরির আজ্ঞা বলা হয়। সেই মন্ত্র বলে সাপকে পোষ মানানো যায়, সাপকে যা বলা যায় সাপ তাই করতে বাধ্য হয়। কিন্তু এটিও ছিল নিছক অন্ধ-বিশ্বাস। গোয়ালার বাড়িতে সাপ ধরতে গিয়ে সাপের কামড়ে মৃত্যুঞ্জয়ের মৃত্যুর মধ্য দিয়েই বিষহরির আজ্ঞা যে নেহায়েত একটি কুসংস্কার, সেটিই প্রমাণিত হয়।

৪৪. ন্যাড়াকে কোন পাপের দণ্ড দিতে হয়েছিল? ব্যাখ্যা করো।
উত্তর: সাপ ধরার ব্যাপারটি যে ঝুঁকির ব্যাপার, এটি মাথায় না রাখার প্রায়শ্চিত্ত ন্যাড়াকে করতে হয়েছিল।
➠ সাপ ধরা ব্যাপারটিকে ন্যাড়া আর মৃত্যুঞ্জয় আনন্দের একটি কাজ হিসেবে নিয়েছিল। এটি যে ভয়ের সেই ভাবনা ন্যাড়ার মনে কখনোই আসেনি এবং এটি আনন্দের ব্যাপার বলে সাপ ধরতে যাওয়ায় তারা কখনোই ভয় পায়নি। এর প্রায়শ্চিত্ত ন্যাড়াকে করতে হয়েছে বন্ধুতুল্য মৃত্যুঞ্জয়কে হারানোর মধ্য দিয়ে।

৪৫. সাপ ধরার বায়না এলেই বিলাসী নানা ভাবে মৃত্যুঞ্জয়কে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করত কেন?
উত্তর: স্বামীকে গভীরভাবে ভালোবাসত বলে তাকে বিপদমুক্ত রাখার জন্য সাপ ধরার বায়না এলে বিলাসী তাতে আপত্তি করত।
➠ বিলাসী সাপুড়ের মেয়ে। সাপ ধরতে গিয়ে যেকোনো মুহূর্তে মৃত্যুঞ্জয় বিপদে পড়তে পারে এবং এর পরিণাম যে মৃত্যু পর্যন্তও গড়াতে পারে তা বিলাসী ভালোভাবেই জানত। ফলে সাপ ধরার বায়না এলে বিলাসী মৃত্যুঞ্জয়কে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করত। মৃত্যুঞ্জয়ের প্রতি অগাধ ভালোবাসা থেকেই বিলাসী মৃত্যুঞ্জয়কে সাপ ধরতে বারণ করত।

৪৬. বিলাসী যে জাত সাপুড়ের মেয়ে তা কেমন করে প্রমাণিত হলো?
উত্তর: গোয়ালার বাড়িতে কয়েক টুকরো কাগজ দেখে বিলাসী যে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল তা ফলে গিয়েই প্রমাণিত হয় যে, বিলাসী জাত সাপুড়ের মেয়ে।
➠ গোয়ালার বাড়িতে মৃত্যুঞ্জয় সাপ ধরতে যায়, সাথে ছিল বিলাসী ঘরের মেঝে খুঁড়ে যে গর্ত পাওয়া গেল তা থেকে পাওয়া কাগজ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বিলাসী রায় দেয় সাপ একজোড়া তো আছেই বেশিও থাকতে পারে। পরে বিলাসীর কথা সত্যে পরিণত হয়। একটি কাগজ দেখে নির্ভুল ধারণা দিতে পারার কারণেই প্রমাণিত হলো যে, বিলাসী জাত সাপুড়ের মেয়ে।

৪৭. মৃত্যুঞ্জয়ের বাবা-মার দেওয়া নাম মিথ্যা প্রতিপন্ন হয় কীভাবে?
উত্তর: মৃত্যুঞ্জয়ের অকাল মৃত্যুর মাধ্যমেই তার বাবা-মায়ের দেয়া নাম মিথ্যা প্রতিপন্ন হলো।
➠ ‘মৃত্যুঞ্জয়’ নামের অর্থ- যিনি মৃত্যুকে জয় করেন। মৃত্যুঞ্জয়ের বাবা মা পুত্রের নাম মৃত্যুঞ্জয় রাখলেও সে মৃত্যুকে জয় করতে পারেনি। বিষধর সাপের কামড়ে মৃত্যুর সাথে লড়ে ব্যর্থ হয়ে মৃত্যুঞ্জয় অচিরেই ঢলে পড়ে মৃত্যুর কোলে। আর এর সাথেই তার বাপ মায়ের দেওয়া মৃত্যুঞ্জয় নামের সার্থকতা মিথ্যা প্রতিপন্ন হয়।

৪৮. ‘সাপের বিষ যে বাঙালির বিষ নয়, তাহা আমিও বুঝিয়াছিলাম।’- উক্তিটি বুঝিয়ে বলো।
উত্তর: উক্তিটির মাধ্যমে ন্যাড়া সাপের বিষের অব্যর্থ প্রভাব সম্পর্কে তার ধারণা নিজ অভিজ্ঞতার আলোকে ব্যক্ত করেছে।
➠ ‘বিলাসী’ গল্পের নায়ক মৃত্যুঞ্জয় সাপুড়ে পেশা গ্রহণ করার পর একদিন সাপ ধরতে গিয়ে সাপের দংশনেই মৃত্যুর মুখে পড়ে। গল্পের কথক ন্যাড়া বুঝেছিল সাপের বিষ একেবারেই অব্যর্থ। তা মন্ত্র, তন্ত্র, মাদুলি, বিষহরীর আজ্ঞা কিছুই মানে না। অন্যদিকে 'বাঙালির বিষ' অর্থাৎ বাঙালির ক্ষোভ ও রোষ স্বল্পস্থায়ী ও অকার্যকর। ন্যাড়া কিছুটা ব্যঙ্গাত্মকভাবে সাপের বিষের সঙ্গে বাঙালির মুখের বিষের তুলনা করেছে।

৪৮. বিলাসীর আত্মহত্যার বিষয়টি অনেকের কাছে পরিহাসের বিষয় হলো কেন?
উত্তর: নিষ্ঠুর সমাজে নিচু শ্রেণির মানুষের জীবন যেমন পরিহাসের, মৃত্যুও সেই সমাজে করুণার উদ্রেক না ঘটিয়ে পরিহাসের উদ্রেক ঘটায়।
➠ মৃত্যুশয্যাশায়ী মৃত্যুঞ্জয় বিলাসীর রাঁধা ভাত খায় বলে সমাজে অন্নপাপ করেছে বলে তাদের সমাজচ্যুত করা হয়। সমাজচ্যুত মৃত্যুঞ্জয় সাপ ধরতে গিয়ে সাপের কামড়ে মারা যায়। ভালোবাসার মানুষের অকাল প্রয়াণে বিলাসীও আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। কিন্তু নিচুকুলের মানুষের এই ভালোবাসার মূল্য সেই নিষ্ঠুর সমাজে ছিল না এবং তাদের কৃত পাপের ফলে তাদের এই পরিণতি অনিবার্য ছিল বলেই তারা মনে করে। একে তো নিচু জাতের, তার ওপর স্বামীর জন্য আত্মহত্যা ফলে বিলাসীর এই আত্মত্যাগ সমাজে পরিহাসের বিষয় হয়েই রইল।

৪৯. বিয়ের ব্যাপারটি Contract হিসেবে প্রতীয়মান হয় কখন?
উত্তর: যেখানে নর-নারীর হৃদয় জয় করার ব্যাপার নেই, পরিবার থেকে বিয়ে চাপিয়ে দেওয়া হয় এবং ভালোবাসা ছাড়াই সারা জীবন অতিবাহিত হয়, সেখানেই বিয়েটাকে Contract বলে মনে হয়।
➠ রক্ষণশীল পল্লী হিন্দু সমাজব্যবস্থায় নর-নারীর মন দেওয়া-নেওয়া ছিল গুরুতর অপরাধ। সেখানে পরিবার ছেলে-মেয়েদের বিয়ে দেয় এবং যেহেতু ভালোবাসা কী তারা তা বোঝেই না, বিয়ের পরও তাই তাদের মাঝে ভালোবাসার স্ফুরণ ঘটে না। সংসার একটা দায়িত্বের পর্যায়ে পড়ে, ভালোবাসার পর্যায়ে পড়ে না। তাই এ রকম সমাজব্যবস্থায় বিয়ে Contract ব্যতীত আর কিছুই নয়।

৫০. 'অতিকায় হস্তী লোপ পাইয়াছে কিন্তু তেলাপোকা টিকিয়া আছে' বলতে কী বোঝানো হয়েছে?
উত্তর: হিন্দু সমাজের নানান আচারবিধি যে নানা বিপ্লবের মধ্য দিয়ে গ্রহণযোগ্যতা হারিয়ে টিকে আছে মাত্র, তা বোঝাতেই প্রশ্নোক্ত উক্তিটির অবতারণা করা হয়েছে।
➠ প্রাচীনকাল থেকে হিন্দু সমাজের আচার-নীতিগুলো মানুষের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করত। এসব রীতিনীতির কিছু সমাজের বিকাশের জন্য বাধা তৈরি করে। নানা বিপ্লবের মধ্য দিয়ে এসব রীতি আজ গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে। কিন্তু মৃত্যুঞ্জয়ের খুড়ার মতো রক্ষণশীলদের মতে, এতকিছুর পরেও হিন্দু সমাজের রীতিগুলোর কিছু তো টিকে আছে। কিন্তু গল্পকথকের মতে, এমন টিকে থাকা সমর্থনযোগ্য নয়। অতিকায় হস্তী পৃথিবী থেকে বহু আগে বিদায় নিলেও তেলাপোকা আজও টিকে আছে। এমনভাবে টিকে থাকার মাঝে গৌরবের কিছু নেই।


সৃজনশীল প্রশ্ন- ১

নিচের উদ্দীপকটি পড়ো এবং প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও।
উজ্জয়িনীর রাজা বিক্রমাদিত্যের রাজসভার প্রখ্যাত জ্যোতির্বিদ বরাহপুত্র মিহিরের স্ত্রী খনা। একদিন পিতা বরাহ এবং পুত্র মিহির আকাশের তারা গণনা করতে গিয়ে সমস্যায় পড়লে খনা এ সমস্যার সমাধান দেন। রাজা বিক্রমাদিত্য তাঁর গুণে মুগ্ধ হন। গণনা করে খনার দেওয়া পূর্বাভাসে রাজ্যের কৃষকরা উপকৃত হতেন বলে রাজা বিক্রমাদিত্য খনাকে দশম রত্ন হিসেবে আখ্যা দেন। কিন্তু খনার এই খ্যাতি ও সম্মান অল্প সময়ের মধ্যেই তাঁর জীবনে বিড়ম্বনা নিয়ে আসে। রাজসভায় প্রতিপত্তি হারানোর ভয়ে ও নারীর জ্ঞানের কাছে নিচু হওয়ার লজ্জায় প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে বরাহের আদেশে মিহির খনার জিহ্বা কেটে দেন। এর কিছুকাল পরে খনার মৃত্যু হয়।

ক. খুড়া কোন বংশের?
খ. ‘ইহা আর একটি শক্তি’- বলতে কী বোঝানো হয়েছে?
গ. বিলাসী চরিত্রের কোন দিকটি খনার সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ তা বর্ণনা করো।
ঘ. ‘মৃত্যুঞ্জয় ও মিহির পরস্পর বিপরীত চরিত্রের মানুষ।’- মন্তব্যটি যাচাই কর।

-----------

সৃজনশীল প্রশ্ন- ২
-------------
-----------

তথ্যসূত্র :
১. সাহিত্য পাঠ: একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড, ঢাকা, ২০২৫।
২. আধুনিক বাংলা অভিধান: বাংলা একাডেমি, এপ্রিল, ২০১৮।
৩. ব্যবহারিক বাংলা অভিধান: বাংলা একাডেমি, ১৮তম, ২০১৫।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url